Prothomalo:
2025-09-18@18:33:42 GMT

কবির জবানবন্দি

Published: 4th, August 2025 GMT

১৯৯৮ সাল। নজরুলজন্মশতবার্ষিকী চলছে দেশজুড়ে। ওই বছরই বর্ধমানের নজরুল একাডেমি থেকে আমাকে ‘নজরুল-পুরস্কার’ দেওয়া হলো। ওই পুরস্কার আনতে কলকাতায় গেলাম। কলকাতার বাংলা আকাদেমি নজরুলজন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আমার একটি একক বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। অন্নদাশঙ্কর রায়ের সভাপতিত্বে ওই অনুষ্ঠানে আমার ভাষণের পরপরই ছিল খ্যাতিমান আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষের একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান। প্রদীপ ঘোষ আবৃত্তি করেছিলেন নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) আটটি কবিতা। তার একটি, ‘কেন আপনারে হানি হেলা’ শুনে প্রদীপ ঘোষকে আমি অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে সাধুবাদ দিয়েছিলাম। এবং ঢাকায় ফিরে দু-একজন চেনা আবৃত্তিকারকে নজরুলের এই অনাদৃত কিন্তু গুরুত্ববহ কবিতার দিকে মনোযোগ দিতে অনুরোধ করেছিলাম। 

আবৃত্তিকর্ম শিল্প কি না জানি না, কিন্তু ভালো আবৃত্তি কোনো একটি কবিতার কোনো কোনো বন্ধ দুয়ার খুলে দেয়, সে নিজের কানেই শোনা আছে। যেমন: কাজী সব্যসাচীর অসাধারণ আবৃত্তি। কিংবা ভোলা অসম্ভব শম্ভু মিত্রের কণ্ঠধৃত জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘মধুবংশীর গলি’ কবিতা! অথবা আমাদেরই কবি শহীদ কাদরীর মন্ত্রকণ্ঠে অনেক দিন আগে রেডিওতে শোনা একটি কবিতা তাঁর কবিতারই গভীরার্থ খুলে দিয়েছিল, সে কথাও মনে পড়ছে। কিংবা অনেক পরে আবিষ্কৃত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের আবৃত্তিসংক্রান্ত স্থির অবলোকন। আর যাঁর কবিতা আজ আলোচ্য আমার, সেই নজরুল নিজেও অসামান্য আবৃত্তিকার ছিলেন। নজরুল তাঁর স্বরচিত কবিতা ‘বিদ্রোহী’, ‘নারী’ ইত্যাদি অনেক জায়গায় আবৃত্তি করে বেড়িয়েছেন।

কবিতা মানেই তো একধরনের স্বীকারোক্তি। তবু কোনো কোনো কবিতায় যেন তার দাগ পড়ে একটু বিশেষভাবেই। এ রকম কবিতা নজরুলের প্রথম জীবনে লেখা ‘আমার কৈফিয়ত’। যখন লিখছেন নজরুল, স্থায়ী কোনো জীবিকা নেই তখন তাঁর। বয়স তাঁর ২৬-২৭।

মূল কথায় চলে আসি এবার।

কবিতা মানেই তো একধরনের স্বীকারোক্তি। তবু কোনো কোনো কবিতায় যেন তার দাগ পড়ে একটু বিশেষভাবেই। এ রকম কবিতা নজরুলের প্রথম জীবনে লেখা ‘আমার কৈফিয়ত’ আর তাঁর সুস্থতার উপান্ত মুহূর্তে রচিত একটু আগে উল্লেখিত ওই ‘কেন আপনারে হানি হেলা’ কবিতাটি। নজরুল নিজে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে একটি পুস্তিকা লিখেছিলেন তাঁর কারাগারে যাওয়ার প্রাক্কালে। আমরা ওপরে উল্লেখিত কবিতা দুটিকে বলতে চাই ‘কবির জবানবন্দি’। কেন, এখন তা বিশদ জানাই। 

অপরূপ আত্মোন্মোচনের এই দুই কবিতার প্রথমটি অর্থাৎ ‘আমার কৈফিয়ত’ সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকার আশ্বিন ১৩৩২ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়, পরে হয় ‘সর্বহারা’ (১৯২৬) গ্রন্থভুক্ত। কবিতাটির রচনাকাল ১৯২৫ সাল। আর ‘কেন আপনারে হানি হেলা’ নজরুল পরিচালিত দৈনিক নবযুগে ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ২২ নভেম্বর সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। কবির অসুস্থতার পরে প্রকাশিত কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের ভূমিকাসংবলিত ‘শেষ সওগাত’ (১৯৫৮) কবিতাগ্রন্থে স্থান পায়। নজরুলের ২৪ বছরের সাহিত্যচর্চার প্রথম ও শেষ আত্মবীক্ষণ হিসেবে কবিতা দুটিকে নির্ণয় করতে চাই আমরা।

