ট্রাম্পকে বশে রাখতে সি চিন পিংয়ের তুরুপের তাস
Published: 20th, November 2025 GMT
দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব নেওয়ার পর সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবারের মতো চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ট্রাম্পের মতে, সাক্ষাৎকারটি ছিল ‘অসাধারণ’।
ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে লাগাতার চাপে রাখবেন। তবে বাস্তবে তার উল্টোটি ঘটে গেছে।
সম্প্রতি বেইজিংয়ে যেসব শীর্ষ চীনা অধ্যাপক ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তাঁদের সবাই একমত—সির আন্তর্জাতিক কৌশল পুরোপুরি সফল হয়েছে এবং ক্রমে ভেঙে যাওয়া বহু মেরুর বিশ্ব আজ চীনের জন্য বড় সুবিধা তৈরি করছে।
চীনা ভাবনা অনুযায়ী, আমরা একটি দীর্ঘস্থায়ী বিশ্বায়নবিরোধী যুগে প্রবেশ করছি। দারিদ্র্য থেকে দেশকে তুলে আনতে চীন বহু বছর ধরে রপ্তানিনির্ভর প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করেছে। এ প্রেক্ষাপটে এমন একটি যুগ তাদের জন্য সমস্যা বলে মনে হতেই পারে। তবে চীনা নেতারা এ নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন নন।
চীনা নেতাদের মতে, শীতল যুদ্ধের পর যে বিশ্বব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল, তার লক্ষ্য ছিল একটি একক বৈশ্বিক বাজার বানানো এবং আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ছড়িয়ে দেওয়া। অথচ আজ একক বাজারের বদলে বিশ্ব তিনটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ব্লকে ভাগ হয়ে গেছে।
আরও পড়ুনচীন যেভাবে বিদেশে স্বৈরাচারী শাসন ‘রপ্তানি’ করছে১০ নভেম্বর ২০২৫ব্লকগুলোর একটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন উত্তর আমেরিকা (যার মধ্যে মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকা অন্তর্ভুক্ত)। দ্বিতীয়টি হলো নিজেদের অবস্থান নির্ধারণে হিমশিম খাওয়া একটি উদীয়মান ইউরোপীয় পরিসর। তৃতীয়টি হলো এমন এক বিস্তৃত চীনা পরিধি, যেখানে আছে আসিয়ানের সদস্যদেশগুলো, দক্ষিণ আমেরিকার বড় অংশ, আফ্রিকার বহু দেশ ও সমগ্র গ্লোবাল সাউথের বিস্তৃত অঞ্চল।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জায়গায় চীনারা ভবিষ্যতে স্বৈরতন্ত্র ও উদারতাবিরোধী গণতন্ত্রের আরও বিস্তার দেখতে পাচ্ছেন। বিশ্বায়নের ধারণা ছিল, ব্যক্তিস্বাধীনতা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে অতিক্রম করবে এবং স্বৈরতন্ত্রের ওপর উদারবাদী গণতন্ত্র জয়ী হবে।
কিন্তু আমার চীনা আলাপসঙ্গীরা বলছেন, এখন পরিস্থিতি উল্টো; এই বিশ্বে মানবাধিকারের ওপর বারবার সার্বভৌমত্বকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। আর যুক্তরাষ্ট্র নিজেই যখন কিছুটা কর্তৃত্ববাদী আচরণ দেখাচ্ছে, তখন বিশ্বে যারা স্বৈরতান্ত্রিক পথে হাঁটতে চায়, তাদেরও আগের মতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
আমার আলাপসঙ্গীদের বিশ্বাস, এ অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ও কর্তৃত্ববাদী পন্থায় ঝুঁকে পড়া প্রবণতা বিশ্বরাজনীতিকে আবার সেই অবস্থায় ফিরিয়ে নেবে, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান ও নিয়মকানুন নয়; বরং শাসকদের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ব্যক্তিত্বই রাজনীতিকে চালাবে।
