বর্তমান বিশ্বে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট’ শব্দটি এমনভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যেন এটি জীবনের সব সমস্যার একমাত্র সমাধান। বিজ্ঞাপন, স্বাস্থ্যপণ্য, এমনকি অনেকে চিকিৎসা পরামর্শেও একে ক্যানসার প্রতিরোধের মূল হাতিয়ার হিসেবে উপস্থাপন করেন।

কিন্তু বিজ্ঞানের কঠোর পরীক্ষায় এ ধারণা টিকে নেই। বাস্তবে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট একটি সাধারণ রাসায়নিক ধারণা। এটি এমন উপাদানকে বোঝায়, যা শরীরের ফ্রি র‍্যাডিকাল বা অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে পারে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া ক্যানসার প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করার সমার্থক নয়।

আরো পড়ুন:

কত বছর বয়সের পরে মেরুদণ্ডের হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে?

গোপালগঞ্জে ৬ দফা দাবিতে স্বাস্থ্য সহকারীদের কর্মবিরতি

মানবদেহের প্রতিটি কোষে শ্বাস-প্রশ্বাস, শক্তি উৎপাদন ও অন্যান্য বিপাকীয় কার্যক্রমের ফলেই কিছু ফ্রি র‍্যাডিকাল তৈরি হয়, যা অতিরিক্ত হলে কোষের ক্ষতি করতে পারে। এই ক্ষতি প্রতিরোধের জন্য দেহে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে। যেমন- গ্লুটাথায়ন, ক্যাটালেজ ও সুপারঅক্সাইড ডিজমিউটেজ এনজাইম।

উদ্ভিদজাত খাদ্যদ্রব্যের বিভিন্ন যৌগ এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে পারে, যাদের আমরা একত্রে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বলি। তবে কোনো খাদ্য বা নির্যাসে এই যৌগের উপস্থিতি মানেই তা ক্যানসার প্রতিরোধে কার্যকর হবে- এমন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।

যদি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যানসার প্রতিরোধে সত্যিই কার্যকর হত, তাহলে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভিটামিন-ই ক্যানসারের মহাঔষধ হয়ে উঠত। বাস্তবে দেখা গেছে, উচ্চমাত্রার ভিটামিন-ই সাপ্লিমেন্ট গ্রহণে বরং কিছু ক্ষেত্রে ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত সিলেক্ট ট্রায়ালে দেখা গেছে, ভিটামিন-ই সাপ্লিমেন্ট গ্রহণকারীদের মধ্যে প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি, নিয়ন্ত্রণ গোষ্ঠীর তুলনায় বেশি ছিল। একইভাবে, একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গ্রহণ কোষের প্রাকৃতিক সংকেত প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে টিউমার কোষের বেঁচে থাকার সুযোগও বাড়াতে পারে।

ননী ফল এই আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ননী ফল নিয়ে নানা ধরনের প্রচারণা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এটি শরীরের সব রোগের বিরুদ্ধে এক জাদুকরী ওষুধ। ফলটি স্কোপলেটিন, ফ্লাভোনয়েড, অ্যান্থ্রাকুইনোন গ্লাইকোসাইড, ট্রাইটারপিনয়েড, ফেনল ও বিভিন্ন ভিটামিন-খনিজে সমৃদ্ধ। এসব যৌগের কিছু ল্যাবরেটরি পর্যায়ে প্রদাহনাশক ও অ্যান্টিক্যানসার কার্যকলাপ প্রদর্শন করেছে।

স্কোপলেটিন নামক উপাদান কিছু ইন-ভিট্রো গবেষণায় ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি রোধে ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। তবে মানুষের শরীরে এর কার্যকারিতা প্রমাণিত নয়। বাস্তবে এই যৌগগুলোর বায়ো-অ্যাভেইলেবিলিটি ও বিপাকীয় স্থায়িত্ব খুব সীমিত। ফলে শরীরে পর্যাপ্ত মাত্রায় পৌঁছে কার্যকর প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম।

ফার্মাকোলজির দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, এন্টিঅক্সিডেন্ট কোনো ঔষধ নয়। এটি একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার সহায়ক মাত্র। ক্যানসার একটি জটিল রোগ, যার পেছনে শুধু অক্সিডেটিভ স্ট্রেস নয়, বরং জেনেটিক পরিবর্তন, সিগন্যালিং পাথওয়ের ত্রুটি, ইমিউন সিস্টেমের ব্যর্থতা এবং পরিবেশগত প্রভাবসহ বহু কারণ কাজ করে। তাই কোনো একক যৌগ বা ফল দ্বারা এর প্রতিকার সম্ভব নয়।

ননী ফলের মতো উদ্ভিজ্জ উপাদানগুলো আমাদের খাদ্য তালিকায় থাকতে পারে। কারণ এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। তবে এই উপাদানগুলোকে ‘ক্যানসার প্রতিরোধক’ হিসেবে প্রচার করা বিজ্ঞানসম্মত নয়। বরং অতিরিক্ত সেবন লিভারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি ঘটাতে পারে। এই কারণে চিকিৎসা বা গবেষণার উদ্দেশ্যে ননী বা অনুরূপ ফলের ব্যবহার অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত ও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বাবধানে হওয়া প্রয়োজন।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট নিয়ে কথা বলেছেন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড.

