কক্সবাজারের পেনোয়ার গান কেন আপনাকে শুনতে হবে
Published: 20th, November 2025 GMT
ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে একটা গানের ভিডিওতে চোখ আটকে যায়। ক্লিক করে শুনতে শুরু করি। গানের নাম, ‘এ রুহের তলে’। সুরের মধ্যে কেমন একটা প্রশান্ত ভাব। গানের দৃশ্যায়নও ভিন্ন। গর্জনের বন, লতাগুল্ম আর সাগরের দৃশ্য যেন গানের কথা ও সুরকে আরও গভীর করে তোলে। এরপর গানটি শেষ হলে আরও একবার বাজাই। সেটি শেষ হলে আরও একবার। এভাবে প্রায় ঘণ্টাখানেক এই গানের আবেশেই কেটে গেল।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। কক্সবাজারের ব্যান্ড দল পেনোয়ার ‘এ রুহের তলে’ রিলিজ হওয়ার পরপরই শুনেছিলাম। এরপর আজ অবধি শুনেছি ১৩টি গান। শুনে মনে হয়েছে, কক্সবাজারের একটা ব্যান্ড এমন সুর, কথা আর গভীরতায় প্রচলিত গানের ধারা ভেঙে বেরিয়ে এল কী করে। অবাক হয়ে শুনেছি ‘কুহু ডাকের হন’ গানটি। গানটির শুরু এমন, ‘আধা রাইত্তা জোনাক ফরর কুহু ডাকের হন/ হইলজা ধরি টান মারের অচিন দরদ বন’। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় এমন গভীর গীতিকাব্য আগে তো শুনিনি। হালকা গিটারের টুংটাং, তবলা-মাদলের মূর্ছনার বাইরে কোনো উচ্চকিত বাদ্যযন্ত্রের আড়ম্বর নেই। গানের ভেতরে কেমন গমগমে নীরবতা জড়িয়ে আছে। যেন শ্রোতার ‘কলজে’ ধরে টান মারে আক্ষরিক অর্থেই।
‘রিক্ত গোলাপ’, ‘শুনতে যা চাও’, ‘প্রিয় মুখ’ কোন গানের কথা রেখে কোন গানের কথা বলি। পেনোয়ার ধীরলয়ের গড়িয়ে যাওয়া সুর ‘বিটলস’ আর ‘মহিনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ডের কথা মনে পড়িয়ে দেবে আপনাকে। কবিতা তাদের গানে সুরের হাত ধরেছে। কেবল তা–ই নয়, কক্সবাজারের লোকজ সুর, পাহাড় আর সাগরে ঘেরা প্রকৃতির উদারতা সবই ধারণ করছে। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের ধারায় পেনোয়া অবশ্যই নতুন এক সংযোজন।কক্সবাজারের নাগরিকতার একটা ছবি যেন উঠে আসে ‘রাতের সাঁতার’ গানে। গানের দৃশ্যচিত্রে একটা ঘোড়া যেন শ্রোতাদের নিয়ে যায় অন্য এক ভ্রমণে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘গুজবাম্প’ বাংলায় তার নাম রোমহর্ষের কাছাকাছি কিছু। তবে বিষয়টি হলো গায়ের রোম খাঁড়া হয়ে যাওয়া। এই গানের কয়েকটি লাইন আমাকে এমন অভিজ্ঞতাই এনে দিয়েছিল। মনে হয়েছে এ তো পুরোই কবিতা। কেন বলছি সে কথা, তা বোঝাতে গানের লাইন কটি তুলে দিচ্ছি। ‘মুখে চাঁদের শিরনি লেগে থাকে মানুষের/ আসে আরও আরও চাঁদ পেয়ালা ভরে।/ আর অন্তরে যেন দুলছে কার মাজার!/ কারা করে কোলাহল বোবাদের জিকিরে।’
‘রিক্ত গোলাপ’, ‘শুনতে যা চাও’, ‘প্রিয় মুখ’ কোন গানের কথা রেখে কোন গানের কথা বলি। পেনোয়ার ধীরলয়ের গড়িয়ে যাওয়া সুর ‘বিটলস’ আর ‘মহিনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ডের কথা মনে পড়িয়ে দেবে আপনাকে। কবিতা তাদের গানে সুরের হাত ধরেছে। কেবল তা–ই নয়, কক্সবাজারের লোকজ সুর, পাহাড় আর সাগরে ঘেরা প্রকৃতির উদারতা সবই ধারণ করছে। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের ধারায় পেনোয়া অবশ্যই নতুন এক সংযোজন।
