সর্বাত্মক ফ্যাসিবাদ কায়েম হয় ২০১৪ সন থেকে: সলিমুল্লাহ খান
Published: 13th, October 2025 GMT
সলিমুল্লাহ খান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘বাংলাদেশ: জাতীয় অবস্থার চালচিত্র’, ‘বেহাত বিপ্লব ১৯৭১’, ‘আদমবোমা’, ‘স্বাধীনতা ব্যবসায়’, ‘প্রার্থনা’, ‘ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়’, ‘উৎসর্গ’, ‘গরিবের রবীন্দ্রনাথ’ এবং ‘আ মরি আহমদ ছফা’। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৩-৮৪), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (১৯৮৪-৮৬) দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর পড়াশোনা আইনশাস্ত্র, ধ্রুপদি অর্থশাস্ত্র, ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণ, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, ইতিহাস ও সাহিত্য বিষয়ে। তিনি ১৯৫৮ সালে কক্সবাজার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শাহেরীন আরাফাত।
শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ কোন পর্যায়ে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হলেন? আর তা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল?
সলিমুল্লাহ খান: এই প্রশ্নের উত্তর দুই ভাগে দেওয়া যায়। এটা বলতে গেলে শুরু করতে হবে ১৯৭২ সন থেকে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে জনগণের যে আকাক্সক্ষা তৈরি হয়, সেটা হচ্ছে স্বাধীনতা আর স্বাধীনতার পর সমাজে সামাজিক বৈষম্যের অবসান। কিন্তু বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের মধ্যে আওয়ামী লীগের যে প্রথম সরকার বাংলাদেশ পরিচালনা করেছে সেই সরকার চরিত্রের দিক থেকে ফ্যাসিবাদী ছিল। কিন্তু মানুষ এই শব্দটা উচ্চারণ করতে ভয় পেয়েছে।
আরো পড়ুন:
ছাত্র-জনতাকে রাজাকার উপাধি দেওয়ায় হাসিনাকে পালাতে হয়েছে: মামুনুল হক
দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু
১৯৭২ সনের সংবিধান, যেখানে তারা মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত আদর্শ, ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারে’র সঙ্গে প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা করে। অর্থাৎ এই আদর্শের কোনো উল্লেখ সংবিধানে ছিল না। তার জায়গায় কতগুলো শব্দ এনে বসিয়েছে, যেগুলো প্রায় অর্থহীন। যেমন জাতীয়তাবাদ। ক্ষুদ্র জাতিগুলোকে নিপীড়ন করা ছাড়া একটা স্বাধীন দেশে জাতীয়তাবাদের ভূমিকা কী? দ্বিতীয়ত, তারা এনেছে সমাজতন্ত্র; এটা ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ ধরনের কথা। সারা বিশ্বে তখন অনেকেই সমাজতন্ত্রের কথা বলেছে। উদাহরণ হিসেবে ভারতের কথাই ধরা যাক। তখন ভারতও বলেছে, ‘আমরা সমাজতন্ত্রের পথে’। এমনকি মিশরে নাসেরও বলেছেন, ‘আমরা সমাজতন্ত্রের পথে।’ এগুলো সব গালভরা বুলি। তারপর এনেছে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য আমাদের আছে; সেটাকে বলে ধর্মীয় সম্প্রীতি, সহনশীলতা। এটা না বলে তারা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কথাটা এমনভাবে আনলেন, যাতে মনে হতে পারে বা অনেকে এটার ব্যাখ্যা করবে যে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে রাষ্ট্র ধর্মহীন হবে। ব্যাখ্যাটা সঠিক নয়। কিন্তু এই সুযোগটা তারা রেখে দিলেন। পরিশেষে থাকে গণতন্ত্র। গণতন্ত্রকে তারা কার্যত ১৯৭৩ সনে হত্যা করলেন। ১৯৭৩ সনের নির্বাচন ছিল ‘ম্যাসিভ রিগড নির্বাচন’। এমন বিজয়ের দরকার ছিল না আওয়ামী লীগের। তারা ৩০০ আসনের মধ্যে প্রায় ২৯৩ আসনে কেড়ে ভোট নিল। আপনি বলতে পারেন, কেড়ে না নিলেও তো তারা জিতত। কিন্তু একটি ভোটও যদি কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে গোটা নির্বাচনই নষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় খন্দকার মোশতাক কী করে দাউদকান্দি আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি হেরে গিয়েছিলেন। হেলিকপ্টারে করে ভোট বাক্স নিয়ে এসে ঢাকায় তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। এরকম শত শত কেড়ে নেওয়া ভোট হয়েছে দেশে। শেখ মুজিবের আমলের প্রথম নির্বাচনটাই হয়েছে আপনার জালিয়াতি নির্বাচন।
তারপর দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। দেশে তাঁকে জরুরি অবস্থা জারি করতে হলো এবং শেষ পর্যন্ত এক পার্টিতে যেতে হলো। সেইসঙ্গে তাদেরই রচিত সংবিধান এমনভাবে সংশোধন করা হলো, যেটা বাতিলের সমপর্যায়ে পড়ে। তারা একদলীয় ব্যবস্থা করলেন। এটাই ফ্যাসিবাদের প্রথম প্রমাণ। তখন তারা জগদ্বিখ্যাত ফ্যাসিবাদী স্লোগান দিলেন―‘এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ।’ এটাই আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদ তৈরির প্রথম চেষ্টা। এটা তার প্রবণতার মধ্যে, তার অস্তিত্বের মধ্যেই আছে। সে একদলীয় শাসন করতে চায়। দেশে একটাই নেতা চায়, গণতন্ত্র চায় না। আর এর পরিণতি তারা ভোগ করলেন, বিয়োগান্ত উপায়ে শেখ মুজিব ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হলেন। তখন শেখ মুজিবের পক্ষে সমবেদনা জানাবার জন্য দেশে একটি মানুষও পাওয়া যায়নি। তার মানে সেই শাসনকে মানুষও প্রত্যাখ্যান করেছে। এটাই হচ্ছে প্রথম পর্যায়।
দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ যখন আবার ক্ষমতায় এল, তখন তার সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। তারা আ স ম আব্দুর রবের মতো ভিন্ন দলের নেতাকেও দলে টেনে সরকার গঠন করতে সক্ষম হলেন। তখনও তারা এমন সব অপশাসনের সূচনা করলেন যে পরবর্তী নির্বাচনে পরাজিত হলেন। তারা সঠিক সিদ্ধান্তটা নেননি। তারা বারবার বলেছেন, তাদের হটিয়ে দেওয়া হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথার মাধ্যমে। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য তারাই আন্দোলন করেছেন ১৯৯৫-১৯৯৬ সনে।
