বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হকের নেতৃত্বে একদল রাজনীতিক সম্প্রতি আফগানিস্তান ঘুরে এসে তাঁদের চোখে ভালো লেগেছে, এমন কিছু বিষয় নিয়ে ঢাকার সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন। আফগানিস্তানে তালেবানি শাসনামলে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে যে বাধানিষেধ রয়েছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশি রাজনীতিকেরা তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে তাঁদের মতে, এত অল্প সময়ের মধ্যে দেশটি নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও ন্যায়পরায়ণ বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পেরেছে। এতে তাঁরা নিজেদের সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

সরকারি পাহারায় এই ‘গাইডেড ট্যুর’ থেকে ধর্মশাস্ত্রে পণ্ডিত এই রাজনীতিকেরা কী দেখলেন, কী শুনলেন, তাতে খুব বেশি গুরুত্ব আরোপের প্রয়োজন নেই। তাঁদের যা দেখানো হয়েছে, তা–ই দেখেছেন, যা শোনানো হয়েছে, তা–ই শুনেছেন। বাংলাদেশ ক্রমে ধর্মভিত্তিক শাসনব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছে—দেশে–বিদেশে অনেকেই এমন ধারণা করছেন। এ অবস্থায় আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই উচিত খোলা চোখে তালেবানি ব্যবস্থা বোঝার চেষ্টা।

দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী—এ কথা বাংলাদেশে যেমন সত্য, আফগানিস্তানেও। সমাজে নারীর অবস্থান বহুলাংশে সে সমাজের উন্নয়ন বা অনুন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। নারীর অবস্থান প্রশ্নে তালেবানের ভাবনার সঙ্গে অধিকাংশ মুসলিম পণ্ডিতের ভাবনা মেলে না। আল-আজহারের গ্র্যান্ড ইমাম শেখ আহমেদ এল-তাইয়েব লিখেছেন, নারী হোক বা পুরুষ—কাউকে বিদ্যাশিক্ষা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা বড় ধরনের অপরাধ। আফগানিস্তানে এ প্রশ্নে তালেবান যা করছে, তা পুরোপুরি ইসলামবিরোধী।

উত্তর আমেরিকা ইসলামিক সোসাইটির মুখপাত্র হারুন ইমতিয়াজ সে কথা সমর্থন করে বলেছেন, নারীশিক্ষা সংকুচিত করে যে নতুন আইন তালেবান প্রকাশ করেছে, তার সঙ্গে পবিত্র কোরআন বা মহানবী (সা.

)–এর শিক্ষার কোনো সংগতি নেই।

আরও পড়ুনপশতুন কাফেলায় বাংলাদেশি: টিটিপি কি নতুন আঞ্চলিক টানাপোড়েন তৈরি করছে০৩ অক্টোবর ২০২৫

সৎকর্ম প্রচার ও অসৎকর্ম পরিহার আইন

নতুন যে আইনের কথা আলোচিত হচ্ছে, তা গত বছরের আগস্ট মাসে ঘোষিত হয়েছে। এটার নাম হলো ‘সৎকর্ম প্রচার ও অসৎকর্ম পরিহার আইন’। নামে যতটা নিরীহ, কাজে এই আইন ততটা নিরীহ নয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ (সংস্থাটির ওয়েবসাইট থেকে এই আইনের একটি পিডিএফ কপি যে কেউ পড়ে নিতে পারেন) গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এর মাধ্যমে আফগান নারী ও পুরুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। মোট ১১৪ পাতার এই আইন, যেখানে ভূমিকা ছাড়া রয়েছে ৪টি অধ্যায় ও ৩৫টি অনুচ্ছেদ বা ধারা, তা আসলে একটি আচরণবিধি।

নারী-পুরুষনির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ কী পোশাক পরবেন, কীভাবে কথা বলবেন, শরীরের কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জনসমক্ষে দেখানো যাবে বা যাবে না, তার সবিস্তার বিবরণ। যেহেতু আইন। ফলে এই বিধি লঙ্ঘন হলে শাস্তির বিধানও রয়েছে। আমি এই আইন থেকে সরাসরি কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি, তাতে পাঠকের উদ্বেগ ও আগ্রহ উভয়ের নিরসন হবে: ‘একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী নিজ গৃহত্যাগের আগে তাঁর কণ্ঠ, মুখাবয়ব ও শরীর ঢেকে রাখবেন।’

