শিল্পী মুর্তজা বশীর তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে ছবি আঁকার পাশাপাশি বেশ কিছু গল্পগ্রন্থ, কাব্যগ্রন্থ ও উপন্যাস রচনা করেছেন। মুদ্রাসংক্রান্ত একাধিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ এবং একটি বইও প্রকাশ করেছেন। তিনি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেছেন। দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে শিল্পচর্চার পাশাপাশি শিল্প নির্দেশক হিসেবেও কাজ করেছেন। ইতিহাস জানার প্রতি মুর্তজা বশীর ছিলেন প্রবল আগ্রহী। বিশেষ করে হাবশি সুলতানদের সম্পর্কে ইতিহাসের বই পড়েছেন; কিন্তু তাতে তিনি তুষ্ট হতে পারেননি। ফলে তিনি ইতিহাসের আকর উপাদান প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার মুদ্রা ও শিলালিপি এবং এসব মুদ্রা ও শিলালিপিতে ব্যবহৃত ক্যালিগ্রাফির প্রতি আকৃষ্ট হন। একটা পর্যায়ে তিনি বাংলায় মধ্যযুগে হাবশি সুলতানদের আগমন এবং তাঁদের জারি করা মুদ্রা, যা তাঁর জানার আগ্রহকে অতিমাত্রায় আকর্ষণ করে এবং সেই সময়ের মুদ্রা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু মুদ্রা নিয়ে গবেষণার কাজটি সহজ ছিল না। তাই তাঁকে জানতে হয়েছে জের–জবরবিহীন আরবি লিপিতে উৎকীর্ণ মুদ্রা পাঠোদ্ধারের কলাকৌশল, সেই সঙ্গে তুলনামূলক গবেষণার জন্য শিলালিপি চর্চায়ও মনোনিবেশ করেন। এই হাবশি সুলতানদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে মুর্তজা বশীর তাঁদের জারি করা মুদ্রাগুলো সংগ্রহ করেছেন এবং মুদ্রা নিয়ে গবেষণা করেছেন, পাশাপাশি সেই সময়ের শিলালিপি নিয়ে বই প্রকাশ করেছেন, যা অনেকেই জানেন না। তাঁর এ–সংক্রান্ত প্রকাশিত বইটি হলো ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ’। একপর্যায়ে তিনি শৌখিন মুদ্রা সংগ্রাহক হন। তাঁর সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে প্রাচীন বাংলার ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা, ছাপাঙ্কিত স্বর্ণমুদ্রা, ইন্দো–গ্রিক, ইন্দো–সিথিয়ান মুদ্রা, কুষাণ মুদ্রা, গুপ্ত মুদ্রা, হরিকেল মুদ্রা, আব্বাসীয় খলিফাদের স্বর্ণের দিনার, মধ্যযুগের দিল্লি ও বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মুদ্রা, মোগল সম্রাটদের মুদ্রা, মোগল সমসাময়িক আসাম, কোচ ও আরাকানি মুদ্রা, ব্রিটিশ শাসনামলের মুদ্রা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সাল থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত প্রচলিত কাগজি মুদ্রা, ধাতব মুদ্রা, স্মারক মুদ্রা, স্মারক নোট প্রভৃতি। তাঁর ছিল বহুমাত্রিক জ্ঞান অন্বেষণের তাড়া। আর এই জ্ঞান অন্বেষণ করতে গিয়ে তিনি হয়েছেন শখের সংগ্রাহক। মুর্তজা বশীরের অন্যান্য শখের সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে স্ট্যাম্প কালেকশন, পুঁথি সংগ্রহ, বই সংগ্রহ, চাবির রিং সংগ্রহ ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়।

হাবশি সুলতানদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে মুর্তজা বশীর তাঁদের জারি করা মুদ্রাগুলো সংগ্রহ করেছেন এবং মুদ্রা নিয়ে গবেষণা করেছেন, পাশাপাশি সেই সময়ের শিলালিপি নিয়ে বই প্রকাশ করেছেন, যা অনেকেই জানেন না।

ইতিহাস চর্চার অনন্য উপাদান হলো মুদ্রা। মুদ্রার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, মুদ্রা প্রচলনের ব্যবস্থা প্রায় সব সভ্যতায় পণ্য বিনিময় প্রথার ওপর গড়ে উঠেছিল। মুদ্রা আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত বিশালাকার পাথর খণ্ড, কড়ি, স্বর্ণের কানের দুল এবং সিলভার টুকরা প্রভৃতি মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। পণ্য বিনিময় প্রথা, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Barter System (বার্টার সিস্টেম)। অর্থাৎ যখন মুদ্রার আবিষ্কার হয়নি তখন মানুষ পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে একে অপরের চাহিদা মেটাত। বিনিময় মাধ্যমের মধ্যে রয়েছে গরুর বিনিময়ে ধান নেওয়া বা মাছের বিনিময়ে চাল, মুরগির বিনিময়ে চাল বা ধান প্রভৃতি নেওয়া হতো। বাংলা তথা বহির্বিশ্বের অন্যান্য দেশে একসময় বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো কড়ি (কড়ি হলো একধরনের সামুদ্রিক শেল)। প্রাচীন লিডিয়া সভ্যতায় প্রথম খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতকে ধাতব মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়েছিল, যা স্টেটার (Stater) নামে পরিচিত। পারস্য সভ্যতা প্রথম স্বর্ণের দারিক মুদ্রা (Achaemenid Daric) প্রচলন করেছিল, যার সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক। প্রাচীন গ্রিসের মুদ্রার নাম ছিল দ্রাকমা (Drachma), যা কয়েকটি যুগ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল অর্থাৎ ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে আধুনিক মুদ্রা প্রচলিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। গ্রিসের অলবিয়া শহরে ডলফিন আকৃতির মুদ্রা ব্যবহার দেখা যায়। রোমানদের বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে প্রচলিত সর্বপ্রাচীন মুদ্রার নাম ছিল স্বর্ণের সলিডাস (Solidus) যার সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতক। প্রাচীন মিসর, মেসোপটেমিয়া, চীন ও মায়া সভ্যতায় মুদ্রাব্যবস্থার প্রচলন না থাকলেও সে সময়কার মানুষ বিনিময় প্রথার মাধ্যমে পণ্য কেনাবেচা করত। মিসরে মুদ্রা আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত স্বর্ণের কানের দুল এবং সিলভার টুকরা মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। মিসরে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এবং টলেমি প্রাচীন গ্রিসের দ্রাকমা মুদ্রা (Drachma) ব্যবহার শুরু করেন। চীন সভ্যতায় ব্রোঞ্জের তৈরি কড়ি এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত কোদাল (Spade Shape) ও ছুরি (Kinfe Shape) মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। প্রাচীন আজটেক সভ্যতায় ছোটখাট কেনাবেচায় কোকোয়া বিন (Cocoa Beans) ব্যবহার করত এবং নির্দিষ্ট পরিমাণের কাপড়ের টুকরা (Quachtli or Cloth), কপারের টুকরা এবং কখনো কখনো শিশুদের বিক্রি করা হতো, যেমন মূল্যমান হিসেবে একটি শিশু = ৬০০ কোকোয়া বিনের (Cocoa Beans) প্রচলন ছিল। মুদ্রাব্যবস্থা বলতে ইনকাস সভ্যতায় পণ্য বিনিময় প্রথা এবং শ্রম বিনিময় প্রথা প্রচলিত ছিল। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার মুদ্রাব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।

