মেঘনা গ্রুপে ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম)/জেনারেল ম্যানেজার (জিএম), রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স পদে নিয়োগ দেবে। কর্মস্থল ঢাকা হেড অফিসে। আবেদনের শেষ সময় ৩০ অক্টোবর ২০২৫।
পদের নাম ও বিবরণ
ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম)/জেনারেল ম্যানেজার (জিএম), রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স
দায়িত্বসমূহ
রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স টিমকে নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা প্রদান করা, যাতে সব কমপ্লায়েন্স ও ডকুমেন্টেশন কার্যক্রম নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয় এবং সব লাইসেন্স, অনুমোদন ও সংশ্লিষ্ট রেগুলেটরি ডকুমেন্ট যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও ট্র্যাক করা হয়। সরকারি সংস্থা ও শিল্প সমিতির সঙ্গে পরিদর্শন, অডিট, বৈঠক ও ফোরামে কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করা। সংশ্লিষ্ট কারখানাপ্রধান ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে সমন্বয় করে সব লাইসেন্স, অনুমোদন ও রেগুলেটরি ডকুমেন্টের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা।
শিক্ষাগত যোগ্যতা
ব্যবসায় প্রশাসন, পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। কমপ্লায়েন্স বা রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স বিষয়ে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ থাকলে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশে সরকারি লিয়াজোঁ, লাইসেন্সিং বা রেগুলেটরি কমপ্লায়েন্স–সংক্রান্ত কাজে ন্যূনতম ১০ থেকে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা।
বেতন ও সুযোগ-সুবিধা
প্রতিযোগিতামূলক বেতন ও সুযোগ-সুবিধা। ফুলটাইম গাড়ি সুবিধা। প্রভিডেন্ট ফান্ড ও অবসরকালীন সুবিধা। বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধি ও দুটি উৎসব ভাতা।
আবেদন প্রক্রিয়া
আগ্রহী প্রার্থীদের তাঁদের হালনাগাদ সিভি ও কভার লেটার [email protected] ঠিকানায় পাঠাতে হবে। ই–মেইলের বিষয় লাইনে অবশ্যই লিখতে হবে — ‘DGM/ GM, Regulatory Affairs’।
আবেদনের শেষ তারিখ
৩০ অক্টোবর ২০২৫
বিস্তারিত দেখতে ভিজিট করুন
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কমপ ল য় ন স
এছাড়াও পড়ুন:
সাইন্টিফিক বিযিনেস: বাঙালির কলুষিত মনস্তত্ত্ব
বাংলা সাহিত্যে আবুল মনসুর আহমেদ ব্যঙ্গাত্মক রচনার জন্য খ্যাতিমান। ১৩৫০ বঙ্গাব্দের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে তার লেখা ‘ফুড কনফারেন্স’ বইটি বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সংযোজন। পঞ্চাশের মন্বন্তর বোঝার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় একটি দলিল।
সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় বলেন, “আয়না লিখিয়া আবুল মনসুর প্রাতঃস্মরণীয় হইয়াছিলেন আর ফুড কনফারেন্স লিখিয়া তিনি অমর হইলেন।”
আরো পড়ুন:
সারা দেশে সরকারি কলেজে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা মঙ্গলবার
শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন শিক্ষার্থীরা
এই গল্পে লেখক হাস্যরসের মাধ্যমে বাঙালির বাস্তব চরিত্র রূপায়ণ করেছেন। আবুল মনসুর আহমেদের এই তীক্ষ্ম ব্যাঙ্গত্মক রচনার ভঙ্গি বোধ করি খানিকটা পুরান ঢাকা থেকে প্রাপ্ত। তিনি হয়ত তার হাস্যরসের খানিকটা রস পুরান ঢাকা থেকেই পেয়েছিলেন। তার বই ‘আত্মকথা’য় উচ্চ শিক্ষা: ঢাকা নামক অধ্যায় উঠে এসেছে জগন্নাথ কলেজে শিক্ষর্থী থাকাকালে তার পুরান ঢাকার স্মৃতিকথা।