অনুশীলনের ফাঁকে পেনোয়ার সদস্যরা.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বেবি শার্ক গান বানিয়ে কোম্পানির বাজার মূলধন প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা
যাদের বাসায় এখন ৯ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশু আছে, তাঁরা জানেন, গত এক দশকে সেই শিশুরা কোন কোন ছড়া/গান শুনেছে। এ প্রজন্ম ইউটিউব ভিডিওর সঙ্গে বেড়ে উঠেছে। ফলে এই বয়সী শিশুদের জন্য কনটেন্ট বানিয়ে অনেকেই বিপুল অর্থ উপার্জন করেছেন।
বিষয়টি হলো ‘বেবি শার্ক’ নামের ৯০ সেকেন্ডের এক শিশুতোষ গানের ভিডিও এখন ইউটিউবের সর্বাধিক দেখা কনটেন্ট, ভিউ ছাড়িয়েছে ১৬ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৬০০ কোটি। ২০২০ সালেই এটি ইউটিউবের সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও কনটেন্টের স্বীকৃতি পায়। এরপর তা থেমে থাকেনি—অগ্রগতি চলছেই।
ফলে এই ভিডিও যারা বানিয়েছে, অর্থাৎ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান পিংকফংয়ের বাজার মূলধন ৪০০ মিলিয়ন ডলার বা ৪০ কোটি ডলার বা ৪ হাজার ৯০৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। মঙ্গলবার দক্ষিণ কোরিয়ার শেয়ারবাজারে পিংকফংয়ের লেনদেন শুরু হয়। প্রথম দিনেই শেয়ারের দাম ৯ শতাংশ বেড়ে যায়। এর মূল কারণ যে এই বেবি শার্ক ডু ডু ডু, তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। খবর বিবিসি।
এর জনপ্রিয়তা কেমন, সে বিষয়ক এক বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যাক। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের এক মা ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, সন্তানকে ঘুম পাড়ানোর পর বা অনেক ক্ষেত্রে কাজের সময় তাঁর কানে যেন এক শিশুতোষ ছড়াগান বাজতে থাকে। সেটি হলো, বেবি শার্ক ডু ডু ডু, বেবি শার্ক। যাদের বাড়িতে ইন্টারনেট এবং ৯ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশু আছে, তাঁদের মধ্যে খুব কম মানুষই আছেন, যিনি এই গান শোনেননি। আরও পরিষ্কারভাবে বললে, যাদের বাড়িতে ইন্টারনেট আছে, সেই বাড়ির ৯ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশুরা এই গান শোনেনি, এমন নজির খুঁজে পাওয়া কঠিন।
এই ভিডিও দুনিয়াজোড়া ঠিক কেমন আলোড়ন তুলবে, সেটি নিশ্চিতভাবেই কেউ আগে ভাবেননি। ২০১৬ সালের জুনে ভিডিওটি প্রকাশের অনুমতি দেন পিংকফংয়ের প্রধান নির্বাহী কিম মিন-সিওক। তিনি বলেন, ‘আমরা ভাবিনি, এটি অন্য কনটেন্ট থেকে আলাদা কিছু হবে। পরে বুঝেছি, এটি আমাদের বৈশ্বিক যাত্রাপথের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।