ধারাটি ব্যাখ্যা করে জাতিসংঘ জানাচ্ছে, এ নির্দেশের মোদ্দা অর্থ হলো কোনো নারীকে ঘরের বাইরে যেতে তাঁকে শুধু যে আপাদমস্তক পূর্ণাবৃত থাকতে হবে, তা–ই নয়, তাঁকে এ ব্যাপার নিশ্চিত করতে হবে যে তাঁর কণ্ঠ যেন ঘরের বাইরে কোনো পুরুষের কান পর্যন্ত না পৌঁছায়। কোনো নারী তাঁর নিকট আত্মীয় নন, এমন কারও দিকে চোখে তুলে তাকাতে পারবেন না। কথা বলা, পাঠ করা অথবা গান গাওয়া থেকে এমনভাবে বিরত থাকতে হবে, যাতে অন্য কেউ তাঁর কণ্ঠ শুনতে না পায়। কোনো নারী যাতে একা কোনো পুরুষ অভিভাবক ছাড়া দীর্ঘ কোনো যাত্রায় না যান, তার বিধানও রাখা হয়েছে।

শুধু নারী নন, পুরুষদের জন্যও সুনির্দিষ্ট পোশাক ও আচরণবিধি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, গৃহের বাইরে আসার সময় প্রত্যেক পুরুষকে কমপক্ষে তাঁর নাভি থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত আবৃত রাখতে হবে। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের জন্য দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক। দাড়ির দৈর্ঘ্য কমপক্ষে তাঁর হাতের মুঠির সমান হতে হবে।

গান শোনা বা বাজানো নিষিদ্ধ। (অনুমান করি, বাংলাদেশে স্কুলে সংগীতশিক্ষক নিয়োগ বাতিলের দাবিটি সম্ভবত এ আইন দ্বারাই অনুপ্রাণিত)। কোনো উৎসবে বা পরবে গানবাজনা চলবে না।

ঠিক কীভাবে এই আইন প্রয়োগ করা হবে অথবা কোনো লঙ্ঘন ঘটলে কী শাস্তির বিধান থাকবে, এই আইনে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, আইনের যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘সৎকর্ম প্রচার ও অসৎকর্ম রোধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ব্যাপক ক্ষমতা থাকবে (জি হ্যাঁ, এই নামের একটি মন্ত্রণালয়ও রয়েছে)। টহলরত নৈতিক পুলিশ প্রয়োজনবোধে যেকোনো নারী বা পুরুষকে আটক বা গ্রেপ্তারের অধিকার ভোগ করবে। এতে আর্থিক জরিমানা বা জেলে পাঠানোর বিধান রয়েছে।

 

শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারী

এই আইন প্রকাশের আরও আগে, ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই, নারীশিক্ষা প্রশ্নে তালেবান সরকার কঠোর নিয়মনীতি চালু করে। সে দেশে মেয়েদের সর্বোচ্চ ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ রয়েছে। এখনো সে নিয়মই চালু রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠের কোনো সুযোগের প্রশ্নই উঠছে না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী লেখকদের বইয়ের প্রচার-প্রকাশ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ বছরের সেপ্টেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ পাতার দীর্ঘ এক তালিকা পাঠানো হয়েছে, যাতে ৬৭৯টি গ্রন্থ নিষিদ্ধ বলে জানানো হয়েছে।

শুধু শিক্ষাক্ষেত্র নয়, কর্মক্ষেত্রেও নারীদের জন্য প্রায় সব দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আফগান মেয়েদের সব দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি নিষিদ্ধ করা হয়। পরের বছর এপ্রিলে জাতিসংঘের কোনো প্রতিষ্ঠানে তাঁদের কর্মের সুযোগ বাতিল করা হয়। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্র ছাড়া সব সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়। মিডিয়ায়, বিশেষত টেলিভিশনে মেয়েদের চাকরি নিষিদ্ধ বা সংকুচিত করা হয়েছে। এমনকি নার্স বা সেবিকা বৃত্তি গ্রহণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