ঢাকাইয়া মানুষের হাস্যরসাত্মক স্বভাব নিয়ে তিনি লিখেন, “.... তাদের মধ্যকার আদি ঢাকাবাসীদের ভাষা ছিল ঢাকাইয়া উর্দু, এরা তাই সবাই ছিল স্বভাব-রসিক। সে রসিকতার উপমা, শব্দবিন্যাস, বাক্য-রীতি, প্রকাশ-ভঙ্গি ছিল অপূর্ব, মৌলিক ও প্রাসঙ্গিক। ঘটনাও পরিস্থিতি যতই আকস্মিক ও অভাবনীয় হউক তার উপযোগী মওকা-মাফিক অদ্ভূত কল্পনা-প্রসূত রসিকতা যেন তাদের ঠোঁটের আগায় সদাপ্রস্তুত থাকিত। ঘটনার আকস্মিকতার মতই তাদের রসিকতার আকস্মিকতাও দর্শক ও শ্রোতাকে তাক লাগাইয়া দিত।” মানুষ তার পারিপার্শ্বিক দ্বারা প্রভাবিত হন, তিনিও নিশ্চয়ই তার ব্যতিক্রম নন।
এবার গল্পে ফেরা যাক। ফুড কনফারেন্স বইটিতে নয়টি গল্প স্থান পেয়েছে। আমরা আজ এই বইটির দ্বিতীয় গল্প অর্থাৎ সাইন্টিফিক বিযিনেস নামক গল্পের উপর আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
এই গল্পের একটি চরিত্র আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তিনি ছিলেন রসায়নবিদ, শিক্ষক। এছাড়াও তার রয়েছে নানাবিধ পরিচয়।
প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ব্যবসা সম্পর্কীত বক্তব্য- “লক্ষ্য স্থির কর। ঝুঁকি নাও। কেবল মুখস্ত বিদ্যার জন্য নয় পড় কারিগরি শিক্ষা অর্জনের জন্য। চাকরি না করে ব্যবসা কর, একটা সমগ্র জাতি শুধুমাত্র কেরানি বা চাকরিজীবী হয়ে টিকে থাকতে পারে না।”
আবুল মনসুর আহমেদ অনেকাংশে প্রফুল্লচন্দ্রের এই ধারণাকে কেন্দ্র করে তার গল্পটি লিখেছেন। তিনি প্রফুল্লচন্দ্রের চরিত্রটিকে বাঙালির হৃদয়ে আলোড়ন তুলতে ব্যঙ্গাত্মকভাবে বেদনাবিধুর আবহে উপস্থাপন করেছেন। ব্যঙ্গাত্মক রচনার একটি বৈশিষ্ট্য হলো- কোনো বিষয়কে বিপরীতভাবে উপস্থাপন করে সত্যকে বোঝানো। লেখক প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং তার ব্যবসায়িক ধারণাকে নিয়ে সেই ভেলকিই দেখিয়েছেন।
গল্পের শুরু হয় এভাবে- “বাঙালি যাত্রা ছিল একটা প্রতিভাশালী জাত। তবে তাদের দোষের মধ্যে মূলত দোষ ছিল, তারা চাকরি ছাড়া আর কিছু বুঝতো না। তেজারতি ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে তাদের খেয়াল ছিল না মোটেই। ফলাফল হলো যা হবার তা-ই, বাঙালিরা পশ্চিমাদের সওদাগরি অফিসের কেরানি ও তাদের দালানের ভাড়াটেরূপে দিন গুযরান করতে লাগল।”
কাজেই এই তামাম বাংলাকে রক্ষা করতে করুণা করে মহামান্য প্রফুল্লচন্দ্রকে খোদা তায়ালা পাঠান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে বুঝতে পারেন যে, অক্সিজেন হাইড্রোজেন একসঙ্গে মিশিয়ে পানি তৈরি করা হয় আর দেশসেবা ও টাকা একত্রে মিশিয়ে সুন্দর মুনাফায় রূপান্তর করা সম্ভব।
লেখক প্রফুল্লচন্দ্রের ব্যবসার ধারণাকে উল্টো করে গ্রহণ করে দুর্নীতি নামক ব্যবসাতে ঝাঁপিয়ে পড়াকে ব্যঙ্গ করে বলেন, “বাঙালি জাতি মূলত দেশপ্রেমিক ও সেবা পরায়ণ জাতি। চিন্তার জগতে এরা আর্ট অর আর্থ সেইকে'র সমর্থক হলেও বিষয়জগতে এরা বিজনেস ফর বিজনেস সেইকে'র সমর্থক নয়। এরা ধর্মের জন্য ব্যবসা, সেবার জন্য ব্যবসা, দেশপ্রেমের জন্য ব্যবসা, কৃষ্টি-সভ্যতা ও মানবতার জন্য ব্যবসা করে ব্যবসার আধ্যাত্মিক রূপায়ণের পক্ষপাতী।”
গল্পে আচার্যের দাবি ভাটিয়া, মাড়োয়ারি অসভ্য জাত। আমরা তা নই। ছোটলোকদের মত দাঁড়ি-পাল্লা নিয়ে আমরা বসবো না। আমরা ইন্টেলেকচুয়াল। কাজেই আমাদের কারবার হবে জনসেবা ও দেশপ্রেমের কারবার। আমরা বিক্রি করব ধর্ম, মানবতা এবং আমাদের ব্যবসার পদ্ধতি হবে যা বলব, তা আমরা করবো না। যেমন- কৃষক-প্রজার সাইনবোর্ড দিয়ে ব্যাংকিং, গো- রক্ষা কমেডি সাইনবোর্ড দিয়ে চামড়ার বিজনেস হবে।