প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা তথা বাংলার প্রথম মুদ্রার প্রচলন শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে, যা ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা (Silver Punch Marked Coin) নামে পরিচিত। শিল্পীর সংগ্রহে ছাপাঙ্কিত রৌপ্য ও স্বর্ণমুদ্রার পাশাপাশি রয়েছে গান্ধার জনপদের বেন্টবার ও সচার শেপ আকৃতির ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা, পঞ্চচালা জনপদের মুদ্রা, প্রাচীন বাংলার ঢালাই তাম্রমুদ্রা (খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-প্রথম শতক), ইন্দো–গ্রিক, ইন্দো-সিথিয়ান রৌপ্যমুদ্রা, কুষাণ স্বর্ণ ও তাম্রমুদ্রা (খ্রিষ্টীয় প্রথম শতক), গুপ্ত অনুকৃত স্বর্ণমুদ্রা (চতুর্থ-সপ্তম খ্রি.

), হরিকেল মুদ্রা (খ্রিষ্টীয় সপ্তম-নবম থেকে দ্বাদশ–ত্রয়োদশ শতক) এবং আব্বাসীয় খলিফাদের স্বর্ণের দিনার। মধ্যযুগের দিল্লি ও বাংলার সুলতানদের মুদ্রা (১২০৪-১৫৫৮ খ্রি.) ও মোগল সম্রাটদের মুদ্রা (১৫২৬-১৮৫৭ খ্রি.), স্বর্ণের কয়েকটি দুর্লভ মুদ্রা, মোগল সমসাময়িক আসাম, কোচ, ত্রিপুরা, আরাকানি মুদ্রা, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির মুদ্রা (১৭৫৭-১৮৫৮ খ্রি.), ভারতের বিভিন্ন স্টেট মুদ্রা, ব্রিটিশ ভারতীয় মুদ্রা (১৮৩৭-১৯৪৭ খ্রি.) এবং পাকিস্তান আমলের কাগজি নোট ও ধাতব মুদ্রা (১৯৪৭-১৯৭১ খ্রি.), আধুনিক বাংলাদেশের কাগজি ও ধাতব মুদ্রা ও স্মারক মুদ্রা ও স্মারক নোট এবং মুদ্রাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য নিদর্শন (১৯৭২-২০২০ খ্রি.)। এ ছাড়া রয়েছে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাগজি, ধাতব ও স্মারক মুদ্রা এবং স্মারক নোটের বিশাল সমারোহ। 

মুর্তজা বশীরের সংগ্রহের মুদ্রাগুলো নিয়ে গবেষণা করা এবং ক্যাটালগ প্রকাশ করার প্রয়োজন রয়েছে। সর্বোপরি তাঁর শিল্পকর্ম, মুদ্রা, স্ট্যাম্প ও অন্যান্য সংগ্রহ নিয়ে তাঁর নামে একক একটি জাদুঘর/সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করা একান্ত জরুরি।

ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা (খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতক): বাংলাদেশের তথা ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বপ্রাচীন মুদ্রা হলো ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা। যার সময়কাল মৌর্য যুগের (খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ-খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় পর্যন্ত এই মুদ্রার ব্যাপক প্রচলন ছিল প্রাচীন বাংলায়)। এই মুদ্রাগুলোর বিশেষত্ব হলো এগুলোতে বিভিন্ন প্রকারের চিত্র প্রস্ফুটিত হয়েছে।

চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে সূর্য, পাহাড়, পাহাড়ের ওপর চাঁদ, নদী, নৌকা, গাছ, নদীতে মাছ, বিক্রির জন্য প্লেটে মাছ রাখার দৃশ্য, নৌকার ওপর মাছ, পাখি, ময়ূর, হাতি, খরগোশ, হরিণের সামনে গাছ, জঙ্গলে প্রবেশরত বাঘ, ষাঁড়, গন্ডার, সাপ, তিন খিলানবিশিষ্ট প্রবেশপথ প্রভৃতি। তবে প্রাথমিক পর্বের শিল্পকর্ম বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি, সেখানেও রয়েছে এ ধরনের চিত্র, যা প্রাথমিক পর্বের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার নওগাঁর পাহাড়পুর, বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার লালমাই-ময়নামতি প্রভৃতি স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আমরা যেসব পোড়ামাটির ফলকচিত্র পাই সেসব ফলকচিত্রেও আমরা এসব বন্য জীবজন্তুর মধ্যে সিংহ, হাতি, হরিণ, সাপ,বেজি, বানর, হনুমান, পশুপাখির মধ্যে ময়ূর, টিয়া পাখি; প্রকৃতির মধ্যে যেমন নদ-নদী, নদীতে মাছ, পাহাড়-পর্বত, পাহাড়ের ওপর চাঁদ, গাছপালা, সূর্য, চাঁদ প্রভৃতির চিত্র দেখতে পাই, যা সেই সময়ের এসব পশুপাখির আধিক্যকে নির্দেশ করে। তেমনি ভাষা হিসেবে এসব সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছিল বলে ধারণা করা যেতে পারে। এই মুদ্রায় কোনো লিপি বা রাজা–বাদশাহদের নাম পাওয়া যায় না। ফলে কোন শাসক এটি প্রবর্তন করেছিলেন, তা বলা দুরূহ। তবে মুদ্রায় ব্যবহৃত চিত্রগুলোকে ভাষা হিসেবে চিত্রলিপি ব্যবহৃত হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে এবং চিত্রগুলো মূল্যমান হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে। মুদ্রাগুলোর আকারগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে গোলাকার, চতুর্কোনাকার, আয়তাকার, পঞ্চকোনাকার, অষ্টকোনাকার প্রভৃতি। মুদ্রাগুলো তৈরিতে সাধারণত ধাতু হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে রুপা কখনো কখনো তামা এবং মুদ্রাগুলোর ওজন সাধারণত ২.৯৯ গ্রাম থেকে ৩.১২ গ্রাম পর্যন্ত লক্ষ করা যায়। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত মুদ্রাগুলোকে জনপদ এবং রাজকীয় সিরিজ—এ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। রাজকীয় সিরিজের মুদ্রার এক পিঠে পাঁচটি চিত্র থাকে। সাধারণত এই শ্রেণির মুদ্রা বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। জনপদ সিরিজের মুদ্রায় একের অধিক, তবে পাঁচটির কম চিত্র দেখা যায়। সাধারণত এই শ্রেণির মুদ্রা নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। শিল্পীর সংগ্রহে রয়েছে বেশ কিছু ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা। এ ছাড়া গান্ধার জনপদের ‘বক্রদণ্ড’ আকৃতির ও ‘বৃত্তাকার’ মুদ্রা এবং বাকিগুলো রাজকীয় সিরিজের মুদ্রা। রয়েছে প্রাচীন ভারতের ছাপাঙ্কিত স্বর্ণমুদ্রা, পাশাপাশি রয়েছে বাংলার মুদ্রারও এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। মুদ্রায় ব্যবহৃত ভাষা আমাদের বলে দেয় বিভিন্ন যুগে বাংলায় কী কী ভাষা প্রচলিত ছিল। যেখানে কোনো ভাষা বোধগম্য নয়, সে ক্ষেত্রে চিত্রলিপি যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বিশেষ স্থান করে নেয়। বাংলার যেসব মুদ্রায় ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো ধারাবাহিকভাবে বিস্তারিত জানা যাবে।

ঢালাই তাম্রমুদ্রা (খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-খ্রিষ্টীয় প্রথম শতক/মোর্য-শুঙ্গ): প্রাচীন বাংলায় ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রার পর ছাঁচে ঢালাই করা একধরনের তামার মুদ্রার প্রচলন ছিল, যা ঢালাই তাম্রমুদ্রা বা কাস্ট কপার কয়েন নামে পরিচিত। এই মুদ্রাগুলোর শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য হলো মুদ্রাগুলো চতুষ্কোনাকার, গোলাকার মুদ্রার একদিকে দণ্ডায়মান ঘোড়া, হাতি, উট, কোনোটিতে আবার দুরন্ত বেগে ঘোড়সওয়ারের ছুটে চলার দৃশ্য, রেলিং ট্রি, অন্যদিকে তিন খিলানবিশিষ্ট পাহাড়ের ওপর চাঁদ, তার নিচে ক্রুশসদৃশ চিহ্ন এবং ত্রিশূলের চিত্র রয়েছে। তবে ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রার মতো এই মুদ্রায়ও ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে চিত্রলিপি। ১৯৯১-৯২ সালে ফ্রান্স-বাংলাদেশ টিম বগুড়ার মহাস্থানগড়ে খননে ১৯টি ঢালাই তাম্রমুদ্রা আবিষ্কার করে। প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র থেকে জানা যায়, গুপ্ত যুগেও ঢালাই তাম্রমুদ্রার প্রচলন ছিল। শিল্পী মর্তুজা বশীরের সংগ্রহে রয়েছে দুটি ঢালাই তাম্রমুদ্রা।

কুষাণ মুদ্রা (খ্রিষ্টীয় প্রথম শতক): প্রাচীন ভারতে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে কুষাণ মুদ্রার প্রচলন ছিল। চীনের ইউ-চি জাতির একটি শাখা কিউ-সুয়াং থেকে প্রাচীন ভারতের কুষাণ জাতির উদ্ভবের কথা জানা যায়। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে কুষাণ সম্রাটেরা পূর্বে বারানসি পর্যন্ত এবং পশ্চিমে ভারতের সীমান্ত ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। ইতিহাস থেকে কুষাণ যুগের ছয়জন সম্রাটের নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন ১. কুজুল কদফিস, ২. ভীম কদফিস (৭৮ খ্রি.) ৩. প্রথম কণিষ্ক , ৪. বশিষ্ক (১০১-১০৬ খ্রি.) ৫. হুবিস্ক (১০৬-১৩৮ খ্রি.), ৬. প্রথম বাসুদেব (১৪২ খ্রি.)। এ ছাড়া কিদারা কুষাণ নামে নতুন আরও একটি জাতির নাম জানা যায়। কুষাণ যুগের মুদ্রার মূল্যমান হিসেবে দিনার ব্যবহৃত হয়েছিল। যেমন ভীম কদফিসের দুই দিনার, এক দিনার এবং সিকি দিনার মূল্যমানের মুদ্রা। তা ছাড়া বর্তমান বাংলাদেশের মুদ্রার মূল্যমান হিসেবে ব্যবহার করা হয় টাকা। আর এই টাকার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কুষাণ শাসনামলে প্রাচীন ভারতের ওডিশা প্রদেশে ‘পুরিকুষাণের’ কপারের তঙ্কা মূল্যমানের মুদ্রা পাওয়া যায়, যার সময়কাল খ্রিষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দী (জন ডেল ২০১৪:৩৩)। এ মুদ্রাগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো—মুদ্রাগুলো দেখতে গোলাকার। মুদ্রার এক পিঠে রয়েছে কুষাণ সম্রাটদের প্রতিকৃতি, যেমন হুবিস্ক ও বাসুদেবের ছবি। অন্য পিঠে রয়েছে দেবদেবীর মূর্তি, গ্রিকলিপি, খরোষ্ঠী লিপি, কখনো ঘোড়সওয়ার এবং হাতে অস্ত্র। বাংলাদেশের কুমিল্লা ও বগুড়া থেকে বেশ কিছু কুষাণ যুগের স্বর্ণ ও তাম্রমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। ধারণা করা হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে হয়তো মুদ্রাগুলো এখানে এসেছিল। কুষাণ যুগের বিপুল পরিমাণের স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্রমুদ্রার উপস্থিতি তৎকালীন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে। কুষাণ স্বর্ণমুদ্রার ওজন পরিমাপ করে দেখা গেছে, এতে ৭.৮৪-৭.৯৪ গ্রাম স্বর্ণ ব্যবহৃত হয়েছে এবং তাম্রমুদ্রায় ২.৫০, ৬.২৫, ৭.২৩ থেকে ৮.৭৩, ১০.৮৭ থেকে ১৬.২৭ গ্রাম তামা ব্যবহৃত হয়েছে। কুষাণ সম্রাটেরা যে নিজেদের আভিজাত্যকে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন, তা তাঁদের প্রতিকৃতি থেকে বোঝা যায়। শিল্পী মর্তুজা বশীরের সংগ্রহে রয়েছে কুষাণ সম্রাট হুবিস্ক, বাসুদেব, বশিষ্ক ও কিদারা কুষাণের স্বর্ণমুদ্রা। এ ছাড়া বেশ কিছু তাম্রমুদ্রাও রয়েছে। 

