ঢাকায় জনসংখ্যা বাড়ছে দ্রুতগতিতে। বিকেন্দ্রীকরণের অভাবে সারা দেশ থেকে মানুষ এসে বসতি গড়ছে ঢাকায়। বিপুল এই জনসংখ্যার চাপই বাড়িয়ে দিচ্ছে ঢাকায় ভূমিকম্প ও অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি। অব্যবস্থাপনা, ঘনবসতি ও দুর্বল নগর–পরিকল্পনার কারণে ঢাকা এখন ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে।

‘ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ডে বিপর্যস্ত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ঢাকার পরিকল্পনাগত সংকট ও করণীয়: আইপিডির পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এ অভিমত উঠে এসেছে। আজ শুক্রবার সকালে ভার্চ্যুয়ালি এ সভার আয়োজন করে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।

সভায় আলোচ্য বিষয় নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইপিডির সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। এতে বলা হয়, জাতিসংঘের হিসাবে ঢাকার জনসংখ্যা এখন ৩ কোটি ৬৬ লাখ। জাপানের টোকিওকে পেছনে ফেলে ঢাকা এখন বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল নগরে পরিণত হয়েছে। দেশে নগরায়ণের হার ১৯৭৪ সালের ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ থেকে বেড়ে বর্তমানে ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর বড় অংশই ঢাকামুখী।

দ্রুত নগরায়ণ ঢাকার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে উল্লেখ করে এই নগর–পরিকল্পনাবিদ বলেন, ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় প্রচুর ভবন ইমারত নির্মাণ বিধিমালা (বিল্ডিং কোড) অনুসরণ না করেই নির্মিত হয়েছে। দুর্বল মাটি, জলাভূমি ভরাট করে গড়ে ওঠা আবাসন প্রকল্প ও সংকীর্ণ সড়ক—সব মিলিয়ে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কয়েক গুণ বাড়াতে পারে। মধুপুর ফাটলরেখায় (ফল্টলাইন) ৬ দশমিক ৯ বা এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ পর্যন্ত ভবন ধসে পড়তে পারে। শহরের প্রায় ৪০ শতাংশ সরকারি ভবনও ঝুঁকিপূর্ণ।

দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে বড় বিপর্যয় হবে

ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিও উদ্বেগজনক জানিয়ে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বস্তি ও নিম্ন আয়ের আবাসনে ঘনবসতি, দাহ্য অবকাঠামো ও পর্যাপ্ত খোলা জায়গার অভাবে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বাড়ছে। টেকসই নগর–পরিকল্পনা, বিল্ডিং কোডের কঠোর বাস্তবায়ন, দুর্বল ভবনের তালিকা তৈরি করা ও উচ্ছেদ এবং ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এসব ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণ না করলে ভবিষ্যৎ দুর্যোগে ঢাকায় বড় বিপর্যয় হবে।

অনিয়ন্ত্রিত বসতি ও দুর্বল নগর–পরিকল্পনার কারণে ঢাকা ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ডসহ নানা দুর্যোগের ঝুঁকিতে বলে উল্লেখ করেন আইপিডির উপদেষ্টা অধ্যাপক আক্তার মাহমুদ। তিনি বলেন, ভবন নির্মাণে নকশা, প্রকৌশল, নির্মাণের মান ও আইন প্রয়োগ—এ চারটি ধাপ সঠিকভাবে অনুসরণ না করার কারণে ঝুঁকি আরও বাড়ছে। বিল্ডিং কোড মানা না হলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ ও দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। এ ছাড়া ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।

দুর্বল মাটি, জলাভূমি ভরাট করে গড়ে ওঠা আবাসন প্রকল্প ও সংকীর্ণ সড়ক—সব মিলিয়ে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কয়েক গুণ বাড়াতে পারেঅধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান, সভাপতি, আইপিডি

সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা হলে ঢাকা শহরকে নিরাপদ করা সম্ভব বলে মনে করেন অধ্যাপক আক্তার মাহমুদ। তিনি বলেন, কর্মশালা, সেমিনার ও প্রকল্পভিত্তিক কাজের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্ববোধ ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। সামগ্রিকভাবে, পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও আইন প্রয়োগের কাঠামো শক্তিশালী করাই ঢাকাকে বিপর্যয় মোকাবিলায় সক্ষম করতে পারে।

সবকিছুই এক শহরে কেন্দ্রীভূত

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সহসভাপতি সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন বলেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ঢাকাকে দ্বিতীয় জনবহুল শহর বলা হলেও এটি শুধুই জনসংখ্যার ভিত্তিতে তৈরি মূল্যায়ন। সেবা, আকার, পরিবেশ ও পরিকল্পনার মান যুক্ত হলে অবস্থান আরও ভিন্ন হতো।

বাংলাদেশের উন্নয়ন দীর্ঘদিন ধরে ঢাকাকেন্দ্রিক উল্লেখ করে শাহরিয়ার আমিন বলেন, অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, রাজনীতি, বিচার ও প্রশাসন—সব এক শহরে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় সারা দেশের ভার এসে পড়েছে ঢাকায়। অন্যান্য শহরে শিল্পায়ন, অবকাঠামো ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ার কারণে ঢাকার ওপর অস্বাভাবিক চাপ তৈরি হয়েছে, যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।