‘আমার কৈফিয়ত’ লিখছেন যখন নজরুল, তত দিনে তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি ঘটনা হয়ে উঠেছেন। ১৯১৯ সালে নজরুল লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, ১৯২২ সালে গ্রন্থকার হিসেবে (একই বছরে তাঁর ছোটগল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়)। ১৯২৫ সালের আগেই তাঁর তিনটি গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয়েছে; এক বছরের জন্যে সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেছেন; সম্পন্ন করেছেন দুটি বিবাহ (তার একটি ভেঙে গেছে)। স্থায়ী কোনো জীবিকা নেই তখন তাঁর। বয়স তাঁর ২৬-২৭, কিন্তু বিচিত্রবিশাল অভিজ্ঞতার পাহাড় পার হয়ে এসেছেন। ফলে তাঁর কবিতা (ও অন্য রচনা) প্রত্যক্ষতায় ঋদ্ধ হয়েছে। সমসাময়িক পত্রপত্রিকায় তাঁর পক্ষে ও বিপক্ষে অবিশ্রাম লেখা চলেছে। ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে একডাকে চেনে তাঁকে সবাই। সংগীতে তখনো তিনি প্রবেশ করেননি, তখনো তাঁর প্রধান পরিচিতি কবিরূপেই। ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতাটিতে কবির আত্মজীবনের কিছু রেখা অন্তত পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা; কারাভোগ; ‘শনিবারের চিঠি’র নিয়মিত ব্যঙ্গবিদ্রূপ; হিন্দু দেব-দেবীর উল্লেখ করায় একশ্রেণির মুসলমানের অসন্তুষ্টি, আবার আরবি-ফারসি শব্দ কবিতায় প্রয়োগ করায় একশ্রেণির হিন্দুর বিরাগ; রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীকে না মেনে আত্মচারিত্রে অধিষ্ঠান; বই বাজেয়াপ্তি; অসহযোগী ও বিপ্লবী কারোরই মন না পাওয়া; তাঁর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা; চারণ কবির মতো সারা দেশে বিরামহীন সফর—এ রকম অনেক প্রসঙ্গই নজরুলের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়।

নজরুল সম্পর্কে এ রকম কূটাভাসিক মন্তব্য সেকালে তো হয়েছেই, চলেছে আজও। ‘বর্তমানের কবি’—সেকালেই নজরুলের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল, কিন্তু সাময়িকতা নিংড়ে তাঁকে কবিতায় শব্দায়িত করে তোলার কাজ যে নজরুল করেছিলেন, তাঁর অকালনিস্তব্ধতার বছর ষাট পরে এ কথা দেদীপ্যমান হয়ে ফুটে আছে। শ্রেণির অভেদ কামনা করেছিলেন নজরুল, স্বাধীনতার আদীপ্র ঘোষণা দিয়েছেন তাঁর গদ্যে-পদ্যে-প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে; হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির গান গেয়েছেন। সাময়িকতার এই ব্যবহার নিয়েই হয়তো রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ভর্ৎসনা করেছিলেন, তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচার কথা বলে (নজরুল তাঁর গদ্যেও রবীন্দ্রনাথের এই সংলাপ জানিয়েছেন আমাদের)। আমাদের এই ব্যাখ্যা যদি সত্য হয়, তাহলে বলতে হবে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কাব্যপ্রতিন্যাসের মধ্যে ছিল মৌলিক ব্যবধি। যা ছিল খবরের কাগজের বিষয়, রবীন্দ্রনাথ তাকে প্রবন্ধায়িত করেছেন। যেমন হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে ঢের লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এই হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ককে করে তুলেছেন কবিতা। কবি জসীমউদ্‌দীন একবার একটি রচনায় নজরুলের কবিতাকে যে প্রবন্ধের সঙ্গে তুলনা দিয়েছিলেন, এ উক্তি সুপ্রযোজ্য। নজরুল ছন্দবদ্ধ প্রবন্ধই লিখেছেন অনেক কবিতায়, কিন্তু তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে কবিতার জিনিসপত্র প্রবেশ করিয়েছেন যে তা প্রাণবান হয়ে উঠেছে। ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতাটি প্রণীত হয়েছিল আশি বছর আগে, কিন্তু আজও যে তার গাত্রে শেওলা জমেনি, আজও যে কবিতাটি কাঁচা-তাজা জোশে টগবগ করছে, তার কারণ ওই প্রাণপূর্ণতা। হালকা চালে শুরু হয়েছে কবিতাটি, এগিয়েছেও হালকা চালেই, কিন্তু ক্রমেই মেঘ ঘনিয়েছে। ১৪টি স্তবকে সম্পূর্ণ হয়েছে কবিতাটি, ১৩টি স্তবক সমমাপ ও সুসমঞ্জস, নজরুলের প্রিয় ৬ মাত্রার মাত্রাবৃত্তে, বিস্ময়কর সব অন্ত্যমিলে নৃত্যপরায়ণ। শেষ ভিন্নধর্মী স্তবকে সব লঘুতার কুয়াশা ছিঁড়ে উচ্চারিত হলো একটি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও স্বপ্নময় প্রার্থনা:

‘পরোয়া করি না, বাঁচি বা না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে।

মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।

প্রার্থনা করো—যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,

যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!’

শেক্সপিয়ারের সনেটের ১২ পঙ্‌ক্তির মেলবন্ধনের অন্তিমে শেষ দুই ছত্র যেমন হাতুড়ির আঘাতের মতো এসে পড়ে একটি অন্ত্যমিলের জোড়া, তেমনি এই মিলান্ত চতুষ্ক পুরো কবিতাটিকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে উন্মীলন/জাগরণ ঘটিয়েছে। অপরূপ, অদ্ভুত সেই জাগরণ। সেই জাগৃতিতে যেন পুরোনো কাব্যতত্ত্ব চুরমার হয়ে গেল। যুগসন্ধির কবি হিসেবে যশস্বী ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তও তাঁর কালকে রূপায়িত করেছেন, কিন্তু তা পদ্যের স্তর অতিক্রম করতে পারেনি; নজরুলের কৃতিত্ব হচ্ছে, তিনি তাঁকে কবিতায় নিষিক্ত করেছেন।

নজরুলই বাংলা ভাষায় প্রথম বইয়ের নাম দিলেন ‘সাম্যবাদী’ বা ‘সর্বহারা’ যে দশকে রবীন্দ্রনাথের কবিতাগ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘লিপিকা’ বা ‘পূরবী’। শুধু গ্রন্থনামই নয়, তাঁর সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ছবি ছাপা হচ্ছে স্বাধীনতাপাগল বিপ্লবীদের।

‘বর্তমান বিশ্বসাহিত্য’ নামে নজরুল একটি অসামান্য রচনা প্রণয়ন করেছিলেন। সেখানে আধুনিক বিশ্বসাহিত্যে তিনি লক্ষ করেছিলেন ত্রিধারা: ১.

রোমান্টিক, ২. বাস্তববাদী ও ৩. মৃত্তিকানির্ভর রোমান্টিকতা। নজরুল এই মৃত্তিকানির্ভর রোমান্টিক। অমন যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা, তারও ভেতরে ধ্বনিত-রণিত হয়েছে ‘কাঁকন-চুড়ির কঙ্কন’, যা নিয়ে স্বয়ং কাজী আবদুল ওদুদ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। এই মৃত্তিকানির্ভর রোমান্টিকতায় নজরুলের সহযাত্রিক স্প্যানিশভাষী কবি পাবলো নেরুদা, রুশ কবি মায়াকোভিস্ক কিংবা ফরাসি কবি লুই আরাগঁ-পল এলুয়াররা। নজরুলই বাংলা ভাষায় প্রথম বইয়ের নাম দিলেন ‘সাম্যবাদী’ বা ‘সর্বহারা’ যে দশকে রবীন্দ্রনাথের কবিতাগ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘লিপিকা’ বা ‘পূরবী’। শুধু গ্রন্থনামই নয়, তাঁর সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ (প্রথম প্রকাশ: ১১ আগস্ট ১৯২২) পত্রিকায় ছবি ছাপা হচ্ছে (কারও কারও অবশ্য পাওয়া যায়নি) স্বাধীনতাপাগল বিপ্লবীদের—রবীন্দ্রকুমার ঘোষ (১৮৮০-১৯৫৯), কানাইলাল দত্ত (১৮৮৮-১৯০৮), ক্ষুদিরাম বসু (১৮৮৯-১৯০৮), প্রফুল্ল চাকী (১৮৮৮-১৯০৮), যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন, ১৮৭২-১৯১৫) প্রমুখের; ছাপা হচ্ছে কামাল পাশা, আনোয়ার পাশা, জামালুদ্দীনবিষয়ক সন্দীপক রচনা; ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় সম্পর্কে ধারাবাহিক রচনা (বিখ্যাত ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার সম্পাদক, ‘ধূমকেতু’তে ‘সন্ধ্যা’র শৈলী অবলম্বিত হয়েছে, নজরুলের একটি দ্রোহাত্মক কবিতাগ্রন্থের নামও ‘সন্ধ্যা’ [১৯২৯]; দুঃখের বিষয়, নজরুল সাহিত্যের আলোচনায় ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের নামই নেওয়া হয় না)। নজরুল সম্পাদিত আরেকটি পত্রিকা ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের মুখপত্র—লাঙল’ (প্রথম প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ১৯২৫)। সেখানে কমিউনিজম ও সোশ্যালিজম সম্পর্কে সন্দর্ভ ছাপা হচ্ছে; কার্ল মার্ক্সের জীবনী, লেনিন, সান-ইয়াত্ সেন সম্পর্কে তথ্যাবলি; নজরুল লিখছেন ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছ, ‘কৃষাণের গান’, ‘শ্রমিকের গান’, ‘জেলেদের গান’, ‘সর্বহারা’ এই সব নামের কবিতা। কবিতায় এই প্রথম উঠে আসছে সাধারণ মানুষ। কথাশিল্পে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যয়, জগদীশ গুপ্ত প্রমুখ যে কাজ করেছিলেন, কবিতায় নজরুল তা একা সম্পন্ন করেছেন এবং তাকে নিয়ে গেছেন এক শিখরে। নজরুলই বাংলা সাহিত্যে প্রথম সাধারণ মানুষের কবি। ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায়ও নজরুল সাধারণ মানুষেরই জয়ধ্বনি উচ্চারণ করেছেন।

