Prothomalo:
2025-11-20@09:20:51 GMT

লাল মুনিয়ার খোঁজে

Published: 20th, November 2025 GMT

শরৎ–হেমন্তসহ সারা বছরই প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য দেখা যায় ঢাকার আফতাবনগরে। এখানে রয়েছে ঘাসবনের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা ডানাযুক্ত কিছু খুদে প্রাণ। তার মধ্যে মুনিয়া পাখি অন্যতম। বাংলাদেশে পাওয়া ছয় প্রজাতির মুনিয়া পাখি ঢাকার আফতাবনগরের ঘাসবনে দেখা যায়। তবে এই ছয় প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এবং সংখ্যায় কম পাওয়া প্রজাতিটি হলো ‘লাল মুনিয়া’।

আমাদের গবেষণাকাজের অংশ হিসেবে আফতাবনগরে ঘাসবনের পাখি জরিপ করার সময় মুনিয়া পাখির দেখা পাই। দূর থেকে দেখলে মনে হবে সাদা কাশফুলের ওপর যেন লাল আলতার ফোঁটা। এদের কোথাও কোথাও ‘আলতা মুনিয়া’ নামেও ডাকা হয়। ইংরেজিতে বলা হয় Red Avadavat অথবা Strawberry Finch এবং বৈজ্ঞানিক নাম Amandava amandava। বাংলাদেশের চরাঞ্চল, নদীনালা, খালবিলের আশপাশের কিছু কিছু ঘাসবনে এদের পাওয়া যায়। তবে সংখ্যায় বেশ কম এবং সাধারণত এ দেশে কমই দেখা যায়।

এদের পুরুষ ও স্ত্রী পাখির দেহের রং আর ধরন আলাদা হয়ে থাকে। পুরুষের দেহ লাল, চোখ, ঠোঁট লাল এবং লাল দেহে সাদা তিল রয়েছে। স্ত্রীর দেহ, মাথা, পিঠ বাদামি এবং ডানা কালচে। স্ত্রী পাখিদের ঠোঁট, চোখ এবং কোমর লাল হয়ে থাকে। প্রজনন মৌসুম যত এগিয়ে আসে, পুরুষের দেহ তত বেশি লাল হতে থাকে।

এরা বীজভোজী পাখি। প্রধান খাদ্য হলো ঘাসের বীজ, আগাছা আর ফসলের বীজ। তা ছাড়া প্রজনন মৌসুমে এরা ছোট ছোট পোকামাকড় এবং জলাভূমিতে জমে থাকা শৈবাল খেয়ে থাকে। অন্যদিকে এরা প্রকৃতির খাদ্যশৃঙ্খলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ, আকারে ছোট হওয়ায় এরা শিকারি পাখিদের অন্যতম খাদ্য। এভাবে এরা প্রকৃতিতে বীজ বিস্তারকারী, পোকা নিয়ন্ত্রক, বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য এবং পরিবেশের স্বাস্থ্যের সূচক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।

মুনিয়া বাংলাদেশের আবাসিক পাখি। সাধারণত বর্ষা বা বর্ষার পরপরই এরা প্রজনন করে থাকে। পুরুষ পাখিরা প্রজনন মৌসুমে উজ্জ্বল লাল রঙের তলদেশ, সাদা বিন্দু ও আকর্ষণীয় ঠোঁটের রং প্রদর্শন করে। পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখিকে আকর্ষণ করতে গান গায়, ডানা ঝাঁকুনি ও লেজের নড়াচড়া করে। গান ও প্রদর্শনী স্ত্রী পাখিকে আকর্ষণ এবং নিজেদের এলাকা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এরা ঘন ঘাসভূমি, কৃষিভূমি বা ঝোপঝাড়পূর্ণ এলাকা পছন্দ করে, যেখানে এদের বাসা গোপন ও সুরক্ষা থাকে। এরা গম্বুজাকার বা গোলাকার বাসা তৈরি করে, যার পাশে ছোট একটি প্রবেশপথ থাকে। বাসা সাধারণত ঘন ঘাস বা কাঁটাযুক্ত ঝোপের মধ্যে লুকানো অবস্থায় থাকে। বাসা নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণ সাধারণত ঘাস, সূক্ষ্ম ডাঁটা, পালক ও নরম উদ্ভিজ্জ তন্তু। বাসা সাধারণত মাটির ওপরে কয়েক সেন্টিমিটার থেকে প্রায় এক–দুই মিটার উচ্চতায় থাকে।

কৃষি সম্প্রসারণ, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, অবৈজ্ঞানিক বসতি বিস্তার ও বনায়নহীন উন্নয়নের কারণে দ্রুত নষ্ট হচ্ছে এদের আবাসস্থল। এরা উজ্জ্বল লাল রঙের কারণে পোষা পাখি হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে জনপ্রিয়। ফলে এদের জীবন্ত সংগ্রহ ও অবৈধ শিকার অনেক জায়গায় চলছে। বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এরা পোষা পাখি বাণিজ্যের একটি বড় অংশ।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ আইইউসিএন ২০১৫–এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এরা ঝুঁকিমুক্ত ক্যাটাগরিভুক্ত হলেও দিন দিন এদের সংখ্যা কমে আসছে। এর একটি বাস্তব উদাহরণ ঢাকার আফতাবনগর। একসময় পাখি আলোকচিত্রীরা এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে এই পাখি দেখতে পেতেন। কিন্তু এখন আর সেই ঝাঁক দেখা যায় না, কিছুসংখ্যক টিকে আছে; তবে যেভাবে নির্বিচার বাসস্থান ধ্বংস আর নগরায়ণ হচ্ছে, তাতে বেশি দিন হয়তো এখানে এদের দেখা যাবে না।