২০১০ সালে ‘স্মার্টস্টাডি’ নামে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি মূলত ১২ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করত। মাত্র তিনজন কর্মচারী নিয়ে শুরু করে পরবর্তীকালে ছোট শিশুদের দিকে মনোযোগ দিয়ে কনটেন্টে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। একপর্যায়ে কর্মীর সংখ্যা ১০০ জনে পৌঁছায়। এরপর তারা সহজ, শিক্ষাভিত্তিক গেম ও কনটেন্টকে অগ্রাধিকার দেয় এবং তখনই বেবি শার্কের বাজার মাত করে।
ব্রিটিশ মিডিয়া বিশ্লেষক কেভিন চিউর মতে, বেবি শার্ক গানটি ‘শিশুদের কাছে আকর্ষণীয়, যদিও প্রাপ্তবয়স্কদের কাছে সম্ভবত বিরক্তিকর। তবে কিম মিন-সিওকও এই গানে আসক্তি ধরানোর ক্ষমতা সম্পর্কে অবগত। তিনি বলেন, ‘এটি কে-পপ গানের মতো—খুব দ্রুতলয়ের ও ছন্দময়। ফলে আসক্তি তৈরি করতে পারে।’
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শিশুদের মধে৵ এটি দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। অনলাইনে এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে বেবি শার্ক গানটি ইউটিউবের সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিওর স্বীকৃতি অর্জন করে। এমনও হয়েছে, ভিডিওটি প্রকাশের পর প্রথম দিকে এই কোম্পানি যত আয় করেছে, তার প্রায় অর্ধেক এসেছে এই গান থেকে। সেই সঙ্গে নিত্যনতুন কনটেন্ট তো তারা বানিয়েছে।
একটি গাননির্ভর নয়২০২২ সাল থেকে পিংকফং কোম্পানির অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজি যেমন বেবেফিন ও সিলুকেরও দ্রুত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তবে কোরিয়া ইউনিভার্সিটির প্রভাষক মিন জাং কিম বলেন, কোম্পানিকে প্রমাণ করতে হবে, এই সফলতা শুধু বেবি শার্কের ওপর নির্ভরশীল নয়।
কিম মিন-সিওকের জোর দাবি, বেবি শার্ক ছাড়া অন্যান্য কনটেন্ট থেকেও তাদের ব্যবসা বাড়ছে। বর্তমানে পিংকফংয়ের আয়ের প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসছে বেবি শার্ক থেকে। বেবেফিন থেকে আসছে কোম্পানির আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ।
স্টক মার্কেটে অভিষেক থেকে প্রায় ৫২ মিলিয়ন বা ৫ কোটি ২০ লাখ ডলার সংগ্রহ করেছে পিংকফং। কিম জানান, এই অর্থ কনটেন্ট ও চরিত্রের উন্নয়নে ব্যবহৃত হবে।
উদ্ভাবনে পিছিয়ে থাকতে চায় না তারা। মানুষের পছন্দ কী, সে বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করে প্রযুক্তিভিত্তিক কনটেন্ট বানাতে চায় তারা। কিম বলেন, অনেক নির্মাতা সারা জীবন ধরে যে স্বপ্ন দেখেন, পিংকফং এরই মধ্যে তা অর্জন করে ফেলেছে। এখন বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে হবে, তারা কেবল একটি হিট গান–নির্ভর কোম্পানি নয়।
আইনি চ্যালেঞ্জপিংকফংয়ের যাত্রাপথ একেবারে কণ্টকমুক্ত ছিল না। ২০১৯ সালে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। অভিযোগ—এক মার্কিন সংগীতজ্ঞের সুর তারা নকল করেছে; কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার সুপ্রিম কোর্ট এই অভিযোগ খারিজ করে দেয়। আদালত বলেন, জনপরিসরে প্রচলিত লোকগান থেকে তারা সুর নিয়েছে।
আদালতের এই রায়ে তারা জোর পায়। সেই ধারাবাহিকতায় এখন তারা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলো।