ডায়েরির পাতা খুললে যেমন মনে আসে পুরোনো দিনের কথা, তেমনি সিডনির এক সন্ধ্যায় সেই স্মৃতির পাতা ছুঁয়ে গেলেন শিল্পী নিজাম উজ্জ্বল। হারমোনিয়াম, তবলা, সেতার, গিটার ও কি-বোর্ডের সুরে মিশে ছিল বাংলা গান আর গজলের গল্প—নস্টালজিয়ায় ভরা সেই আয়োজনের নাম ছিল ‘ডায়েরির পাতা থেকে’।
গত রোববার সন্ধ্যায় সিডনির হার্স্টভিল সিভিক থিয়েটারে সিডনি মিউজিক ক্লাব আয়োজন করে বৈঠকি এই সংগীত সন্ধ্যার। দর্শকে পরিপূর্ণ মিলনায়তনে নিজাম উজ্জ্বল যখন একে একে গাইছিলেন পরিচিত সুরগুলো, তখন মনে হচ্ছিল—এ যেন প্রবাসের নয়, ঢাকার কোনো পুরোনো দিনের সংগীত সন্ধ্যা।

প্রথম পর্বে উজ্জ্বল গেয়েছেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় গান ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ ও ‘শুধু কি আমার ভুল’। সেই গানগুলো যেন ডায়েরির পুরোনো পাতায় লেখা অনুভূতির মতো শ্রোতাদের মনে জাগিয়ে তোলে অতীতের আবেগ। দ্বিতীয় পর্বে তিনি গেয়ে শোনান ‘হোশ ওয়ালো কো খবর কিয়া’, ‘দুনিয়া কিসি কে পেয়ার মে’সহ গজল, যা মিলনায়তনে তৈরি করে এক নীরব মুগ্ধতা। শেষ পর্বে ‘দামাদাম মাস্ত কালান্দার’-এর ছন্দে উঠে দাঁড়ান শ্রোতারা—বৈঠকি গানের আসর পরিণত হয় উৎসবে।
অনুষ্ঠান শেষে নিজাম উজ্জ্বল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার বহুজাতিক সমাজে বাংলা গান পৌঁছে দেওয়া আমার লক্ষ্য। বাংলাদেশের কালজয়ী গীতিকার ও শিল্পীদের গান এখানে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছি।’

প্রবাসী দর্শক আতিকুর রহমান বলেন, ‘সিডনিতে অনেক অনুষ্ঠান হয়, কিন্তু এমন বৈঠকি মেজাজে বাংলা গান শোনার সুযোগ খুব কম। উজ্জ্বলের গায়কি আর যন্ত্রশিল্পীদের বাজনা আমাদের পুরোনো দিনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।’ সাংস্কৃতিক কর্মী আবিদা রুচি বলেন, ‘প্রবাসে থেকেও এভাবে নিজেদের গান শুনতে পারা আনন্দের।’

আসরে যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন সুবীর গুহ, ইয়াসির পারভেজ, শাহরিয়ার জামাল, নীলাদ্রি চক্রবর্তী ও সোহেল খান। উপস্থাপনায় ছিলেন নোরা পারভেজ। সিডনি মিউজিক ক্লাবের সদস্য শিখা গমেজ বলেন, ‘বিদেশে বসে বাংলা গানের শুদ্ধ চর্চা ও নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এটি আমাদের প্রচেষ্টা।’
উপস্থিত দর্শকের মতে, এ সন্ধ্যার প্রতিটি গান যেন একেকটি ডায়েরির পাতা—যেখানে লেখা ছিল সুর, তাল আর স্মৃতির গল্প। সিডনির সেই বৈঠকি সংগীত আসর প্রবাসী শ্রোতাদের মনে রয়ে গেল এক সুরভরা স্মৃতি হয়ে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রব স সন ধ য

এছাড়াও পড়ুন:

ইসলামে পুরুষের জন্য স্বর্ণের অলঙ্কার পরা কেন বৈধ নয় 

ইসলাম মানব সমাজে শালীনতা, পরিমিতি ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ধর্ম। এটি শুধু ইবাদত নয়, বরং জীবনযাত্রার নান্দনিক ও নৈতিক দিকগুলোও নির্ধারণ করে। পুরুষ ও নারীর পোশাক, আচরণ, অলঙ্কার—সব ক্ষেত্রেই ইসলাম একটি স্পষ্ট পার্থক্য রেখেছে।

