বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণার প্রথম ধাপই হচ্ছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। সেই ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে বাঙালি স্বপ্ন দেখেছে স্বাধীনতার আর পেয়েছে মুক্তিসংগ্রামের উজ্জীবনী শক্তি ও সাহস। ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ এলে অন্যতম যে নামটি সবার মনে পড়ে, সেটি হলো—ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন, যিনি ‘ভাষামতিন’ নামেই পরিচিত আমাদের কাছে।
২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর অবসান হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের সেই অন্যতম সংগঠক আবদুল মতিনের ৮৮ বছরের বর্ণিল জীবনের। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ায় দেড় মাসের বেশি সময় ধরে পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান অনন্তযাত্রায়।
সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার ধুবালিয়া গ্রামে ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর জন্ম নিলেও পরবর্তী সময়ে বাবার কর্মের সুবাদে এই কিংবদন্তির ছেলেবেলা কেটেছে দার্জিলিংয়ে। সেখানে স্কুলজীবন শেষ করে ১৯৪৩ সালে রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন এবং পরে মাস্টার্স করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে। ১৯৫২ সালে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আবদুল মতিন।
ভাষা আন্দোলনের পর আবদুল মতিন ছাত্র ইউনিয়ন গঠনে ভূমিকা রাখেন এবং পরে সংগঠনটির সভাপতিও হন। এরপর কমিউনিস্ট আন্দোলনে সক্রিয় হন তিনি। ১৯৫৪ সালে পাবনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক হন আবদুল মতিন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ‘ন্যাপ’ গঠন করলে ১৯৫৭ সালে তাতে যোগ দেন আবদুল মতিন। ১৯৫৮ সালে মতিন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) গঠন করেন। ১৯৯২ সালে তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ২০০৬ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে ২০০৯ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি পুনর্গঠিত হলে আবদুল মতিন আবারও এতে যোগ দেন।
ভাষা আন্দোলন বিষয়ে আবদুল মতিনের রচিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘বাঙালি জাতির উৎস সন্ধান ও ভাষা আন্দোলন’, ‘ভাষা আন্দোলন কী এবং কেন’ ও ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’। এ ছাড়া প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘জীবন পথের বাঁকে বাঁকে’। ঢাকার মোহাম্মদপুরে পরিবারের সঙ্গেই থাকতেন দুই মেয়ের বাবা আবদুল মতিন। মৃত্যুর আগে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই নিজের দেহ তিনি দান করে গেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য, আর চোখ দান করে গেছেন সন্ধানীকে।
আবদুল মতিন নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ে কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সারাটা জীবন অতিক্রম করেছেন। তিনি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন, তা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাঁকে ক্ষমতা আকৃষ্ট করতে পারেনি। শুধু ক্ষমতাই রাজনীতির উদ্দেশ্য হতে পারে না—জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেটারই প্রমাণ রেখেছেন তিনি। সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের মানবতাবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে রাজনীতির মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন তিনি।
মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের জন্মগ্রহণকারী ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন আমাদের জাতীয় রাজনীতির অহংকার আর দেশপ্রেমিক ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনীতির আলোকবর্তিকা। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ে কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অতিক্রম করেছেন সারাটা জীবন। তিনি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন, তা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আজও বাংলাদেশে একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মাওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী ভাষামতিন রাজনীতি করেছেন দেশ ও মানুষের জন্য। ক্ষমতার মোহ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আবদুল মতিনের রাজনৈতিক সহকর্মীরা আজ আর তাঁকে স্মরণ করেন না। কেউ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করেন না, খবরও রাখেন না। এতে দুঃখ নেই। মাওলানা ভাসানী–পরবর্তী ক্ষমতার বাইরে থেকেও জনগণের কল্যাণ করা যায়, তার সার্থকতা প্রমাণ করেছেন ভাষামতিন।
মৃত্যুর পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মূল বেদির উল্টো দিকে ছোট-বড় বেশ কিছু গগনশিরীষগাছ মাথার ওপর ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে নির্মিত অস্থায়ী মঞ্চে রাখা হয়েছিল ভাষামতিনের কফিন। সেদিন বায়ান্নর সহযোদ্ধা ও নেতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কফিনের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আরেক ভাষাসৈনিক প্রয়াত রওশন আরা বাচ্চু আক্ষেপ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘ছি, কী লজ্জা! আমরা দিন দিন অকৃতজ্ঞ জাতিতে পরিণত হচ্ছি। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকেও আমরা দিতে পারিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা।’ আরেক ভাষাসৈনিক শামসুল হুদা বলেছিলেন, ‘জাতি যদি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে সম্মান না দিতে পারে, তাহলে গোটা জাতিই কলঙ্কিত হয়। আমরা আর কত কলঙ্কের দায়ভার নেব?’