এত কেন তত্ত্ব কথা। লেখক এবার এই তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটান। গল্পের দ্বিতীয় ভাগে আজিজ, নরেন ও ভুঁড়িওয়ালা নামক তিন বন্ধুর আবির্ভাব ঘটে।
আব্দুল আজিজ পেশাই উঁচু পদের সরকারি চাকরিজীবী। তিনি আগে ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের দলের সমর্থক। হক সাহেবের পতনের পর মুসলিম লীগ ক্ষমতায় এলে তার সমর্থনও লীগের দিকে ঝুঁকে যায়।
দ্বিতীয় চরিত্র নরেন্দ্র বসু। পেশায় ডাক্তার। তিনি লীগকে অসহ্য জ্ঞান করেন। কারণ নরেন ঘোরতর জাতীয়তাবাদী। তিনি সাম্প্রদায়িকতাবাদী লীগ মন্ত্রীদের কুকীর্তির অভিযোগ করেন হিন্দুসভার কাছে।
অর্থাৎ প্রথম এই দুই বাঙালি চরিত্রে এক ধরনের কপটতা পরিলক্ষিত হয়। প্রথমজনকে বলা যায় রাজনৈতিক সুবিধাভোগী। আর দ্বিতীয় জন অসাম্প্রদায়িকতার মুখোশে ঘোরতর সম্প্রদায়িক। এই দুই চরিত্রই অধিকাংশ বাঙালির জুতসই প্রতিনিধি।
তৃতীয় চরিত্র হলো রুপারচাঁদ সোনারচাঁদ ভুঁড়িওয়ালা, পেশায় ব্যবসায়ী। সে নিজে গোমাতার ভক্ত ও হিন্দুসভার সমর্থক। তবে মুসলিম লীগের প্রতি তার কোনো বিদ্বেষ নেই। উপরন্তু ‘রায় সাহেব’ খেতাব পেলে লীগকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা দেওয়ার মনোবাঞ্ছা ব্যক্ত করেন। অর্থাৎ এই চরিত্রে পুরোপুরি ব্যবসায়িক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে। তার মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও নিজের স্বার্থ এর থেকে সেটি বড় নয়। মতাদর্শ নিয়ে সে হম্বিতম্বি করতে নারাজ।
একদিন আজিজ ও নরেন প্রফুল্লচন্দ্রের ব্যবসা সম্পর্কিত বক্তৃতা শুনে সে বিষয়ে বিস্তর আলাপ জুড়েছেন। প্রফুল্লচন্দ্রের বক্তৃতায় তারা অত্যন্ত উত্তেজিত। মাড়োয়ারি বাটারা বাংলা মুল্লুকের সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করে বসে আছে। বড় বড় বাজার দালানকোঠা সমস্ত তাদের দখলে।
নরেনের ভাষায়, “শালারা আমাদের দেশটা লুটে খাচ্ছে।” এমন সময় মাড়োয়ারি ভুঁড়িওয়ালার আবির্ভাব। তাকে দেখেই তারা চুপ। কিন্তু কোনো ফায়দা নেই। অতি চালাক মাড়োয়ারি নিজেও জনসভায় ছিলেন এবং তাদের দেখেছেন এবং সন্দর্পনে তাদের সব কথাও শুনেছেন।
মাড়োয়ারি স্বীকার করেন, প্রফুল্লচন্দ্র যা বলেছেন মারওয়ারীরা বাংলা মুল্লুক লুটপাট করে খাচ্ছে, এ কথা হক। এমন উদারতা দেখে নরেন ও আজিজ খানিকটা অবাকই হন। যাই হোক ভুঁড়িওয়ালা নরেন বাবুকে হাসপাতালের রোজকার চাল, ডাল, আটা, দুধ, ফল ইত্যাদি সাপ্লাই দেওয়ার কারবার অন্য কাউকে না দিয়ে নিজের নাম গোপন করে কন্ট্রাক্ট নেওয়ার পরামর্শ দেন এবং আজিজ সাহেবকে তার সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের দু’চারটা কারবার হাতিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন। সঙ্গে পুঁজি দিয়ে সহায়তাও করতে চান। অর্থাৎ দুটো ব্যাবসায়িক ধারণায় বেশ খানিকটা অসাধুতা বিদ্যমান।
তারা দুজনেই মাড়োয়ারি ভদ্রলোকের প্রস্তাবনা যথাসাধ্য অশ্রদ্ধার সঙ্গে ছুড়ে ফেলে দেন। কারণ হিসেবে উল্লেখ্য, এসব ব্যবসায় লোকসানের সম্ভাবনা আছে। আবার ভুঁড়িওয়ালা যে তাদের পুঁজি দেবে, সে দেনার দায়ে তাদের ব্যবসা হাতিয়ে নেওয়ার একটা চক্রান্তের সম্ভাবনাও আছে। কাজেই তারা এমন ব্যবসা করবে যেখানে লোকসানের কোনো সম্ভাবনা নেই। এ শুনে ভুঁড়িওয়ালার আক্কেল গুড়ুম। এমন ব্যবসাও হয়!
