উহুদের অখ্যাত বীর আবু রুহুম গিফারি
Published: 5th, October 2025 GMT
তায়েফ থেকে ফিরছিলেন নবীজি (সা.)। সঙ্গে ছিলেন সাহাবিরা। পথিমধ্যে নবীজির উটকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় এক সাহাবির উট। সেই উটে আরোহী সাহাবির জুতার কিনারা নবীজির উরুতে এসে আঘাত করে আটকে যায়। নবীজি কষ্ট পাচ্ছিলেন। সহ্য করতে না পেরে তাঁর পায়ে বেত্রাঘাত করে বলেন, ‘তোমার পা সরাও, আমার উরুতে ব্যথা লাগছে!’
নবীজির অসন্তুষ্টি সাহাবির বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। তিনি বেত্রাঘাতের কষ্ট ভুলে যান। পরকালের চিন্তা মাথায় চলে আসে। সকালে বাহিনী যখন ‘জিয়ির্রানা’ নামক প্রান্তরে যাত্রাবিরতি করে, তখন উট চড়াতে বেরিয়ে পড়েন তিনি। ভয় ঢেউ ভাঙছিল মনে।
যাত্রাবিরতি করে, তখন উট চড়াতে বেরিয়ে পড়েন তিনি। ভয় ঢেউ ভাঙছিল মনে। ফিরে এসে সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করেন, ‘আল্লাহর রাসুল আমাকে খোঁজ করেননি তো?ফিরে এসে সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করেন, ‘আল্লাহর রাসুল আমাকে খোঁজ করেননি তো?’
জবাবে সঙ্গীরা বলেন, ‘হ্যাঁ, খোঁজ তো করেছিলেন।’
এ কথা শুনে আরও ঘাবড়ে যান তিনি। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাজির হন নবীজির খেদমতে। নবিজি (সা.
খুশিতে চিৎকার করে ওঠেন সেই সাহাবি। যেখানে তিনি শাস্তির ভয়ে দুরুদুরু কাঁপছিলেন, সেখানে কি না পুরস্কার! আনন্দে এতটাই উচ্ছল হয়ে ওঠেন, পা মাটিতে স্থির থাকছিল না। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আজ আমার থেকে আর কে বেশি খুশি হতে পারে, আমার মনিব আমাকে শুধু আজ ক্ষমাই করেননি; দয়াও দেখিয়েছেন।’
নবীজির সেই সাহাবি ছিলেন আবু রুহুম গিফারি (রা.)। তাঁর নাম ছিল কুলসুম। উপাধি মানহুর। নবীজি (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু ঠিক কখন ইমান এনেছিলেন, ইতিহাসের বইয়ে এর সঠিক বিবরণ পাওয়া যায় না।
উহুদে বেশ বীরত্ব দেখিয়েছেন। অন্যরকম এক উদ্দীপনা নিয়ে লড়েছিলেন সেই যুদ্ধে। যুদ্ধের তুমুল মুহূর্তে একটি তির এসে বিঁধে তাঁর বুকে। মারাত্মক আহত হন আবু রুহুম গিফারি।বদর যুদ্ধেও তাঁর উপস্থিতি মিলে না কোথাও। কিন্তু উহুদে বেশ বীরত্ব দেখিয়েছেন। অন্যরকম এক উদ্দীপনা নিয়ে লড়েছিলেন সেই যুদ্ধে। যুদ্ধের তুমুল মুহূর্তে একটি তির এসে বিঁধে তাঁর বুকে। মারাত্মক আহত হন আবু রুহুম গিফারি।
যুদ্ধের পর তাঁকে নবীজির কাছে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি তাঁর ক্ষতস্থানে লালা লাগিয়ে দেন। নবীজির পবিত্র লালার বরকতে খুব দ্রুত ভালো হয়ে যায় তাঁর ক্ষত। ফলে তিনি ‘মানহুর’ উপাধিতে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। আরবিতে সিনা বা বক্ষকে বলে ‘নহর’। তাঁর বুকে নবীজির লালা লেগেছিল বলে তাকে বলা হয় ‘মানহুর’।
ষষ্ট হিজরি সনে হওয়া হুদাইবিয়ার সন্ধিতে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। নবীজি (সা.)-এর হাতে সেদিন যারা বায়াত গ্রহণ করেছিলেন; তিনি তাঁদের একজন। আল্লাহ তায়ালা সেদিন যাঁদের জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন, সেখানেও ছিল তাঁর নাম।
হুদাইবিয়া প্রান্তরে হওয়া বায়াতে রিদওয়ানের (উসমান বিন আফফানকে হত্যার প্রতিশোধগ্রহণের প্রেক্ষিতে নেওয়া নবীজির হাতে ১৪০০ সাহাবির বায়াত) পর তিনি খাইবার যুদ্ধে অংশ নেন। নবীজি (সা.) তাঁকে যুদ্ধ-লব্ধ সম্পদ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির ভাগ প্রদান করেন।
আরও পড়ুনসাহাবি ইবনে বিশরের অলৌকিক লাঠি১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ইতিহাসের গ্রন্থাদিতে তাঁকে দ্বিতীয় শ্রেণির ভাগ থেকে সম্পদ প্রদানের কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে আমরা ধরে নিতে পারি, হয়তো তিনি যুদ্ধে বিশেষ কোনো ভূমিকা রেখেছিলেন। তায়েফে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ছিল। সেখান থেকে ফেরার সময়ই নবীজি ও তাঁর সাথে ওপরের ঘটনাটি ঘটে।
পুরোদমে চলছে তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি। নবীজি (সা.) আবু রুহুম গিফারিকে তাঁর গোত্রের লোকদের কাছে পাঠান। উদ্দেশ্য ভিন্ন কিছু নয়, আসন্ন যুদ্ধে যোগদানের ব্যাপারে তাদের আগ্রহী করে তোলা। তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
সে বছর গরম পড়েছিল খুব। বড়ই শুষ্ক বছর ছিল বছরটি। এদিকে তাবুকের পথও বেশ লম্বা। লোকেরা ঘাবড়ে যাচ্ছিল আগেই। কিন্তু আবু রুহুম গিফারি তাঁর গোত্রের লোকদের এমনভাবে তৈরি করেছিলেন, সেই দুঃসময়ে সাড়া দিয়েছিল সবাই। নিজেদের মাতৃভূমি ছেড়ে যুদ্ধে শরিক হওয়ার ইচ্ছায় ব্যাপকভাবে তাঁদের এই আগমন বাকিদের মনে বেশ প্রভাব বিস্তার করে।
‘জিয়িররানা’ নামক স্থানে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটি মনে পড়ে যায় তাঁর। এজন্য যখনই তাঁর উটটি নবীজির উটের কাছাকাছি হয়ে যাচ্ছিলে, তখনই তিনি তার লাগাম টেনে ধরছিলেন।তাবুক থেকে ফেরার পথেও নবীজির উটর কাছাকাছি চলছিল আবু রুহুম (রা.)-এর উট। ‘জিয়িররানা’ নামক স্থানে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটি মনে পড়ে যায় তাঁর। এজন্য যখনই তাঁর উটটি নবীজির উটের কাছাকাছি হয়ে যাচ্ছিলে, তখনই তিনি তার লাগাম টেনে ধরছিলেন।
ইতিহাসে তাঁর মৃত্যুর কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে বেশ উঁচু স্তরের গুণ দান করেছিলেন। সেসব গুণের কল্যাণেই নবীজি (সা.)-এর দয়া ও দানের পাত্র হয়ে উঠেছিলেন তিনি। নবীজির চোখেও ছিলেন বেশ অমূল্য।
সূত্র: রওশন সিতারে, আব্দুল্লাহ ফারানি, পৃষ্ঠা: ৬২-৬৫
জাবির মাহমুদ: লেখক, অনুবাদক
আরও পড়ুনহজরত উমর (রা.) ছিলেন সুশিক্ষিত সাহাবি০২ ডিসেম্বর ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর ছ ল ন আল ল হ গ রহণ
এছাড়াও পড়ুন:
উহুদের অখ্যাত বীর আবু রুহুম গিফারি
তায়েফ থেকে ফিরছিলেন নবীজি (সা.)। সঙ্গে ছিলেন সাহাবিরা। পথিমধ্যে নবীজির উটকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় এক সাহাবির উট। সেই উটে আরোহী সাহাবির জুতার কিনারা নবীজির উরুতে এসে আঘাত করে আটকে যায়। নবীজি কষ্ট পাচ্ছিলেন। সহ্য করতে না পেরে তাঁর পায়ে বেত্রাঘাত করে বলেন, ‘তোমার পা সরাও, আমার উরুতে ব্যথা লাগছে!’
