মৌলভীবাজারে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় নিশ্চিত করল ডিনেট
Published: 7th, October 2025 GMT
মৌলভীবাজারের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সুশাসন ও সরকারি সেবার মান নিশ্চিতে মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর ২০২৫) একটি পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডিনেটের (Dnet) উদ্যোগে এবং মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে স্থানীয় হোটেল রেস্ট ইনের কনফারেন্স রুমে আয়োজিত এ সভার লক্ষ্য হলো—প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনা আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন, চাহিদা মূল্যায়ন প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন এবং সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য মূল সরকারি বিভাগ ও স্থানীয় অংশীদারদের সহযোগিতামূলক সমর্থন নিশ্চিত করা।
সভায় বিশেষ অতিথি এবং প্যানেল আলোচনা অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মো.
২৭ মাসব্যাপী ‘নাগরিক সমন্বয়’ প্রকল্পটি সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন (এসডিসি) এবং গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার (জিএসি) আর্থিক সহায়তায় সিভিক এনগেজমেন্ট ফান্ডের (নাগরিকতা) অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। ডিনেট চারটি স্থানীয় সহযোগী সংস্থার সঙ্গে অংশীদারত্বে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। সংস্থাগুলো হলো—কমলগঞ্জে জনকল্যাণ কেন্দ্র (জে কে কে), শ্রীমঙ্গলে প্রগতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (পিএসইউএস), কুলাউড়ায় নিঃস্ব সহায়ক সংস্থা (এনএসএস) এবং বড়লেখায় প্রচেষ্টা।
প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো—মৌলভীবাজারের চার উপজেলা—বড়লেখা, কুলাউড়া, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলের জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারী, যুব ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য ক্লাইমেট জাস্টিস এবং সরকারি সেবার সমতা নিশ্চিত করতে নাগরিক সমাজের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
সভার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল—প্রকল্পের চাহিদা মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ফলাফল উপস্থাপন করা। এই গবেষণামূলক তথ্য স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি সেবার ঘাটতি এবং নাগরিক অংশগ্রহণের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্ণিত করেছে, যা সবার মধ্যে একটি অভিন্ন বোঝাপড়া তৈরি করবে এবং প্রকল্পের অ্যাডভোকেসি কৌশল নির্ধারণে মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
সভায় উপস্থাপিত মূল গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, মৌলভীবাজার জেলায় অর্থনৈতিক বৈষম্য বেশ প্রকট। চা শ্রমিকদের ৫১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ৩৬ শতাংশ এখনো মারাত্মকভাবে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার। সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা পেতেও নাগরিকদের জটিলতা পোহাতে হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৫৩ শতাংশ নারী জানিয়েছেন যে, ভাতা পেতে তাদের ঘুষ (১০০ থেকে ৩০০ টাকা) দিতে হয়েছে। জলবায়ুগত ঝুঁকির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলের মতো উপজেলাগুলোতে ৬৪ শতাংশ নারী বন্যা ও ভূমিধসের মতো জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে তাদের আয়ের প্রধান উৎস হারিয়েছেন।
ডিনেটের নির্বাহী পরিচালক মাহমুদ হাসান বলেছেন, “আগামী দুই বছরে আমাদের লক্ষ্য—মৌলভীবাজারে এমন কিছু সাফল্যের গল্প তৈরি করা, যা এই প্রকল্পের পরবর্তী ধাপের যাত্রাকে আরো শক্তিশালী করে তুলবে।”