১৯৯০ সনের গণঅভ্যুত্থানের পর যে নতুন নির্বাচন হয়, তাতে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দলে পরিণত হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে বিএনপি নিজে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টায় নির্বাচনে কিছু কিছু রিগিং করে। বিশেষ করে মাগুরার উপ-নির্বাচনে। তখন থেকে একে কেন্দ্র করে যে নতুন আন্দোলন হয়, তার জোরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তখনই এ দলের মধ্যে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা দেখা দেয়। মুক্তিযুদ্ধকে একমাত্র অবলম্বন করা ছাড়া তার আর কোনো মূলধন ছিল না। কারণ জনগণের জন্য কোনো কল্যাণমূলক কাজ তাদের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। তারা বরং বৃহৎ পুঁজিপতিদের, আন্তর্জাতিক পুঁজিপতিদের, সবচেয়ে দুঃখজনকভাবে পাশের দেশ ভারতের তোষামোদ এবং তাঁবেদারি শুরু করলেন। বিদেশি শক্তির তাঁবেদারি করাটা আমাদের মতো দেশে গণতন্ত্রহীনতার অন্যতম কারণ। আর জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে দেশকে অন্য দেশের এজেন্ট হিসেবে শাসন করার প্রবণতাও ফ্যাসিবাদের লক্ষণ; বিশেষ করে বর্তমান যুগে অনুন্নত দেশে।
অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে ২০০৯ সনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এল, তার মধ্যে এই প্রবণতা সাংঘাতিকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ইতোমধ্যে দেশে ধনতন্ত্রের বিকাশ হচ্ছে, নতুন পুঁজিপতি গোষ্ঠী গড়ে উঠছে। এই পর্যায়ে ফ্যাসিবাদের উত্থানের পেছনে প্রথমে যে উপাদান আমলে নিতে হবে, সেটা হলো নতুন ধনতান্ত্রিক গোষ্ঠীগুলোর উদ্ভব, যারা আইনবহির্ভূত পথে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে বিপুল ধনসম্পদ হাতিয়ে নিয়েছে এবং এখনো নিচ্ছে। এটা হলো ফ্যাসিবাদের সামাজিক ভিত্তি। তার আদর্শগত ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেছে মুক্তিযুদ্ধকে― আমরাই একমাত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আর কেউ মুক্তিযুদ্ধ করে নাই; সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক মালিকানা একমাত্র আমাদের। তার একটা বহিঃপ্রকাশ হয় সেই বিখ্যাত স্লোগানে ‘আমার বাপ দেশটা স্বাধীন করে দিয়ে গেছে।’ এটার মানে ভেবে দেখলে শিউরে উঠতে হয়। অর্থাৎ দেশের পা থেকে মাথা পর্যন্ত যে বিশাল জনগোষ্ঠী, তাদের অবদানকে প্রকারান্তরে অস্বীকার করা। কারণ জনগোষ্ঠী ছাড়া কোনো নেতা হতে পারে না। তিনি বলছেন ‘আমার বাবাই সবটুকু করেছেন,’ অথবা তিনি বলেছেন, অন্য সকলের অবদানের চেয়ে আমার বাবার অবদান বেশি; কিন্তু প্রকৃত সত্যটা কী? শেখ মুজিব ১৯৭১ সনের পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে প্রথম রাতেই আত্মসমর্পণ করেন। এই ঘটনার ব্যাখ্যা কিন্তু এখনো আমাদের সামনে হাজির হয়নি। এটা এখন অবিসংবাদিত সত্য যে, তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নাই। তিনি গণবক্তৃতা দিয়েছেন, ‘এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’ এ ধরনের কথা কবিরা বলেন। এটা রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য নয়। স্বাধীনতার কোনো ঘোষণাপত্রে তিনি স্বাক্ষর করেননি বা কোনো ঘোষণা রেকর্ড করেননি। ইতিহাস তা-ই বলে।
১৯৭২ সনে তিনি সংবিধান রচনা করলেন, দেশ শাসন করলেন। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। যুদ্ধের সময় তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করা হয়েছিল― অনুপস্থিত রাষ্ট্রপতি। এজন্য একজন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি দেওয়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। তাতে কী প্রমাণ করে? তিনি বন্দী ছিলেন। তিনি কি পালিয়ে যাওয়ার সময় ধৃত হয়েছিলেন? না, তিনি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন। আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা এটা― স্বাধীনতা যুদ্ধের যিনি সর্বজনসম্মত নেতা, তিনি সর্বজনের মতামতের অপেক্ষা না করে, কারো মত না নিয়ে, পলিটব্যুরো বা কেন্দ্রীয় কমিটির মত না নিয়ে একাই সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আত্মসমর্পণ করবেন। অন্যদিকে তাঁর ঘনিষ্ঠতম প্রতিনিধিরা পালিয়ে ভারতে চলে গেলেন। দেশের ভেতর থেকে তাঁরা প্রতিরোধ আন্দোলন রচনা করতে পারেননি। এই প্রতিরোধ করেছেন তারাই যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন― পুলিশ, তৎকালীন ইপিআর, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সাধারণ ছাত্র ও যুবসমাজ এবং কোনো কোনো ছোট রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ বড় দল হিসেবে কোথাও প্রতিরোধ রচনা করতে পারেনি। যারা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন, তারাও অংশগ্রহণ করেছেন। তারা তো আওয়ামী লীগের লোক না। তারা দেশের জনগণ। আওয়ামী লীগ কার্যত মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেছে।
আওয়ামী লীগের যে স্বৈরাচার তৈরি হয়েছে ১৯৭২ সনে, শেখ হাসিনা তাকে কাজে লাগানো শুরু করেছেন ২০০৯ সনে। তাঁর ক্ষমতায় আসার দুই মাস না যেতেই আমাদের পিলখানায় হত্যাকাণ্ড হলো― বিডিআর বিদ্রোহ। সেটার কোনো তদন্ত প্রকৃত প্রস্তাবে হয়নি। তাতে বোঝা যায়, তখন থেকে সূত্রপাত হলো একমুখী স্বৈরাচারের। তখন মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে তিনি নিজের নৈতিক বৈধতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেন। অর্থনৈতিক বৈধতা প্রতিষ্ঠার করার চেষ্টা করলেন তথাকথিত উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সেটাও হয়েছে বিদেশ থেকে আনা ঋণের মাধ্যমে। প্রথমে বিশ্বব্যাংকের সাথে চেষ্টা করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক যখন বিমুখ হয়েছে, তখন চীন, জাপান এবং অন্যদের সহায়তায় দেশে নানা উন্নয়ন প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। এটা আন্তর্জাতিক পুঁজির কারণেই হয়েছে। তারা তাদের পণ্য বিক্রির জন্য এখানে পথ খুলবে। পাশের দেশ ভারত চায় ট্রানজিট, সেটিকে তারা নানা রকমের নতুন নামকরণ করেছে।
এই বিদেশি শক্তির আজ্ঞাবহ শাসক হিসেবে আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের ওপর দমননীতি চালিয়েছে এবং নতুন নতুন ছুতা তৈরি করেছে। উদাহরণস্বরূপ জঙ্গি ছুতা। আবার যে যুদ্ধের বিচার শেখ মুজিব বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের মধ্যে করেন নাই, সেই বিচারের দাবিতে যখন দেশের মানুষের মধ্যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় নাই। জাহানারা ইমামের অনুসারীরা যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন; তাঁর নেতৃত্বে তার নাম দেওয়া হয় ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। ঐ কমিটিকে সমর্থন করে আওয়ামী লীগ। প্রকারান্তরে যাকে ব্যবহার করে তারা ফায়দাটা লুটেছে। এরপর ২০০৯ সনের পর হাসিনা এই বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য ট্রাইবুনাল গঠন করলেন এবং সেই ট্রাইবুনালকে তিনি নিজের ক্ষমতায় থাকার বৈধতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলেন। এটাও তার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার আরেকটা পদক্ষেপ। শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সনে যে তিনি হেরে গিয়েছেন, সেটা আমরা সকলে দেখেছি চোখের সামনে। তার প্রমাণ, তিনি ছলেবলে কৌশলে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসন আগেই জিতে নিয়েছেন। কোনো দেশে যখন নির্বাচনে অংশগ্রহণের মতো প্রার্থী পাওয়া যায় না, তখন নির্বাচন বাতিল করতে হয়। যদি ১৫৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো লোক না থাকে, তাহলে বোঝা যাচ্ছে সেই নির্বাচনে জনগণের আগ্রহ নেই। তাহলে সেই নির্বাচন আপনা-আপনি বাতিল বলে গণ্য হবে যেকোনো আন্তর্জাতিক আইনের নিয়ম বা প্রথা অনুসারে। শেখ হাসিনা সেটাকে তাঁর ‘বিজয়ের বরমাল্য’ গণ্য করেছেন।
আমি মনে করি, ফ্যাসিবাদ পুরোপুরি কায়েম হয়েছে এই ২০১৪ সন থেকে। এরপর ২০১৮ সনে কোনো নির্বাচনই হয়নি। যেটা হয়েছে, সেটা সম্পূর্ণ একটি প্রহসন এবং পরিষ্কার অর্থে এটা হলো পূর্ণ ডাকাতি। অন্য নির্বাচনগুলোকে আমরা বলি আংশিক ডাকাতি। আর ২০২৪ সনের নির্বাচনের কথা না বললেও চলে, ওটা কোনো নির্বাচন নয়। তাহলে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪― এই তিনবার নির্বাচনে তিনি অনির্বাচিত। আমি মনে করি, শেখ হাসিনার সরকার ২০১৪ সন থেকেই অবৈধ। অর্থাৎ তিনি গায়ের জোরে, রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও অ-রাষ্ট্রীয় প্রাইভেট বাহিনীর জোরে ক্ষমতায় থেকেছেন। এই ধরনের ক্ষমতাকেই ইউরোপের ইতিহাসে ‘ফ্যাসিবাদ’ বলা হয়েছে। ফ্যাসিবাদ বলার আরেকটা কারণ হচ্ছে, সে বাইরে একটা জনসমর্থনের মুখোশ (ভধম্ফধফব) তৈরি করে। জনসমর্থনের একটা বারান্দা তৈরি করে। মনে হবে যেন জনগণ তাঁকে চায়।
জাতীয়তাবাদের স্লোগানটাই এখানে ফ্যাসিবাদের প্রধান তাত্ত্বিক হাতিয়ার। বাংলাদেশে সেটা হয়েছে শাহবাগ আন্দোলনে। হাসিনা ২০০৯ সনের নির্বাচনে হয়তো কৌশলে জিতেছে। এরপর নিজের ক্ষমতাহীনতাকে ঢাকবার জন্য ২০১৪ সনের নির্বাচনের আগে তারা দুটো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। একটা হলো সংবিধানের সংশোধনী, যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথাÑ যার বলে তারা ক্ষমতায় এসেছেন, সেই ধারাই বাতিল করলেন। যে গাছের ডালে আপনি বসেছেন, সেই ডালটাই কাটলেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা একদলীয় সিদ্ধান্তে বাতিল করার মতো জিনিস নয়। যেহেতু এটা একদলীয় সিদ্ধান্তে হয়নি, এটা কায়েম হয়েছিল ১৯৯১ সনে একবার, আবার ১৯৯৬ সনে আপসের মাধ্যমে। উভয় ক্ষেত্রেই এ দেশের প্রধান প্রধান সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে এটা বাতিলও হতে পারত। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের যে রায়ের নাম দিয়ে এটা বাতিল করা হয়েছে, সেখানেও বলা ছিল, ইচ্ছা করলে জাতীয় সংসদ আরও দুইবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন করতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচনটা আইডিয়াল নয়, এটা হলো সংকটের নিদান, সংকট মোচনের একটি উপায়। কিন্তু সেটা করা হয়েছে একদলীয়ভাবে, হাসিনার কৃত্রিম বিজয়ের মাধ্যমে যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা, তার জোরে সংবিধানের পরিবর্তন করা হয়েছে। সংবিধান এমন জিনিস নয়, যেটা নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পরিবর্তন করা যায়। তাঁর সেই প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংসদে ছিল কিন্তু নৈতিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। গাণিতিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও নৈতিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাঁর ছিল না। এটাই ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার ভিত্তিমূল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে হাসিনা বুঝিয়ে দিলেন, আমি ক্ষমতা থেকে কখনো আর নামব না। যারা নামতে এই ধরনের অস্বীকৃতি জানায়, ইতিহাস দেখিয়েছে, তাদের পতন অবশ্যই বিপ্লবের মাধ্যমে হয়। বর্তমানে যেই ঘটনাকে আমরা আলোচনা করছি― ২০২৪ সনের জুলাই-আগস্টের ঘটনা; এটা ঠিক কোন তারিখে ঘটবে, মানুষ বলতে পারেনি। এটাই বিপ্লবের লক্ষণ। বিপ্লবকে আগে থেকে দিনক্ষণ বলে দেওয়া যায় না। এখনো অনেকে বলতে চাচ্ছেন, এটি কি ষড়যন্ত্র, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র বা সামরিক অভ্যুত্থান? প্রাসাদ ষড়যন্ত্র দিনক্ষণ ঠিক করে হয়, সামরিক অভ্যুত্থান দিনক্ষণ ঠিক করে হয়। এটা যে তা নয়, এর প্রমাণ এর দিনক্ষণ কেউ জানত না।
ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
সলিমুল্লাহ খান: ফ্যাসিবাদ যে অপকৃতি রেখে গেছে, তার একটা হলো, সে দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজকে নষ্ট করেছে, দেশের সংস্কৃতি নষ্ট করেছে, দেশের সভ্যতা নষ্ট করেছে। শুধু নষ্ট করে ক্ষান্ত হয় নাই, সে যে মাঠ রেখে গেছে পেছনে, তা বিরানভূমি। সে শুধু বর্তমান পুরুষকে শেষ করে নাই, ভবিষ্যৎ পুরুষকেও শেষ করে দিয়েছে। এতে আমার ভয় হয়, ভবিষ্যতেও আমার দেশে জ্ঞানী-গুণীর উদ্ভব খুব দ্রুত হতে পারবে না। আওয়ামী লীগ স্বপ্ন দেখেছিল ২০৪১ সন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে। ২০৪১ বা ২০৫০ সন পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো সভ্যতার উদয় হবে কি না, সেটা নির্ভর করে পরবর্তীকালে আমরা কী প্রোগ্রাম গ্রহণ করছি তার ওপর।
হাসিনার আমলে আমরা যারা প্রাণরক্ষার জন্য পালিয়ে গিয়েছিলাম, আত্মগোপনে ছিলাম বা নিজের মনের কথা না বলে অন্য কথার ভান করছিলাম টিকে থাকার জন্য, শুধু প্রাণ বাঁচাবার জন্য, এই পত্রিকায় সেই পত্রিকায় চাকরি করছিলাম, আসল কথা না বলে, এরপর এখন গর্ত থেকে সব শিয়ালের মতো আমরা বেরিয়ে আসছি, আমরা কিন্তু দেশের সেরা লোক নই। কারণ এই ধরনের অত্যাচারের ফলে মানুষের চরিত্র বহুলাংশে নষ্ট হয়। আমাদেরও কিছুটা নষ্ট হয়েছে। এ জন্য ফ্যাসিবাদ যে ক্ষতি করে গেছে, তার ফলাফল এখনো পরিষ্কার হচ্ছে না, পরিষ্কার হতে আরও সময় লাগবে। তবে এই ক্ষতি ভয়াবহ!
