আজ থেকে ১০০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গিয়েছিলেন আর্জেন্টিনায়। সেখানে তিনি আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন আর্জেন্টাইন কবি ও মানবাধিকারকর্মী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর। দুজনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত সেসব জায়গায় ছুটে গিয়েছেন এক বাংলাদেশি নারী। খুঁজে ফিরেছেন বাঙালি এই কবির স্মৃতিচিহ্ন। কান পেতে যেন শোনার চেষ্টা করেছেন দুই কিংবদন্তির সম্পর্কের আদ্যোপান্ত। বলছিলাম লেখক মহুয়া রউফের ভ্রমণ বই লাতিনের নাটাই–এর ‘প্লাতা সব জানে’ গল্পটির কথা।

মূলত দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা স্থান পেয়েছে এই বইয়ে। লেখক জানাচ্ছেন, কিশোর বয়সেই লাতিন আমেরিকান সভ্যতা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। কথোপকথন ও গল্পের ঢঙে লেখা ভ্রমণ গল্পগুলোতে লেখক নিজের দেখা বর্তমানের লাতিন আমেরিকার সমান্তরালে এ অঞ্চলের বিচিত্র ভূগোল, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, সভ্যতা ও ইতিহাসের নানা বিষয় তুলে এনেছেন। বইয়ের সর্বত্রই স্বদেশকে কেন্দ্রে রেখে এই সব দেশ, সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে লেখকের একধরনের তুলনামনস্কতা চোখে পড়ে।

বইয়ের ‘ভ্রমণের ভগবান’ গল্পে লেখক আর্জেন্টিনা ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন বলিভিয়ায়। এই ভ্রমণের ভগবান আর কেউ নয়—স্বয়ং চে গুয়েভারা! তিনি ঘুরে ঘুরে চের স্মৃতিধন্য প্রতিটি জায়গা পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন—কোথায় তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল, কোথায় গোপনে কবর দেওয়া হয়েছিল—সবকিছু। এ জন্য তাঁকে বলিভিয়ার দুর্গম লাইগেরা ভ্রমণ করতে হয়েছিল। একজন নারী, নিজের প্রাণ ও অচেনা পুরুষের ভয়কে তুচ্ছ করে পাহাড়ি বিপৎসংকুল পথে, রাত্রিকালীন, অনিরাপদ যাত্রা করেন অচেনা ড্রাইভারকে সঙ্গী করে লাইগেরার উদ্দেশে। এ যাত্রা তাই নিছক ভ্রমণ নয়, তীর্থযাত্রা।

দক্ষিণ-পশ্চিম বলিভিয়ার আন্দিজ পর্বতমালার কাছে অবস্থিত ‘সালার দে উইউনি’ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে ‘নুনের মতো ভালোবাসি’ গল্পে। এখানে চারদিকে বিস্তীর্ণ ধু ধু লবণের মরুভূমি দেখার দারুণ এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন লেখক।

বলিভিয়া থেকে লেখকের পরের গন্তব্য চিলি। সেখানকার দুই বিখ্যাত কবি ভিক্তর হারা ও পাবলো নেরুদা। সাম্যবাদী কবি ও সংগীতজ্ঞ ভিক্তর হারা সামরিক স্বৈরশাসকের হাতে নিহত হন। তাঁর স্মৃতিময় জায়গা দেখার অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে ‘ভিক্তর হারার শেষ কবিতা—এস্তাদিও চিলি’ অংশে। আর সান্তিয়াগোতে পাবলো নেরুদার বাড়ি পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা হয়েছে ‘নেরুদা, বাড়ি আছ’ অংশটি। লেখক জানাচ্ছেন, নেরুদা বাড়ির নামকরণ করেছেন তৃতীয় স্ত্রীর চুলের নামানুসারে—‘লা চাসকোনা’ যার অর্থ কোঁকড়ানো চুল!