গুপ্ত মুদ্রা (খ্রিষ্টীয় চতুর্থ-সপ্তম শতক): গুপ্ত যুগে শিল্পের বিশেষ করে ভাস্কর্য, মূর্তি, গুহাচিত্র, তাম্রশাসন, মুদ্রা প্রভৃতিতে শিল্পের চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল। গুপ্ত যুগকে শিল্পের স্বর্ণযুগও বলা হতো, যা ধ্রুপদি শিল্পকলা বা ক্লাসিক্যাল আর্ট নামে পরিচিত। গুপ্ত যুগে অসংখ্য স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করা হয়েছিল, যার জন্য সমসাময়িক একজন কবি গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রাকে বৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করেছেন। আকারে ছোট্ট একটি মুদ্রার শৈল্পিক দিক শিল্পী এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে দর্শককে বিমোহিত করে। যেমন চন্দ্র গুপ্ত মোর্য দ্বিতীয়ের স্বর্ণমুদ্রার একদিকে ত্রিভঙ্গিমায় দাঁড়ানো দেবীর প্রতিকৃতি, যার এক হাতে স্বচ্ছ বসন ধরা, অন্য হাতে ত্রিশূল। মুদ্রাটির অপর পিঠে বজ্রাসনে বসা দেবীর চিত্র। গুপ্ত রৌপ্যমুদ্রার বৈশিষ্ট্য হলো—একদিকে রাজা–বাদশাহদের প্রতিকৃতি, অপর দিকে দেব-দেবীর ছবি। লিপিমালা হিসেবে পাওয়া যায় ব্রাহ্মীলিপি। যদিও ভারতের বিহার অঞ্চলে খ্রিষ্টীয় ৩২০ শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। শুধু মুদ্রাই নয়, তাম্রশাসন, সাহিত্যিক উপাদান এবং বিদেশি তথ্যসূত্র প্রভৃতি থেকে জানা যায়, গুপ্ত শাসন খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কুমিল্লার শালবন বিহার ও গুনাইগড়, বগুড়ার মহাস্থানগড়, পলাশবাড়ী ও বামনপাড়া, গাইবান্ধার সাহেবগঞ্জ, ফরিদপুরের গোঘাখোলা, যশোরের মোহাম্মদপুর প্রভৃতি স্থান থেকে গুপ্ত সময়কালের বেশ কিছু মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। মুদ্রাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এগুলোর মধ্যে রয়েছে গুপ্ত শাসক সমুদ্র গুপ্ত, কুমারা গুপ্ত-১, চন্দ্র গুপ্ত দ্বিতীয় এবং স্কন্দ গুপ্তের মুদ্রাসমূহ। বাংলায় গুপ্ত যুগের যেসব স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে তার বৈশিষ্ট্য হলো—এগুলো দেখতে গোলাকার। গুপ্ত যুগের মুদ্রার মূল্যমান হিসেবে ধরা হয়েছে দিনার। গুপ্ত যুগের শাসকদের মধ্যে শ্রী গুপ্ত (৩২০ খ্রি.), চন্দ্র গুপ্ত-১ (৩২০ খ্রি.), সমুদ্র গুপ্ত (৩৪০-৩৭৫ খ্রি.), চন্দ্র গুপ্ত দ্বিতীয় (৩৭৫-৪১৪ খ্রি.), কুমারা গুপ্ত-১ (৪১৪-৪৫৫ খ্রি.), স্কন্দ গুপ্ত (৪৫৫-৪৬৮ খ্রি.), নরসিংহ গুপ্ত (৫২৫-৫৩০ খ্রি.) প্রায় সবাই স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। বাংলায় গুপ্ত যুগের যে সকল স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে তার বৈশিষ্ট্য হলো, দেখতে গোলাকার। শিল্পী মর্তুজা বশীরের সংগ্রহে রয়েছে গুপ্ত অনুকৃতি একটি স্বর্ণমুদ্রা।

 হরিকেল মুদ্রা (খ্রিষ্টীয় সপ্তম-অষ্টম থেকে দ্বাদশ–ত্রয়োদশ শতক): বাংলার প্রাচীন একটি জনপদের নাম হরিকেল। তবে কুমিল্লার ময়নামতি থেকে আবিষ্কৃত একটি কপার প্লেটে রণবঙ্কমল্ল হরিকেল দেব নামের একজন রাজা (রণবঙ্কমল্ল) ও রাজ্যের (হরিকেল) নাম জানা যায়। এর থেকে এই মুদ্রার নাম হরিকেল মুদ্রা। কুমিল্লার ময়নামতি থেকে বেশ কিছু হরিকেল মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। মুদ্রা সাক্ষ্যে ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে খ্রিষ্টীয় সপ্তম-অষ্টম থেকে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত হরিকেল মুদ্রার প্রচলন ছিল। হরিকেল মুদ্রার বৈশিষ্ট্য হলো সম্মুখপৃষ্ঠে গোলাকার বৃত্তের মাঝে ব্রাহ্মীলিপিতে হরিকেল রাজ্যের নাম উৎকীর্ণ করা হয়েছে এবং শিবের বাহন নন্দী বা ষাঁড় ও বৃত্তের বাইরে চারপাশে চেইন নকশা করা, বিপরীত পৃষ্ঠে রয়েছে গোলাকার বৃত্তের মাঝে ত্রিশূল এবং বৃত্তের অভ্যন্তরে ও বাইরে চারপাশে চেইন নকশা করা। মুদ্রাগুলো গোলাকার এবং অন্যান্য মুদ্রা থেকে ওজনে হালকা। প্রাচীন জনপদ হরিকেল রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল আধুনিক সিলেট, কুমিল্লা-ময়নামতিসহ, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে। শিল্পী মর্তুজা বশীরের সংগ্রহে রয়েছে বিভিন্ন মূল্যমানের বেশ কিছু হরিকেল রৌপ্যমুদ্রা।

মুর্তজা বশীরের সংগ্রহের মুদ্রাগুলো নিয়ে গবেষণা করা এবং ক্যাটালগ প্রকাশ করার প্রয়োজন রয়েছে। সর্বোপরি তাঁর শিল্পকর্ম, মুদ্রা, স্ট্যাম্প ও অন্যান্য সংগ্রহ নিয়ে তাঁর নামে একক একটি জাদুঘর/সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করা একান্ত জরুরি। তাঁর মুদ্রা সংগ্রহ ও গবেষণা এবং এ–সংক্রান্ত জীবনাচার সম্পর্কে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: খ র ষ ট য় প রথম শতক ম দ র র প রচলন ছ ল ব যবহ ত হয় ছ ল র ব শ ষ ট য হল র স গ রহ র ম খ র ষ টপ র ব য র সময়ক ল ম দ র র এক স ই সময় র র ব যবস থ এই ম দ র অন য ন য স বর ণ র র স বর ণ ত স বর ণ স ধ রণত ব যবহ র প রচল ত জনপদ র র ট কর পর চ ত কর ছ ল কর ছ ন স ম রক র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