ফ্যাসিবাদ পাঠ্যপুস্তকের ক্ষতি করেছে, লেখাপড়ার ক্ষতি করেছে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে। এ দেশের নতুন ধনিকশ্রেণি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ক্রমশ নিম্ন থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত ইংরেজি মাধ্যমে নিয়ে গেছে। তারা যে জাতীয় ভাষাকে, জাতীয় সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত করছে, ধ্বংস করছে― এটা কেউ বুঝতে পারছে না। এটা ফ্যাসিবাদের প্রথম সাংস্কৃতিক ফলাফল।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে এ দেশের মানুষ কার্যত গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই খারিজ করেছে, কারণ এই রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যেই ফ্যাসিবাদ বিদ্যমান। কথাটা আপনি অনেক আগে থেকেই বলে এসেছেন। গণঅভ্যুত্থানের পর এখন ফ্যাসিবাদের রূপটা কেমন?
সলিমুল্লাহ খান: এ প্রশ্নের উত্তর একটু ঘুরিয়ে বলতে হয়। গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে খারিজ করেছে― কথাটা আমরা আমাদের মতো ব্যাখ্যা করে বলছি। কিন্তু আন্দোলনকারীদের চোখে সেটা এমন ছিল না। তারা মনে করেছিল প্রথমে কোটা সংস্কার করতে হবে অথবা রাস্তাঘাটের সংস্কার করতে হবে। ২০১৮ সনে অনেক ছাত্র মারা গেল বাসে পিষ্ট হয়ে। তখন কয়েকটা আন্ডারপাস বা কয়েকটা ওভারব্রিজ করলে সমস্যার সমাধান হবে বলে ঠিক করে ফেললাম আর মেনে নিলাম। স্কুলের ছাত্ররা কয়েকদিন রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করল। লক্ষ্য করার বিষয় কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থার কিছুই বদলায় নাই। পরবর্তীকালে ২০১৮ সনে কোটা সংস্কার আন্দোলন হলো। সেটাকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারল। এইবারও তারা মনে করেছেন, নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। কিন্তু এবার তারা পারলেন না। এবারের আন্দোলনে বরং ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে মানুষের যে ন্যায়সঙ্গত বিক্ষোভ জমা হয়েছিল, সেটারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ‘এক দফা এক দাবি, হাসিনা তুই কবে যাবি?’― এটাই ছিল মূল স্লোগান।
রাষ্ট্রব্যবস্থাকে যদি সত্যিই তারা খারিজ করতে পারতেন, দেশে বিপ্লবী সংগঠন উপস্থিত থাকত। বিপ্লবের চরিত্র হলো স্বতঃস্ফূর্ততা, স্পন্টেনিটি মানে আকস্মিকতা। আকস্মিক মাত্রই বিপ্লব নয়, কিন্তু বিপ্লব মাত্রই আকস্মিক। যেমন পশু মাত্রই মানুষ নয়, মানুষ মাত্রই পশু; সে ভিন্ন ধরনের পশু। আকস্মিকতা হচ্ছে বিপ্লবের একটি লক্ষণ। এটা যে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, সামরিক অভ্যুত্থান বা নিছক বিদ্রোহ না, তার প্রমাণ হলো এর দিনক্ষণ কেউ জানত না। এমনকি যারা বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারাও জানতেন না। তাদের কথা থেকেই তা বোঝা গেছে। বিপ্লবের পর আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিপ্লবের যারা সন্তান, তাদের বিপ্লব এতই শক্তিশালী যে, মূল যে আদর্শের জন্য বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল অর্থাৎ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে খারিজ করা― সেটাকেও এখন ধ্বংস করেছে। বিপ্লবের শক্তি, তার তোড় বন্যার জলের মতো এত বেশি যে, যে আদর্শ নিয়ে বিপ্লব শুরু হয়েছিল, সেটাও মানুষ ভুলে গেছে এখন। এখন সবাই গিয়ে নুন-খাওয়া মুরগির মতো ঝিমাচ্ছে। এখনও পুরাতন রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ন। প্রথম প্রমাণ হচ্ছে, তারা দেশের আমলাতন্ত্রকে স্পর্শ করেনি। উপরদিকে অপরাধী দুয়েকজনকে সরিয়েছে মাত্র। দ্বিতীয়ত, দেশের সামরিক বাহিনী এবং অন্যান্য আধা-সামরিক বা বেসামরিক বাহিনী অর্থাৎ রাষ্ট্রের পেশিশক্তির কোনো সংস্কার হয়নি। যেমন সামরিক বাহিনীর প্রধানকে সরাবার মতো মুরোদ এই বিপ্লবীদের হয় নাই। পুরোনো সরকারের যে রাষ্ট্রপতি, তাঁকে পর্যন্ত স্পর্শ করার সাহস হয় নাই। ফলে বিপ্লব একটা পরিহাসে পরিণত হয়েছে। আমরা আশা করেছিলামÑ ইতিহাস হবে, ল্যান্ডমার্ক রেভলিউশন হবে। তা না হয়ে এটা হয়েছে একটা ফার্স বা পরিহাস। ইংরেজিতে বলে আইরনি। অর্থাৎ যা আমরা ভেবেছিলাম, ফল হয়েছে তার বিপরীত। রাষ্ট্রব্যবস্থা একটুও বদলায় নাই।
অভ্যুত্থানের সময় জনগণের মধ্যে যে ঐক্য দেখা গিয়েছিল কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে আবারও বিভাজন দেখা দিতে থাকে। এর কারণগুলো কী বলে মনে করেন?