নবীজির অসন্তুষ্টি সাহাবির বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। তিনি বেত্রাঘাতের কষ্ট ভুলে যান। পরকালের চিন্তা মাথায় চলে আসে। সকালে বাহিনী যখন ‘জিয়ির্রানা’ নামক প্রান্তরে যাত্রাবিরতি করে, তখন উট চড়াতে বেরিয়ে পড়েন তিনি। ভয় ঢেউ ভাঙছিল মনে।
যাত্রাবিরতি করে, তখন উট চড়াতে বেরিয়ে পড়েন তিনি। ভয় ঢেউ ভাঙছিল মনে। ফিরে এসে সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করেন, ‘আল্লাহর রাসুল আমাকে খোঁজ করেননি তো?ফিরে এসে সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করেন, ‘আল্লাহর রাসুল আমাকে খোঁজ করেননি তো?’
জবাবে সঙ্গীরা বলেন, ‘হ্যাঁ, খোঁজ তো করেছিলেন।’
এ কথা শুনে আরও ঘাবড়ে যান তিনি। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাজির হন নবীজির খেদমতে। নবিজি (সা.) তাঁকে দেখে বলেন, ‘তোমার জুতো লেগে উরু ছড়ে গিয়েছিলে আমার। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে তোমাকে বেত্রাঘাত করেছিলাম। সেজন্য তোমার কষ্ট হয়ে থাকবে। সেটার ক্ষতিপূরণ হিসেবে তোমাকে এই বকরির পাল দিচ্ছি।’
আরও পড়ুনবীর সাহাবি জারদ ইবনে উমর (রা.)৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫খুশিতে চিৎকার করে ওঠেন সেই সাহাবি। যেখানে তিনি শাস্তির ভয়ে দুরুদুরু কাঁপছিলেন, সেখানে কি না পুরস্কার! আনন্দে এতটাই উচ্ছল হয়ে ওঠেন, পা মাটিতে স্থির থাকছিল না। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আজ আমার থেকে আর কে বেশি খুশি হতে পারে, আমার মনিব আমাকে শুধু আজ ক্ষমাই করেননি; দয়াও দেখিয়েছেন।’
নবীজির সেই সাহাবি ছিলেন আবু রুহুম গিফারি (রা.)। তাঁর নাম ছিল কুলসুম। উপাধি মানহুর। নবীজি (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু ঠিক কখন ইমান এনেছিলেন, ইতিহাসের বইয়ে এর সঠিক বিবরণ পাওয়া যায় না।
উহুদে বেশ বীরত্ব দেখিয়েছেন। অন্যরকম এক উদ্দীপনা নিয়ে লড়েছিলেন সেই যুদ্ধে। যুদ্ধের তুমুল মুহূর্তে একটি তির এসে বিঁধে তাঁর বুকে। মারাত্মক আহত হন আবু রুহুম গিফারি।বদর যুদ্ধেও তাঁর উপস্থিতি মিলে না কোথাও। কিন্তু উহুদে বেশ বীরত্ব দেখিয়েছেন। অন্যরকম এক উদ্দীপনা নিয়ে লড়েছিলেন সেই যুদ্ধে। যুদ্ধের তুমুল মুহূর্তে একটি তির এসে বিঁধে তাঁর বুকে। মারাত্মক আহত হন আবু রুহুম গিফারি।
যুদ্ধের পর তাঁকে নবীজির কাছে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি তাঁর ক্ষতস্থানে লালা লাগিয়ে দেন। নবীজির পবিত্র লালার বরকতে খুব দ্রুত ভালো হয়ে যায় তাঁর ক্ষত। ফলে তিনি ‘মানহুর’ উপাধিতে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। আরবিতে সিনা বা বক্ষকে বলে ‘নহর’। তাঁর বুকে নবীজির লালা লেগেছিল বলে তাকে বলা হয় ‘মানহুর’।
