সুঠাম দেহে রোপণ করেছেন মুক্তির চারাগাছ
Published: 10th, August 2025 GMT
এ দেশের শিল্প-সংস্কৃতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম এস এম সুলতান, যিনি তাঁর শিল্পচর্চার পথে দীপ্ত পায়ে হেঁটে পৌঁছেছিলেন এই গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও মানুষের কাছে। সুলতানের রংতুলি আজও আমাদের ডেকে নিয়ে যায় এই বাংলার আদিম প্রকৃতির পরম ভালোবাসায়; যে ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিয়ে সুলতান একের পর এক দৃশ্য রচনা করেছিলেন। সংগ্রামী ও শক্তিশালী মানুষের সুঠাম দেহে রোপণ করেছিলেন মুক্তির চারা গাছ। তাঁর ছবিতে কিষান-কিষানির তামাটে রোদে পোড়া ঘর্মাক্ত দেহের রেখা যেন তিরের মতো তীব্র গতিতে এগিয়ে চলে টিকে থাকার লড়াইয়ে।
এ দেশের গ্রামের মাটিতে প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধের বিশালদেহী, ক্রোধে কম্পিত পেশির মানুষগুলো যূথবদ্ধ হয়ে দৌড়াতে থাকে স্থির লক্ষ্যে। শত্রুর মোকাবিলা করে শক্তসমর্থ পেশিবহুল পুরুষ ও নারী উভয়েই। এই মানুষগুলোই সুলতানের অনুপ্রেরণা। তাঁর ছবিতে নারী চরিত্র কোনো অংশে কম শক্তিশালী নয়। বরং কোথাও কোথাও বেশি। গ্রামের সহজ–সরল গৃহবধূকে তিনি মোটেও অসহায় রূপে প্রকাশ করেনি। স্বাস্থ্যবতী কর্মিষ্ঠা অথচ নমনীয় সদা দৈনন্দিন কাজে মত্ত যেন পৃথিবীর প্রাণ জাগিয়ে তোলা অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রতীকী চরিত্র।
ছবির ক্যানভাসে যে ব্যাপকতা, বিষয়বস্তুর যে বিশালতা, ফিগারের যে বলিষ্ঠতা, তাতে সুলতানের স্বকীয় আত্মপ্রকাশ উজ্জ্বল হয়ে ফুটেছে। তাঁর ছবিতে কয়েকটি জিনিস পরিলক্ষিত হয়। তা হলো ছবিতে কোথাও কোনো শূন্যস্থান নেই।যুদ্ধের পর আমি সাধারণ মানুষ এবং কৃষকদের আঁকার টান অনুভব করেছি। তাদের অবদানই শহরটিকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল এবং সেই কারণেই তাদের দৈহিক দেহ আমাকে আন্দোলিত করেছিল।এস এম সুলতানকিষানজীবনের প্রতি সুলতানের গভীর অনুরাগ ও নিবিড় মমতা রয়েছে। সে জন্যই বাংলার কর্মঠ মানুষদের ধারণ করেছেন তাঁর মনস্তাত্ত্বিক জগতে। গ্রামের মানুষ দৈনন্দিন জীবনধারার স্রোতে যুগের পর যুগ পেরিয়ে অনন্তের পথে ভেসে যাচ্ছে, এমন ছবি ঘুরেফিরে বর্ণিত হয়েছে তাঁর ক্যানভাসে। সুলতান কৃষকদের তাঁর প্রেরণা হিসেবে বেছে নেন। তাঁর কাজগুলোতে কৃষকদের দৃঢ় সাহস, টিকে থাকার শক্তি এবং জমির প্রতি অবিরাম প্রতিশ্রুতি চিত্রিত। পাকিস্তান আমলে তিনি কিছু বিমূর্ত ছবি এঁকেছেন, যদিও পরে তা আর দেখা যায় না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এর পেছনে একটি কারণ হতে পারে মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের পর আমি সাধারণ মানুষ এবং কৃষকদের আঁকার টান অনুভব করেছি। তাদের অবদানই শহরটিকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল এবং সেই কারণেই তাদের দৈহিক দেহ আমাকে আন্দোলিত করেছিল।’
উপমহাদেশের চিত্রকলায় সুলতান একজন বড় মাপের শিল্পী। ছবির ক্যানভাসে যে ব্যাপকতা, বিষয়বস্তুর যে বিশালতা, ফিগারের যে বলিষ্ঠতা, তাতে সুলতানের স্বকীয় আত্মপ্রকাশ উজ্জ্বল হয়ে ফুটেছে। তাঁর ছবিতে কয়েকটি জিনিস পরিলক্ষিত হয়। তা হলো ছবিতে কোথাও কোনো শূন্যস্থান নেই। সর্বত্রই রং আর রেখা। দুই আলোর খেলা। সুলতানের মতো লাইন নিয়ে এমন ব্রাশিং কম শিল্পীই করেছেন। একদম প্রকৃতির কাছে। ঋতু, দিনের প্রহর, আলোছায়ার খেলা, রঙের সমারোহ, আদিম গন্ধ—সবকিছু মিলেমিশে এগিয়ে গেছে সৃজনশীল পথে।
ইউরোপীয় শিল্পদর্শন দ্বারা আমাদের শিল্পভাবনা ও চর্চা শুরু হয় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন আমল থেকেই। এই চর্চা থেকে সুলতানকে বি–উপনিবেশায়নে তৎপর হতে দেখা যায় তাঁর ছবিতে, তাঁর জীবনযাপনেও।ষোড়শ শতক—উত্তর ইউরোপীয় উপনিবেশের নতুন মাত্রা ছিল। তার প্রভাব কেবল সামরিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না, ছিল মনস্তাত্ত্বিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রভাবও। এ ধরনের উপনিবেশায়নের বহুমাত্রিক প্রভাব পড়ে উপনিবেশিতের ভাষা, চিন্তা, দর্শন, শিল্পসহ অন্যান্য রুচিবোধে। শিল্প–সংস্কৃতি অনেক কিছুই অনুকরণপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ কারণে ঘটেছে আমাদের আত্মসত্তা থেকে বিচ্ছেদ। ইউরোপীয় শিল্পদর্শন দ্বারা আমাদের শিল্পভাবনা ও চর্চা শুরু হয় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন আমল থেকেই। এই চর্চা থেকে সুলতানকে বি–উপনিবেশায়নে তৎপর হতে দেখা যায় তাঁর ছবিতে, তাঁর জীবনযাপনেও।