জীবনের শেষ দিকে আমরা ভাষামতিনকে খুব কাছ থেকে পেয়েছিলাম। ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশের (ন্যাপ) নেতৃত্বে থাকার কারণে আমাকে ও আমাদের দলীয় প্রধান জেবেল রহমান গানিকে খুবই স্নেহ করতেন এবং বলতেন, ‘রাজনৈতিক এই দায়িত্ব ধরে রাখো। একদিন পরিবর্তন আসবেই। সেদিনের অপেক্ষায় লড়াই চালিয়ে যাও।’ তিনি বলতেন, ‘মাওলানা ভাসানী ও ন্যাপকে ত্যাগ করা আমার রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এই ভুল না হলে বাংলাদেশের ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হতো।’
বর্তমান রাজনীতিতে যে অবক্ষয়, তাতে নতুন প্রজন্ম আবদুল মতিনের মতো একজন ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক মানুষের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজবে। তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানালে সম্মানিত হতো গোটা জাতিই। কিন্তু রাষ্ট্রের অবহেলার মধ্য দিয়েই তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছে এই নশ্বর পৃথিবী থেকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘ সময় পরও সর্বস্তরে বাংলা চালু না হওয়ায় ক্ষোভ ছিল ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘যে ভাষার জন্য সংগ্রাম হলো, জীবন দিতে হলো, সেই বাংলা এখনো সর্বস্তরে চালু হয়নি। এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, বাঙালিদের ভালো করে ইংরেজি শিখতে হলেও বাংলা জানতে হবে। কারণ, ভালো বাংলা ছাড়া ভালো ইংরেজিও শেখা যাবে না।’
বাম রাজনীতি করেছেন আজীবন, যুক্ত ছিলেন কৃষক-শ্রমিকদের সঙ্গে। সমকালে মাওলানা ভাসানী ছিলেন আবদুল মতিনের আদর্শ। গৌরবময় ইতিহাসের নায়ক কীভাবে জীবিতকালে লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে এবং সুযোগ্য সম্মান না পেয়ে আমাদের এই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বসবাস করে গেলেন—ভাবতেও কষ্ট হয়, দুঃখ হয়। বাংলা ভাষার এই দেশে যেন তিনি ছিলেন এক আগন্তুক। কোনো সরকারই তাঁকে চিনতে চায়নি, সম্মান দিতে চায়নি।
যতটুকু সময় ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে, দেখেছি, তিনি কখনো ব্যক্তিগত বিষয়-আশয় নিয়ে আক্ষেপ বা ক্ষোভ প্রকাশ করতেন না। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী আবদুল মতিন দরিদ্রতা পরিহার করতে পারেননি। তাঁকে এই অভিশাপ থেকে উদ্ধার করে একটু স্বস্তি দেওয়ার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের। কিন্তু কোনো সরকার তাঁর এই বাস্তবতাকে সমর্থন দেয়নি, করেনি যোগ্য সম্মান।
ভাষা আন্দোলন দমাতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে ভাষামতিনকে সিএসপি বানানোর গোপন প্রস্তাব দেওয়া হয়, যার শর্ত ছিল তিনি ভাষা আন্দোলন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবেন। কিন্তু বাঙালির অধিকার আন্দোলনে তিনি ছিলেন আপসহীন। ব্যক্তিস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে তাই তিনি বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন।