বাইরের দিক থেকে চীনকে যতটা আত্মবিশ্বাসী মনে হয়, আমার আলাপসঙ্গীদের দেওয়া ইঙ্গিত অনুসারে ততটা আত্মবিশ্বাসী তাঁরা নন। কারণ, তাঁদের দেশের ভেতরে দুর্বলতা ও অস্থিরতার বেশ কিছু উৎস রয়েছে। সেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে। ভোক্তাদের আস্থা দুর্বল হচ্ছে। আর স্থানীয় সরকারগুলোর বিপুল ঋণ এখনো বড় সমস্যা হয়ে আছে।ভৌগোলিক বাস্তবতা, শক্তির ভারসাম্য বা সম্পদের মতো কাঠামোগত উপাদানের চেয়ে এখন নেতাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও তাঁদের ব্যক্তিগত হিসাব-নিকাশের গুরুত্ব দ্রুত বাড়ছে।
আমার আলাপসঙ্গীরা মনে করেন, সামনের দিনগুলোতে ব্যক্তিগত স্বার্থ জাতীয় স্বার্থকে ছাপিয়ে যাবে। নেতাদের মধ্যে চুক্তি হবে, কিন্তু সেটি আসলে আনুষ্ঠানিক ‘চুক্তিপত্র’ অ্যাগ্রিমেন্ট হবে না, হবে ‘ডিল’। সেখানে প্রাধান্য পাবে ব্যক্তিগত ‘ইগো’, কোনো মতাদর্শ নয়।
এর অর্থ দাঁড়ায়—আজকের বাজারে যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক চলছে, তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিনির্ভর ও অনির্দেশিত হয়ে উঠছে। বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে যে অবস্থা ছিল, এর পর থেকে এমনটা আর হয়নি।
আরও পড়ুনসি চিন পিংয়ের কাছে লড়াইয়ে পরিষ্কারভাবে হেরে যাচ্ছেন ট্রাম্প২১ অক্টোবর ২০২৫প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের সময়ে বিশ্বের ভাগ্য নির্ভর করত রুশ জার নিকোলা দ্বিতীয়, জার্মান কাইজার ভিলহেলম দ্বিতীয় ও হ্যাবসবার্গ সম্রাট ফ্রানৎস জোসেফের ব্যক্তিগত খেয়ালখুশির ওপর। আর আজ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ট্রাম্প, সি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং তাঁদের মতো আরও অনেক নেতা।
চীনারা মনে করেন, এ নতুন বিশ্বের বাড়বাড়ন্ত দ্রুততর করতে বড় ভূমিকা রেখেছেন ট্রাম্প। তাঁদের দৃষ্টিতে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ প্রকল্পের দুটি লক্ষ্য আছে। প্রথম লক্ষ্য হলো বিভিন্ন অঞ্চলে এমন নিরাপত্তাকাঠামো তৈরি করা, যেখানে বড় শক্তিগুলোর মোকাবিলার ‘কঠিন কাজগুলো’ যুক্তরাষ্ট্র অন্যদের ওপর ছেড়ে দেবে। এতে ইউরোপীয়রা রাশিয়াকে ঠেকানোর দায়িত্ব নেবে; জাপান ও অস্ট্রেলিয়া চীনকে ভারসাম্যে রাখার কাজ আরও বেশি করে করবে; আর ইসরায়েল ও উপসাগরীয় দেশগুলো সামলাবে ইরানকে।
এতে ট্রাম্পের দ্বিতীয় লক্ষ্য পূরণ সহজ হবে। ট্রাম্পের সেই দ্বিতীয় লক্ষ্যটি হলো বিশ্বের অন্য বড় নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়া ও তাঁদের সঙ্গে ‘ডিল’ করার দিকে মনোযোগ দেওয়া। সে ডিলগুলো হতে পারে পুতিনের সঙ্গে অ্যাঙ্কোরেজে, সির সঙ্গে বুসানে বা ভবিষ্যতে কোনো একদিন ইরানের নেতৃত্বের সঙ্গে অন্য কোথাও।
আরও পড়ুনসি–পুতিনের মধ্যে শত্রুতা বাধাতে গিয়ে উল্টো বিপদে ট্রাম্প!২৬ মার্চ ২০২৫চীনারা অবশ্যই এ ধরনের ব্যবস্থাকে স্বাগত জানাবেন। কারণ, তাঁরা বহুদিন ধরেই একধরনের ‘অরাজকতামুখী বিশ্ব’ বা অগোছালো আন্তর্জাতিক পরিবেশের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছেন। এমনকি তাঁদের মধ্যে কিছু লোক এটিকে এক বিরল সুযোগ হিসেবেও দেখছেন। ট্রাম্পের সঙ্গে তাইওয়ান নিয়ে কোনো বড় ডিল করার সুযোগও করে দিয়েছে এ ব্যবস্থা। তাঁরা এমন একটি চুক্তির সম্ভাবনা কল্পনা করেন, যেখানে তাইওয়ানের বিদ্যমান কার্যত স্বাধীনতা শেষ হয়ে যাবে। এর বদলে ট্রাম্প শুধু অস্পষ্টভাবে প্রতিশ্রুতি দেবেন—বিশ্বের অন্য অঞ্চলগুলোতে এখন যে নিরাপত্তাব্যবস্থা আছে, তা আপাতত যেমন আছে তেমনই রাখা হবে।
কিন্তু প্রভাববলয় ভাগ করা একটি বৈশ্বিক ঝুঁকিও তৈরি করে। এ কারণেই চীন বহুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বল দিকগুলো খুঁটিয়ে দেখছে এবং এমন সব কৌশলগত পয়েন্ট চিহ্নিত করছে, যেগুলোকে প্রয়োজনে চাপ হিসেবে, মানে ‘ট্রাম্প কার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
