ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে বিশ্বের নজর এখন গাজায় যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনার দিকে। ইসরায়েল খাদ্য বিতরণের নামে মানুষ হত্যার যে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া চালু করেছে, তাতে বিশ্বনেতারাসহ মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো অসন্তুষ্ট। একটা কথা এসেছে, গাজার বর্তমান অবস্থার যে দৃশ্যপট, তা কোনো সিনেমায়ও তৈরি করা সম্ভব না। মানুষ হত্যার সবগুলো কৌশল এখানে সক্রিয়। এই অবস্থায় যুদ্ধবিরতির দিকে তাকিয়ে গোটা বিশ্ব।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা সম্ভব। তার এই বক্তব্য বিশ্ববাসীকে আরও আশাবাদী করে তুলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, যুদ্ধবিরতি কত দূর।
গত সপ্তাহে নেতানিয়াহু মধ্যপ্রাচ্যে একটি ‘টেকটোনিক পরিবর্তন’ আনার ঘোষণা দেন। তিনি দাবি করেন, ইরান দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় আরও আরব রাষ্ট্রকে স্বাভাবিকীকরণ চুক্তির (ইসরায়েলকে স্বীকৃতি) আওতা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি ঘোষণা দেন, ‘আমরা অক্ষ ভেঙে ফেলেছি। এটি একটি বিশাল পরিবর্তন। শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, গোটা বিশ্বে ইসরায়েলের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। হামাসের পরাজয় হয়েছে। ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তির এখনই সুযোগ।’
নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যেও গাজায় যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনার আভাস আছে। তবে ঠিক কবে এবং কী প্রক্রিয়ায় তা হবে এটা কারও কাছে স্পষ্ট নয়।
এদিকে যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাপ সৃষ্টি করছে বলে ইসরায়েলি গণমাধ্যম দৈনিক হারেৎজ জানিয়েছে। ফাঁস হওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমটি জানিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা শিগগির কায়রোতে হামাস-ইসরায়েল আলোচনা চান। এটি বাস্তবায়নে নেতানিয়াহুর ওপর চাপ সৃষ্টিও করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, নেতানিয়াহু ও তার কৌশলগত বিষয়কমন্ত্রী রোনাল্ড ডার্মার আলাপ-আলোচনাও হয়েছে। তাদের কর্থাবার্তায় দুই সপ্তাহের মধ্যে একটা যুদ্ধবিরতির বিষয়টি উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে দ্য ইন্ডিডেনডেন্ট।
আমেরিকান জিউস কমিটি (এজেসি) মনে করে, নিঃশর্তভাবে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতির পথ সঠিক নয়। পার্ল হারবারে বোমা হামলার পর অথবা নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার পর যেমন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়নি, তেমনি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের ভয়াবহ হামলার পর ইসরায়েলও শত্রুতা বন্ধে রাজি হবে না।
এজেসির বক্তব্য, হামাসের যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গের দীর্ঘ ইতিহাসও রয়েছে, যার সর্বশেষ উদাহরণ ৭ অক্টোবরের হামলা। তাছাড়া ইসরায়েলের মৃত্যু ও ধ্বংসের জন্য হামাস প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যুদ্ধবিরতি ব্যবহার করে হামাস নিজ সামরিক ক্ষমতা বাড়িয়ে পুনরায় হামলা করে থাকে।
ইসরায়েলি শান্তি কর্মী গেরশন বাসকিনের মতে, চরম পরিস্থিতিতেও হামাস কখনও নিজেদের শর্ত থেকে পিছপা হয়নি। এখন তারা ইসরায়েলের শর্ত মেনে নেবে সেই সম্ভাবনা কম।
যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে স্বার্থ খুঁজছে ইসরায়েল
ফাঁস হওয়া তথ্যে আরও জানা গেছে, গাজায় শান্তি চুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলের বড় স্বার্থ রয়েছে। এর বিনিময়ে দখলদার দেশটি সৌদি আরব ও আসাদ পরবর্তী নতুন সিরিয়াকে স্বাভাবিকীকরণ প্রকল্পে যুক্ত করতে চায়। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হলেই কেবল গাজায় যুদ্ধবিরতির কথা চিন্তা করতে পারে তেলআবিব, অন্যথায় তারা হামলা চালিয়ে যাবে। এর আগে ২০২০ সালে আমিরাত ও বাহরাইন ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। তাদের মধ্যে এখন কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক চলমান রয়েছে।
ইসরায়েলের আরেকটি শর্ত হলো, শান্তিচুক্তি হলে হামাস আর গাজা পরিচালনার দায়িত্বে থাকতে পারবে না। এর পরিবর্তে গাজা শাসন করবে একটি ভিন্ন কর্তৃপক্ষ, যারা ‘আরব জোট’ নাম ধারণ করে কাজ করবে। এর মাধ্যমে ইসরায়েল গাজার জনসংখ্যাকে স্থানান্তরিত করার গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চাইছে।