এ কাজ সুলতান অবচেতন মনে নয়, সজাগ ও সচেতনতার সঙ্গেই করেছেন। কেননা অনেকেই মনে করেন, আমাদের শিল্পীরা সমগ্র বিশ্বের শিল্পচর্চার ধ্যানধারণা থেকে বহির্ভূত। আসলে তা নয়। সুলতানের জীবন বিচিত্র। তিনি গতানুগতিকভাবে আর্ট কলেজের পরীক্ষা পাস করে বের হননি। নিয়মিত প্রদর্শনীও করেননি। তাঁর কোথাও স্থির ঠিকানা ছিল না। তিনি মিশেছেন সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষের সঙ্গে। তাঁর ছবিতে দুর্বোধ্যতার বিপরীতে আছে সরলতা, যা হয়তো অশিক্ষিতের মতো মনে হয়েছে। কিন্তু তাঁর পাহাড়সম উচ্চতার স্বীকৃতি তাঁকে তেমনভাবে দিতে পারেনি কেউই।
১৯৫৩ থেকে ১৯৬৫—এ সময়কে সুলতানের রাধাপর্ব বলা যেতে পারে। চিরকুমার এই শিল্পী গৈরিক শাড়ি পরে রাধা সেজে বৈষ্ণবলীলার আধ্যাত্মিক রসে মগ্ন থেকেছেন। সুলতান আসর জমাতে ওস্তাদ। ভালো বাঁশি বাজাতেন। মাঝেমধ্যে নাচতেনও, কিছুদিন নাচের স্কুলেও গিয়েছিলেন। সুলতানের মতে, ‘বড় করে জীবনের বৃত্ত এঁকেছি। সেই বৃত্তে অল্প অল্প করে সবকিছুই জানতে চাই, কোনো কিছুই বেশি শেখার ইচ্ছে নেই।’ তিনি জানতেন নাচের উৎস বেদান্তে। এসব ক্ষেত্রে বাঙালিদের অবদান আছে। এই উত্তর আধুনিক যুগে বসে আমরা যতখানি আধুনিক হতে পারিনি, তা তিনি শতবর্ষ আগে জন্ম নিয়েও হতে পেরেছিলেন।
সুলতান নিজেকে রূপান্তরের জন্য শাড়ি পরেও বের হতেন অনেক সময়। হয়তো একই দেহে দুটি সত্তা ধারণ করে নারী-পুরুষকে সমানভাবে শ্রদ্ধা জানাতেন। সুলতান সমসাময়িক বাংলাদেশের সবচেয়ে রহস্যময় চিত্রশিল্পী। তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু চিত্রকর্ম হলো ‘চরদখল’, ‘প্রথম বৃক্ষরোপণ’, ‘শাপলা তোলা’, ‘মাছ কাটা’, ‘বন্যার পর’, ‘জমিকর্ষণে যাত্রা’ ইত্যাদি। নড়াইলে ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট জন্ম নেওয়া কিংবদন্তি শিল্পী এস এম সুলতান বেঁচে থাকুক এই বাংলার বুকে আলোকবর্ষ ধরে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ষকদ র উপন ব শ কর ছ ন কর ছ ল আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
মাগুরা মাল্টিপ্লেক্সের মুনাফা কমেছে ১৩.৭২ শতাংশ
পুঁজিবাজারে পেপার ও প্রিন্টিং খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বাংলাদেশ মাগুরা মাল্টিপ্লেক্স পিএলসির পরিচালনা পর্ষদ চলতি হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০২৫) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, আলোচ্য প্রান্তিকে আগের হিসাব বছরের তুলনায় কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) কমেছে ১৩.৭২ শতাংশ।
আরো পড়ুন:
পুঁজিবাজারে সূচকের উত্থান
প্রথম প্রান্তিকে ইউনিক হোটেল ও ইফাদ অটোসের মুনাফায় বড় উত্থান
সোমবার (১৭ নভেম্বর) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এর আগে রবিবার (১৬ নভেম্বর) কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে সর্বশেষ বছরের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা ও অনুমোদনের পর প্রকাশ করা হয়।
২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানির সমন্বিত শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ০.৮৮ টাকা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ১.০২ টাকা। সে হিসেবে কোম্পানিটি আলোচ্য প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি মুনাফা কমেছে ০.১৪ টাকা বা ১৩.৭২ শতাংশ।
আলোচ্য সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি নিট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো (এনওসিএফপিএস) দাঁড়িয়েছে ০.২৪ টাকা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি নিট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো ছিল ০.৩৫ টাকা।
২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে কোম্পানির সমন্বিত শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ৭৫.৬৭ টাকা।
ঢাকা/এনটি/এসবি