শাহরিয়ার আমিন বলেন, দেশে সমস্যা তৈরি হওয়ার পর পরিকল্পনা করা হয়। এতে বিশৃঙ্খলা বাড়ে। ভবন নির্মাণে জবাবদিহির অভাব রয়েছে। সব ক্ষেত্রে সমানভাবে আইন প্রয়োগ না করা ঢাকায় অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। ঢাকার পরিকল্পনাকে সারা দেশের নীতিগত সিদ্ধান্তের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। আইনের শাসন পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর করে ভবন, নগর ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সমন্বয়ে পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব।

ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় মারাত্মক বিপর্যয়ের শঙ্কা

ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ শহর হওয়ায় ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি বলে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফরহাদুর রেজা। তিনি বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ভূমির সঠিক ব্যবহারের অভাব ও খোলা জায়গার স্বল্পতা শহরকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করেছে।

ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে বিল্ডিং কোড মেনে চলতে বাধ্য করা, পর্যাপ্ত খোলা জায়গা, দুর্ঘটনার সময় ভবন থেকে বের হওয়ার মতো জায়গা রাখা ও জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হলে তা মোকাবিলায় ওয়ার্ডভিত্তিক দল গঠনের মতো বিষয়গুলোকে অত্যাবশ্যক বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক ফরহাদুর রেজা। তিনি একই সঙ্গে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎসহ নাগরিক পরিষেবা ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য ও নিরাপদ করার পরামর্শ দেন।

ফরহাদুর রেজা বলেন, ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত তোলায় শহরের নিচে ভ্যাকুয়াম (শূন্যস্থান) তৈরি হচ্ছে, যা ভূমিকম্পের সময় মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই উপরিতলের পানির ব্যবহার বৃদ্ধি ও ভূগর্ভস্থ পানি জমানো জরুরি। ঢাকার ভারবহনের সক্ষমতা বিবেচনায় দেশের অন্যান্য শহরে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দেন তিনি।

আলোচনা সভায় আরও যুক্ত ছিলেন স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও আইপিডির রিসার্চ ফেলো কে এম আসিফ ইকবাল, প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জিনিয়াস জান্নাত ও কাজী তাসনিয়া তাবাসসুম।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ভ ম কম প র আইপ ড র জনস খ য ন বল ন দ র বল

এছাড়াও পড়ুন:

এই মুহূর্তে বিচার, সংস্কার, নির্বাচনই দেশের মানুষের প্রধান স্বার্থ: জোনায়েদ সাকি

এই মুহূর্তে বিচার, সংস্কার, নির্বাচনই দেশের মানুষের প্রধান স্বার্থ উল্লেখ করে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছেন, বর্তমানের বিদ্যমান সংবিধান না বদলালে জনগণের হাতে ক্ষমতা আসবে না। কারণ, সংবিধানের অগণতান্ত্রিকতার সুযোগে একজন ব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল।

শুক্রবার বিকেলে গণসংহতি আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর শাখার উদ্যোগে আয়োজিত মিছিলের পর সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জোনায়েদ সাকি এ মন্তব্য করেন। ​নগরের খানপুর মেট্রো হলের সামনে থেকে দলের নির্বাচনী প্রতীক ‘মাথাল’ নিয়ে মিছিলটি শুরু হয় এবং শহরের প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে নিতাইগঞ্জে গিয়ে শেষ হয়।

​সমাবেশে জোনায়েদ সাকি বলেন, শেখ হাসিনা সংবিধানের অগণতান্ত্রিকতার সুযোগ নিয়ে স্বৈরাচার হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। সংবিধানে অনেক অধিকারের কথা বলা থাকলেও কার্যত এক ব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল। এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার ও ক্ষমতা এত দিন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বর্তমান বিদ্যমান সংবিধান না বদলালে জনগণের হাতে ক্ষমতা আসবে না। এ কথা শুরু থেকে বলে আসছে গণসংহতি আন্দোলন।

জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘অভ্যুত্থানের পরও আমরা কথা বলা থামাইনি। জুলাই সনদ তৈরিতে আমরা গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছি, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে না পারে। এখন দায়িত্ব জনগণের। চোর-লুটেরাদের ভোট দিলে তারা আবার ফাঁকফোকর খুঁজবে।’

জনগণের স্বার্থই গণসংহতি আন্দোলনের স্বার্থ বলে উল্লেখ করেন জোনায়েদ সাকি। তিনি তাঁর দলের প্রতীক ‘মাথাল’ মার্কায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীরা গত ১৬ বছর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লড়াই করেছেন, অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের ওপর ভরসা রাখুন এবং মাথাল মার্কাকে বিজয়ী করুন।’

জোনায়েদ সাকি বলেন, শেখ হাসিনা গায়ের জোরে তিনটি নির্বাচন করেছিল। এর মাধ্যমেই তারা সারা দেশে সহিংসতা শুরু করার ম্যান্ডেট পেয়েছে। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যাকে লাশের নদীতে পরিণত করেছে। তিনি বলেন, ‘এই শামীম ওসমান গং ত্বকীকে হত্যা করেছে। সাত খুন করেছে।’

সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন দলের জেলা সমন্বয়কারী তরিকুল সুজন, নির্বাহী সমন্বয়কারী অঞ্জন দাস, মহানগর সমন্বয়কারী বিপ্লব খান, নির্বাহী সমন্বয়কারী পপি রানী সরকার, জেলার যুগ্ম সমন্বয়কারী আলমগীর হোসেন আলম ও মহানগর কমিটির সদস্য ফারহানা মানিক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