যেমন বিরল খনিজ (রেয়ার আর্থ) রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে সত্যিই অপ্রস্তুত করে ফেলেছে এবং আলোচনার টেবিলে টেনে এনেছে। এটিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে সি ট্রাম্পের সঙ্গে নিজের অনুকূল একটি চুক্তি নিশ্চিত করেছেন।
তবে বাইরের দিক থেকে চীনকে যতটা আত্মবিশ্বাসী মনে হয়, আমার আলাপসঙ্গীদের দেওয়া ইঙ্গিত অনুসারে ততটা আত্মবিশ্বাসী তাঁরা নন। কারণ, তাঁদের দেশের ভেতরে দুর্বলতা ও অস্থিরতার বেশ কিছু উৎস রয়েছে। সেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে। ভোক্তাদের আস্থা দুর্বল হচ্ছে। আর স্থানীয় সরকারগুলোর বিপুল ঋণ এখনো বড় সমস্যা হয়ে আছে।
মার্ক লিওনার্ড ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক
স্বত্ব : প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র গণতন ত র ব যবস থ দ র বল ন র ভর লক ষ য আম র ক র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
জকসু: জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ অনিকের সম্মানে পদ খালি রাখল ছাত্রশক্তি
প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জকসু) নির্বাচনে ‘ঐক্যবদ্ধ জবিয়ান’ নামে প্যানেল ঘোষণা করেছে জাতীয় ছাত্রশক্তি। তবে বিশেষ সম্মান প্রদর্শনের অংশ হিসেবে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র’ সম্পাদক পদটি খালি রেখেছে সংগঠনটি।
গত বছরের জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হওয়া অনিক কুমার দাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংগঠনটি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।
আরো পড়ুন:
জকসু: প্যানেল ঘোষণাতেই আচরণবিধি লঙ্ঘন শিবির-ছাত্রশক্তির
জকসু নির্বাচন: নবীনদের ‘তরুণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল ঘোষণা
মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা শহীদ রফিক ভবনের সামনে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদ হাসান প্যানেল ঘোষণা করলে এ তথ্য জানা যায়।
গত বছরের ১৬ জুলাই ঢাকার সিএমএম আদালত এলাকায় আন্দোলন চলাকালে চারজন গুলিবিদ্ধ হন। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা অনিক তাদেরই একজন।
জবি শাখা ছাত্রশক্তির আহ্বায়ক ফয়সাল মুরাদ বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যে চারজন প্রথম গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, অনিক তাদের মধ্যে একজন। তার ত্যাগ পুরো দেশ দেখেছে। সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা আওয়ামী লীগ সমর্থক—এই প্রচলিত ধারণাটিও অনিক ভেঙে দিয়েছে নিজের বুক পেতে গুলি খেয়ে।”
তিনি বলেন, “অনিকের সেই অবদান ও ত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশক্তি ‘মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র’ সম্পাদক পদে কোনো প্রার্থী দেইনি।”
অনিক কুমার দাস বর্তমানে ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নির্ভীক জবিয়ান’ প্যানেল থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র’ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর এবারই প্রথম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জকসু নির্বাচন। আগামী ২২ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণ হবে। ইতোমধ্যে মনোনয়নপত্র বিতরণ প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে।
ঢাকা/লিমন/মেহেদী