শিল্পী মুর্তজা বশীরের মুদ্রা সংগ্রহ

শিল্পী মুর্তজা বশীর তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে ছবি আঁকার পাশাপাশি বেশ কিছু গল্পগ্রন্থ, কাব্যগ্রন্থ ও উপন্যাস রচনা করেছেন। মুদ্রাসংক্রান্ত একাধিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ এবং একটি বইও প্রকাশ করেছেন। তিনি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেছেন। দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে শিল্পচর্চার পাশাপাশি শিল্প নির্দেশক হিসেবেও কাজ করেছেন। ইতিহাস জানার প্রতি মুর্তজা বশীর ছিলেন প্রবল আগ্রহী। বিশেষ করে হাবশি সুলতানদের সম্পর্কে ইতিহাসের বই পড়েছেন; কিন্তু তাতে তিনি তুষ্ট হতে পারেননি। ফলে তিনি ইতিহাসের আকর উপাদান প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার মুদ্রা ও শিলালিপি এবং এসব মুদ্রা ও শিলালিপিতে ব্যবহৃত ক্যালিগ্রাফির প্রতি আকৃষ্ট হন। একটা পর্যায়ে তিনি বাংলায় মধ্যযুগে হাবশি সুলতানদের আগমন এবং তাঁদের জারি করা মুদ্রা, যা তাঁর জানার আগ্রহকে অতিমাত্রায় আকর্ষণ করে এবং সেই সময়ের মুদ্রা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু মুদ্রা নিয়ে গবেষণার কাজটি সহজ ছিল না। তাই তাঁকে জানতে হয়েছে জের–জবরবিহীন আরবি লিপিতে উৎকীর্ণ মুদ্রা পাঠোদ্ধারের কলাকৌশল, সেই সঙ্গে তুলনামূলক গবেষণার জন্য শিলালিপি চর্চায়ও মনোনিবেশ করেন। এই হাবশি সুলতানদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে মুর্তজা বশীর তাঁদের জারি করা মুদ্রাগুলো সংগ্রহ করেছেন এবং মুদ্রা নিয়ে গবেষণা করেছেন, পাশাপাশি সেই সময়ের শিলালিপি নিয়ে বই প্রকাশ করেছেন, যা অনেকেই জানেন না। তাঁর এ–সংক্রান্ত প্রকাশিত বইটি হলো ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ’। একপর্যায়ে তিনি শৌখিন মুদ্রা সংগ্রাহক হন। তাঁর সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে প্রাচীন বাংলার ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা, ছাপাঙ্কিত স্বর্ণমুদ্রা, ইন্দো–গ্রিক, ইন্দো–সিথিয়ান মুদ্রা, কুষাণ মুদ্রা, গুপ্ত মুদ্রা, হরিকেল মুদ্রা, আব্বাসীয় খলিফাদের স্বর্ণের দিনার, মধ্যযুগের দিল্লি ও বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মুদ্রা, মোগল সম্রাটদের মুদ্রা, মোগল সমসাময়িক আসাম, কোচ ও আরাকানি মুদ্রা, ব্রিটিশ শাসনামলের মুদ্রা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সাল থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত প্রচলিত কাগজি মুদ্রা, ধাতব মুদ্রা, স্মারক মুদ্রা, স্মারক নোট প্রভৃতি। তাঁর ছিল বহুমাত্রিক জ্ঞান অন্বেষণের তাড়া। আর এই জ্ঞান অন্বেষণ করতে গিয়ে তিনি হয়েছেন শখের সংগ্রাহক। মুর্তজা বশীরের অন্যান্য শখের সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে স্ট্যাম্প কালেকশন, পুঁথি সংগ্রহ, বই সংগ্রহ, চাবির রিং সংগ্রহ ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়।

হাবশি সুলতানদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে মুর্তজা বশীর তাঁদের জারি করা মুদ্রাগুলো সংগ্রহ করেছেন এবং মুদ্রা নিয়ে গবেষণা করেছেন, পাশাপাশি সেই সময়ের শিলালিপি নিয়ে বই প্রকাশ করেছেন, যা অনেকেই জানেন না।

ইতিহাস চর্চার অনন্য উপাদান হলো মুদ্রা। মুদ্রার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, মুদ্রা প্রচলনের ব্যবস্থা প্রায় সব সভ্যতায় পণ্য বিনিময় প্রথার ওপর গড়ে উঠেছিল। মুদ্রা আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত বিশালাকার পাথর খণ্ড, কড়ি, স্বর্ণের কানের দুল এবং সিলভার টুকরা প্রভৃতি মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। পণ্য বিনিময় প্রথা, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Barter System (বার্টার সিস্টেম)। অর্থাৎ যখন মুদ্রার আবিষ্কার হয়নি তখন মানুষ পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে একে অপরের চাহিদা মেটাত। বিনিময় মাধ্যমের মধ্যে রয়েছে গরুর বিনিময়ে ধান নেওয়া বা মাছের বিনিময়ে চাল, মুরগির বিনিময়ে চাল বা ধান প্রভৃতি নেওয়া হতো। বাংলা তথা বহির্বিশ্বের অন্যান্য দেশে একসময় বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো কড়ি (কড়ি হলো একধরনের সামুদ্রিক শেল)। প্রাচীন লিডিয়া সভ্যতায় প্রথম খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতকে ধাতব মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়েছিল, যা স্টেটার (Stater) নামে পরিচিত। পারস্য সভ্যতা প্রথম স্বর্ণের দারিক মুদ্রা (Achaemenid Daric) প্রচলন করেছিল, যার সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক। প্রাচীন গ্রিসের মুদ্রার নাম ছিল দ্রাকমা (Drachma), যা কয়েকটি যুগ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল অর্থাৎ ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে আধুনিক মুদ্রা প্রচলিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। গ্রিসের অলবিয়া শহরে ডলফিন আকৃতির মুদ্রা ব্যবহার দেখা যায়। রোমানদের বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে প্রচলিত সর্বপ্রাচীন মুদ্রার নাম ছিল স্বর্ণের সলিডাস (Solidus) যার সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতক। প্রাচীন মিসর, মেসোপটেমিয়া, চীন ও মায়া সভ্যতায় মুদ্রাব্যবস্থার প্রচলন না থাকলেও সে সময়কার মানুষ বিনিময় প্রথার মাধ্যমে পণ্য কেনাবেচা করত। মিসরে মুদ্রা আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত স্বর্ণের কানের দুল এবং সিলভার টুকরা মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। মিসরে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এবং টলেমি প্রাচীন গ্রিসের দ্রাকমা মুদ্রা (Drachma) ব্যবহার শুরু করেন। চীন সভ্যতায় ব্রোঞ্জের তৈরি কড়ি এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত কোদাল (Spade Shape) ও ছুরি (Kinfe Shape) মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। প্রাচীন আজটেক সভ্যতায় ছোটখাট কেনাবেচায় কোকোয়া বিন (Cocoa Beans) ব্যবহার করত এবং নির্দিষ্ট পরিমাণের কাপড়ের টুকরা (Quachtli or Cloth), কপারের টুকরা এবং কখনো কখনো শিশুদের বিক্রি করা হতো, যেমন মূল্যমান হিসেবে একটি শিশু = ৬০০ কোকোয়া বিনের (Cocoa Beans) প্রচলন ছিল। মুদ্রাব্যবস্থা বলতে ইনকাস সভ্যতায় পণ্য বিনিময় প্রথা এবং শ্রম বিনিময় প্রথা প্রচলিত ছিল। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার মুদ্রাব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।

প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা তথা বাংলার প্রথম মুদ্রার প্রচলন শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে, যা ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা (Silver Punch Marked Coin) নামে পরিচিত। শিল্পীর সংগ্রহে ছাপাঙ্কিত রৌপ্য ও স্বর্ণমুদ্রার পাশাপাশি রয়েছে গান্ধার জনপদের বেন্টবার ও সচার শেপ আকৃতির ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা, পঞ্চচালা জনপদের মুদ্রা, প্রাচীন বাংলার ঢালাই তাম্রমুদ্রা (খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-প্রথম শতক), ইন্দো–গ্রিক, ইন্দো-সিথিয়ান রৌপ্যমুদ্রা, কুষাণ স্বর্ণ ও তাম্রমুদ্রা (খ্রিষ্টীয় প্রথম শতক), গুপ্ত অনুকৃত স্বর্ণমুদ্রা (চতুর্থ-সপ্তম খ্রি.), হরিকেল মুদ্রা (খ্রিষ্টীয় সপ্তম-নবম থেকে দ্বাদশ–ত্রয়োদশ শতক) এবং আব্বাসীয় খলিফাদের স্বর্ণের দিনার। মধ্যযুগের দিল্লি ও বাংলার সুলতানদের মুদ্রা (১২০৪-১৫৫৮ খ্রি.) ও মোগল সম্রাটদের মুদ্রা (১৫২৬-১৮৫৭ খ্রি.), স্বর্ণের কয়েকটি দুর্লভ মুদ্রা, মোগল সমসাময়িক আসাম, কোচ, ত্রিপুরা, আরাকানি মুদ্রা, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির মুদ্রা (১৭৫৭-১৮৫৮ খ্রি.), ভারতের বিভিন্ন স্টেট মুদ্রা, ব্রিটিশ ভারতীয় মুদ্রা (১৮৩৭-১৯৪৭ খ্রি.) এবং পাকিস্তান আমলের কাগজি নোট ও ধাতব মুদ্রা (১৯৪৭-১৯৭১ খ্রি.), আধুনিক বাংলাদেশের কাগজি ও ধাতব মুদ্রা ও স্মারক মুদ্রা ও স্মারক নোট এবং মুদ্রাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য নিদর্শন (১৯৭২-২০২০ খ্রি.)। এ ছাড়া রয়েছে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাগজি, ধাতব ও স্মারক মুদ্রা এবং স্মারক নোটের বিশাল সমারোহ। 

মুর্তজা বশীরের সংগ্রহের মুদ্রাগুলো নিয়ে গবেষণা করা এবং ক্যাটালগ প্রকাশ করার প্রয়োজন রয়েছে। সর্বোপরি তাঁর শিল্পকর্ম, মুদ্রা, স্ট্যাম্প ও অন্যান্য সংগ্রহ নিয়ে তাঁর নামে একক একটি জাদুঘর/সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করা একান্ত জরুরি।

ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা (খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতক): বাংলাদেশের তথা ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বপ্রাচীন মুদ্রা হলো ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা। যার সময়কাল মৌর্য যুগের (খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ-খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় পর্যন্ত এই মুদ্রার ব্যাপক প্রচলন ছিল প্রাচীন বাংলায়)। এই মুদ্রাগুলোর বিশেষত্ব হলো এগুলোতে বিভিন্ন প্রকারের চিত্র প্রস্ফুটিত হয়েছে।

চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে সূর্য, পাহাড়, পাহাড়ের ওপর চাঁদ, নদী, নৌকা, গাছ, নদীতে মাছ, বিক্রির জন্য প্লেটে মাছ রাখার দৃশ্য, নৌকার ওপর মাছ, পাখি, ময়ূর, হাতি, খরগোশ, হরিণের সামনে গাছ, জঙ্গলে প্রবেশরত বাঘ, ষাঁড়, গন্ডার, সাপ, তিন খিলানবিশিষ্ট প্রবেশপথ প্রভৃতি। তবে প্রাথমিক পর্বের শিল্পকর্ম বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি, সেখানেও রয়েছে এ ধরনের চিত্র, যা প্রাথমিক পর্বের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার নওগাঁর পাহাড়পুর, বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার লালমাই-ময়নামতি প্রভৃতি স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আমরা যেসব পোড়ামাটির ফলকচিত্র পাই সেসব ফলকচিত্রেও আমরা এসব বন্য জীবজন্তুর মধ্যে সিংহ, হাতি, হরিণ, সাপ,বেজি, বানর, হনুমান, পশুপাখির মধ্যে ময়ূর, টিয়া পাখি; প্রকৃতির মধ্যে যেমন নদ-নদী, নদীতে মাছ, পাহাড়-পর্বত, পাহাড়ের ওপর চাঁদ, গাছপালা, সূর্য, চাঁদ প্রভৃতির চিত্র দেখতে পাই, যা সেই সময়ের এসব পশুপাখির আধিক্যকে নির্দেশ করে। তেমনি ভাষা হিসেবে এসব সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছিল বলে ধারণা করা যেতে পারে। এই মুদ্রায় কোনো লিপি বা রাজা–বাদশাহদের নাম পাওয়া যায় না। ফলে কোন শাসক এটি প্রবর্তন করেছিলেন, তা বলা দুরূহ। তবে মুদ্রায় ব্যবহৃত চিত্রগুলোকে ভাষা হিসেবে চিত্রলিপি ব্যবহৃত হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে এবং চিত্রগুলো মূল্যমান হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে। মুদ্রাগুলোর আকারগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে গোলাকার, চতুর্কোনাকার, আয়তাকার, পঞ্চকোনাকার, অষ্টকোনাকার প্রভৃতি। মুদ্রাগুলো তৈরিতে সাধারণত ধাতু হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে রুপা কখনো কখনো তামা এবং মুদ্রাগুলোর ওজন সাধারণত ২.৯৯ গ্রাম থেকে ৩.১২ গ্রাম পর্যন্ত লক্ষ করা যায়। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত মুদ্রাগুলোকে জনপদ এবং রাজকীয় সিরিজ—এ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। রাজকীয় সিরিজের মুদ্রার এক পিঠে পাঁচটি চিত্র থাকে। সাধারণত এই শ্রেণির মুদ্রা বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। জনপদ সিরিজের মুদ্রায় একের অধিক, তবে পাঁচটির কম চিত্র দেখা যায়। সাধারণত এই শ্রেণির মুদ্রা নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। শিল্পীর সংগ্রহে রয়েছে বেশ কিছু ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা। এ ছাড়া গান্ধার জনপদের ‘বক্রদণ্ড’ আকৃতির ও ‘বৃত্তাকার’ মুদ্রা এবং বাকিগুলো রাজকীয় সিরিজের মুদ্রা। রয়েছে প্রাচীন ভারতের ছাপাঙ্কিত স্বর্ণমুদ্রা, পাশাপাশি রয়েছে বাংলার মুদ্রারও এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। মুদ্রায় ব্যবহৃত ভাষা আমাদের বলে দেয় বিভিন্ন যুগে বাংলায় কী কী ভাষা প্রচলিত ছিল। যেখানে কোনো ভাষা বোধগম্য নয়, সে ক্ষেত্রে চিত্রলিপি যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বিশেষ স্থান করে নেয়। বাংলার যেসব মুদ্রায় ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো ধারাবাহিকভাবে বিস্তারিত জানা যাবে।

ঢালাই তাম্রমুদ্রা (খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-খ্রিষ্টীয় প্রথম শতক/মোর্য-শুঙ্গ): প্রাচীন বাংলায় ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রার পর ছাঁচে ঢালাই করা একধরনের তামার মুদ্রার প্রচলন ছিল, যা ঢালাই তাম্রমুদ্রা বা কাস্ট কপার কয়েন নামে পরিচিত। এই মুদ্রাগুলোর শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য হলো মুদ্রাগুলো চতুষ্কোনাকার, গোলাকার মুদ্রার একদিকে দণ্ডায়মান ঘোড়া, হাতি, উট, কোনোটিতে আবার দুরন্ত বেগে ঘোড়সওয়ারের ছুটে চলার দৃশ্য, রেলিং ট্রি, অন্যদিকে তিন খিলানবিশিষ্ট পাহাড়ের ওপর চাঁদ, তার নিচে ক্রুশসদৃশ চিহ্ন এবং ত্রিশূলের চিত্র রয়েছে। তবে ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রার মতো এই মুদ্রায়ও ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে চিত্রলিপি। ১৯৯১-৯২ সালে ফ্রান্স-বাংলাদেশ টিম বগুড়ার মহাস্থানগড়ে খননে ১৯টি ঢালাই তাম্রমুদ্রা আবিষ্কার করে। প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র থেকে জানা যায়, গুপ্ত যুগেও ঢালাই তাম্রমুদ্রার প্রচলন ছিল। শিল্পী মর্তুজা বশীরের সংগ্রহে রয়েছে দুটি ঢালাই তাম্রমুদ্রা।

কুষাণ মুদ্রা (খ্রিষ্টীয় প্রথম শতক): প্রাচীন ভারতে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে কুষাণ মুদ্রার প্রচলন ছিল। চীনের ইউ-চি জাতির একটি শাখা কিউ-সুয়াং থেকে প্রাচীন ভারতের কুষাণ জাতির উদ্ভবের কথা জানা যায়। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে কুষাণ সম্রাটেরা পূর্বে বারানসি পর্যন্ত এবং পশ্চিমে ভারতের সীমান্ত ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। ইতিহাস থেকে কুষাণ যুগের ছয়জন সম্রাটের নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন ১. কুজুল কদফিস, ২. ভীম কদফিস (৭৮ খ্রি.) ৩. প্রথম কণিষ্ক , ৪. বশিষ্ক (১০১-১০৬ খ্রি.) ৫. হুবিস্ক (১০৬-১৩৮ খ্রি.), ৬. প্রথম বাসুদেব (১৪২ খ্রি.)। এ ছাড়া কিদারা কুষাণ নামে নতুন আরও একটি জাতির নাম জানা যায়। কুষাণ যুগের মুদ্রার মূল্যমান হিসেবে দিনার ব্যবহৃত হয়েছিল। যেমন ভীম কদফিসের দুই দিনার, এক দিনার এবং সিকি দিনার মূল্যমানের মুদ্রা। তা ছাড়া বর্তমান বাংলাদেশের মুদ্রার মূল্যমান হিসেবে ব্যবহার করা হয় টাকা। আর এই টাকার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কুষাণ শাসনামলে প্রাচীন ভারতের ওডিশা প্রদেশে ‘পুরিকুষাণের’ কপারের তঙ্কা মূল্যমানের মুদ্রা পাওয়া যায়, যার সময়কাল খ্রিষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দী (জন ডেল ২০১৪:৩৩)। এ মুদ্রাগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো—মুদ্রাগুলো দেখতে গোলাকার। মুদ্রার এক পিঠে রয়েছে কুষাণ সম্রাটদের প্রতিকৃতি, যেমন হুবিস্ক ও বাসুদেবের ছবি। অন্য পিঠে রয়েছে দেবদেবীর মূর্তি, গ্রিকলিপি, খরোষ্ঠী লিপি, কখনো ঘোড়সওয়ার এবং হাতে অস্ত্র। বাংলাদেশের কুমিল্লা ও বগুড়া থেকে বেশ কিছু কুষাণ যুগের স্বর্ণ ও তাম্রমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। ধারণা করা হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে হয়তো মুদ্রাগুলো এখানে এসেছিল। কুষাণ যুগের বিপুল পরিমাণের স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্রমুদ্রার উপস্থিতি তৎকালীন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে। কুষাণ স্বর্ণমুদ্রার ওজন পরিমাপ করে দেখা গেছে, এতে ৭.৮৪-৭.৯৪ গ্রাম স্বর্ণ ব্যবহৃত হয়েছে এবং তাম্রমুদ্রায় ২.৫০, ৬.২৫, ৭.২৩ থেকে ৮.৭৩, ১০.৮৭ থেকে ১৬.২৭ গ্রাম তামা ব্যবহৃত হয়েছে। কুষাণ সম্রাটেরা যে নিজেদের আভিজাত্যকে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন, তা তাঁদের প্রতিকৃতি থেকে বোঝা যায়। শিল্পী মর্তুজা বশীরের সংগ্রহে রয়েছে কুষাণ সম্রাট হুবিস্ক, বাসুদেব, বশিষ্ক ও কিদারা কুষাণের স্বর্ণমুদ্রা। এ ছাড়া বেশ কিছু তাম্রমুদ্রাও রয়েছে। 