তালেবানি বিচারব্যবস্থা

তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণের পর চার বছর কেটে গেছে। আমি একাধিক মানবাধিকার সংগঠনের মূল্যায়ন থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি, তাতে আফগানিস্তানের একটা হালনাগাদ চিত্র মিলবে। এ বছরে সেপ্টেম্বরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত চার বছরে আফগানিস্তানে তালেবানের হাতে মেয়েদের শিক্ষা ও অন্যান্য মৌলিক অধিকারের যে লঙ্ঘন হয়েছে, তা এককথায় নিষ্ঠুর ও অমানবিক।

শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট, তালেবান দেশের মেয়েদের বলছে, ‘১২ বছর হলেই স্কুলের দরজা তোমাদের জন্য বন্ধ। কোনো স্বপ্ন দেখার অধিকার তোমাদের নেই।’ প্রায় একই কথা জাতিসংঘের নারীবিষয়ক বিভাগ ইউএন উইমেনের। তারা বলেছে, আর আগে আফগানিস্তানের মেয়েরা শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে যে অগ্রগতি অর্জন করেছিল, গত কয়েক বছরে তার প্রায় সবটাই হারিয়ে গেছে। নারী ও মেয়েরা কার্যত গৃহে বন্দী। তাদের অনেকেই গার্হস্থ্য সহিংসতা, বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার।

ধর্মীয় বিধানের কথা বলে আফগানিস্তানে তালেবান সরকার যে বিচারব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে, তাকে ভদ্রভাষায় মধ্যযুগীয় বলা যায়। নব্বইয়ের দশকে মোল্লা ওমরের তালেবানি শাসনে জনসমক্ষে, এমনকি স্টেডিয়ামে মহা আড়ম্বরে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হতো। প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত তো ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। সে ব্যবস্থা এখনো চালু আছে। উদাহরণ দিয়ে বলি।

আরও পড়ুনদক্ষিণ এশিয়ায় নতুন রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা ও কূটনীতির টানাপোড়েন০১ জানুয়ারি ২০২৫

গার্ডিয়ান পত্রিকা জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে এক হাজারের বেশি নারীকে ‘অনৈতিক’ ব্যবহারের জন্য প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করা হয়েছে। এ অনৈতিক ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে মাহরাম বা নিকট পুরুষ আত্মীয় ছাড়া ঘরের বাইরে আসা অথবা প্রকাশ্যে পুরুষের সঙ্গে বাক্যালাপ। পত্রিকাটি দিবা নামের এক নারীর কথা লিখেছে। ৩৮ বছর বয়সী সাত সন্তানের জননী এই নারী তাঁর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পেশায় দরজি। কখনো কখনো কাপড় ক্রয় করতে বা অর্ডারমাফিক কাপড় নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে দিতে তাঁকে ঘরের বাইরে আসতে হয়।

একা কেন বাইরে এসেছেন, এ অপরাধে তাঁকে (দিবা) চার মাস জেল খাটতে হয়েছে। একবার তাঁর আত্মীয় নন, এমন এক পুরুষের কাছ থেকে সেলাই মেশিন ভাড়া করার অপরাধে তাঁকে ‘বেশ্যা’ বলা হয় ও প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করা হয়। এ রকম গল্প দু–একটি নয়, অসংখ্য।

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস জানিয়েছে, সারি পুই প্রদেশে ২০২৪–এর জুন মাসে ৬৩ নারীকে ‘অনৈতিক ব্যবহারের’ জন্য প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করা হয়েছে। জাতিসংঘ জানাচ্ছে, এ বছর ১১ এপ্রিলে বাঘদিস, নিমরোজ ও ফারাহ প্রদেশে চারজনকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।

শুধু নারী নন, দেশের সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, বিশেষত শিয়া ও হাজারা গোত্রভুক্ত আফগানরাও ধর্মের নামে বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। হিরাতের তালেবান গভর্নর শিয়াদের ‘ইসলামের শত্রু’ আখ্যা দিয়ে একটি বই লিখেছেন, যা ব্যবহার করে এই গোত্রভুক্ত মানুষদের মসজিদে হামলা, এমনকি বোমাবাজির ঘটনা ঘটেছে। বিধর্মী আখ্যা দিয়ে শিয়া ও হাজারাদের কাবুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

তালেবান কী, তা জানতে কাবুল পর্যন্ত ছুটে যেতে হয় না। চোখকান খোলা রাখলে যে কেউ বুঝবেন তালেবানি ব্যবস্থা শুধু পশ্চাৎপদই নয়, আন্তর্জাতিক আইনের চোখে তা খোলামেলাভাবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।

