ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘কাছের লোক’ হিসেবে পরিচিত কারা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহাবুবুল ইসলামকে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ তিনি কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার (উপতত্ত্বাবধায়ক) ছিলেন।

কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-প্রিজন) জান্নাত-উল-ফরহাদ আজ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, কারা কর্মকর্তা মাহাবুবুল ইসলামকে বরখাস্তের আদেশ–সংবলিত চিঠি অধিদপ্তরে এসেছে।

১৮ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে মাহাবুবুলকে বরখাস্ত করার কথা জানানো হয়। ১৬ জুন রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে ওই প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন সুরক্ষা সেবা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব নাসিমুল গনি।

কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে মাহাবুবুল গুরুত্বপূর্ণ কারাগারগুলোয় দায়িত্বরত ছিলেন। তাঁর চাকরিজীবনের বেশি সময় কেটেছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। এর মধ্যে নিয়ম ভেঙে সর্বশেষ টানা সাত বছর জেলার হিসেবে এই কারাগারে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘কাছের লোক’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রভাব খাটাতেন। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে বন্দীদের সুবিধা দিয়ে উৎকোচ আদায়সহ নানা অভিযোগ ছিল।

মাহাবুবুল ২০০৩ সালের ৫ আগস্ট ডেপুটি জেলার হিসেবে যোগ দেন। তাঁর প্রথম কর্মস্থল ছিল পিরোজপুর কারাগার। তিনি ২০০৫ সালের নভেম্বরে বদলি হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আসেন। এক–এগারোর সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হয়ে সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত বিশেষ কারাগারে বন্দী ছিলেন, সেখানকার ডেপুটি জেলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন মাহাবুবুল। সেই সুবাদে শেখ হাসিনার ‘ঘনিষ্ঠ মানুষ’ হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে সহকর্মী ও কারা কর্মকর্তাদের কাছে তিনি শেখ হাসিনার খুব কাছের মানুষ বলে প্রচার করেন মাহাবুবুল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর জেলার হিসেবে (চলতি দায়িত্ব) তিনি মুন্সিগঞ্জ কারাগারে যোগ দেন। একই বছরের অক্টোবরে নারায়ণগঞ্জ কারাগারের দায়িত্ব পান। প্রায় ১১ মাসের মাথায় ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার হিসেবে যোগ দেন। ২০১২ সালের জুলাইয়ে জেলার পদে স্থায়ী হন তিনি। তিন বছর তিন মাস ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৪ সালের আগস্টে বদলি হন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। দুই বছর পাঁচ মাস পর আবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার হয়ে আসেন মাহাবুব। শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ছবি তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্টে রেখেছিলেন। গত বছরের মে মাসে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কুমিল্লা কারাগারে বদলি করা হয়।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে পলাতক ছিলেন তিনি। স্থায়ী ঠিকানায় চিঠি দিয়েও মাহাবুবের সাড়া পায়নি কারা অধিদপ্তর। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে মাহাবুবুল ইসলামের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে কল করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মাহাবুবুল কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার থাকাকালে গত বছরের ৩ আগস্ট রাত ১১টা ১৭ মিনিটে জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ককে ফোন করে বলেন অতি জরুরি পারিবারিক সমস্যার কারণে তিনি মধ্যরাতে কর্মস্থল ত্যাগ করবেন এবং পরদিন সকালে তিনি কাজে যোগ দেবেন। পরদিন কর্মস্থলে যোগ না দিয়ে শারীরিক অসুস্থতাজনিত বিষয়ে তিন মাসের অর্জিত ছুটি চেয়ে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়কের কাছে ডাকযোগে আবেদন পাঠান মাহাবুবুল। কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক একাধিকবার যোগাযোগ করে তাঁর মুঠোফোন নম্বরটি বন্ধ পান। পরে কারা অধিদপ্তর যোগাযোগ করতে তাঁর স্থায়ী ঠিকানায় চিঠি পাঠায়। কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকেও তাঁকে কর্মস্থলে যোগ দিতে চিঠি পাঠানো হয়।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, তাঁর কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ এবং ‘পলায়নের’ দায়ে অভিযুক্ত করে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয় এবং তাঁর স্থায়ী ঠিকানায় রেজিস্টার্ড ডাকযোগে অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণী পাঠানো হয়। তিনি অভিযোগনামার জবাব দাখিল করেননি। পরে তদন্ত কর্মকর্তা মাহাবুবুলের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা তাঁর প্রতিবেদনে মাহাবুবুলের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮–এর ৩(খ) ও ৩(গ) বিধি অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ ও ‘পলায়ন’–এর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন তাঁকে ‘চাকরি হতে বরখাস্তকরণ’র বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রস্তাবিত গুরুদণ্ড আরোপের পরামর্শ দেয়। সেহেতু মাহাবুবুলের বিরুদ্ধে ‘অসদাচরণ’ ও ‘পলায়নের’ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জেলার মাহাবুবুল ইসলামকে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম হ ব ব ল ইসল ম গত বছর র কর মকর ত বরখ স ত আগস ট সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

এন্নিও মোররিকোনে, শোনাতেন ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের সুর

বাংলা সিনেমার এক টিপিক্যাল দৃশ্য দিয়ে শুরু করা যাক। ধরলাম, সিনেমার নায়ক জসিম। পাহাড়ের পাদতলে ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি ছুটে যাচ্ছেন ভিলেন জাম্বুকে পাকড়াও করতে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে। এক ভুতুড়ে-রহস্যময় সুর। ড্রামের মৃদু তালে তালে ঠোঁটের শিস। ট্রাম্পেটের ঢেউ। কখনো সেই সুর মিলিয়ে যাচ্ছে হ্রেষায়, কখনো খুরের টগবগে (সুরকে যদি ভাষায় প্রকাশ করা যেত!)। ক্ষণে ক্ষণে গা শিউরে উঠছে দৃশ্য ও সুরের পরম্পরায়, ঘটনার উত্তেজনায়। কিন্তু তখন কি জানতাম, বাংলা সিনেমায় এমন জাদুকরি সুর নেওয়া হয়েছে ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’ থেকে!

কিংবদন্তি ইতালিয়ান কম্পোজার প্রয়াত এন্নিও মোররিকোনের এই ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর বিশ্ব সিনেমার জগতে অনন্য হয়ে থাকবে সব সময়। তেমনি ‘স্পেগেত্তি ওয়েস্টার্নের’ স্রষ্টা সার্জিও লিওনের ‘ডলার্স ট্রিলজি’। ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’র শেষ দৃশ্যে কবরস্থানে যখন ত্রিমুখী হয়ে বন্দুক হাতে ‘ম্যান উইথ নো নেম’ (ক্লিন্ট ইস্টউড), ‘টুকো’ (এলি ওয়ালাচ) ও ‘অ্যাঞ্জেল আইস’ (লি ফন ক্লিফ) দাঁড়ায়, তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে সেই বিখ্যাত সাসপেন্স-থ্রিলারমাখা সুর। সেই সুরের কথাই বলেছি মূলত শুরুতে। মোররিকোনের মিউজিক কেবল ঢালিউডে নয়; বলিউডের বহু চলচ্চিত্রেও হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ডলার্স’ সিরিজসহ লিওনের আরও দুই মাস্টারপিস ছবি ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন ওয়েস্ট’ ও ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন আমেরিকা’র মিউজিকও কম্পোজ করেন মোররিকোনে।

চলচ্চিত্রের শুরুর দিককার সময় কোনো সুর ছিল না। নির্বাক যুগ পেরিয়ে সিনেমা এখন এত দূর বিস্তৃত, যা এক শতকের মধ্যেই শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া তো এখন সিনেমার কথা চিন্তাই করা যায় না!

চলচ্চিত্রের শুরুর দিককার সময় কোনো সুর ছিল না। নির্বাক যুগ পেরিয়ে সিনেমা এখন এত দূর বিস্তৃত, যা এক শতকের মধ্যেই শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া তো এখন সিনেমার কথা চিন্তাই করা যায় না! এখন দর্শক কেবল পর্দার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে থাকেন না; কানকেও কাজে লাগান সিনেমাবোধের জন্য। কাহিনিকে যদি আমার শরীর ধরি, তবে অভিনয় হচ্ছে সিনেমার প্রাণ। আর সংগীত যেন এই দুইয়ের সংযোগস্থল। কাহিনি ও অভিনয়কে আরও বেগবান করে তোলে সংগীত।

এন্নিও মোররিকোনে (১০ নভেম্বর ১৯২৮—৬ জুলাই ২০২০)

সম্পর্কিত নিবন্ধ