গুপ্ত মুদ্রা (খ্রিষ্টীয় চতুর্থ-সপ্তম শতক): গুপ্ত যুগে শিল্পের বিশেষ করে ভাস্কর্য, মূর্তি, গুহাচিত্র, তাম্রশাসন, মুদ্রা প্রভৃতিতে শিল্পের চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল। গুপ্ত যুগকে শিল্পের স্বর্ণযুগও বলা হতো, যা ধ্রুপদি শিল্পকলা বা ক্লাসিক্যাল আর্ট নামে পরিচিত। গুপ্ত যুগে অসংখ্য স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করা হয়েছিল, যার জন্য সমসাময়িক একজন কবি গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রাকে বৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করেছেন। আকারে ছোট্ট একটি মুদ্রার শৈল্পিক দিক শিল্পী এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে দর্শককে বিমোহিত করে। যেমন চন্দ্র গুপ্ত মোর্য দ্বিতীয়ের স্বর্ণমুদ্রার একদিকে ত্রিভঙ্গিমায় দাঁড়ানো দেবীর প্রতিকৃতি, যার এক হাতে স্বচ্ছ বসন ধরা, অন্য হাতে ত্রিশূল। মুদ্রাটির অপর পিঠে বজ্রাসনে বসা দেবীর চিত্র। গুপ্ত রৌপ্যমুদ্রার বৈশিষ্ট্য হলো—একদিকে রাজা–বাদশাহদের প্রতিকৃতি, অপর দিকে দেব-দেবীর ছবি। লিপিমালা হিসেবে পাওয়া যায় ব্রাহ্মীলিপি। যদিও ভারতের বিহার অঞ্চলে খ্রিষ্টীয় ৩২০ শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। শুধু মুদ্রাই নয়, তাম্রশাসন, সাহিত্যিক উপাদান এবং বিদেশি তথ্যসূত্র প্রভৃতি থেকে জানা যায়, গুপ্ত শাসন খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কুমিল্লার শালবন বিহার ও গুনাইগড়, বগুড়ার মহাস্থানগড়, পলাশবাড়ী ও বামনপাড়া, গাইবান্ধার সাহেবগঞ্জ, ফরিদপুরের গোঘাখোলা, যশোরের মোহাম্মদপুর প্রভৃতি স্থান থেকে গুপ্ত সময়কালের বেশ কিছু মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। মুদ্রাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এগুলোর মধ্যে রয়েছে গুপ্ত শাসক সমুদ্র গুপ্ত, কুমারা গুপ্ত-১, চন্দ্র গুপ্ত দ্বিতীয় এবং স্কন্দ গুপ্তের মুদ্রাসমূহ। বাংলায় গুপ্ত যুগের যেসব স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে তার বৈশিষ্ট্য হলো—এগুলো দেখতে গোলাকার। গুপ্ত যুগের মুদ্রার মূল্যমান হিসেবে ধরা হয়েছে দিনার। গুপ্ত যুগের শাসকদের মধ্যে শ্রী গুপ্ত (৩২০ খ্রি.), চন্দ্র গুপ্ত-১ (৩২০ খ্রি.), সমুদ্র গুপ্ত (৩৪০-৩৭৫ খ্রি.), চন্দ্র গুপ্ত দ্বিতীয় (৩৭৫-৪১৪ খ্রি.), কুমারা গুপ্ত-১ (৪১৪-৪৫৫ খ্রি.), স্কন্দ গুপ্ত (৪৫৫-৪৬৮ খ্রি.), নরসিংহ গুপ্ত (৫২৫-৫৩০ খ্রি.) প্রায় সবাই স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। বাংলায় গুপ্ত যুগের যে সকল স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে তার বৈশিষ্ট্য হলো, দেখতে গোলাকার। শিল্পী মর্তুজা বশীরের সংগ্রহে রয়েছে গুপ্ত অনুকৃতি একটি স্বর্ণমুদ্রা।

 হরিকেল মুদ্রা (খ্রিষ্টীয় সপ্তম-অষ্টম থেকে দ্বাদশ–ত্রয়োদশ শতক): বাংলার প্রাচীন একটি জনপদের নাম হরিকেল। তবে কুমিল্লার ময়নামতি থেকে আবিষ্কৃত একটি কপার প্লেটে রণবঙ্কমল্ল হরিকেল দেব নামের একজন রাজা (রণবঙ্কমল্ল) ও রাজ্যের (হরিকেল) নাম জানা যায়। এর থেকে এই মুদ্রার নাম হরিকেল মুদ্রা। কুমিল্লার ময়নামতি থেকে বেশ কিছু হরিকেল মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। মুদ্রা সাক্ষ্যে ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে খ্রিষ্টীয় সপ্তম-অষ্টম থেকে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত হরিকেল মুদ্রার প্রচলন ছিল। হরিকেল মুদ্রার বৈশিষ্ট্য হলো সম্মুখপৃষ্ঠে গোলাকার বৃত্তের মাঝে ব্রাহ্মীলিপিতে হরিকেল রাজ্যের নাম উৎকীর্ণ করা হয়েছে এবং শিবের বাহন নন্দী বা ষাঁড় ও বৃত্তের বাইরে চারপাশে চেইন নকশা করা, বিপরীত পৃষ্ঠে রয়েছে গোলাকার বৃত্তের মাঝে ত্রিশূল এবং বৃত্তের অভ্যন্তরে ও বাইরে চারপাশে চেইন নকশা করা। মুদ্রাগুলো গোলাকার এবং অন্যান্য মুদ্রা থেকে ওজনে হালকা। প্রাচীন জনপদ হরিকেল রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল আধুনিক সিলেট, কুমিল্লা-ময়নামতিসহ, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে। শিল্পী মর্তুজা বশীরের সংগ্রহে রয়েছে বিভিন্ন মূল্যমানের বেশ কিছু হরিকেল রৌপ্যমুদ্রা।

মুর্তজা বশীরের সংগ্রহের মুদ্রাগুলো নিয়ে গবেষণা করা এবং ক্যাটালগ প্রকাশ করার প্রয়োজন রয়েছে। সর্বোপরি তাঁর শিল্পকর্ম, মুদ্রা, স্ট্যাম্প ও অন্যান্য সংগ্রহ নিয়ে তাঁর নামে একক একটি জাদুঘর/সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করা একান্ত জরুরি। তাঁর মুদ্রা সংগ্রহ ও গবেষণা এবং এ–সংক্রান্ত জীবনাচার সম্পর্কে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