বাংলাদেশি নারীর লাতিন আমেরিকা ভ্রমণবৃত্তান্ত
Published: 27th, June 2025 GMT
আজ থেকে ১০০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গিয়েছিলেন আর্জেন্টিনায়। সেখানে তিনি আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন আর্জেন্টাইন কবি ও মানবাধিকারকর্মী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর। দুজনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত সেসব জায়গায় ছুটে গিয়েছেন এক বাংলাদেশি নারী। খুঁজে ফিরেছেন বাঙালি এই কবির স্মৃতিচিহ্ন। কান পেতে যেন শোনার চেষ্টা করেছেন দুই কিংবদন্তির সম্পর্কের আদ্যোপান্ত। বলছিলাম লেখক মহুয়া রউফের ভ্রমণ বই লাতিনের নাটাই–এর ‘প্লাতা সব জানে’ গল্পটির কথা।
মূলত দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা স্থান পেয়েছে এই বইয়ে। লেখক জানাচ্ছেন, কিশোর বয়সেই লাতিন আমেরিকান সভ্যতা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। কথোপকথন ও গল্পের ঢঙে লেখা ভ্রমণ গল্পগুলোতে লেখক নিজের দেখা বর্তমানের লাতিন আমেরিকার সমান্তরালে এ অঞ্চলের বিচিত্র ভূগোল, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, সভ্যতা ও ইতিহাসের নানা বিষয় তুলে এনেছেন। বইয়ের সর্বত্রই স্বদেশকে কেন্দ্রে রেখে এই সব দেশ, সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে লেখকের একধরনের তুলনামনস্কতা চোখে পড়ে।
বইয়ের ‘ভ্রমণের ভগবান’ গল্পে লেখক আর্জেন্টিনা ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন বলিভিয়ায়। এই ভ্রমণের ভগবান আর কেউ নয়—স্বয়ং চে গুয়েভারা! তিনি ঘুরে ঘুরে চের স্মৃতিধন্য প্রতিটি জায়গা পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন—কোথায় তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল, কোথায় গোপনে কবর দেওয়া হয়েছিল—সবকিছু। এ জন্য তাঁকে বলিভিয়ার দুর্গম লাইগেরা ভ্রমণ করতে হয়েছিল। একজন নারী, নিজের প্রাণ ও অচেনা পুরুষের ভয়কে তুচ্ছ করে পাহাড়ি বিপৎসংকুল পথে, রাত্রিকালীন, অনিরাপদ যাত্রা করেন অচেনা ড্রাইভারকে সঙ্গী করে লাইগেরার উদ্দেশে। এ যাত্রা তাই নিছক ভ্রমণ নয়, তীর্থযাত্রা।
দক্ষিণ-পশ্চিম বলিভিয়ার আন্দিজ পর্বতমালার কাছে অবস্থিত ‘সালার দে উইউনি’ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে ‘নুনের মতো ভালোবাসি’ গল্পে। এখানে চারদিকে বিস্তীর্ণ ধু ধু লবণের মরুভূমি দেখার দারুণ এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন লেখক।
বলিভিয়া থেকে লেখকের পরের গন্তব্য চিলি। সেখানকার দুই বিখ্যাত কবি ভিক্তর হারা ও পাবলো নেরুদা। সাম্যবাদী কবি ও সংগীতজ্ঞ ভিক্তর হারা সামরিক স্বৈরশাসকের হাতে নিহত হন। তাঁর স্মৃতিময় জায়গা দেখার অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে ‘ভিক্তর হারার শেষ কবিতা—এস্তাদিও চিলি’ অংশে। আর সান্তিয়াগোতে পাবলো নেরুদার বাড়ি পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা হয়েছে ‘নেরুদা, বাড়ি আছ’ অংশটি। লেখক জানাচ্ছেন, নেরুদা বাড়ির নামকরণ করেছেন তৃতীয় স্ত্রীর চুলের নামানুসারে—‘লা চাসকোনা’ যার অর্থ কোঁকড়ানো চুল!