উত্তর চিলিতে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে শুষ্ক মরুভূমি আতাকামা। আতাকামা দেখতে গিয়ে লেখক বৈরী আবহাওয়ার সম্মুখীন হন। সেই প্রতিকূলতার বর্ণনা রয়েছে ‘আটকা পড়েছি আতাকামায়’ ভ্রমণগল্পে ‘সেনোরিতা’ ও ‘সভ্যতায় বেঁধেছি প্রাণ’ গল্প দুটি পেরুর ইনকাদের সমৃদ্ধ সভ্যতার গল্প। ৫০০ বছর আগে ইনকা সভ্যতা গড়ে উঠেছিল পেরুর আন্দিজ পর্বতকে কেন্দ্র করে। লেখক ইনকাদের বয়নশিল্পের রঙিন ইতিহাস, তাদের বিস্ময়কর স্থাপত্যশৈলী, অনন্য কৃষিপ্রযুক্তির নানা বিষয় জানিয়েছেন এখানে।

‘কৃষ্ণ গেছেন রিও’ গল্পটি ব্রাজিলের কর্কোভাডো পর্বতে প্রসারিত বাহুতে সফেদ যিশুখ্রিষ্টের মূর্তি দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে। আবার মেক্সিকোর চিচেন ইতজায় ভ্রমণের বৃত্তান্ত স্থান পেয়েছে ‘চিচেন ইতজা: বিস্ময় এক’ গল্পে। এখানে মায়াসভ্যতার বিস্ময়কর নিদর্শন পিরামিড ও তাঁদের আবিষ্কৃত বর্ষপঞ্জি দেখার অভিজ্ঞতা যেমন উঠে এসেছে, তেমনি এই সভ্যতার পৈশাচিকতার নিদর্শন ‘বল কোর্টে’র বর্বরতার কাহিনিও তুলে ধরেছেন লেখক। ক্যারিবিয়ান সাগরের তীরবর্তী মধ্য আমেরিকার দেশ নিকারাগুয়া ভ্রমণের বর্ণনা আছে ‘ওলা নিকারাগুয়া’, ‘দূরদেশের বড়দিন’, ‘আগুন পাহাড়’—এই তিন গল্পজুড়ে। এসব গল্পে আছে হ্রদ ও আগ্নেয়গিরির দেশ নিকারাগুয়ার বৃষ্টিবন, জলপ্রপাত, মুগ্ধতা ছড়ানো ফুলের শহর মাসায়ার শরৎ কার্নিভ্যাল আর সেরো নেগ্রো’ সামিটে গিয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতির অভিজ্ঞতার কথা।

এক বাংলাদেশি লেখকের লাতিন আমেরিকা ভ্রমণের বৃত্তান্ত জানার সমান্তরালে এই ভ্রমণ বইয়ের ঝরঝরে গদ্য ও ছবি পাঠককে নিয়ে যাবে এই অঞ্চলের ইতিহাস–ঐতিহ্যের কাছে, তা সহজেই বলা যায়।

লাতিনের নাটাই

মহুয়া রউফ

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

মূল্য: ৩৪০ টাকা; পৃষ্ঠা: ১৬০

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ল ত ন আম র ক ভ রমণ র হয় ছ ল

এছাড়াও পড়ুন:

লক্ষ্মীপুরে যাতায়াতের দুর্ভোগ নিরসন হবে কবে

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা লক্ষ্মীপুর। প্রাকৃতিক সম্পদ, মানবসম্পদ এবং ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে এটি একটি সম্ভাবনাময় অঞ্চল। প্রতিবছর এখান থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করেন—চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও চাকরির উদ্দেশ্যে। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, আজও লক্ষ্মীপুর-ঢাকা সরাসরি রুটে কোনো উন্নত মানের এসি বাস সার্ভিস নেই। এমনকি নির্ভরযোগ্য নন-এসি পরিবহন ব্যবস্থাও একেবারে সীমিত। এটি কেবল দুঃখজনক নয়, বরং দীর্ঘদিনের পরিকল্পনাহীনতা এবং নীতিগত অবহেলার একটি বড় উদাহরণ।