সলিমুল্লাহ খান: স্বৈরাচার জনগণের ওপর চেপে বসেছিল। আমি বলব না শুধু ১৬ বছর। ১৯৭২ সন থেকেই আমাদের ওপর একটা স্বৈরাচার চেপে ছিল। আমরা এখন সে কথা ভুলে যাচ্ছি। শেখ মুজিবের আমলের সাড়ে তিন বছরের স্বৈরাচার আর পরে দেশে ১৫ বছরের সামরিক শাসন ছিল নানা প্রকারের। তারপরে একটা নির্বাচন হলো। সেই নির্বাচনে বিএনপি জেতে। তারাও স্বৈরাচারী হলেন। তারপরে হাসিনাও স্বৈরাচারী হলেন। এরপর তো স্বৈরাচারী শাসনই চলেছে। বাংলাদেশের ৫৪ বছরে গণতান্ত্রিক শাসনের একটা বছরও আমি দেখি না।
গণঅভ্যুত্থানে সকলের লক্ষ্য ছিল হাসিনাকে সরিয়ে দেওয়া। তবে তাদের ভেতরের অনুচ্চারিত লক্ষ্য ছিল সকল প্রকার স্বৈরতন্ত্রের অবসান। অন্তত ১০-১১ বছর মানুষ ভোট দেওয়ার স্বাভাবিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিল। এই ভোট দেওয়াটা গণতন্ত্রের বাইরের একটা লক্ষণ। ভেতরের লক্ষণটা কী? গণতন্ত্রে মানুষের শিক্ষার অধিকার থাকবে, স্বাস্থ্যের অধিকার থাকবে, যাতায়াতের অধিকার থাকবে। ঢাকা শহর দেখলে বোঝা যায়, এখানে গণতন্ত্র কীভাবে থাকতে পারে! এত নৈরাজ্য! একটা নগরে পরিবহন ব্যবস্থা বলতে কিছু নাই। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নাই। অন্যান্য দিক থেকেও এটাই দেখা যায়। তারা নির্লজ্জভাবে বলছে, ‘আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছি।’ পৃথিবীর নিম্নতম আয়ের দেশেরও এত পরিমাণ আবর্জনা, এত ময়লা থাকে না; যেটা ঢাকা শহরে আছে। বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টা এ কথা বলেছেন সম্প্রতি। কথা তো সত্য। একটা মরা ঘড়িও দিনে দুবার সঠিক সময় দেয়। মানে বর্তমান সরকার কোনো কাজই করতে পারছে না, কিন্তু দু’য়েকটা সত্য কথা মাঝেমধ্যে বলছে। আর এটা হচ্ছে অনৈক্যের কারণে।
সরকারের কাছে আমরা যা আশা করেছিলাম, সরকার তার ন্যূনতমটাও বাস্তবায়ন করতে পারে নাই। বরং তাদের দুরবস্থা, সিদ্ধান্তহীনতা এবং শক্তিহীনতার ফলে পতিত স্বৈরতন্ত্র আবার ফিরে আসার মতো একটা পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এটি হচ্ছে বিপদের কারণ। যেমন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে বিপ্লবের নেতৃত্ব বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের একটা অংশ জাতীয় নাগরিক পার্টি প্রস্তাব করেছেন। অন্যান্য অংশ তাদের সাথে নাই। আগে বিএনপি বা জামায়াত তাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বিএনপি নেতারাও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, এই ছাত্ররাই প্রথম আগুনটা দিয়েছে। কিন্তু তাদের পেছনে যতটা জনসমর্থন আছে বলে তারা মনে করেছিলেন, বাস্তবে তা নাই। অন্তত তারা সেটা গড়ে তোলার সময় পান নাই। কিন্তু তারা তাদের কাজ করেছেন, কর্তব্য করেছেন। অন্যরা তো সে কর্তব্য পালন করেন নাই। অন্যরা তার ফল ভোগ করছেন। যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা বাতিল হয়েছে; এখন কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান নাই। কোন বিধানে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো? অভ্যুত্থানের শক্তিতে। এটা সংবিধান অনুসারে হয়নি। সেই অভ্যুত্থানের যারা প্রণেতা, আপনি তাদেরই খেয়ে ফেলছেন। উপদেষ্টা পরিষদ থেকে তাদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য এমন আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন যে, তাদের মধ্য থেকে একজনকে সরিয়ে দেওয়া হলো। আরও দুই-তিনজন যে আছেন, তারাও যকেোনো দিন সরিয়ে দেওয়ার হুমকিতে আছেন। তার মানে কী? সংকীর্ণ অর্থে, অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু ব্যাপক অর্থে মানুষের মধ্যে যে আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে, তার ওপর আর স্বৈরশাসন চাপিয়ে দেওয়া যাবে না; সেই দিক থেকে অভ্যুত্থান বিজয়ী হয়েছে। আমি এটাকে বিপ্লব বলার পক্ষপাতী আকাক্সক্ষার দিক থেকে। বিপ্লবী আকাক্সক্ষা থেকে এ দেশের পরিবর্তনটা হয়েছে।
কিন্তু বিপ্লবের সাথে বিপ্লবের প্রতিনিধি বলে যাঁরা পরিচিত হয়েছেন, তাঁরা ঠিক তাঁদের কথা রক্ষা করেননি। এটা বিভক্তির একটি কারণ। আরেকটা কারণ হলো সমাজে নানা প্রকারের শ্রেণস্বিার্থ আছে। তারা সকলেই একটা জায়গায় একত্রিত হয়েছিলেন। কিন্তু দেশের নতুন ধনিকশ্রেণি গাছেরটাও খাবেন, তলারটাও কুড়াবেন। তারা হাসিনার সঙ্গে স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘আপনার সাথে আমরা আজীবন আছি।’ তারা কিন্তু এখনো আছেন। এ দেশের স্থায়ী আমলাতন্ত্র এবং স্থায়ী পুঁজিকে অভিভাবক হিসেবে পেছন থেকে দেখভাল করছে আন্তর্জাতিক পুঁজি, আর তারা আন্তর্জাতিক পুঁজির এজেন্ট হিসেবেই এখানে কাজ করেন। যেমন আমাদের সবচেয়ে বহুলকথিত সেলাই শিল্প তৈরি পোশাক কারখানা এবং তার রপ্তানি প্রক্রিয়া। এটা তো আন্তর্জাতিক পুঁজির শাখা মাত্র। তারা এনক্লেভ ইকোনমি (ছিটমহল অর্থনীতি)। আমাদের জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নাই। এটা আন্তর্জাতিক পুঁজির যোগানদার হিসেবে এখানে কারখানা বসিয়েছে মাত্র। অতএব, একটা দেশের অর্থনীতি যখন সম্পূর্ণভাবে বিদেশের ওপর নির্ভরশীল হয়, আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়, আন্তর্জাতিক পুঁজির ওপর নির্ভরশীল হয়; তখন তার জাতীয় চরিত্র আর থাকে না।
আমাদের দেশে একদিকে জনগণ বা জাতি, আরেকদিকে আন্তর্জাতিক পুঁজি। মাঝখানে রাষ্ট্রটা মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে উদ্ভূত রাষ্ট্র অথবা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে যে পাকিস্তান কায়েম হয়েছিল, সবগুলোই জাতীয় চরিত্রসম্পন্ন ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক পুঁজির চাপে পাকিস্তান আমেরিকান শিবিরে চলে যায়। তখন তারা সেন্টো, সিয়াটোর মতো চুক্তিগুলোতে যোগ দেয়। বাংলাদেশ ওরকম সামরিক শক্তিতে যোগ না দিলেও অর্থনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক পুঁজির কাছে আরও বেশি করতলগত হয়েছে। ফলে আমাদের রাষ্ট্রের চরিত্র যতটা জাতীয়, তার চেয়ে ঢের বেশি আন্তর্জাতিক। যতটা দেশীয়, তার চেয়ে বেশি বেশি বিদেশি। ফলে জনগণের মধ্যে একটি বিভক্তি তৈরি হয়েছে। একদল লোক, যারা রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত, আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে জড়িত; তারা ইংরেজিতে কথা বলেন নিজেদের মধ্যে। এক জাতির ভিতরে দুই জাতি তৈরি হয়েছে শুধু ধন-সম্পদে নয়; সংস্কৃতিতে, ভাষাতেও। তারা ইংরেজি পত্রিকায় লেখেন এবং এ লেভেল, ও লেভেল পরীক্ষা দেন। স্বাধীনতার পর দেশে ইংরেজি মাধ্যম অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। তারাই হচ্ছেন দেশের গুণীজন, জ্ঞানীজন। তারাই এলিট। তারাই দেশের সেরা লোকজন। তারা দেশ শাসন করছে। তারা হাসিনার আমলে সকল সুবিধা ভোগ করেছেন। এখন করছেন। সামনে নতুন সরকারের আমলেও ভোগ করবেন।