শুধু রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে যেন কাউকে সম্মান জানাতে আমরা কার্পণ্য না করি। মনে রাখতে হবে, ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন জাতির সঙ্গে কিংবা মেহনতি মানুষের সঙ্গে কখনোই বেইমানি করেননি। এই জাতিকে সারা জীবন শুধু দিয়েই গেছেন, কিছুই নেননি। লোভের কাছে কখনোই পরাস্ত হননি। এমনকি মৃত্যুর পর নিজের দেহ ও চোখ পর্যন্ত দান করে দিয়ে গেলেন মানবকল্যাণে। চৌহালী উপজেলার গেদু থেকে বাঙালির ভাষামতিন হয়ে ওঠা এই মহান ও অকুতোভয় নেতার আদর্শ আমাদের প্রেরণার উৎস।
তাঁর ১১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে অমর স্মৃতির প্রতি গভীরতম শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া রাজনীতিক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক র জন ত র ভ ষ মত ন কর ছ ন আম দ র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
মেসির উদাহরণ টেনে লারার প্রশ্ন, তারা কি সত্যিই ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলতে চায়
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট পতনের দিকে—এই আলোচনা নতুন না। তবে বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে ৪ অক্টোবর আহমেদাবাদে প্রথম টেস্টে ভারতের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংস ১৪০ রানে হারের পর। ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক রোস্টন চেজ হারের পর ‘অবকাঠামোগত সমস্যা’ এবং ধারাবাহিকভাবে ‘আর্থিক সমস্যা’র কথা বলেছিলেন।
এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি এবং সাবেক অধিনায়ক ব্রায়ান লারাও মেনে নিলেন, ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট ক্রমশ নিম্নমুখী হওয়ার পেছনে রয়েছে অর্থ ও প্রযুক্তির অভাব। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জার্সির প্রতি আরেকটু ভালোবাসা ঢেলে আরও ভালোভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আহ্বানও জানিয়েছেন লারা। পাশাপাশি একটি প্রশ্নও তুলেছেন কিংবদন্তি, ‘তারা (খেলোয়াড়) কি সত্যিই ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলতে চায়?’
কিংস্টনে গত জুলাইয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে ২৭ রানে অলআউট হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এরপর আগস্টে ক্লাইভ লয়েড, লারা, ডেসমন্ড হেইন্স, শিবনারায়ণ চন্দরপলদের মতো ক্যারিবিয়ান গ্রেটদের নিয়ে একটি কমিটি করে ক্রিকেট ওয়েস্ট ইন্ডিজ (সিডব্লুআই)। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটকে টেনে তুলতে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও সেসব বাস্তবায়নের রূপরেখাও তৈরি করে সেই কমিটি। লারা ও চেজ দুজনেই এই কমিটির অংশ।
মুম্বাইয়ে গত মঙ্গলবার সিয়াট ক্রিকেট রেটিং অ্যাওয়ার্ডসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের পতন নিয়ে কথা বলেন লারা। টেস্টে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংস খেলার রেকর্ডধারী কিংবদন্তির মুখেই শুনুন সেসব কথা, ‘কোনো কিছু করতে চাইলে সেটা করার সামর্থ্য থাকতে হবে। এটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু একই সময়ে আমি রোস্টন চেজ ও বাকিদের বলতে চাই, তারা কি হৃদয়ে সত্যিই ক্রিকেট লালন করে? তারা কি সত্যিই ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলতে চায়? এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাতে পথ খুঁজে নেওয়া যায়।’
আহমেদাবাদে ভারতের কাছে প্রথম টেস্ট বাজেভাবে হারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