ওই তথ্য বলছে, শান্তিচুক্তির মাধ্যমে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দিতে পারে। এর মাধ্যমে মূলত ইসরায়েল ভূখন্ড বৃদ্ধির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। পশ্চিম তীরে অবৈধ দখল অব্যাহত রেখেছে বসতিস্থাপনকারী ইহুদিরা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই দখলবাজিকে স্বীকৃতি দেয়নি। সার্বভৌত্ব দিয়ে দখল প্রক্রিয়াকে তারা বৈধ করতে চায়। তবে ইসরায়েলকে দুই রাষ্ট্রের ধারণা মেনে নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর সংঘাতে যেতে না হয়। তবে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা দ্বিরাষ্ট্র ভিত্তিক শর্ত মানবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়।
বেঁকে বসতে পারে হামাস
গাজার বর্তমান পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে হামাসও। তারা যুদ্ধরিবতির ব্যাপারে কথা তুললেও আগের দাবি থেকে সরবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। হামাস যদি গাজা থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের শর্ত থেকে না সরে, তাহলে এই শান্তিচুক্তি করা সম্ভব হবে না। অধিকৃত পশ্চিম তীরের দাবি থেকে সম্পূর্ণ সরে আসাও হামাসের জন্য কঠিন হবে।
আগে থেকেই হামাস দাবি করে আসছে, ইসরায়েলকে গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে এবং চলতি বছরের মার্চ মাসে সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করার পর গাজায় দখল চালিয়ে যাওয়ার বৈধতা আর নেই। সব সেনাকে প্রত্যাহার করতে হবে।
আল জাজিরা জানায়, হামাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্যারান্টিও চায়, যাতে আলোচনা অব্যাহত থাকতে পারে। তারা এই গ্যারান্টিও চায়, যাতে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে বিশ্বাসঘাতকতা করতে না পারে।
সূত্র: আলজাজিরা, দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, আমেরিকান জিউস কমিটি
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র প রক র য় র বর ত ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
এন্নিও মোররিকোনে, শোনাতেন ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের সুর
বাংলা সিনেমার এক টিপিক্যাল দৃশ্য দিয়ে শুরু করা যাক। ধরলাম, সিনেমার নায়ক জসিম। পাহাড়ের পাদতলে ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি ছুটে যাচ্ছেন ভিলেন জাম্বুকে পাকড়াও করতে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে। এক ভুতুড়ে-রহস্যময় সুর। ড্রামের মৃদু তালে তালে ঠোঁটের শিস। ট্রাম্পেটের ঢেউ। কখনো সেই সুর মিলিয়ে যাচ্ছে হ্রেষায়, কখনো খুরের টগবগে (সুরকে যদি ভাষায় প্রকাশ করা যেত!)। ক্ষণে ক্ষণে গা শিউরে উঠছে দৃশ্য ও সুরের পরম্পরায়, ঘটনার উত্তেজনায়। কিন্তু তখন কি জানতাম, বাংলা সিনেমায় এমন জাদুকরি সুর নেওয়া হয়েছে ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’ থেকে!
কিংবদন্তি ইতালিয়ান কম্পোজার প্রয়াত এন্নিও মোররিকোনের এই ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর বিশ্ব সিনেমার জগতে অনন্য হয়ে থাকবে সব সময়। তেমনি ‘স্পেগেত্তি ওয়েস্টার্নের’ স্রষ্টা সার্জিও লিওনের ‘ডলার্স ট্রিলজি’। ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’র শেষ দৃশ্যে কবরস্থানে যখন ত্রিমুখী হয়ে বন্দুক হাতে ‘ম্যান উইথ নো নেম’ (ক্লিন্ট ইস্টউড), ‘টুকো’ (এলি ওয়ালাচ) ও ‘অ্যাঞ্জেল আইস’ (লি ফন ক্লিফ) দাঁড়ায়, তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে সেই বিখ্যাত সাসপেন্স-থ্রিলারমাখা সুর। সেই সুরের কথাই বলেছি মূলত শুরুতে। মোররিকোনের মিউজিক কেবল ঢালিউডে নয়; বলিউডের বহু চলচ্চিত্রেও হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ডলার্স’ সিরিজসহ লিওনের আরও দুই মাস্টারপিস ছবি ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন ওয়েস্ট’ ও ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন আমেরিকা’র মিউজিকও কম্পোজ করেন মোররিকোনে।
চলচ্চিত্রের শুরুর দিককার সময় কোনো সুর ছিল না। নির্বাক যুগ পেরিয়ে সিনেমা এখন এত দূর বিস্তৃত, যা এক শতকের মধ্যেই শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া তো এখন সিনেমার কথা চিন্তাই করা যায় না!চলচ্চিত্রের শুরুর দিককার সময় কোনো সুর ছিল না। নির্বাক যুগ পেরিয়ে সিনেমা এখন এত দূর বিস্তৃত, যা এক শতকের মধ্যেই শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া তো এখন সিনেমার কথা চিন্তাই করা যায় না! এখন দর্শক কেবল পর্দার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে থাকেন না; কানকেও কাজে লাগান সিনেমাবোধের জন্য। কাহিনিকে যদি আমার শরীর ধরি, তবে অভিনয় হচ্ছে সিনেমার প্রাণ। আর সংগীত যেন এই দুইয়ের সংযোগস্থল। কাহিনি ও অভিনয়কে আরও বেগবান করে তোলে সংগীত।
এন্নিও মোররিকোনে (১০ নভেম্বর ১৯২৮—৬ জুলাই ২০২০)