জনগণ কেন বিভক্ত হয়েছে? আরো বিভক্ত হতে পারে, কারণ সরকার কোনো আশা পূরণ করছে না। একটাও মৌলিক সংস্কার হয়নি। তারা তো দেশের যানবাহনেও সংস্কার করতে পারে না। সারা দেশের কথা বাদ দিলাম; ঢাকা শহরে একটা ইউনিফায়ডে কোম্পানির নামে পরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে পারেন নাই। এখানে প্রায় আড়াইশ কোম্পানি আছে, যারা দৌরাত্ম্য চালাচ্ছে। তারা ৩০ বছরের পুরনো বাস চালাবার জন্য ধর্মঘট করছে। সুতরাং, দিল্লি অনেক দূরে আছে।
বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতার চর্চাকে আপনি বর্তমানে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? মতপ্রকাশের সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোন গোষ্ঠী?
সলিমুল্লাহ খান: ফ্যাসিবাদের প্রথম লক্ষণ― সে আপনাকে কথা বলতে দেবে না। আপনারা দেখছেন, হাসিনার আমলে কত সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, কতজনকে গুম করা হয়েছে, কতজনকে নির্যাতন করা হয়েছে। বন্দি অবস্থায় অনেকে মারা গেছেন। তাছাড়া অনেককে নির্বাসনেই পাঠানো হয়েছে। সেটা এখনো দূর হয় নাই। এখন শুধু একটু স্থানচ্যুতি হয়েছে― এই গোষ্ঠীর জায়গায় সেই গোষ্ঠী। কারণ, যদি সত্যিই কোনো দেশে বাকস্বাধীনতা থাকে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। অমর্ত্য সেন মহাশয় এ প্রস্তাবটা করেছেন। সংবাদপত্রে যদি আপনি নির্ভেজাল খবর প্রকাশ করতে পারেন, দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি সংবাদপত্রের পাতায় আগেই শোনা যায়। কিন্তু সংবাদপত্রকে যখন বলা হয়, এটা প্রচার করা যাবে না, ওটা প্রকাশ করা যাবে না, তখন তো তা জানতে পারবেন না। এমনকি হাসিনার যে শোচনীয় পরিণতি হয়েছে, তাঁকে যে নির্লজ্জভাবে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে, সেটাও তাঁর স্বৈরতন্ত্রের ফসল। অর্থাৎ তিনি পালাতে পেরেছেন, কারণ তাঁর স্বৈরতন্ত্র শক্ত ছিল। তিনি যে আমলাতন্ত্র তৈরি করেছেন, তারাই তাঁকে পার করে দিয়েছে। আবার, জনগণ যে তাঁকে পছন্দ করছে না, এই খবর তাঁর কানে কেন পৌঁছে নাই? এটা তাঁর গোঁয়ার্তুমির জন্য হতে পারে। অথবা মিডিয়া যদি স্বাধীন হতো, জনমত যাচাইয়ের প্রক্রিয়া থাকত, জনগণকে যদি তাদের খোলা মতামত প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে পরাজয়ের খবর তিনি বহু আগেই পেতেন। তাঁর উচিত ছিল ২০১৪ সনেই পদত্যাগ করা। তখন তিনি অন্তত বলতে পারতেন, জনসমর্থন আমি হারিয়েছি, আমি আবার চেষ্টা করে ক্ষমতায় আসব। গণতন্ত্রে এমনই হয়; কিন্তু এ দেশে গণতন্ত্র ছিল না।
গণতন্ত্র না থাকার প্রথম লক্ষণই বাকস্বাধীনতার অভাব। বাকস্বাধীনতাই সবকিছু নয়। বাকস্বাধীনতার পেছনে আরো শক্তি কাজ করে। যেমন সংবাদপত্রের মালিকরাও বাকস্বাধীনতার পক্ষে নন। তারা তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য, সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার জন্য, আত্মনিয়ন্ত্রণ করে, সেলফ সেন্সরশিপ করে।
আবার স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বিরোধ হচ্ছে― জনগণের মধ্যে যে অংশগুলোকে আমরা বলি অন্ধ, পশ্চাৎপদ, তারা অনেক সময় মানুষের স্বাধীনতার, স্বাধীন চিন্তার বিরোধিতা করে। বাঙালি মুসলমান সমাজের বিশেষ রোগের মধ্যে এটা অন্যতম। কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আবির্ভূত হলেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান শত্রুতা করেছে ব্রিটিশ সরকার। দ্বিতীয় শত্রুতা করেছে মুসলিম সমাজ। তারা তাকে ‘কাফের’ উপাধি দিয়েছিলেন। সেই শক্তি এখনো সক্রিয় আছে। মানে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সেটা চলে যায় নাই।
হাসিনার বিদায়ের পর সবাই তো গর্ত থেকে বেরিয়ে আসছেন। কিন্তু সব শিয়ালের এক রা নয়। কেউ কেউ তাদের পুরোনো প্রতিক্রিয়াশীলতার পুনরুজ্জীবন দাবি করছেন। এজন্যই এখন নতুন পর্যায়ে নতুন লড়াই। অর্থাৎ বাংলাদেশ যখন হাসিনামুক্ত হলো, স্বৈরাচারমুক্ত হলো, তখন আপনার সমস্ত লড়াই কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। এখানে বিপদটা হচ্ছে, যারা বাকস্বাধীনতার কথা বলবেন, তাদের দুর্ভাগ্যবশত হাসিনার দোসর হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু এটা টিকবে না। যারা বাকস্বাধীনতার কথা বলেন, তাদের এই সত্য বলতেই হবে যে, হাসিনা স্বৈরতান্ত্রিক ছিলেন; কিন্তু অনেক বুদ্ধিজীবী, নষ্ট হওয়া বুদ্ধিজীবীরা ১৯৭২ সনের সংবিধান পুনরুজ্জীবনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছেন। কিন্তু ১৯৭২-এর সংবিধান তো হাসিনার পলায়নের সঙ্গেই গত হয়েছে। শেখ মুজিবের হাতেই এটি মারা গেছে। এটা ছিল মৃত সংবিধান। দেশটা চলছে সংবিধান অনুসারে নয়। উদাহরণ দেই একটা। সংবিধানে তো লেখা আছে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কোন কিছু তো বাংলায় চলছে না। সংবিধান হচ্ছে একটা নামমাত্র পোস্টার। এখানে সেখানে ঝুলিয়ে দেওয়া সাইনবোর্ড। এই সাইনবোর্ডটা বদলালে পর সত্যের কাছাকাছি আসতে হবে আমাদের। বাকস্বাধীনতার পথে প্রথম যে বাধা, সেটা সংবিধানেই দেওয়া ছিল। ১৯৭২ সনের সংবিধানের ৩৯ ধারার দুই উপধারাতে লেখা আছে, বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হলো, তবে কয়েকটি শর্ত সাপেক্ষে। এই শর্তগুলোর মধ্যে একটা বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয় এমন কথা বলা যাবে না। এ থেকেই বোঝা যায়, এটা বাকস্বাধীনতা নয়।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার করা গণতান্ত্রিক রূপরেখা পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন কোনো দল বাস্তবায়ন করেনি। জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছলেও বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা থেকেই যাচ্ছে। নির্বাচনের পর রাজনৈতিক বাস্তবতা কোন দিকে যেতে পারে?