তারপর বছর বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। মনে হলো যুগের পর যুগ। অথচ মাত্র এক দশক। নজরুল একাগ্র সাধনায় মগ্ন হলেন সংগীতে। এবং অকল্পনীয় সিদ্ধি। একেবারে তাঁর সুস্থ কিন্তু ক্রমক্ষীয়মাণ শরীর-মনের সামঞ্জস্য সাধনে যখন দিকদিগন্ত কম্পমান, তখন ফিরে এলেন সেই কবিতার কাছে। ছন্দ সেই তাঁর অতি প্রিয় ৬ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত, কিন্তু সেখানে আর উন্মদ উত্তালতা নেই, কেমন যেন পরিক্লান্ত, অবসন্ন। যিনি একদিন লিখেছিলেন ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে/মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে/আজ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে’, তিনি এখন লিখলেন, ‘বন্ধু, বিলাস সৃষ্টি এই/আমার কবিতা আমার গান/অন্ধেরে আলো দিত যদি, অপঘাতে তার যেত না প্রাণ’। এখন তিনি বলছেন, কী হবে কবিতা লিখে, কী হবে গান গেয়ে, এসব বিলাসমাত্র। এমনকি তখনো দীর্ণ কণ্ঠে চিত্কার করে উঠেছেন তিনি, ‘আগুন লাগুক রসলোকে’। যিনি জীবনোত্তর রস সৃষ্টি করেছেন, মানুষের প্রতি গভীরতম ভালোবাসাতেই তাঁর এই অভিশাপ বর্ষণ। কারুণ্যে-বেদনায় পরিপ্লুত তাঁর শেষ কণ্ঠস্বর:

‘মুক্তি চাহি না, চাহি না যশ

এদেরই লাগিয়া মাগিব ভিখ্

ভিক্ষার ঝুলি চাহি আমি,

দ্বারে দ্বারে কেঁদে দিবাযামী!’

কবি নিজেই বলেছেন, এখন তাঁর আত্মা রোরুদ্যমান, বুকে উথলে উঠছে কান্নার জোয়ার। সবই সাধারণ মানুষের জন্যে। ‘পরমোন্মাদ’, ‘পরম ভিক্ষু’—এই সব শব্দ নজরুলের সর্বশেষ অনেক কবিতার মতো এখানেও আছে, অধ্যাত্মঅন্বেষী কবি তারপরও তিলমাত্র বিস্মৃত হননি সাধারণ মানুষের প্রতি দরদে। জলের মতন ঘুরে ঘুরে এসে শেষ পর্যন্তও কবি আকাঙ্ক্ষা করেছেন নিপীড়িত মানুষের উত্থান।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর ছ ল ন প রক শ ত নজর ল স য় প রথম ম সলম ন র প রথম প রবন ধ য় নজর ল নজর ল র ন নজর ল ত হয় ছ ন কর ছ কর ছ ন এ রকম র একট