উত্তর চিলিতে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে শুষ্ক মরুভূমি আতাকামা। আতাকামা দেখতে গিয়ে লেখক বৈরী আবহাওয়ার সম্মুখীন হন। সেই প্রতিকূলতার বর্ণনা রয়েছে ‘আটকা পড়েছি আতাকামায়’ ভ্রমণগল্পে ‘সেনোরিতা’ ও ‘সভ্যতায় বেঁধেছি প্রাণ’ গল্প দুটি পেরুর ইনকাদের সমৃদ্ধ সভ্যতার গল্প। ৫০০ বছর আগে ইনকা সভ্যতা গড়ে উঠেছিল পেরুর আন্দিজ পর্বতকে কেন্দ্র করে। লেখক ইনকাদের বয়নশিল্পের রঙিন ইতিহাস, তাদের বিস্ময়কর স্থাপত্যশৈলী, অনন্য কৃষিপ্রযুক্তির নানা বিষয় জানিয়েছেন এখানে।
‘কৃষ্ণ গেছেন রিও’ গল্পটি ব্রাজিলের কর্কোভাডো পর্বতে প্রসারিত বাহুতে সফেদ যিশুখ্রিষ্টের মূর্তি দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে। আবার মেক্সিকোর চিচেন ইতজায় ভ্রমণের বৃত্তান্ত স্থান পেয়েছে ‘চিচেন ইতজা: বিস্ময় এক’ গল্পে। এখানে মায়াসভ্যতার বিস্ময়কর নিদর্শন পিরামিড ও তাঁদের আবিষ্কৃত বর্ষপঞ্জি দেখার অভিজ্ঞতা যেমন উঠে এসেছে, তেমনি এই সভ্যতার পৈশাচিকতার নিদর্শন ‘বল কোর্টে’র বর্বরতার কাহিনিও তুলে ধরেছেন লেখক। ক্যারিবিয়ান সাগরের তীরবর্তী মধ্য আমেরিকার দেশ নিকারাগুয়া ভ্রমণের বর্ণনা আছে ‘ওলা নিকারাগুয়া’, ‘দূরদেশের বড়দিন’, ‘আগুন পাহাড়’—এই তিন গল্পজুড়ে। এসব গল্পে আছে হ্রদ ও আগ্নেয়গিরির দেশ নিকারাগুয়ার বৃষ্টিবন, জলপ্রপাত, মুগ্ধতা ছড়ানো ফুলের শহর মাসায়ার শরৎ কার্নিভ্যাল আর সেরো নেগ্রো’ সামিটে গিয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতির অভিজ্ঞতার কথা।
এক বাংলাদেশি লেখকের লাতিন আমেরিকা ভ্রমণের বৃত্তান্ত জানার সমান্তরালে এই ভ্রমণ বইয়ের ঝরঝরে গদ্য ও ছবি পাঠককে নিয়ে যাবে এই অঞ্চলের ইতিহাস–ঐতিহ্যের কাছে, তা সহজেই বলা যায়।
লাতিনের নাটাই
মহুয়া রউফ
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
মূল্য: ৩৪০ টাকা; পৃষ্ঠা: ১৬০
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল ত ন আম র ক ভ রমণ র হয় ছ ল
এছাড়াও পড়ুন:
দাম্পত্য–জীবনে মতভেদ হলে ইসলামের নির্দেশনা
আল্লাহ বলেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে একটি হলো—তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকেই সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের মাধ্যমে প্রশান্তি লাভ করো। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা রুম, আয়াত: ২১)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, দাম্পত্য জীবন মানে একজন আরেকজনের মধ্যে শান্তি খোঁজা, একে অপরকে ভালোবাসা ও দয়া দেখানো। সম্মান, বোঝাপড়া, সহানুভূতি—এই গুণগুলো ছাড়া সম্পর্ক টিকে থাকে না।
নরম স্বভাব যা কিছুতেই থাকবে, তা তাকে সুন্দর করে তোলে, আর যখনই তা থেকে তুলে নেওয়া হয়, তা কুৎসিত হয়ে যায়।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৫৯৪এক দম্পতির স্ত্রীর অভিযোগ, তাঁর স্বামী প্রতিটি বিষয়কে ‘ধর্মীয় দায়িত্ব’ বলে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘আমি তো শুধু আল্লাহর সামনে দায়িত্ব পালন করছি, তুমি মানো বা না মানো, সেটা তোমার ব্যাপার।’
কিন্তু স্ত্রী এতে আহত হন, কারণ এতে তিনি বোঝেন—স্বামী আসলে তাঁর অনুভূতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ইসলাম শিক্ষা দেয়—পরামর্শ যেন হয় কোমল ভাষায়, স্নেহ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, নরম স্বভাব যা কিছুতেই থাকবে, তা তাকে সুন্দর করে তোলে, আর যখনই তা থেকে তুলে নেওয়া হয়, তা কুৎসিত হয়ে যায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৫৯৪)