সলিমুল্লাহ খান: শেখ হাসিনা যখন নাকে রুমাল চেপে হেলিকপ্টারে চড়ে পলায়ন করেছেন; তখন সংবিধানও ছেড়ে গিয়েছেন তিনি। শেখ হাসিনা লিখিত পদত্যাগপত্র দিয়েছেন কি না, সেটা আদৌ ধর্তব্য বিষয় নয়। কিন্তু জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান যে আংশিক পরাজিত হয়েছে তার প্রমাণ, হাসিনার নিয়োজিত পার্লামেন্টে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ক্ষমতায় আছেন। ইরানের বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের অবস্থা বুঝতে সুবিধা হবে। ইরানের শাহ যখন পলায়ন করলেন ১৯৭৯ সনের ১৬ জানুয়ারি, তখন তিনি একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে গেলেন। তিনি ছিলেন ইরানের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা, মানে বিরোধী দলের নেতা। কিন্তু শাহ তাঁকেই মনে করলেন নিরাপদ। তাঁর নাম শাপুর বখতিয়ার। প্যারিসে শিক্ষিত। তিনি একজন পণ্ডিত লোক। আয়াতুল্লাহ খোমেনি তখন প্যারিস থেকে হুংকার দিয়ে বললেন, শাপুর বখতিয়ারকে সরে যেতে হবে। শাপুর বখতিয়ারের কাছে দাবি করলেন, খোমেনিকে আসতে দিতে হবে। খোমেনি ১ ফেব্রুয়ারি এলেন এবং লড়াইয়ের মাধ্যমে সাপুর বখতিয়ারকে পরাস্ত করলেন ১১ দিনের মাথায়। ১১ ফেব্রুয়ারি শাপুর বখতিয়ারের ন্যাশনাল গার্ড আর্মি আত্মসমর্পণ করল। ১৯৭৯ সনের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ইরান স্বাধীন হলো। বাংলাদেশে ঘটল ভিন্ন ঘটনা। ৫ আগস্ট হাসিনা পালালেন। ৮ আগস্ট ড.
খোমেনি এসে কী করেছিলেন? ড. মেহেদি বাজারগানকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করলেন তিনি কিন্তু নিজে প্রধানমন্ত্রী হলেন না। জাতীয় নেতার এটাই বৈশিষ্ট্য। সেই তুলনায় বাংলাদেশের বিপ্লব হয়ে গেছে আধ-খেঁচড়া। বাংলাদেশের বিপ্লবটা হয়েছে মৃতবৎসা। প্রসব বেদনা শুরু হয়েছে। বাচ্চার মাথা না এসে আগে পা এসেছে এবং বলতে গেলে জননীরও মৃত্যু হয়েছে। এখন যেটাকে জুলাই সনদ বলা হচ্ছে, সেটা কী জিনিস? যে শিশুটা জন্ম নিচ্ছিল, সেটাই জুলাই সনদ। সেটাকে হত্যা করা হয়েছে গলা টিপে। এখন যেটা করা হচ্ছে, সেটা হচ্ছে কাফনমোড়া প্রহসন।
স্বাধীনতার সনদের মূল কথা দুইটা। এক. এই রাষ্ট্র জনগণের সম্পত্তি। নাম হচ্ছে সার্বভৌমত্ব। জনগণের সার্বভৌম বা চূড়ান্ত ক্ষমতা যার হাতে তাকে বলা হয় মালিক― জনগণ। এই রাষ্ট্রের মালিক কোনো ব্যক্তি নয়, কোনো পরিবার নয়, কোনো পার্টি নয়। নির্বাচনে জিতে কেউ দেশের মালিক হয় না, সে পরিচালনার ভার পায়মাত্র। কথাটা সংবিধানে বিধিবদ্ধ আছে, লিপিবদ্ধ আছে― সার্বভৌমত্ব জনগণের। কিন্তু এটাকেই সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। এই জনগণের রাষ্ট্রকে কেউ যদি জবরদখল করে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে, সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অথবা নিছক বিদ্রোহের মাধ্যমে; বিপ্লবের মাধ্যমে নয়; কারণ আমাদের রাষ্ট্র জন্মেছে বিপ্লবের মাধ্যমে; একাত্তরের যুদ্ধকে বিপ্লবী যুদ্ধ বলতে হবে, তাহলে সেই রাষ্ট্রের মালিকানা যারা চুরি করে, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ডাকাতি করে, তাদের শাস্তি সর্বোচ্চ। বর্তমানে এর নাম মৃত্যুদণ্ড।
এখন এটা জুলাই অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হবে যে, তোমরাই অভ্যুত্থান সংগঠিত করেছ। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানকারীরা যা করেছেন সেটা মোটেও ষড়যন্ত্র নয়, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র নয়, সামরিক অভ্যুত্থান নয়। সেটা বিদ্রোহও নয়। সেটা হচ্ছে জনগণের সমর্থন, জাতীয় গণজাগরণ, গণঅভ্যুত্থান অর্থাৎ বিপ্লব। বিপ্লব মাত্রই গণজাগরণ, কিন্তু অনেক ধরনের গণজাগরণ আছে, ভুয়াও আছে। এগুলো বিপ্লব নয়। বিপ্লব অনেক বড় জিনিস। যে কোনো জায়গায় মব জড় হলেই সেটা বিপ্লব হয় না। এটা গ্রহ নয়, বড়জোর গ্রহাণু― বিপ্লবের গ্রহাণু, বিপ্লবচূর্ণ বিপ্লব নয়। এগুলো বিপজ্জনক উল্কাপিণ্ডের মতো।
বৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে, নির্ভেজাল নির্বাচনের মাধ্যমে, জালিয়াতিমুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের সরকার নির্বাচন করবেন। এই পথ ফাঁকি দিয়ে কেউ যদি চোরাপথে ক্ষমতায় আসেন, তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলেন। বর্তমান আইন অনুসারে তাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এটা হচ্ছে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মূল কথা।