নাগরিকতা ফান্ডের প্রতিনিধি ও জিএফএ কনসাল্টিং গ্রুপের লিড এক্সপার্ট– সিএসও সক্ষমতা উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক কর্মকর্তা জনাব নুরুল ইসলাম বলেছেন, “নাগরিকতা কর্মসূচির প্রথম পর্যায়ের লক্ষ্য— ২০২৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১৬ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছানো। তাই, আমরা চেষ্টা করছি এই কর্মসূচি ভৌগোলিক ও জনমিতিকভাবে সকল শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে।”
নাগরিক সমন্বয়ের প্রকল্প পরিচালক আসিফ আহমেদ তন্ময় সভা পরিচালনা করেন।
ঢাকা/আজিজ/রফিক
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ন শ চ ত কর প রকল প র উপস থ প লক ষ য পর চ ল সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
আব্দুল গফুরের হাত ধরে মৌলভীবাজারে মধু চাষের নিরব বিপ্লব
স্বল্প পুঁজিতে বেশি লাভ হওয়ায় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে মধু চাষে ঝুঁকেছেন ৩০ গ্রামের অন্তত ৬০০ চাষি। উপজেলার কাঠলকান্দি গ্রামের আজাদ মিয়ার কৌশল থেকে মধু চাষ উপজেলা ছাড়িয়েও এখন ছড়িয়ে পড়েছে জেলার বিভিন্ন এলাকায়। ফলে জেলাটিতে বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষের নিরব বিপ্লব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ বছর আগে আজাদ মিয়া পাহাড় থেকে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে একটি মৌ-রানি (রানি মৌমাছি) ধরে নিয়ে আসেন। এটিকে আটকে রেখে দেন কাঠের বাক্সে। রানীকে ঘিরে হাজারো মৌমাছি জমা হতে থাকে বাক্সে। এখান থেকেই মধু চাষের যাত্রা শুরু হয় আজাদ মিয়ার। এক রানি থেকে আরো রানির জন্ম হতে থাকে। এর সঙ্গে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে মধু চাষ।
মধু বহু রোগের ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। তাই এর অনেক চাহিদা। ক্রেতারা বাড়ি থেকেই খাঁটি মধু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বাজারজাতের আলাদা চিন্তা করতে হয় না চাষিদের। কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ছাড়াও জেলার মানুষজন জানতেন, খাঁটি মধু সংগ্রহ করার জন্য পাহাড়ি বনে ঘুরতে হয়। এখন তা হাতের কাছে।
কমলগঞ্জ উপজেলার কাঠালকান্দি গ্রামের চাষি আব্দুল গফুর বলেন, “এক সময় পাহাড়ি এক বন্ধুর (ভারতের) কাছ থেকে জানতে পারি মৌমাছি কিভাবে বা কাকে কেন্দ্র করে এক জায়গায় জড়ো হয়। মূলত রানি মৌমাছি যেখানে থাকে, সেই স্থানেই মৌমাছির দল জড়ো হয়ে চাক বাধে। সেই চাকে ফুলের রেণু জমা করে মধু তৈরি করে।”
তিনি বলেন, “তার দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ি একদিন রানি মৌমাছি বনে সনাক্ত করে ছিদ্র যুক্ত একটি বাশেঁর চুঙ্গির ভিতর বন্দি করি। কোনো মতে ঢুকিয়ে দিতেই চারপাশ ভরে যায় কর্মী মৌমাছিতে। এভাবেই মধু চাষ শুরু হয়।”
প্রথমে সনাতনী পদ্ধতিতেই তিনি চাষ করতেন। পরে বিসিক থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় বলে জানান আব্দুল গফুর।
বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) আব্দুল গফুরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বসত ঘরের চারপাশে বেশ কয়েকটি কাঠের বাক্স মাটি থেকে একটু উচুঁতে বিশেষভাবে রাখা। বৃষ্টিতে যাতে কাঠের বাক্স নষ্ট না হয় তাই উপরে টিন দিয়ে ঢেকে দেওয়া। তিনি একটি বাক্স খুললে সেখানে দেখা যায়, চাকে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি।
বাক্সের নিচের দিকে ছোট ছিদ্র যুক্ত একটি নেট লাগানো। এই ছিদ্র দিয়ে মৌ-মাছি যাতায়াত করে। কিন্তু ছিদ্র এমন আকারের যাতে রানি মৌ-মাছি বের হতে না পারে। অন্যরা সহজে চলাচল করতে পারে। রানি অন্যদের চাইতে সাইজে একটু বড় তাই এই ছিদ্র দিয়ে বেড় হতে পারে না।
এক সময় আব্দুল গফুর মধু সংগ্রহের জন্য বনে যেতেন, এখন নিজ বাড়িতে বসেই মধু আহরণ করেন। এ থেকে তার ভালোই আয় হয়। তবে বৃষ্টি, খরায় এই মধু চাষে প্রভাব পড়ে। ফুল কম হলে ঘাটতি হয়। বনের গাছ যেমন বেলফই (জলপাই), লুদরাজ (মালা তৈরি হয়),পাহাড়ী লিচু, নাগেশ্বর এগুলো কমে যাওয়ায় মধু চাষে সমস্যা হয়। এখন এই বাক্স পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয় বলে জানান আব্দুল গফুর।
কমলগঞ্জ উপজেলার প্রায় গ্রামেই এভাবে মধু চাষ করা হয়। একই উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের কোনাগাও গ্রামের বদরুজ্জামান (মঙ্গল) মধু চাষে বেশ এগিয়ে আছেন। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় একটি টিন শেডের নিচে বিশেষ ভাবে রাখা ১১টি মৌমাছির বাক্স। বসত ভিটার বারান্দায় আরো দুটি।
বদরুজ্জামান মঙ্গল জানান, মূলত তিনি কৃষিজীবী। ১০ বছর আগে শখ করে একটি কাঠের বাক্স ১৫০ টাকা দিয়ে তৈরি করে শুরু করেন মধু চাষ। এখন তার বাড়িতে ১৩টি ও বাড়ির বাহিরে ৫০টি বাক্স আছে। এখান থেকে তার বছরে আয় প্রায় লাখ টাকা। এক সময় চাষের কিছুই না জানলেও এখন তিনি পাকা মৌ চাষি। তাকে সবাই মধু মঙ্গল নামে চিনে।
তিনি জানান, চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এই তিন মাস ছাড়াও বছরে দুইবার মধু সংগ্রহ করা যায়। এক সময় খালি হাতে মধু আহরণ করতে গিয়ে মৌমাছির কামড়ে আহত হন। এখন অভিজ্ঞতা হয়েছে। গায়ে বিশেষ পোষাক (এপ্রোন) জড়িয়ে মধু আহরণ করেন এবং চাক পরীক্ষা করেন।
তিনি আরো জানান, মৌমাছিরা ঠান্ডা বা রাতে বের হয় কম। গরমের সময় বেশি ওড়াওড়ি করে। তখন পাখার শব্দ শুনা যায়। এক বাক্স থেকে বছরে ৫-১০ কেজি পর্যন্ত মধু পাওয়া যায়। তিনি নিজেই রানি মৌমাছি সংগ্রহ করেন। রানিসহ মৌমাছির একটি বাক্স ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা বিক্রি হয়। এখন এক লিটার মধূ বিক্রি হয় ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। এই মধু বিক্রির জন্য বাজারে যেতে হয় না। ক্রেতারা বাড়ি থেকেই কিনে নিয়ে যান।
মধু মঙ্গল বলেন, “কমলগঞ্জ উপজেলার আরো যেসব গ্রামে মধু চাষ হয় তার মধ্যে আছে জালালিয়া, বালিগাও, ইটখোলা, রাজটিলা, মাধবপুর, ধলাইর পাড়, সলিমবাজার, কাঠালকান্দি, কালারবিল, কানাইদেশী, গুলেরহাওর, আধকানি, মধ্যভাগ, নওয়াগাও, ভানুবিল, হখতিয়ারখলা, বনগাঁও, কাটাবিল, বাগমারা অন্যতম। এসব গ্রামের প্রায় ৫ শতাধিক লোক এই মধু চাষের সঙ্গে যুক্ত আছেন। কেউ নিজেদের চাহিদা পুরণ করছেন, আবার কেউ সংসারের স্বাচ্ছন্দ ফিরিয়েছেন।”
কমলগঞ্জ উপজেলা মধু চাষি উন্নয়ন পরিষদের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আজাদ মিয়া বলেন, “পুরো জেলায় এখন প্রায় ৪ হাজার বাক্স স্থাপন করা হয়েছে। এই বাক্সগুলোর বড় একটি অংশ দেখাশুনা করতাম আমি নিজেই। বাক্স স্থাপন, মধু সংগ্রহ ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করেছি। এখন শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় দুরে যেতে পারি না। তবে খোঁজখবর রাখি। প্রয়োজনে গিয়ে পরামর্শ দেই নতুন চাষিদের। বিনিময়ে সামান্য আয় হয়।” মধু চাষিদের সরকার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
কমলগঞ্জ উপজেলা মধু চাষি উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি আলতাফ মাহমুদ বাবুল বলেন, “মৌ চাষে নতুন চাষি যুক্ত হচ্ছেন। এর জন্য বাড়তি সময় দিতে হয় না। অনেক পরিবার মধু চাষ করে পরিবারের বাড়তি চাহিদা পুরণ করছে। স্বাচ্ছন্দ্য এনেছে পরিবারে। এখন প্রায় ৬০০ পরিবার এই চাষে যুক্ত আছেন। বড় চাষি কয়েকজন। মধু বাজারজাত করার জন্য আলাদা কোনো বাজার লাগে না। ক্রেতারা বাড়ি থেকেই নিয়ে যান। রানি মৌমাছির জন্য এখন বনে যেতে হয় না। বাক্সেই নতুন কলোনি তৈরি হয়। ২-১টি নতুন রানি জন্ম নেয়। রানি সনাক্ত করে সেখান থেকে আলাদা করতে হয়। কমলগঞ্জে মধু চাষের নিরব বিপ্লব ঘটেছে।”
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাখন চন্দ্র সুত্রধর বলেন, “মধু চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদের সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হবে। সহজভাবে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থাও করে দেওয়া হবে।”
ঢাকা/মেহেদী