বর্তমানে এই রুটে যে বাসগুলো চলাচল করছে, সেগুলোর অধিকাংশই পুরোনো ও অপ্রতিসম যানবাহন। এসব বাসে যাত্রীদের জন্য আরামদায়ক ভ্রমণের ন্যূনতম সুযোগও নেই। আসনবিন্যাসের দুরবস্থা, গরমে হাঁসফাঁস পরিবেশ, যাত্রাপথে দীর্ঘ সময় ধরে থেমে থেমে যাত্রী তোলা কিংবা দেরিতে গন্তব্যে পৌঁছানো—এসবই যেন এই রুটের যাত্রীদের নিত্য সঙ্গী। নারী, শিশু কিংবা অসুস্থ যাত্রীর জন্য এই যাত্রা একধরনের কষ্টকর অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়।

লক্ষ্মীপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি মূলত পাকা এবং বেশির ভাগ অংশে চার লেনে সম্প্রসারিত। কুমিল্লা হয়ে ঢাকা পৌঁছানো যায় তুলনামূলকভাবে কম সময়ে। এমন সড়কপথে উন্নত মানের বাস সার্ভিস চালু না হওয়া নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। আশপাশের জেলা যেমন—ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিংবা ময়মনসিংহে শ্যামলী, হানিফ, সোহাগ, গ্রিনলাইনসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় পরিবহন কোম্পানিগুলোর এসি ও আধুনিক বাস চলাচল করে। অথচ লক্ষ্মীপুর এখনো এই সেবার বাইরে রয়ে গেছে।

প্রশ্ন জাগে—এই রুটে কি যাত্রী কম? বাস্তবতা হলো, লক্ষ্মীপুর একটি প্রবাসীপ্রধান জেলা। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মরত। তাঁরা ছুটি কাটাতে দেশে ফিরে ঢাকায় নামেন এবং সেখান থেকে লক্ষ্মীপুরে যাতায়াত করেন। এ ছাড়া ঢাকায় লক্ষ্মীপুর জেলার হাজারো শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী রয়েছেন, যাঁরা নিয়মিত যাতায়াত করেন। অর্থাৎ, যাত্রীস্রোত আছে, চাহিদাও প্রবল। অভাব শুধু আধুনিক পরিকল্পনা ও কার্যকর উদ্যোগের।

বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির প্রতিনিধিদের ভাষ্যমতে, তারা এই রুটে উন্নত বাস সার্ভিস চালুর আগ্রহ প্রকাশ করলেও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মহল ও পরিবহন–সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর অসহযোগিতার কারণে উদ্যোগগুলো বারবার আটকে যাচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত লোকাল বাস মালিকদের একটি চক্র নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতেই নতুন ও উন্নত সার্ভিসকে প্রতিযোগিতার বাইরে রাখতে চায়।

আরও দুঃখজনক হলো, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকেও এখনো দৃশ্যমান কোনো কার্যকর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। অথচ স্বস্তিদায়ক ও নিরাপদ যাতায়াত নাগরিকদের অন্যতম মৌলিক চাহিদা। শুধু সড়ক নির্মাণই নয়, তা কতটা জনবান্ধবভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সেটাও উন্নয়নের একটি বড় সূচক।

লক্ষ্মীপুরবাসী আর কত দিন এই অব্যবস্থার সঙ্গে আপস করে চলবে? সম্ভাবনাময় একটি জেলার মানুষকে দিনের পর দিন কেন কষ্টকর ভ্রমণের মুখোমুখি হতে হবে? এখনই সময়—এই রুটে উন্নত ও আরামদায়ক পরিবহন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে লক্ষ্মীপুরবাসীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করার। দেরি হলে শুধু জনগণ নয়, পিছিয়ে পড়বে পুরো একটি অঞ্চল—তার সম্ভাবনা, অর্থনীতি ও উন্নয়নের স্বপ্ন।

মো. শিহাব উদ্দিন
চর লরেন্স, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • লক্ষ্মীপুরে যাতায়াতের দুর্ভোগ নিরসন হবে কবে