পরামর্শক কমিটির সুপারিশ অনুসারে এনবিআর ভাগ হয়নি, বললেন কমিটির সদস্য ফরিদ উদ্দিন
Published: 27th, September 2025 GMT
রাজস্ব খাত সংস্কারের জন্য গঠিত পরামর্শক কমিটি যে সুপারিশ করেছিল, তার আলোকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ আলাদা করা হয়নি। এমন মন্তব্য করেছেন এনবিআর সংস্কারের জন্য সরকার গঠিত পরামর্শক কমিটির সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এখন এই দুই বিভাগ ভুলভাবে পরিচালিত হলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।’
আজ শনিবার রাজধানীর গুলশানের পুলিশ প্লাজায় আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় এমন মন্তব্য করেছেন এনবিআরের সাবেক সদস্য ও এনবিআর সংস্কারের জন্য গঠিত পরামর্শক কমিটির সদস্য মো.
মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, কমিটির সুপারিশ ছিল এ রকম—নীতি প্রণয়ন কমিটিতে বাধ্যতামূলকভাবে বেসরকারি খাতের কিছু ব্যক্তিকে রাখতে হবে। এ ছাড়া যে নীতি নেওয়া হবে, তা অন্তত পাঁচ বছর অব্যাহত রাখতে হবে।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ যৌথভাবে ‘কার্যকর কর নীতি ও ব্যবস্থাপনা আনতে এনবিআর সংস্কার’ শীর্ষক এ গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি রহমান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির।
গত ১২ মে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা—এই দুটি বিভাগ করার অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এর পর থেকে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে যৌক্তিক সংস্কারে দাবিতে প্রায় দেড় মাস আন্দোলন করেন। পরে অধ্যাদেশটি সংশোধনের জন্য গত ২৯ জুন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে উপদেষ্টা পরিষদ অধ্যাদেশটির সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে দুটি বিভাগের কার্যক্রম শুরু করার কথা আছে।
ব্যবসায়ীদের মত জরুরি
গোলটেবিল আলোচনায় এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, গত ১০-১৫ বছরে ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন অংশীজনেরা এনবিআরের বিষয়ে যেসব দাবি ও মতামত জানিয়েছিলেন, সবগুলো মূল্যায়ন করে সুপারিশ আকারে প্রতিবেদন তৈরি করে রাজস্ব খাত সংস্কারে গঠিত কমিটি। এরপর ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে মতামত নেওয়ার জন্য ৭৫টি সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, অ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বারের কাছে তা পাঠানো হয়। বিএনপি, জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কাছেও মতামত চাওয়া হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শুধু ফরেন চেম্বারের কাছ থেকে মোটামুটি একটি পূর্ণাঙ্গ উত্তর পাওয়া গেছে। ঢাকা চেম্বার, এমসিসিআই ও আইসিএমএবি থেকে আংশিক মতামত এসেছে। এর বাইরে কেউ মতামত ও পরামর্শ জানায়নি।
এই বাস্তবতায় ফরিদ উদ্দিন মনে করেন, এ বিষয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য না হলে এসব সংস্কার বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা যাবে না। ব্যবসায়ীদের কাছে তাঁর অনুরোধ, তাঁরা যেন বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে কথা বলেন বা আলোচনা করেন।
অনুষ্ঠানে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, ব্যবসায়ী মহল ও অংশীজনদের সুপারিশ আমলে নিতে হবে। শুধু প্রতিবেদন দেওয়া হলো, অধ্যাদেশও হলো, কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকলে তা বাস্তবায়ন হবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় থেকে যায়।
আয়কর আইন প্রত্যক্ষ কর মূল্যহীন
আবদুল মজিদ বলেন, বিগত সরকারের সময়ে সংসদে যে আয়কর আইন পাস হয়েছিল, সেটি প্রকারান্তরে পরোক্ষ কর নীতিতে পরিণত হয়েছে। সেটিকে প্রত্যক্ষ কর নীতি বলা হলেও নানা ধরনের বিধিবিধান থাকায় সেখানে প্রত্যক্ষ করের বিষয়টি মূল্যহীন হয়ে গেছে।