নরেন এর কাছ থেকে জবাব আসে, “সেটা বাঙালির মধ্যে একচেটে ব্যাপার মাড়োয়ারি বা কোনো অবাঙালির মাথায় সেটা ঢুকবে না।”
নরেন করবে, হাসপাতালের রোগীর পথ্য, দুধ রুটি, মাখন পেছনের দরজা দিয়ে পাচার। আর আজিজ করবে, সরকারি কাজে এন্তার দুর্নীতি। এই হলো তাদের পুঁজিহীন ব্যবসা যা বাঙালির পেটেন্ট করা কায়দা। বাঙালির ব্যবসা বিষয়ক ফন্দি ফিকির শুনে, ধন্য বাঙালিকা মগজ! হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টু-ডে, ইন্ডিয়া থিংকস টু মরো। রাম রাম বাবুজি রাম রাম- বলে অসাধু বন্ধুসঙ্গ ত্যাগ করেন।
আজিজ ও নরেন তার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে নিখিল বঙ্গ বণিক-সংঘ গঠন করেন। এ সংঘ নিছক ব্যবসার জন্য ব্যবসা করে না, ধর্ম, সেবা, জনসেবা, দেশ সেবার নামে ব্যবসা চালায়। বিনা মূলধনে ব্যবসা করে।
রাতারাতি কেরানির জাত বাঙালি ব্যবসায়ীর জাতে পরিণত হয়। স্কুল, কলেজ, আদালত, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, রাস্তাঘাট সবখানে এই দুর্নীতি নামক বিনা পুঁজির ব্যবসা চলতে থাকে। এক পর্যায় দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ না খেয়ে মারা যায়। অন্যদিকে, এই দুর্নীতি বাড়তে থাকে।
দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেখা দিলে, গঠন করা হয় রিলিফ কমিটি, সেবা সমিতি, হাসপাতাল, ফ্রি কিচেন, সৎকার সমিতি ও জানাজা আঞ্জুমান। এর মাধ্যমে বাঙালির ব্যবসা আরো প্রসারিত হলো।
যুদ্ধের সময় যেমন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। যুদ্ধ মানেই অর্থের ঝনঝনানি। অর্থ লুটপাতের এক মহা কর্মযজ্ঞ। তেমনি দুর্ভিক্ষও এর ব্যতিক্রম নয়। দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হলো, সেগুলো মূলত লুটপাটের সুযোগ আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল। এমনকি মৃত মানুষকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়ে পোড়ানো ও দাফন খরচ আদায় করা হয়।
এখানে মূলত বাঙালির অধঃপতনের চূড়ান্ত সীমানা অঙ্কিত হয়েছে। চরম দুরবস্থাকালীনও যে বাঙালি চরম অমানবিকতার পরিচয় দিয়ে থাকে, তা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে আবারো বিকট দৈত্যের মতো প্রতিয়মান হয়েছে।
এভাবে বাঙালি জাতি নিজের ধ্বংস ডেকে আনে। প্রথমে আজিজ ও নরেনের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব বেঁচে থাকলেও। শেষমেষ সবাই নিঃশেষ হয়ে যায়। কাঁদবার জন্য পর্যন্ত কেউ আর বাকি থাকে না।
এবার গল্পে আসে অতি নাটকীয়তা। দুনিয়ার কেয়ামত হয়ে গেছে। সমস্ত মানুষ হাশরের ময়দানে উপস্থিত। এবার মহান আল্লাহ বাঙালি জাতিকে তার দুর্নীতি, অনিয়মের দায়ে জাহান্নামে নিক্ষেপের আদেশ দেন। কিন্তু কবি রবীন্দ্রনাথ বাদ সেধে বসেন।
রবি ঠাকুরের যুক্তি, “একের দোষে তুমি ১০ জনকে সাজা দিয়ে ন্যায়ের মর্যাদা নষ্ট করতে পারো না।” আরশের মালিক আল্লাহ যুক্তি দেখান স্বয়ং রবি ঠাকুরের কবিতা থেকেই-
“অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা দোঁহে যেন সমভাবে দহে।”
