‘কৃত্রিম’ বন্যা রোধ: বক্তব্যের ফাঁপা প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতার নির্মম চিত্র
Published: 10th, August 2025 GMT
বাংলাদেশের ভৌগোলিক বাস্তবতায় প্রাকৃতিক বন্যা অনিবার্য হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃত্রিম বন্যা এক ভয়াবহ নগর-দুর্যোগে রূপ নিয়েছে। অতিবৃষ্টি বা উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের মতো প্রাকৃতিক কারণের সঙ্গে এর সম্পর্ক সামান্য; বরং এর জন্ম মানুষের অব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা থেকে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রাকৃতিক জলাধার ও খাল ভরাট, ড্রেনেজব্যবস্থার অদক্ষতা এবং বাঁধ ও খালের রক্ষণাবেক্ষণের অভাব—সব মিলিয়ে কৃত্রিম বন্যা যেন এক পূর্বনির্ধারিত বিপর্যয়।
বক্তব্য বনাম বাস্তবতাআস্থার সংকট: প্রতিবছর বর্ষার আগে রাজনৈতিক নেতাদের মুখে শোনা যায় দৃষ্টিনন্দন প্রতিশ্রুতি— ‘ড্রেনেজ উন্নয়ন চলছে’, ‘খাল উদ্ধার অভিযান হবে’, ‘বাঁধ সংস্কারে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে’।
কিন্তু বর্ষা শেষে দেখা যায়, প্রতিশ্রুতির অগ্রগতি নগণ্য। ঢাকার জলাবদ্ধ এলাকা আগের মতোই পানিতে ডুবে থাকে; একই অবস্থা চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট ও বরিশালের মতো শহরগুলোতেও। যদিও এ বছর চট্টগ্রাম শহরে পরিস্থিতি বেশ উন্নত হয়েছে।
গ্রামীণ এলাকাতেও অনিয়ন্ত্রিত সেচব্যবস্থা, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ ও অসংগঠিত পানি ব্যবস্থাপনার ফলে কৃত্রিম বন্যা দেখা দিচ্ছে। প্রশাসনের অদক্ষতা ও রাজনৈতিক অনীহা এখানে স্পষ্ট। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব স্থায়ী সমাধানের বদলে প্রাধান্য পাচ্ছে স্বল্পমেয়াদি ‘দেখানো’ উদ্যোগ—বর্ষার আগে তড়িঘড়ি বাঁধ মেরামত, একককালীন খাল খনন, অস্থায়ী পাম্প বসানো ইত্যাদি। কিন্তু খাল-নদী ভরাট হওয়া, জলাধারের সংখ্যা হ্রাস এবং নালা-ড্রেনের ক্ষমতা কমে যাওয়ার মতো মূল কাঠামোগত সমস্যা অমীমাংসিতই থেকে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও ধারাবাহিক পরিকল্পনা ছাড়া এর সমাধান সম্ভব নয়।
দুর্নীতি ও অপচয়ের কালো ছায়া: ড্রেনেজ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও বাস্তব ফল প্রায় শূন্য। নিম্নমানের উপকরণ, তদারকির ঘাটতি, সময়মতো কাজ না হওয়া এবং অনিয়ম প্রকল্পগুলোকে অকার্যকর করে দেয়। বর্ষা এলেই নতুন প্রকল্পের ঘোষণা হয়, কিন্তু পুরোনো সমস্যাগুলো অমীমাংসিত থেকে যায়। জনগণের ধারণা, এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য সমস্যা সমাধান নয়, বরং বরাদ্দভোগ।
সমন্বয়ের অভাব: সিটি করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ওয়াসা, রাজউক, পরিবেশ অধিদপ্তর—সবাই কোনো না কোনোভাবে জড়িত, কিন্তু তাদের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় নেই। এক সংস্থা খাল খনন করে, আরেক সংস্থা তার পাশে সড়ক নির্মাণ করে জলপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এই সমন্বয়হীনতা সমস্যাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
জনগণের ক্ষোভ : বর্ষার পর বর্ষা পেরিয়ে একই দুর্ভোগে মানুষ ক্লান্ত। প্রতিশ্রুতি এখন আর আস্থা জাগায় না; বরং জনগণ তা দেখছে রাজনৈতিক ‘বক্তব্যের রাজনীতি’ হিসেবে। এই আস্থা সংকট রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্যও বিপজ্জনক—কারণ ক্ষুব্ধ জনগণ একসময় প্রশ্ন করবেই, ‘আপনারা এত দিন কী করলেন?’