শুধু মুনিয়া নয়, অন্যান্য আবাসিক পাখিসহ নানান পরিযায়ী পাখি এখানে আসে খাবারের সন্ধানে। এ জন্য পাখি আলোকচিত্রীদের কাছে এই জায়গা বেশ জনপ্রিয়। ঢাকার মধ্যে এই সুন্দর জীববৈচিত্র্যপূর্ণ আবাসস্থল ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা না গেলে প্রকৃতি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে।

মোহাম্মদ ফিরোজ জামান: অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

উজ্জল দাস: শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আফত বনগর স ধ রণত প রজনন প রক ত ঘ সবন

এছাড়াও পড়ুন:

পরিবার পরিকল্পনায় নজর দিতে হবে

নারীর প্রজনন হারের হঠাৎ উল্টো যাত্রা আমাদের জনসংখ্যাবিষয়ক নীতি ও পরিকল্পনা যে ঠিক পথে নেই, তারই প্রতিফলন। অথচ গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য খাতে যে অগ্রগতি, তার পেছনে একটা বড় কারণ জন্মহার কমানো ও স্থির অবস্থায় রাখতে পারা। ২০২৪ সালে যেখানে নারীদের মোট প্রজনন হার (টিএফআর) ২ দশমিক ১৭ ছিল, সেখানে বর্তমানে এ হার ২ দশমিক ৪। স্বাধীনতার পর গত ৫৪ বছরে এমন উল্টো যাত্রা আর কখনো দেখা যায়নি।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, গত রোববার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফ যৌথভাবে মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (মিকস) ২০২৫ প্রকাশ করে। জরিপে যেমন উঠে এসেছে বিভাগভেদে নারীদের প্রজনন হারে পার্থক্য আছে, আবার দরিদ্র এবং কম শিক্ষিত ও নিরক্ষর নারীদের মধ্যে টিআরএফ বেশি। এ তথ্য আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে দারিদ্র্য ও বৈষম্য না কমালে এবং শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ মোটেই সহজ নয়।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের টিএফআর ছিল ৬ বা তার বেশি। স্বাধীনতার পর জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে জাতীয় সমস্যা বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। সরকার জনসংখ্যা কমানোকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী মানুষের হাতের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কর্মকৌশল নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সরকারগুলোও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি অগ্রাধিকার দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়। বেতার, টেলিভিশন, পথনাটক ও গানের মাধ্যমে কম সন্তান রাখার গুরুত্ব জনসাধারণের কাছে তুলে ধরে। সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলোও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সমন্বিত নীতি ও পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ একত্র হলে যে বড় সফলতা মেলে, তার একটি ভালো দৃষ্টান্ত হতে পারে বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম। স্বাধীনতার পর পরবর্তী চার দশকে ধারাবাহিকভাবে টিআরএফ কমেছে। ২০১২-২০২২ পর্যন্ত সেটা ২ দশমিক ৩-এ স্থির অবস্থায় ছিল। দুই বছর পর সেটা কমে ২ দশমিক ১৭ হলেও এক বছরের ব্যবধানে অনেকটাই বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশের যে জনসংখ্যা নীতি, সেখানে টিআরএফ ২ দশমিক ১ নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে হঠাৎ উল্টো যাত্রায় উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ এমনিতেই বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ, প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১ হাজার ১৫০ জনের বেশি মানুষ বাস করে। জনসংখ্যার চাপে কৃষিজমি ক্রমে কমছে, অন্যদিকে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিতে স্থবিরতার কারণে দারিদ্র্য ও হতদরিদ্রের হার বাড়ছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে। এ বাস্তবতায় জনসংখ্যা বেড়ে গেলে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান—সবখানেই অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে।

জনসংখ্যাবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, আমাদের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম সঠিকভাবে চলছে না। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে জোরালো দাবি ওঠে, সরকার কমিশনও গঠন করে। কমিশন তাদের প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুরারোগ্য ব্যাধি সারাতে কোনো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিও ঠিক পথে এগোয়নি। গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর মাঠপর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রীর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল। সামগ্রিকভাবে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে যে শিথিলতা, তার প্রভাব জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের ওপর পড়েছে বলে আমরা মনে করি।

টিএফআর বেড়ে যাওয়ার মানে হচ্ছে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ঝুঁকির মুখে ফেলা। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের যে সাফল্য, তার উল্টোযাত্রা কেন, নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই সে প্রশ্নে গভীর মনোযোগ দিতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সরকারি প্রতিষ্ঠানটি কি অবহেলায় ধ্বংস হবে
  • পরিবার পরিকল্পনায় নজর দিতে হবে
  • রাজবাড়ী সরকারি মুরগি প্রজনন খামার জরাজীর্ণ, নষ্ট হচ্ছে কোটির টাকার সম্পদ