সোনালি সাফল্যের আড়ালে ধূসর বাস্তবতা
Published: 17th, August 2025 GMT
দেশের একসময়কার ফুটবল–উন্মাদনা হারিয়ে গেলেও এ খেলায় নতুন এক জোয়ার এনেছেন নারী ফুটবলাররা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একের পর এক সাফল্যের কাব্য লিখে চলেছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ধরে রেখে তারা এখন এশিয়ার ফুটবল অঙ্গনে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু এই সোনালি সাফল্যের আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক চরম হতাশার গল্প। সাফল্যের বিপরীতে নারী ফুটবলারদের পরিচর্যার ঘাটতি বারবার সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে, যা খুবই দুঃখজনক।
দেশের হয়ে সম্মান বয়ে আনা নারী ফুটবলারদের সামান্য পাওনাটুকুও মাসের পর মাস আটকে থাকছে। ম্যাচ ফি থেকে শুরু করে বেতন, পুরস্কারের টাকা—সবকিছুই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর দায়িত্বহীনতার বেড়াজালে আটকা পড়ে আছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উঠে আসা তথ্যগুলো সত্যিই পীড়াদায়ক। একাধিক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে আসা নারী ফুটবলাররা এখনো তাঁদের প্রাপ্য ম্যাচ ফি পাননি। যেখানে এক মিনিটের জন্য মাঠে নামলেও ১০ হাজার টাকা প্রাপ্য, সেই সামান্য অর্থও সময়মতো না পেয়ে দেশের শীর্ষ ফুটবলাররা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ফুটবলাররা জানাচ্ছেন, চুক্তি অনুযায়ী বেতনও বাকি। একুশে পদক জেতার পর সরকারের দেওয়া আর্থিক পুরস্কারের ১২ হাজার টাকাও খেলোয়াড়দের হাতে পৌঁছায়নি। এসব আর্থিক পাওনা আটকে থাকার কারণ হিসেবে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, তা আরও হতাশাজনক। বাফুফের এক কর্মকর্তা বলছেন, ‘ফাইন্যান্স আমার বিষয় নয়’, আরেকজন বলছেন ‘নো কমেন্ট’, এবং সাধারণ সম্পাদক দাবি করছেন যে তথ্য সঠিক নয়। এ ধরনের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা প্রমাণ করে ফুটবলারদের প্রাপ্য নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
সবচেয়ে বড় হতাশার বিষয় হলো, সাফ শিরোপা জয়ের ৯ মাস পার হয়ে গেলেও বাফুফের ঘোষণা করা দেড় কোটি টাকার পুরস্কার এখনো ফুটবলাররা পাননি। এই পুরস্কারের ঘোষণা ছিল তাঁদের প্রাপ্য সম্মানের প্রতীক, যা এখন এক তিক্ত প্রহসনে পরিণত হয়েছে। একজন খেলোয়াড়ের প্রশ্ন, ‘টাকাই যখন দেবেন না, তখন ঘোষণার কী প্রয়োজন ছিল?’ এই প্রশ্ন কেবল একজন খেলোয়াড়ের নয়, এটি প্রত্যেক নাগরিকের প্রশ্ন। যারা দেশকে সম্মান এনে দিল, তাদের প্রাপ্যটুকুও নিশ্চিত করতে যারা ব্যর্থ, তাদের কর্মকাণ্ডের যৌক্তিকতা কী?
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) যখন ফুটবল তারকা ঋতুপর্ণা চাকমাকে বাড়ি বানিয়ে দেওয়ার কথা বলছে, তখন বাফুফের মতো প্রতিষ্ঠান নারী ফুটবলারদের ন্যূনতম প্রাপ্যটুকুও নিশ্চিত করতে পারছে না। দেশের ফুটবলের অভিভাবক হয়ে বাফুফে কেবল নিজেদের দায় এড়ানোর খেলায় ব্যস্ত। নারী ফুটবল লিগের অনিয়মিত আয়োজন ও দেশের বাইরে গিয়ে খেলতে গিয়ে ভুটানের মতো দেশের মেয়েদের কাছে লজ্জিত হওয়ার ঘটনা আমাদের ফুটবলের অব্যবস্থাপনারই প্রতিফলন। আমরা চাই নিয়মিত লিগ আয়োজন করা হোক এবং সেটি যেন দায়সারাভাবে না হয়।
মাঠের বাইরের নানা বঞ্চনা নারী ফুটবলারদের মনোবল ভেঙে দিচ্ছে। অথচ তাঁদের কঠোর পরিশ্রম এবং ত্যাগই দেশের জন্য এই সম্মান বয়ে এনেছে। বাফুফের উচিত অবিলম্বে এই সমস্যার সমাধান করা। খেলোয়াড়দের সব বকেয়া পাওনা দ্রুত মিটিয়ে দেওয়া, পুরস্কারের অর্থ হস্তান্তর করা এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
আমাদের দেশের নারী ফুটবলাররা মাঠে নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছেন, আবার মাঠের বাইরে নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে তাঁদের। এটি পেশাদারি ফুটবলের চরম ক্ষতির পথ উন্মোচন করবে। আমরা আমাদের ফুটবলের হারানো গৌরব ফিরে পেতে চাইলে ফুটবলারদের বঞ্চনা–গঞ্জনা থেকে মুক্ত করতে হবে। বাফুফের উচিত শুধু বিজয় উদ্যাপন নয়, বরং দেশের এই তারকাদের প্রতি তাদের দায়িত্বটুকুও পালন করা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রস ক র র স ফল য র ফ টবল র র ফ টবল
এছাড়াও পড়ুন:
সার্কভুক্ত ‘দেশি’ ফুটবলার আশীর্বাদ নাকি শঙ্কা
বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে সার্কভুক্ত দেশগুলোর ফুটবলারদের ‘দেশি’ খেলোয়াড় হিসেবে সুযোগ দেওয়াকে কেউ স্বাগত জানাচ্ছেন, কেউ আবার এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন।
আবাহনী লিমিটেডের কোচ মারুফুল হক বলেন, ‘এই চ্যালেঞ্জটা আমাদের দেশি খেলোয়াড়দের সামনে থাকা উচিত।’ অন্যদিকে সাবেক জাতীয় ফুটবলার আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নুর প্রশ্ন, ‘দেশি খেলোয়াড়দের সুযোগ না দিলে জাতীয় দল কীভাবে গড়ে উঠবে?’
নতুন মৌসুমের জন্য খেলোয়াড় নিবন্ধন শেষ হয়েছে গতকাল। শেষ খবর, চারটি ক্লাব সার্কভুক্ত দেশের মোট আট ফুটবলারকে বাফুফের কাছে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। বাংলাদেশ পুলিশ এফসি নিয়েছে নেপালের গোলরক্ষক ও অধিনায়ক কিরণ কুমার লিম্বু, ফরোয়ার্ড আয়ুশ ঘালান এবং ভুটানের মিডফিল্ডার ওয়াংচুক শেরিংকে। ফর্টিস এফসিতে শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক ও গোলরক্ষক সুজান পেরেরা এবং নেপালের ডিফেন্ডার অনন্ত তামাং। রহমতগঞ্জে নেপালের ডিফেন্ডার অভিষেক লিম্বু। আরামবাগ নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী ও মিঠুন সামান্তাকে, তাঁদের একজন গোলকিপার একজন ডিফেন্ডার।
কোনোভাবেই সার্কের খেলোয়াড়কে দেশি কোটায় আনা ঠিক হয়নি। দেশিদের সুযোগ না দিলে খেলোয়াড় উঠে আসবে কীভাবে? জাতীয় দলই–বা কীভাবে তৈরি হবে? এগুলো ভাবতে হবে।আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, সাবেক ফুটবলারক্লাবগুলোর সার্কের ফুটবলারের দিক ঝোঁকার বড় কারণ অর্থনৈতিক সুবিধা। স্থানীয় শীর্ষ খেলোয়াড়দের মাসিক বেতন যেখানে পাঁচ–ছয় লাখ টাকা বা তারও বেশি, সেখানে নেপাল বা ভুটানের জাতীয় দলের খেলোয়াড় পাওয়া যাচ্ছে এক থেকে দেড় লাখ বা তারও কম টাকায়। অর্থনৈতিক ব্যাপারটা যে বড় কারণ, তা স্বীকার করে নিলেন রহমতগঞ্জের সভাপতি টিপু সুলতান, ‘নেপাল, শ্রীলঙ্কা বা ভুটানের ফুটবলারদের মান বাংলাদেশিদের চেয়ে পিছিয়ে নেই। কিন্তু ওদের পাওয়া যাচ্ছে কম টাকায়। ক্লাব এই সুযোগটা নেবেই।’
নতুন নিয়মে প্রতিটি ক্লাব সার্কভুক্ত দেশ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচজন খেলোয়াড় নিবন্ধন করাতে পারবে এবং তাঁদের সবাইকে এক ম্যাচে খেলানো যাবে। সার্কের বাইরের দেশ থেকে পাঁচজন বিদেশি নেওয়া যাবে, তবে মাঠে একসঙ্গে সর্বোচ্চ তিনজন খেলতে পারবেন। অর্থাৎ, এ মৌসুমে কোনো ক্লাব চাইলে একাদশে সর্বোচ্চ আটজন বিদেশি খেলাতে পারবে। কোনো দল যদি এ সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে, সেই দলের একাদশে দেশি খেলোয়াড় থাকবেন মাত্র তিনজন। তাঁদের মধ্যে একজন আবার অনূর্ধ্ব–১৯ হতে হবে।
সার্ক দেশগুলোর খেলোয়াড় এলে আমাদের লিগের মান বাড়তে পারে। তবে সার্কের এক বা দুজন ঠিক আছে, পাঁচজন খেললে দেশের খেলোয়াড়দের সুযোগ কমবে, এটা ঠিক।ছাইদ হাছান কানন, বাফুফের সদস্য ও সাবেক ফুটবলারদেশের ফুটবল–বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, এত বিদেশি খেলানো জাতীয় দলের জন্য ক্ষতিকর। মোহামেডানের কোচ আলফাজ আহমেদ বলেন, ‘সার্কভুক্ত খেলোয়াড়দের দেশি কোটায় আনা উচিত নয়। এতে বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের খেলার সুযোগ কমে যাবে। নতুন নিয়মটা কোনোভাবেই সমর্থন করি না।’ তাঁর প্রস্তাব, সার্কভুক্ত একজন, সার্কের বাইরে তিনজনসহ মোট চারজন বিদেশি খেলানো যেতে পারে।