মো. শফিকুল ইসলাম। 

তিনি বলেন, “প্রতিটি উদ্ভিদ উপাদানের মধ্যেই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যানসারের ওপর কোন কাজ করে না। এটি স্বাস্থ্যবান ব্যক্তির জন্য মহা উপকারী। আমি আমার গবেষনায় বহু ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ট্রায়াল করেছি। যারা বলেন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যানসারের উপর  কাজ করে, তারা সেটা হওয়ায় না, হাওয়ায় বলে। যদি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যানসারের উপর কাজ করতো, তাহলে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হলো ভিটামিন-ই, সেটাই হত ক্যানসারের মহাঔষধ।”

তিনি আরো বলেন, “অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, এমন কি কারো কথাও যদি অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়, সেটা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। উদাহরনস্বরূপ, কেউ যদি বলে আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি, আমি তোমাকে ভালবাসি, ভালো বাসতে বাসতে ফঁতুর করে দেব, সেটিও ওই ব্যক্তির জন্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট একটি টার্ম, উপাদান নির্দিষ্ট নয়।”

বিজ্ঞান আমাদের শিখিয়েছে, কোনো পদার্থকে ‘প্রাকৃতিক’ বললেই তা নিরাপদ হয় না। প্রকৃতির প্রতিটি রাসায়নিকেরই একটি কার্যকারিতা এবং সীমা আছে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যৌগগুলো নিঃসন্দেহে দেহে ভারসাম্য রক্ষা করে। তবে তাদের ভূমিকা চিকিৎসার বিকল্প নয়। একমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণা, নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা এবং সতর্ক বিশ্লেষণই আমাদের এসব প্রাকৃতিক উপাদানের প্রকৃত মূল্য ও সীমাবদ্ধতা বোঝার পথে এগিয়ে নিতে পারে।

ঢাকা/মেহেদী

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প রক র য় ক জ কর উপ দ ন

এছাড়াও পড়ুন:

ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে তিস্তায় পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

টানা ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলায় নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। হাতীবান্ধার ছয়টি ইউনিয়নসহ পাটগ্রামের দহগ্রাম ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পক্ষ থেকে রেড অ্যালার্ট জারির পর মাইকিং করে তিস্তাপারের বাসিন্দাদের সরে যেতে বলা হয়েছে।

পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আজ রোববার ও আগামীকাল সোমবার ভারী বৃষ্টিপাতের প্রভাবে তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এতে লালমনিরহাটসহ নীলফামারী ও রংপুর জেলার নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা আছে। ইতিমধ্যে হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলায় তিস্তা নদীর পানি বাড়ায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে দুই উপজেলার প্রায় আড়াই হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে পুকুর, আমনের খেতসহ আগাম শীতকালীন সবজির খেত।

পাউবো সূত্র জানায়, আজ সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ২৫ মিটার। অর্থাৎ স্বাভাবিক বিপৎসীমা ৫২ দশমিক ১৫ মিটার থেকে ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আজ দুপুর ১২টায় পানি বিপৎসীমার ৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বেলা তিনটায় বিপৎসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়।

তিস্তায় পানি বাড়ায় হাতীবান্ধা উপজেলার ছয় ইউনিয়নের অন্তত ১০টি চর ও নিম্নাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম ইউনিয়নের তিস্তা চরাঞ্চলসহ মুন্সিপাড়া, ক্লিনিকপাড়া, কাদেরের চর, মহিমপাড়া, চরপাড়া, কাতিপাড়া, সৈয়দপাড়া এলাকায় পাঁচ শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সন্ধ্যা পৌনে সাতটায় পাউবোর কর্মীরা তিস্তাপারের বাসিন্দাদের মাইকিং করে সরে যেতে বলেন।

হাতীবান্ধার সিন্দুর্না ইউনিয়নের চরসিন্দুর্না এলাকার এনামুল হক বলেন, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে তাঁদের এলাকায় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। বাড়িঘরে পানি উঠেছে। পরিবার নিয়ে তাঁরা কষ্টে আছেন।

পাটগ্রামের দহগ্রাম ইউনিয়নের কাতিপাড়া গ্রামের আমির হোসেন বলেন, বন্যায় ঘরে পানি ওঠায় রান্না করা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। পানি সড়কের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একটি সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শামীম মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদীর পানি অব্যাহতভাবে বাড়ছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে বন্যার পানি ঢুকেছে। প্রায় দুই হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বন্যার ক্ষয়ক্ষতি রোধে কাজ করছে।’

পাউবোর লালমনিরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার প্রথম আলোকে বলেন, ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে তিস্তার পানি বেড়েছে। বর্তমানে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