হাসান ফেরদৌস সাংবাদিক ও লেখক

মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আফগ ন স ত ন প রক শ য ব যবহ র ব যবস থ গ রহণ র এই আইন দ ধ কর চ ত কর র জন ত র জন য ক ষমত সরক র আইন র র একট অপর ধ

এছাড়াও পড়ুন:

ছোলা, সয়াবিন, চিনাবাদাম ও কাঁচকলায় তৈরি দেশীয় খাবার অপুষ্টি রোধে উদ্ভাবনের বিশ্বসেরার তালিকায়

অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর অন্ত্রের উপকারী জীবাণু পুনর্গঠনে সহায়ক এক বিশেষ খাবার এমডিসিএফ-২ বা মাইক্রোবিওটা-ডাইরেক্টেড কমপ্লিমেন্টারি ফুড। ছোলা, সয়াবিন, চিনাবাদাম ও কাঁচকলার মিশ্রণে তৈরি খাবারটি জায়গা পেয়েছে বিশ্বখ্যাত টাইম সাময়িকীর ‘২০২৫ সালের সেরা উদ্ভাবনের’ তালিকায়। এমডিসিএফ-২-কে রাখা হয়েছে ‘সামাজিক প্রভাব’ বিভাগে।

এ খাবার যৌথভাবে উদ্ভাবন করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি ইন সেন্ট লুইস। আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক তাহমিদ আহমেদ ও ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির জেফরি গর্ডন এ উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

এর আগে ওরস্যালাইন উদ্ভাবনের সঙ্গেও যুক্ত ছিল আইসিডিডিআরবি। পরে বিশ্বের নানা দেশে সমাদৃত হয় ওরস্যালাইন। এ উদ্ভাবন বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ শিশুর প্রাণ বাঁচিয়েছে এবং বাঁচিয়ে যাচ্ছে।

এমডিসিএফ-২ ছোলা, সয়াবিন, চিনাবাদাম ও কাঁচকলার মিশ্রণে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যা অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর শরীরে থাকা অন্ত্রের উপকারী জীবাণুকে সক্রিয় করে। এসব জীবাণু শিশুর শরীর ও মস্তিষ্কের বিকাশ এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আমাদের অন্ত্রে দুই ধরনের জীবাণু আছে। কিছু ভালো জীবাণু, কিছু খারাপ জীবাণু। এ খাবার অন্ত্রের ভালো জীবাণুকে পুষ্টি দেয়। এতে করে ওই জীবাণুগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। জীবাণুর সংখ্যা বৃদ্ধিতে শিশুর শরীর তিনভাবে উপকৃত হয়। শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে, মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ে।তাহমিদ আহমেদ, আইসিডিডিআরবির গবেষক।

বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক বা গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই) ২০২৫–এর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী ১০ দশমিক ৭ শতাংশ শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার। এ ছাড়া অপুষ্টিজনিত কারণে ৩ দশমিক ১ শতাংশ শিশু জন্মের পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যায়।

আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক তাহমিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অপুষ্টির শিকার শিশুদের মৃত্যুঝুঁকি অন্যদের তুলনায় ১২ গুণ বেশি। এমডিসিএফ-২ অপুষ্টিতে ভোগা শিশুরা গ্রহণ করবে। এটি ওষুধ হিসেবে কাজ করবে।

তাহমিদ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের অন্ত্রে দুই ধরনের জীবাণু আছে। কিছু ভালো জীবাণু, কিছু খারাপ জীবাণু। এ খাবার অন্ত্রের ভালো জীবাণুকে পুষ্টি দেয়। এতে ওই জীবাণুগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। জীবাণুর সংখ্যা বৃদ্ধিতে শিশুর শরীর তিনভাবে উপকৃত হয়। শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে, মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।’