এর অন্যতম উদাহরণ হলো পুরুষের জন্য স্বর্ণ (Gold) পরিধান নিষিদ্ধকরণ। এই নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুশাসন নয়; বরং এটি সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রজ্ঞায় ভরপুর এক বিধান।

কোরআনের নির্দেশনা ও ব্যাখ্যা

যদিও কোরআনে সরাসরি পুরুষদের স্বর্ণ পরার নিষেধাজ্ঞা নেই, তবে এতে সাজসজ্জার সীমা ও শালীনতার নীতি সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত। আল্লাহ বলেন, “বল, কে হারাম করেছে আল্লাহর সৌন্দর্যোপকরণ, যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র জীবনোপকরণ।”  (সুরা আ‘রাফ, আয়াত: ৩২)

সাজসজ্জা বৈধ, তবে তা এমনভাবে হতে হবে যাতে শরিয়তের নির্ধারিত সীমা অতিক্রম না করে। পুরুষদের জন্য স্বর্ণ ও রেশম সেই সীমা অতিক্রমের অন্তর্ভুক্ত।ইবনে কাসির (রহ.), তাফসির ইবনে কাসির

ইবনে কাসির (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “সাজসজ্জা বা সৌন্দর্যোপকরণ বৈধ, তবে তা এমনভাবে হতে হবে যাতে শরিয়তের নির্ধারিত সীমা অতিক্রম না করে। পুরুষদের জন্য স্বর্ণ ও রেশম সেই সীমা অতিক্রমের অন্তর্ভুক্ত।” (তাফসির ইবনে কাসির, সংশ্লিষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যা)

অতএব, কোরআনের সাধারণ নীতিমালা থেকেই বোঝা যায়—যে সাজসজ্জা নারীদের জন্য বৈধ, পুরুষদের জন্য তা নিষিদ্ধ হতে পারে। হতে পারে তা নারীর অনুকরণের কারণে অথবা বিলাসিতা সৃষ্টি করার কারণে।

আরও পড়ুনইসলামি দিনারের উদ্ভব এবং ইতিহাসের প্রথম মুদ্রাযুদ্ধ১৪ জুন ২০২৫হাদিসে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা

রাসুল (সা.)-এর জীবন থেকে আমরা এই নিষেধাজ্ঞার সবচেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ পাই। আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) বলেন, “নবীজি রেশম ও স্বর্ণ পরিধান থেকে নিষেধ করেছেন এবং বলেছেন — ‘এই দুটি জিনিস আমার উম্মতের নারীদের জন্য বৈধ, কিন্তু পুরুষদের জন্য নিষিদ্ধ।’” (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৪০৫৭; সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩৫৯৫)

ইবনে আব্বাস (রা.) একটি হাদিসে বর্ণনা করেন, “নবীজি এক ব্যক্তির হাতে স্বর্ণের আংটি দেখে তা খুলে ফেলে দেন এবং বলেন, ‘তুমি কি (দোজখের) আগুনের টুকরা হাতে নিতে চাও?’” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২০৯০)

বুরাইদাহ (রা.) বলেন, “নবীজি পুরুষদের জন্য স্বর্ণের আংটি পরা হারাম করেছেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৮৬৩)

চারটি প্রধান মাজহাব—হানাফি, মালিকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি—সবগুলোর আলেমগণ একমত যে, পুরুষদের জন্য স্বর্ণ পরা বৈধ নয়।

এগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে পুরুষদের জন্য স্বর্ণের ব্যবহার শরীয়তসম্মত নয়, বরং এটি জাহান্নামের আগুনের প্রতীক হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।

ফিকহি ব্যাখ্যা ও ঐক্যমত

চারটি প্রধান মাজহাব—হানাফি, মালিকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি—সবগুলোর আলেমগণ একমত যে, পুরুষদের জন্য স্বর্ণ পরা বৈধ নয়।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন: “পুরুষের জন্য স্বর্ণ বা রেশমের কোনো অংশ বৈধ নয়, যদি না যুদ্ধ বা চিকিৎসায় প্রয়োজন পড়ে।”