সমাধানের পথদীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন ও ধারাবাহিক বাস্তবায়ন, খাল-নদী উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রাখা ও দখলকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, ড্রেনেজব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, বরাদ্দকৃত অর্থের স্বচ্ছ ব্যবহার নিশ্চিত করতে জনসম্পৃক্ত তদারকি, সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার মধ্যে সমন্বিত টাস্কফোর্স গঠন। কৃত্রিম বন্যা কেবল অবকাঠামোগত সমস্যা নয়—এটি রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও জবাবদিহির পরীক্ষাও। জনগণ আর শুধু বক্তব্য শুনতে চায় না; তারা চায় বাস্তব পরিবর্তন। যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে কৃত্রিম বন্যা আগামী দিনে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে—আর তখন শুধু মঞ্চের মাইকে নয়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে জবাব দিতে হবে ক্ষুব্ধ জনতাকে।
মো.
শামীম মিয়া
জুমাড়বাড়ি, সাঘাটা, গাইবান্ধা
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ত র ম বন য র জন ত ক প রকল প ব যবস থ বর দ দ সমস য সমন ব
এছাড়াও পড়ুন:
চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাজনীতি করতে চাই: নাসীরুদ্দীন
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, “আমরা চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাজনীতি করতে চাই। যারা আমাদের সঙ্গে অঙ্গীভূত হবেন, একীভূত হবেন, তাদের জন্য সেখানে একটি নামমাত্র ফি রাখা হয়েছে। আপনারা জানেন, নির্বাচনের জামানত ফি এবার ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। নতুন যে রুলস-রেগুলেশন সেখানে এসেছে, আমরা ন্যূনতম একটা ফি রেখেছি।”
বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর বাংলামোটরে দলটির অস্থায়ী কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
এসময় তিনি বলেন, “আপনারা দেখেছেন নির্বাচনের ডামাডোল বেজে গিয়েছে। আমাদের যেমন সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হবে, সাথে সাথে আমাদের একটি সুন্দর পার্লামেন্ট উপহার দেওয়ার জন্য কাজ করতে হবে। তাই আমাদের দল থেকে বা আমাদের দলের খুব একটা সুন্দর টিম আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন। মানুষজনের সামনে আমরা কোনো দলের প্রতিনিধি চাপিয়ে দিতে চাই না, জনগণের প্রতিনিধি দিতে চাই।”
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, “বর্তমান যে পরিস্থিতি রয়েছে, এই পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে একটি দল নিজস্ব কিছু ব্যক্তিকে মানুষের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আমরা এই দুর্বৃত্তায়ন ভাঙতে চাই। আমরা এই টপ টু ডাউন নয়, ডাউন টু টপ সিস্টেমে যেতে চাই। অর্থাৎ সরকার এবং জনগণের মধ্যে যে পার্লামেন্ট রয়েছে, এই পার্লামেন্ট হাউজে আমরা জনগণের প্রতিনিধি পাঠাতে চাই। কোনো দলীয় প্রতিনিধি পাঠাতে চাই না।”
তিনি বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের পরে আমরা একটি সুন্দর ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য একটি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংসদ লাগবে। কিন্তু এর পূর্বে আমরা বলেছিলাম যে তারা কোন প্রক্রিয়া চালাবে। গত ৫০ বছরে যে ভিত্তিতে চালিয়েছিল, ভিত্তিমূলটা অনেক দুর্বল ছিল। ওই ভিত্তিমূল ছিল সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি। একদলীয় শাসন বাকশাল থেকে শুরু করে অসংখ্য (দুর্বলতা), যেগুলো বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেওয়ার যাত্রা আমরা দেখেছিলাম।”
এনসিপি’র এই নেতা বলেন, “আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ গঠন করব। যেই নতুন বাংলাদেশের মধ্যে এই ধরনের কার্যকলাপ আর প্রত্যক্ষ করব না। সেই জায়গা থেকে সংস্কার ও ঐকমত্য কমিশন গঠন হয়েছিল। ঐকমত্য কমিশনে ৩০টির অধিক দল মিলে তারা একটা পর্যায়ে এসেছে, একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছে, সুপারিশমালা দিয়েছে। সেটার উপরে সরকার একটি আদেশ জারি করার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের এখন যে পরিস্থিতি রয়েছে, সেখানে জামায়াত এবং বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন, এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব ও কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি তাসনিম জারা, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুব আলম মাহির, খালেদ সাইফুল্লাহ, এহতেশাম হক, যুগ্ম সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল আমিন, জহিরুল ইসলাম, আলাউদ্দিন মোহাম্মদ, হুমায়রা নূর, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক সাইফুল্লাহ হায়দার এবং জতীয় যুব শক্তির আহ্বায়ক মো. তারিকুল ইসলাম।
ঢাকা/রায়হান/এস