দুই. জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান হচ্ছে ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধের মূল অঙ্গীকার― সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার। তথাকথিত জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র নয়। ওটাই ছিল প্রথম জুয়াচুরি। আরেকটা জুয়াচুরিও ছিল। এটা জুলাই অভ্যুত্থানকারীরা জানেন কি না, আমার সন্দেহ। বাহাত্তরের সংবিধান ছিল ফ্যাসিবাদী। তার প্রথম প্রমাণ কী? সংবিধানের মূল অংশ শুরু হলো প্রথম তিন ভাগের পরে― প্রথম ভাগ প্রস্তাবনা, দ্বিতীয় ভাগ মূলনীতি, তৃতীয় ভাগ মৌলিক অধিকার, চতুর্থ ভাগ নির্বাহী বিভাগ। কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রথমে থাকে আইনসভা। আইনসভা মানে জনগণের প্রতিনিধিত্ব যারা করেন, তারা যে আইন করবেন সে অনুসারে সরকার গঠিত হবে। দ্বিতীয় ভাগে থাকে নির্বাহী বিভাগ। আমাদের এখানে হয়েছে উল্টা― নির্বাহীকে আগে এনেছে, আইনসভাকে পরে নিয়েছে। তারপরে আছে বিচার বিভাগ। নির্বাহী বিভাগের পরম ক্ষমতাই ফ্যাসিবাদের কুলক্ষণ।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানকারীদের দাবি― আমাদের এমন একটা নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়া উচিত, যাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রথম দায়িত্ব হবে সংবিধান রচনা করা। সংবিধান রচনা করার পরে সেই গণপরিষদ বা সংবিধান পরিষদ, ইংরেজিতে যাকে বলে কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি― নিজেকে নিজেই বিলুপ্ত করবে। তারপরে নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় আইনসভা গঠিত হবে। সেই পথে না গিয়ে আমরা যেটা নিয়ে এখন গড়িমসি করছি, তা জোড়াতালি দেওয়ার পথ। এর ফলাফল ভালো হবে না। এখনও জাতীয় সংবিধান সভার নির্বাচন হওয়া উচিত কিন্তু সম্ভব কি না, জানি না। অবস্থা এরই মধ্যে বেগতিক হয়ে গেছে।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
সলিমুল্লাহ খান: ধন্যবাদ।
ঢাকা/রাসেল/তারা
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব এনপ জ ল ই গণঅভ য ত থ ন এনস প আওয় ম ল গ প র স দ ষড়যন ত র গণঅভ য ত থ ন র শ প র বখত য় র ক ষমত য় থ ক স ব রতন ত র ব যবহ র কর পরবর ত ক ল স ব ধ নত র ত হয় ছ ল ন ব ধ নত র প র ষ ট রপত দ র প রথম ব যবস থ ক র ক ষমত য় স ব দপত র গণতন ত র ব ত ল কর ত তর র ম কর ছ ল ন র চর ত র খ র জ কর ব র জন য প রক র য় প রস ত ব ক য় ম হয় ক র করত তখন ত র আকস ম ক প রথম প জনগণ র একদল য় প রবণত ন পর য মন ত র অন য ন নত ন ন ক জ কর পর য য় জ কর ছ রক র র শ ষ কর ন র পর শ সন র অন স র র লক ষ র মন র ষ ট হয় সন থ ক র র জন ভ গ কর প রক শ ক র কর রক র ন ষ ট কর কর ছ ন হয় ন ই শ শ সন বল ছ ন অর থ ৎ সন র স আম দ র আওয় ম ব এনপ র সময় র ওপর র একট করছ ন ন রচন সবচ য় র আমল ত রপর করল ন ধরন র অবস থ আপন র গ রহণ করব ন আদর শ
এছাড়াও পড়ুন:
পিআর পদ্ধতিতে জনগণের কোনো সুবিধা নেই: মঈন খান
পিআর পদ্ধতি দলীয় কিছু আসন বৃদ্ধি ছাড়া জনগণের জন্য কোনো সুবিধা নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান।
ড. মঈন খান বলেন, “আমি কেন পিআর চাচ্ছি? একটু যদি আমরা খোলাখুলি বলি, পিআরটা চাচ্ছি এই কারণে যে, আমি পার্লামেন্টে কিছু বেশি সিট (আসন) পাব, এর বাইরে কিছু নাই। এখন আমি পার্লামেন্টে অধিকতর ক্ষমতাবান হব, অধিক সিট পাব সেই কারণে মানুষের মৌলিক যে দাবি সেটাকে আমি অগ্রাহ্য করব? এটা তো গণতন্ত্রের ভাষা নয়। কাজেই সেই দিক থেকে এটা সেলফ কনট্রাডিক্টরি। আসুন, মানুষের কল্যাণে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থেকে কাজ করি, এখানে খোলা মন নিয়ে কাজ করতে হবে।”
আরো পড়ুন:
ভেদাভেদ ভুলে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করতে হবে: দুলু
জনতা চায় নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, এটিই আমাদের লক্ষ্য: ফখরুল
আব্দুল মঈন খান বলেন, “দেখুন, পিআর করার অর্থটা কি? পিআর হচ্ছে ব্যক্তির যে অবস্থান সেটাকে দুর্বল করে দলের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করে দিচ্ছে অর্থাৎ মানুষ ভোট দিবে দলকে এবং দল নির্ধারণ করে দেবে কে প্রার্থী হবেন।”
ড. মঈন খান বলেন, “তাহলে কি হচ্ছে? আমাদের যে মৌলিক চিন্তাধারা, জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে এবং জনগণের প্রতিনিধিরা সরাসরি জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে সেইটা তো তাহলে আর থাকছে না। দলকে শক্তিশালী করে দিতে আমরা জনপ্রতিনিধিকে দুর্বল করে দিয়ে সেখানে একটি দলকে যদি আমরা শক্তিশালী করে দেই তাহলে কিন্তু মানুষের যে সিস্টেমটা তৈরি হবে সেটাও কিন্তু একটা সেলফ কন্ট্রাডিকশন। সেলফ কন্ট্রাডিকশন এই কারণে যে মানুষ সাধারণ মানুষের যে প্রত্যাশা, সেটা হচ্ছে এই, দল যেন অতিরিক্ত শক্তিশালী না হয়, বিশেষ করে বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক ইতিহাস আমরা বিগত ৫৪ বছরে দেখেছি। যখনই দল বেশি শক্তিশালী হয়ে গেছে তখনই কিন্তু জনগণের জন্য দুর্যোগ নেমে এসেছে।”
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/সাইফ