ইমাম নববী (রহ.) বলেন: “এই নিষেধাজ্ঞা এমন মাত্রায় প্রযোজ্য যে, স্বর্ণের সামান্য অংশও পরিধান করা জায়েয নয়।” (শারহ মুসলিম, খণ্ড ১৪, পৃ. ৩২)

আরও পড়ুনকেনা জমিতে খুঁড়ে পাওয়া গেল সোনা২৩ অক্টোবর ২০২৩নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ বিষয়ে পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা

ইমাম গাজালি (রহ.) তাঁর বলেন, “পুরুষের জন্য স্বর্ণ হারাম করা হয়েছে, যাতে নারী-পুরুষের বাহ্যিক রূপে পার্থক্য বজায় থাকে এবং পুরুষ অহংকার, বিলাসিতা ও আত্মম্ভরিতার পথে না যায়।” (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, খণ্ড ২, পৃ. ৩১২)

ইবনে কাইয়িম জাওযি (রহ.) বলেন, “স্বর্ণের প্রতি আসক্তি আত্মতৃপ্তি ও অহংকারের প্রতীক, যা পুরুষের বিনয় ও আধ্যাত্মিক চরিত্রকে দুর্বল করে।” (ইলামুল মুওয়াক্কি‘ইন, খণ্ড ১, পৃ. ৪৮৬)

এই দৃষ্টিকোণ থেকে, স্বর্ণ নিষিদ্ধকরণ পুরুষের আত্মসংযম, বিনয় ও মানসিক শক্তি রক্ষার এক মাধ্যম। তা ছাড়া স্বর্ণ সাধারণত সৌন্দর্য, বিলাসিতা ও সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। ইসলাম চায় না পুরুষ বাহ্যিক অলঙ্কারে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করুক; বরং তার মর্যাদা নির্ধারিত হোক চরিত্র, জ্ঞান ও দায়িত্ববোধে।

পুরুষের জন্য স্বর্ণ হারাম করা হয়েছে, যাতে নারী-পুরুষের বাহ্যিক রূপে পার্থক্য বজায় থাকে এবং পুরুষ অহংকার, বিলাসিতা ও আত্মম্ভরিতার পথে না যায়।ইমাম গাজালি (রহ.), ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, ২/৩১২

মনোবিজ্ঞানী কারেন হর্নাই (Karen Horney) তার Neurosis and Human Growth গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “যেসব সমাজে পুরুষরা বাহ্যিক সৌন্দর্য ও অলঙ্কারকে পরিচয়ের অংশ বানায়, সেখানে পুরুষত্বের ধারণা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং আত্মমর্যাদাবোধ হ্রাস পায়।”

ইসলাম এই মানব-মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে পুরুষকে আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য ও নৈতিক দৃঢ়তা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করেছে।

আধুনিক ইসলামি চিন্তাবিদদের মধ্যে ইউসুফ কারজাভি বলেন, “স্বর্ণ পুরুষের জন্য মানানসই নয়; এটি পার্থিব সৌন্দর্যের প্রতীক, আর ইসলাম পুরুষকে আত্মিক সৌন্দর্যের দিকে আহ্বান করে।” (আল-হালাল ওয়াল-হারাম ফিল ইসলাম, পৃ. ৭৩)

বিকল্প ব্যবস্থা: রুপা পরিধান

রাসুল (সা.) নিজে রুপার আংটি পরতেন। হাদিসে আছে, “রাসুল (সা.)-এর একটি রুপার আংটি ছিল, যার পাথরে লেখা ছিল ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’।’’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৮৭৭)

সুতরাং, রুপা পরিধান পুরুষের জন্য বৈধ, তবে সেটিও অহংকার ও প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নয়, বরং সরলতার প্রকাশ হিসেবে।

পুরুষের জন্য স্বর্ণ পরিধান নিষিদ্ধকরণ ইসলামের গভীর সমাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। এই নিষেধাজ্ঞা পুরুষকে বিলাসিতা ও বাহ্যিক আভিজাত্য থেকে দূরে রেখে আত্মিক উন্নয়ন, বিনয় ও দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ করে।

ইসলাম পুরুষের মর্যাদা নির্ধারণ করেছে তার তাকওয়া, সততা ও কর্মে; স্বর্ণের অলঙ্কারের মাধ্যমে নয়।

আরও পড়ুনওসমানিয়া নারীদের মিথ ও বাস্তবতা১৯ জুন ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