এছাড়াও পড়ুন:

কাতারে ইসরায়েলের হামলার পর যৌথ প্রতিরক্ষায় সম্মত উপসাগরীয় দেশগুলো

যেকোনো ধরনের বিদেশি হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক যৌথ ব্যবস্থা নিতে সম্মত হয়েছে উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলভুক্ত (জিসিসি) দেশগুলো। আজ বৃহস্পতিবার ছয় সদস্যের জোটটির যৌথ প্রতিরক্ষা কাউন্সিল কাতারের রাজধানী দোহায় এক বিশেষ অধিবেশনে এ বিষয়ে সম্মত হয়। ৯ সেপ্টেম্বর দোহায় ইসরায়েলের হামলার প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

জিসিসির প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠক শেষে এক যৌথ ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, মন্ত্রীরা তাৎক্ষণিকভাবে গোয়েন্দা তথ্যবিনিময় সম্প্রসারণের নির্দেশ দিয়েছেন। একীভূত সামরিক কমান্ডের মাধ্যমে এটা করা হবে। আঞ্চলিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করা হবে। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পূর্বসতর্কতা ব্যবস্থা দ্রুততর করা হবে। পাশাপাশি মন্ত্রীরা যৌথ প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা হালনাগাদেরও নির্দেশ দিয়েছেন।

যৌথ ঘোষণায় মোট ছয়টি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। বাকি দুটি হলো জিসিসিভুক্ত দেশগুলো তিন মাসের মধ্যে যৌথ আকাশ এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা মহড়ার অনুমোদন দিয়েছে। এরপর দেশগুলো একটি যৌথ বিমান মহড়ায় অংশ নেবে। অংশগ্রহণকারী মন্ত্রী ও প্রতিনিধিরা জোর দিয়ে বলেন, কাতারের ওপর হামলার অর্থ হলো পুরো জিসিসির ওপর হামলা।

জিসিসির প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কাতারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রতিমন্ত্রী শেখ সৌদ বিন আবদুর রহমান আল থানি। বৈঠকে জিসিসির ছয় দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, দেশগুলোর ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধি এবং জোটটির মহাসচিব জাসিম আল-বুদাইউই অংশ নেন। আলোচনায় মন্ত্রীরা দোহায় ইসরায়েলের হামলাকে আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘ সনদের গুরুতর লঙ্ঘন উল্লেখ করে তীব্র নিন্দা জানান।

এই বৈঠকের আগে সোমবার দোহায় আরব লিগ ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) এক বিশেষ বৈঠকে প্রায় ৬০টি দেশ অংশ নেয়। সেখানে জিসিসির দেশগুলোর প্রতিনিধিরা আলাদা করে বৈঠক করেছিলেন। বৈঠক শেষে জোটটির সদস্যদেশের সমন্বিত সামরিক ব্যবস্থা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।

১৯৮১ সালে জিসিসি গঠিত হয়। এর পর থেকে জোটটির কোনো সদস্যদেশে ৯ সেপ্টেম্বরের আগপর্যন্ত সরাসরি হামলা চালায়নি ইসরায়েল। জোটটির প্রায় সব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের সুসম্পর্ক রয়েছে।

আরও পড়ুনইসরায়েলের বিরুদ্ধে কি যৌথ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলবে উপসাগরীয় আরব দেশগুলো১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এদিকে গাজা উপত্যকার গাজা নগরীতে গত বুধবার শুরু হওয়া ইসরায়েলের সর্বাত্মক হামলায় আজ অন্তত ১৯ জন নিহত হয়েছেন। একই সময়ে গাজার অন্যান্য স্থানে নিহত হয়েছেন আরও অন্তত ১০ জন। প্রায় দুই বছরের ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল অন্তত ৬৫ হাজার ১৪১। আহত হয়েছেন অন্তত ১ লাখ ৬৫ হাজার ৯২৫ জন।

ইসরায়েলের দাবি, গত কয়েক সপ্তাহে প্রায় সাড়ে তিন লাখ ফিলিস্তিনি গাজা নগরী ছেড়েছেন। স্থানীয় প্রশাসনের তথ্যমতে, উপত্যকার বৃহত্তম শহরটিতে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা শুরুর আগে কমবেশি ১০ লাখ ফিলিস্তিনি ছিলেন, যাঁদের অনেকে অন্যান্য জায়গা থেকে একাধিকবার স্থানচ্যুত হয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

আরও পড়ুনগাজা নগরীতে দুই দিনে দেড় শতাধিক হামলা ইসরায়েলের১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