এখানে লেখক বাঙালির দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্বল উভয় চিত্তে তীক্ষ্মভাবে আঘাত হেনেছেন।
এরপর বিখ্যাত আইনজীবী রাসবিহারী ঘোষ বলেন, “বাঙালির অপরাধ নেই, মি. লর্ড। তারা খুশি ঘোশালেতে কেরানিগিরি ও চাপরাশিগিরি করে খাচ্ছিল। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রই যত গোলমাল বাধান। ....... শাস্তি যদি কারো পেতে হয়, তবে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের পাওয়া উচিত।”
এখানে আমাদের বাঙালিদের কল্যাণকারীর উপর অন্যায্য আরোপ এবং তাকে শাস্তির মুখে দাঁড় করানোর যে খাসলত, তা ব্যঙ্গাত্মকভাবে অঙ্কিত হয়েছে।
প্রফুল্লচন্দ্রকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আনা হলো। কিন্তু এবার আপত্তি করলেন হক সাহেব। তার যুক্তি খোদা তায়ালার হুকুম ছাড়া একটি গাছের পাতাও নড়ে না। কাজেই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বাঙালি জাতিকে তেজারতি শেখাতে গেছিলেন খোদা তায়ালার ইচ্ছাতেই। একথা শুনে আল্লাহ তায়ালা তাকে শাস্তি দেওয়া থেকে নিবৃত হন এবং বলেন, “বাঙালি জাতকে দোযখের আগুন থেকে রেহাই দেওয়া হলো। বেহেশতে তাদের জায়গা হবে। কিন্তু বেহেস্তে তাদের কোন শরাফৎ (মর্যাদা) দেওয়া হবে না। তারা শুধু বেহেশতের কেরানিগিরি ও চাপরাশিগিরি করবে এই আমার রায়।”
এ দায়িত্ব পেয়ে বাঙালিরা বেহেস্তে। কিন্তু তাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হলো, সেখানেও শুরু হল অনিয়মা-দুর্নীতি। দোজখবাসীদের অনেককে বেহেস্তের গেট পাশ দেওয়া হলো। বেহেস্তের মাওয়া, শরবত পেছনে দরজা দিয়ে দোজখে পাচার করা হয়। অর্থাৎ ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। বাঙালিকে করুণা করে সুখ ভোগের ব্যবস্থা করে দিলেও সে অনিষ্ট করতে কসুর করবে না। অবশেষে খোদা তায়ালা বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার হুকুম দেন।
লেখক গল্পের শেষ চরণে উচ্চারণ করেন সবচেয়ে তীক্ষ্ম, ব্যাঙ্গত্মক এবং বেদনাদায়ক বাক্যটি- “বাঙালি জাত যেখানে যেখানে বাস করেছে, হাইজিনিক মেম্বার হিসেবে, সেই সব জায়গায় বেশ করে ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দাও।”
এই গল্প শুধু ১৩৫০ এর দুর্ভিক্ষের কথা অঙ্কিত হয়নি। মূলত এই গল্পে সামগ্রিকভাবে বাঙালির মনস্তত্ত্ব ধরা পড়েছে। অদ্যাবধি সেই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন সাধনা বাঙালির মধ্যে হয়নি।
এখনও আমরা দেখতে পাই, ব্যবসা-বাণিজ্যে বাঙালির প্রবল অনীহা। মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে অসাধু উপায়ে চাকরিতে নিতে আমরা কসুর করি না। অথচ সেই টাকা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করলে হয়তো ভাগ্যের চাকা ঘুরত কয়েকগুণ বেশি গতিতে। চাকরি নেওয়ার পরে শুরু করে বাণিজ্য, হরেক রকমের বাণিজ্য, রমরমা বাণিজ্য!
অনেকে আবার এর বাইরে থেকেই করছেন ধর্ম ব্যবসা, জনসেবা ব্যবসা। এলাহি তাদের কারবার। ঐতিহাসিকভাবেই যেন এ দেশ ‘সাইন্টিফিক বিযিনেস’ এর দেশ।
(লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)
ঢাকা/মেহেদী