এ–সংক্রান্ত গবেষণায় মিরপুরের বস্তিতে সুস্থ-সবল শিশুদের অন্ত্রের জীবাণু এবং হাসপাতালের অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের অন্ত্রের জীবাণু বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণাকাজটি চলে ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, মোট ১২৪ শিশুকে নিয়ে। ডিএনএ সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে পরিচালিত এই গবেষণার কিছু কাজ ঢাকায়, কিছু কাজ ওয়াশিংটনে হয়।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের অন্ত্রে ভালো জীবাণুর সংখ্যা কম। তাহমিদ আহমেদ বলেন, ‘আমরা গবেষণায় দেখেছি, দেশীয় উপাদান দিয়ে তৈরি এ খাবার ভালো জীবাণুগুলো গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু খারাপ জীবাণুগুলো এটা গ্রহণ করতে পারে না। এতে ভালো জীবাণুর সংখ্যা বাড়ে।’

জেফরি গর্ডনকে উদ্ধৃত করে আইসিডিডিআরবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমাদের কয়েক দশকের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, শিশুদের বৃদ্ধি এবং পুষ্টি গ্রহণে অন্ত্রের জীবাণুই মূল ভূমিকা পালন করে। আমরা যে উপকারী জীবাণুগুলো চিহ্নিত করেছি, সেগুলো এমন গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদানগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করতে সহায়তা করে, যা আমাদের শরীর নিজে থেকে করতে পারে না।’

এমডিসিএফ-২ তৈরি হয়েছে ছোলা, সয়াবিন, চিনাবাদাম ও কাঁচকলার মিশ্রণে। এটি এমনভাবে তৈরি, যা অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর শরীরে থাকা অন্ত্রের উপকারী জীবাণুকে সক্রিয় করে। এসব জীবাণু শিশুর শরীর ও মস্তিষ্কের বিকাশ এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

অপুষ্টি পরিমাপের পদ্ধতি নিয়ে তাহমিদ আহমেদ বলেন, ওজন মাপা ছাড়াও সহজেই ফিতার মাধ্যমে অপুষ্টি পরিমাপের একটি পদ্ধতি আছে। ফিতাটি দিয়ে শিশুর বাহু মাপা হয়। বাহুর পরিধির ভিত্তিতে ফিতাতে সবুজ, হলুদ আর লাল রং করা থাকে। হলুদ বা লাল রং হলে শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে ধরা হয়। অপুষ্টি চিহ্নিত হলে তখন স্বাস্থ্যকর্মী ওই শিশুকে ডাক্তার দেখিয়ে এমডিসিএফ-২ দিতে পারবেন। শিশুর মাকে স্বাস্থ্যকর্মী বিষয়টি বুঝিয়ে দেবেন।

আরও পড়ুনবাংলাদেশের শিশুপুষ্টি পরিস্থিতি: বিদ্যমান অবস্থা ও উন্নয়নের পথ০৪ মার্চ ২০২৫

এমডিসিএফ-২ বিনা মূল্যে দেওয়ার আশা করছেন তাহমিদ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘অপুষ্টিতে ভোগা শিশুরা দারিদ্র্যের শিকার। ফলে আমরা এটা আশা করতে পারি না, এটি তাদের মা-বাবা কিনে খাওয়াবে। আমাদের চেষ্টা থাকবে, এটিকে বিনা মূল্যে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া। আমরা চিন্তা করছি, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র আর কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে যাতে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছানো যায়।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলেন, খাবারটি দেশীয় উপাদান দিয়ে বানানো। এটি ওরস্যালাইনের মতো একটি সম্ভাবনাময় উদ্ভাবন হতে পারে। আগেও আমাদের দেশে স্থানীয় উপাদানে চালের স্যালাইনের মতো উদ্ভাবন হয়েছে। নতুন এ উদ্ভাবন সহজে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে পারলে, তা বড় একটি জনগোষ্ঠীর জন্য উপকারী হতে পারে।

আইসিডিডিআরবি জানায়, বর্তমানে ভারত, পাকিস্তানের পাশাপাশি আফ্রিকার দেশ মালি ও তানজানিয়ায় এ খাবার নিয়ে আরও বড় পরিসরে গবেষণা চলছে। গবেষকদের প্রত্যাশা, এ উদ্ভাবন বৈশ্বিক পুষ্টি কর্মসূচিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে এবং চিকিৎসা পদ্ধতিকে বদলে দেবে।  

আরও পড়ুনশিশুজীবন রক্ষার জাদুকরি সমাধান১৮ জানুয়ারি ২০২০আরও পড়ুনটাইম ম্যাগাজিনের বিশ্ব স্বাস্থ্যে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় বাংলাদেশের ডা. তাহমিদ আহমেদ০৮ মে ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