আবদুল মজিদ আরও বলেন, কর ব্যবস্থাপনা থেকে কর নীতি আলাদা করার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, নীতি প্রণয়নে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করা। কমিটির সুপারিশ ছিল এ রকম—নীতি প্রণয়ন কমিটিতে বাধ্যতামূলকভাবে বেসরকারি খাতের কিছু ব্যক্তিকে রাখতে হবে। এ ছাড়া যে নীতি নেওয়া হবে, তা অন্তত পাঁচ বছর অব্যাহত রাখতে হবে।
এনবিআরের বিভক্তি একমাত্র সমাধান নয়
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি ভাগে বিভক্ত করলেই যে সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে তা নয় বলে মনে করেন তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ইনামুল হক খান। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো মনে করে, রাজস্ব বোর্ড ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট–সংক্রান্ত রাজস্ব নীতিসমূহ দীর্ঘমেয়াদি, কমপক্ষে পাঁচ বছর মেয়াদি করা প্রয়োজন। এ ছাড়া আইন, এসআরও, বিধিবিধান, প্রজ্ঞাপন জারি ও সংশোধনের ক্ষেত্রে অংশীজনদের মতামত নিতে হবে।
করনীতি মানবাধিকারবিরোধী
রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য যে করনীতি রয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে বেআইনি ও মানবাধিকারবিরোধী বলে মত দেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিসহ নানা ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের প্রত্যয়নপত্র লাগে। এতে সময়ক্ষেপণ হয়, বাড়তি অর্থ দিতে হয়।
সভায় মেট্রো চেম্বারের সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, দেশের মাত্র ৩ শতাংশেরও কম মানুষ আয়কর দেন। ব্যবসায়িক পর্যায়ে বড় ধরনের কর ফাঁকি আছে। কর আইন কার্যকর করার প্রক্রিয়া খুবই দুর্বল; প্রায়ই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কর সংগ্রহের ব্যবস্থা অতিরিক্ত জটিল ও স্বেচ্ছাচারমূলক।
কাস্টমসের অটোমেশনের অবস্থা ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল’—অনেকটা এ রকম বলে মত দেন এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির।
সরকারের হাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট টাকা নেই। এই অর্থের ঘাটতির কারণে অবকাঠামো, মানব সম্পদ, স্বাস্থ্য ও আইনশৃঙ্খলা খাতের বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয় বলে মত দেন পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত খাতে ব্যবসায়ীরা সেবা পেতে সমস্যায় পড়েন। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব তো আছেই।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, কেবল কাঠামোগত পরিবর্তন নয়, বরং রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা ও জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া প্রকৃত সংস্কার সম্ভব নয়। এতে ব্যর্থ হলে কর রাজস্ব ঘাটতি, বিনিয়োগ সংকট ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা আরও ব্যাহত হতে পারে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এনব আর র স ব ক কম ট র স প র শ র জন ত ক ম হ ম মদ ব যবস য় ব সরক র ক ষ কর কর ন ত র জন য মত মত এমস স সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
একজন সরকারি চাকরিজীবী কীভাবে আয়করের হিসাব করবেন
সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের প্রতিবছর আয় ও ব্যয়ের খবর জানিয়ে আয়কর রিটার্ন দিতে হয়। দশম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক। কারণ, রিটার্ন না দিলে বেতন–ভাতা পাওয়ায় জটিলতা তৈরি হয়।
এমন সরকারি কর্মকর্তারা কীভাবে আয় ও কর হিসাব করবেন, এর একটি উদাহরণ দেওয়া হলো। প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত আয়ের হিসাব দিতে হয়। চলতি মাসের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন দেওয়ার সময়সীমা নির্ধারিত আছে।
জাহিদ কবির একজন সরকারি কর্মচারী। ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আগের এক বছরের আয়–ব্যয়ের হিসাব করতে হবে।
জাহিদ কবিরের আয় হলো মাসিক মূল বেতন ২৬ হাজার টাকা; ২৬ হাজার টাকা করে দুটি উৎসব বোনাস ৫২ হাজার টাকা, চিকিৎসার ভাতা ১ হাজার ৫০০ টাকা, শিক্ষাসহায়ক ভাতা ৫০০ টাকা ও বাংলা নববর্ষ ভাতা ৪ হাজার ৪০০ টাকা। এ ছাড়া তিনি রাজধানীর বেইলি রোডের সরকারি বাসায় থাকেন।
এ ছাড়া ভবিষ্য তহবিলে জাহিদ কবির প্রতি মাসে ৩ হাজার ২০০ টাকা জমা রাখেন। হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে পাওয়া প্রত্যয়নপত্রে দেখা যায় যে ৩০ জুন ২০২৫ তারিখে ভবিষ্য তহবিলে অর্জিত সুদের পরিমাণ ছিল ২৯ হাজার ৫০০ টাকা। কল্যাণ তহবিল ও গোষ্ঠী বিমা তহবিলে চাঁদা প্রদান বাবদ প্রতি মাসে বেতন থেকে কর্তন ছিল যথাক্রমে ১৫০ ও ১০০ টাকা।
করযোগ্য আয় কত২০২৫–২৬ করবর্ষে জাহিদ কবিরের মোট আয় হলো বেতন খাতে মূল বেতন ৩ লাখ ১২ হাজার টাকা (২৬ হাজার টাকার ১২ মাসের মূল বেতন) ও উৎসব বোনাস ৫২ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা।
জাহিদ কবির চিকিৎসার ভাতা, শিক্ষাসহায়ক ভাতা ও বাংলা নববর্ষ ভাতা পেয়েছেন তা তাঁর জন্য প্রযোজ্য চাকরি (ব্যাংক, বিমা ও ফাইন্যান্স কোম্পানি) (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০১৫–এর অন্তর্ভুক্ত। ফলে এসব ভাতার জন্য তাঁকে আয়কর প্রদান করতে হবে না।
কত কর হবে
কর দায় গণনার হিসাব অনুসারে, প্রথম ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত করহার শূন্য অর্থাৎ কোনো কর দিতে হবে না। তাই জাহিদ কবিরের ১৪ হাজার টাকার ওপর কর বসবে। এই ১
বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত কত
জাহিদ কবির ভবিষ্য তহবিলে প্রতি মাসে ৩ হাজার ২০০ টাকা করে চাঁদা দিয়েছেন। সারা বছরে দিয়েছেন ৩৮ হাজার ৪০০ টাকা। কল্যাণ তহবিলে প্রতি মাসে ১৫০ টাকা করে পুরো বছরে দিয়েছেন ১ হাজার ৮০০ টাকা। গোষ্ঠী বিমা তহবিলে প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে পুরো বছরে দিয়েছেন ১ হাজার ২০০ টাকা। সব মিলিয়ে জাহিদ কবির বিনিয়োগ করেছেন ৪১ হাজার ৪০০ টাকা।
বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত নেওয়ার নিয়ম হলো মোট আয়ের দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ; মোট অনুমোদনযোগ্য বিনিয়োগের ১৫ শতাংশ কিংবা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা—এই তিনটির মধ্যে যেটি কম হবে, তাই রেয়াতের পরিমাণ।
জাহিদ কবিরের মোট আয়ের (৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা) দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ হলো ১০ হাজার ৯২০ টাকা; মোট অনুমোদনযোগ্য হলো (৪১ হাজার ৪০০ টাকার ১৫ শতাংশ) ৬ হাজার ২১০ টাকা। বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত নেওয়ার সর্বোচ্চ সীমা ১০ লাখ টাকা। এই তিনটির মধ্যে সবচেয়ে কম হলো ৬ হাজার ২১০ টাকা। এটিই হলো জাহিদ কবিরের প্রাপ্য কর রেয়াতের পরিমাণ।
কর রেয়াত পাবেন কিযেহেতু জাহিদ কবিরের মোট আয়ের ওপর প্রযোজ্য কর ৭০০ টাকা এবং আইনানুগ রেয়াতের পরিমাণ ৬ হাজার ২১০ টাকা। এই ক্ষেত্রে করদাতা কোনো প্রকার কর রেয়াত প্রাপ্য হবেন না। কর রেয়াতের পরিমাণ কখনোই কর দায়ের বেশি হবে না। সেই ক্ষেত্রে জাহিদ কবিরের করের পরিমাণ ৭০০ টাকা।
কিন্তু আয়কর আইন অনুসারে, জাহিদ কবিরকে দিতে হবে পাঁচ হাজার টাকা। কারণ, করদাতার অবস্থান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় হলে ন্যূনতম পাঁচ হাজার টাকা, অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকায় হলে ন্যূনতম চার হাজার টাকা ও সিটি করপোরেশন ব্যতীত অন্যান্য এলাকায় হলে তিন হাজার টাকা দিতে হবে।৪ হাজার টাকার ওপর কর বসবে। হিসাবটি এমন, করের হিসাবের প্রথম স্তরে ১ লাখ টাকার হিসাবে ৫ শতাংশ হারে ৭০০ টাকা কর প্রযোজ্য হবে।