অন্য হাদিসে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার পরিবারের জন্য উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের জন্য সবচেয়ে উত্তম।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩,৮৯৫)
আরও পড়ুনআয়েশা (রা.) রাগ করলে নবীজি (সা.) কী করতেন১২ জুন ২০২৫পরামর্শ ও সমাধান কী হতে পারে?এমন পরিস্থিতি প্রায় দম্পতির মধ্যেই হয়। তাই একে জটিল করে দেখা উচিত নয়। পারস্পরিক কল্যাণ ভাবনার দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। কয়েকটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার:
আপনি যদি স্ত্রী হন, তবে শান্তভাবে বলুন—’আমি তোমার কথা শুনতে চাই, কিন্তু আমাকেও কথা বলতে দাও।’১. আলোচনার পথ খোলা রাখা
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মতভেদ হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা হয় যখন একপক্ষ সবসময় আদেশ করে আর অন্য পক্ষ কথা বলার সুযোগই পায় না। ভালোবাসার সম্পর্কে এটি গ্রহণযোগ্য নয়। আপনি যদি স্ত্রী হন, তবে শান্তভাবে বলুন—’আমি তোমার কথা শুনতে চাই, কিন্তু আমাকেও কথা বলতে দাও।’ আর যদি স্বামী হন, তাহলে বুঝুন—আপনার স্ত্রীর মন খুলে কথা বলার প্রয়োজন আছে। আপনি তাঁর মালিক নন, বরং তাঁর সঙ্গী।
২. ‘পরামর্শ’ আর ‘নিয়ন্ত্রণ’ এক নয়
অনেকে পরামর্শের নামে স্ত্রীকে চাপে ফেলেন। সেটা ঠিক না। পরামর্শ তখনই কাজে আসে, যখন তা ভালোবাসা আর সম্মানের সঙ্গে দেওয়া হয়। কাউকে সম্মান করা মানে এই নয় যে তাঁর সব কথা মানতেই হবে। ইসলাম আমাদের চিন্তা ও বিচারবোধ দিয়েই সম্মানিত করেছে।
৩. বড় সিদ্ধান্তগুলো একসঙ্গে নিন
বিয়ের আগে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় না—যেমন: পোশাক, হিজাব বা নিকাব নিয়ে মতভেদ, সন্তান পালনের পদ্ধতি, সামাজিক আচার ইত্যাদি। এসব নিয়ে খোলামেলা আলাপ করুন। একসাথে বসে ঠিক করুন—কোন বিষয়গুলো তোমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনগুলোতে একে অপরকে ছাড় দেওয়া সম্ভব।
আরও পড়ুনমহানবী (সা.) যেভাবে সমালোচনা মোকাবেলা করতেন২৫ জুন ২০২৫৪. সমঝোতা ও সহানুভূতির পরিবেশ তৈরি করুন
আপনার স্বামী যদি বলে, ‘আমি তো দায়িত্ব পালন করে দিচ্ছি, তুমি মানো বা না মানো সেটা তোমার ব্যাপার’, তখন আপনি বলতে পারেন: ‘আলহামদুলিল্লাহ, আপনি দায়িত্ব পালন করছেন। আমিও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই চিন্তা করি। আসুন আমরা একসাথে বুঝে নেই কী করলে আল্লাহ বেশি খুশি হবেন, আর আমাদের সম্পর্কটাও সুন্দর থাকবে।’
তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার পরিবারের জন্য উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের জন্য সবচেয়ে উত্তম।সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩,৮৯৫৫. একান্ত প্রয়োজনে পারিবারিক পরামর্শ নিন
দাম্পত্যে কিছু সমস্যা এমন হয় যা বাইরের একজন বোঝাতে পারলে দুজনেই স্বস্তি পায়। একজন বিশ্বস্ত ইসলামিক কাউন্সেলর বা বুঝদার অভিভাবকের সহায়তা নিতে পারেন। বিয়ে মানে শুধু দায়িত্ব নয়, বরং একে অপরের অন্তরকে জানার, বোঝার এবং নিরাপদ আশ্রয় পাওয়ার সম্পর্ক।
মতভেদ থাকবেই। কিন্তু সেটা যেন ভালোবাসা ও সম্মানের ভিতরে থেকে সমাধান হয়। কারও মুখ বন্ধ করে দিয়ে, কাউকে নিচু দেখিয়ে কোনো সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয় না। একসাথে বসে কথা বলুন, ভুল বুঝলে ক্ষমা চান, একজন আরেকজনের হৃদয় খোলার সুযোগ তৈরি করুন।
আল্লাহ আমাদের সকলকে শান্তিপূর্ণ, ভালোবাসাময় দাম্পত্য জীবন গঠনের তাওফিক দিন।
আরও পড়ুনকোরআনের আয়াত ও দাম্পত্য সম্পর্কে সমঝোতা১৪ মার্চ ২০২৪