ষষ্ট হিজরি সনে হওয়া হুদাইবিয়ার সন্ধিতে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। নবীজি (সা.)-এর হাতে সেদিন যারা বায়াত গ্রহণ করেছিলেন; তিনি তাঁদের একজন। আল্লাহ তায়ালা সেদিন যাঁদের জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন, সেখানেও ছিল তাঁর নাম।
হুদাইবিয়া প্রান্তরে হওয়া বায়াতে রিদওয়ানের (উসমান বিন আফফানকে হত্যার প্রতিশোধগ্রহণের প্রেক্ষিতে নেওয়া নবীজির হাতে ১৪০০ সাহাবির বায়াত) পর তিনি খাইবার যুদ্ধে অংশ নেন। নবীজি (সা.) তাঁকে যুদ্ধ-লব্ধ সম্পদ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির ভাগ প্রদান করেন।
আরও পড়ুনসাহাবি ইবনে বিশরের অলৌকিক লাঠি১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ইতিহাসের গ্রন্থাদিতে তাঁকে দ্বিতীয় শ্রেণির ভাগ থেকে সম্পদ প্রদানের কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে আমরা ধরে নিতে পারি, হয়তো তিনি যুদ্ধে বিশেষ কোনো ভূমিকা রেখেছিলেন। তায়েফে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ছিল। সেখান থেকে ফেরার সময়ই নবীজি ও তাঁর সাথে ওপরের ঘটনাটি ঘটে।
পুরোদমে চলছে তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি। নবীজি (সা.) আবু রুহুম গিফারিকে তাঁর গোত্রের লোকদের কাছে পাঠান। উদ্দেশ্য ভিন্ন কিছু নয়, আসন্ন যুদ্ধে যোগদানের ব্যাপারে তাদের আগ্রহী করে তোলা। তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
সে বছর গরম পড়েছিল খুব। বড়ই শুষ্ক বছর ছিল বছরটি। এদিকে তাবুকের পথও বেশ লম্বা। লোকেরা ঘাবড়ে যাচ্ছিল আগেই। কিন্তু আবু রুহুম গিফারি তাঁর গোত্রের লোকদের এমনভাবে তৈরি করেছিলেন, সেই দুঃসময়ে সাড়া দিয়েছিল সবাই। নিজেদের মাতৃভূমি ছেড়ে যুদ্ধে শরিক হওয়ার ইচ্ছায় ব্যাপকভাবে তাঁদের এই আগমন বাকিদের মনে বেশ প্রভাব বিস্তার করে।
‘জিয়িররানা’ নামক স্থানে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটি মনে পড়ে যায় তাঁর। এজন্য যখনই তাঁর উটটি নবীজির উটের কাছাকাছি হয়ে যাচ্ছিলে, তখনই তিনি তার লাগাম টেনে ধরছিলেন।তাবুক থেকে ফেরার পথেও নবীজির উটর কাছাকাছি চলছিল আবু রুহুম (রা.)-এর উট। ‘জিয়িররানা’ নামক স্থানে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটি মনে পড়ে যায় তাঁর। এজন্য যখনই তাঁর উটটি নবীজির উটের কাছাকাছি হয়ে যাচ্ছিলে, তখনই তিনি তার লাগাম টেনে ধরছিলেন।
ইতিহাসে তাঁর মৃত্যুর কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে বেশ উঁচু স্তরের গুণ দান করেছিলেন। সেসব গুণের কল্যাণেই নবীজি (সা.)-এর দয়া ও দানের পাত্র হয়ে উঠেছিলেন তিনি। নবীজির চোখেও ছিলেন বেশ অমূল্য।
সূত্র: রওশন সিতারে, আব্দুল্লাহ ফারানি, পৃষ্ঠা: ৬২-৬৫
জাবির মাহমুদ: লেখক, অনুবাদক
আরও পড়ুনহজরত উমর (রা.) ছিলেন সুশিক্ষিত সাহাবি০২ ডিসেম্বর ২০২৪