আটজন বিদেশি খেললে বাকি তিনজন হবে স্থানীয় এবং তারা মানসম্মত হবে। যারা সুযোগ পাবে না, তারা নিজেদের যোগ্যতা বাড়াবে। দুই-তিন মৌসুমের মধ্যে দেশে মানসম্মত খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে।মারুফুল হক, কোচ, আবাহনী লিমিটেডবাংলাদেশের ফুটবলে এর আগে পাঁচজন বিদেশি এক ম্যাচে খেলতে পেরেছেন। কিন্তু এবার নজিরবিহীনভাবে তা আটে পৌঁছানোর সম্ভাবনা আছে। যদিও কোনো ক্লাবই পাঁচজন সার্কভুক্ত খেলোয়াড় নেয়নি। বড় দলগুলো একজনও নেয়নি। তারপরও অভিজ্ঞ কোচ জুলফিকার মাহমুদ মিন্টুও নিয়মটা সমর্থন করছেন না, ‘সার্কভুক্ত খেলোয়াড়দের দেশি কোটায় খেলানোর সিদ্ধান্তটা আরও চিন্তাভাবনা করে নেওয়া উচিত ছিল। বলা হচ্ছে, আমাদের খেলোয়াড়দের জন্য সার্কের অন্য দেশগুলোর দুয়ারও খুলবে। কিন্তু আমাদের খেলোয়াড়েরা কোথাও তো ডাক পায়নি। পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখছি না। এর ফলে আমাদের ফুটবল ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
সাবেক ফুটবলার আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নুও নিয়মটা মানতে পারছে না। তাঁর কথায়, ‘এমনিতে বিদেশিরা বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে আমাদের ফুটবলে। তার ওপর এখন কোনোভাবেই সার্কের খেলোয়াড়কে দেশি কোটায় আনা ঠিক হয়নি। দেশিদের সুযোগ না দিলে খেলোয়াড় উঠে আসবে কীভাবে? জাতীয় দলই–বা কীভাবে তৈরি হবে? এগুলো ভাবতে হবে।’
সার্কভুক্ত খেলোয়াড়দের দেশি কোটায় আনা উচিত নয়। এতে বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের খেলার সুযোগ কমে যাবে। নতুন নিয়মটা কোনোভাবেই সমর্থন করি না।আলফাজ আহমেদ, কোচ, মোহামেডানতবে এর ইতিবাচক দিকও দেখছেন আবাহনী লিমিটেডের কোচ মারুফুল হক। তিনি বলেন, ‘পুরো বিষয়টা নেতিবাচক হিসেবে দেখছি না। আটজন বিদেশি খেললে বাকি তিনজন হবে স্থানীয় এবং তারা মানসম্মত হবে। যারা সুযোগ পাবে না, তারা নিজেদের যোগ্যতা বাড়াবে। দুই–তিন মৌসুমের মধ্যে দেশে মানসম্মত খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে।’ মারুফুলের সংযোজন, ‘এই চ্যালেঞ্জ দেশি খেলোয়াড়দের সামনে থাকা উচিত। পাশাপাশি আমাদের খেলোয়াড়দের সার্কের অন্যান্য দেশে খেলতে পারার জন্য সব দেশের মধ্যে সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন।’
বাফুফের সদস্য ও সাবেক ফুটবলার সাইদ হাছান কানন মনে করেন, সার্কভুক্ত মানসম্মত খেলোয়াড় এলে সমস্যার কিছু নেই। তিনি বলেন, ‘সার্ক দেশগুলোর খেলোয়াড় এলে আমাদের লিগের মান বাড়তে পারে। তবে সার্কের এক বা দুজন ঠিক আছে, পাঁচজন খেললে দেশের খেলোয়াড়দের সুযোগ কমবে, এটা ঠিক।’ কী কারণে বাফুফে এ নিয়ম করেছে? বাফুফের পেশাদার লিগ কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন চৌধুরীর ভাষ্য, ‘মূল লক্ষ্য হলো সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে খেলোয়াড় আদান-প্রদান ও প্রতিযোগিতা বাড়ানো। আমাদের পর ভারতও এই নিয়ম করেছে। তবে ভালো ফল না এলে নিয়মটা বদলের সুযোগও আছে।’
বিষয়টি এখনো পরীক্ষামূলক, ১৯ সেপ্টেম্বর প্রিমিয়ার লিগ মাঠে গড়ালে সার্কভুক্ত ফুটবলারদের ‘দেশি’ হিসেবে পারফরম্যান্স বিচার করা যাবে। তখনই নিয়মটির কার্যকারিতা ও প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠবে।