ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে যেসব দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো রয়েছে তা উন্মুক্ত। সবগুলো ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে রয়েছে। সেখান থেকে দেখে নিতে বললেন বাংলাদেশের জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম। বৃহস্পতিবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন তিনি।

ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশটির নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন কিনা, সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানা নেই বাংলাদেশ সরকারের। একইসঙ্গে শেখ হাসিনা দেশটিতে কোন বিবেচনায় থাকছেন তা ভারতের বিবেচনাধীন বিষয় হিসেবে দেখছে সরকার বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ রফিকুল আলম।

ভারতের সঙ্গে চুক্তি পর্যালোচনা নিয়ে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে হয়েছে। কোনো মন্ত্রণালয় ও সংস্থা পর্যালোচনা অনুভব করলে, করতে পারে। ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে, তার সব চুক্তি প্রকাশিত। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে, এগুলো জনগনের জন্য উন্মুক্ত।

বাংলাদেশ কি চুক্তিগুলো হারিয়ে ফেলেছে, কেনো ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখতে হবে– উত্তরে রফিকুল আলম বলেন, বিষয়টি ছিল চুক্তিগুলো কবে উন্মোচিত করা হবে। এখানে উন্মোচনের বিষয় নেই, কারণ এগুলো উন্মোচিত। বাংলাদেশ উন্মোচন করেছে কি না, তা বিবেচ্য নয়। নথিগুলো ইতোমধ্যে উন্মুক্ত।

ভারতের সঙ্গে কোনো গোপন চুক্তি আছে কিনা-জানতে চাইলে মুখপাত্র বলেন, সেটা আমার জানা নেই।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে যা আছে সেটি কি সঠিক হিসেবে ধরে নিতে হবে, কারণ সম্প্রতি সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নিয়েও নিজেদের সঠিক বলে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল। উত্তরে তিনি বলেন, আমি নিজে তাদের ওয়েবসাইটে যতগুলো চুক্তি দেখেছি, সেখানে উভয় পক্ষের স্বাক্ষর রয়েছে। সেখান থেকে ধরে নিতে পারি চুক্তিগুলো সঠিক। বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে পৃথিবীর কোনো দেশের সঙ্গেই চুক্তিগুলো আপলোড করা নেই।

দিল্লিতে বাংলাদেশের নতুন হাইকমিশনার হিসেবে মনোনীত ব্যক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এগ্রিমো চেয়েছি এবং ভারত থেকে এটার উত্তরের জন্য অপেক্ষায় রয়েছি। সাধারণত এগুলোর নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। তবে দুই থেকে চার মাসের মধ্যে হয়ে যায়।

জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলকে তথ্য দেওয়া নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে রফিকুল আলম বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ইতোমধ্যে জাতিসংঘকে দেওয়া হয়েছে।

মুখপাত্র জানান, আগামী ২১-২৪ জানুয়ারি ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের (ডাবলুইএফ) বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। এ জন্য সুইজারল্যান্ডের ডাভোস সফর করবেন তিনি। সফরে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয় সংক্রান্ত বিশেষ দূত এবং এসডিজি বিষয়ক প্রিন্সিপাল কোওর্ডিনেটর অংশগ্রহণ করবেন। 

এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ‘শেপিং দ্যা ইন্টিলিজেন্ট এজ’ এর আলোকে আয়োজিত বিভিন্ন সেশনে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করবে। এছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানসহ গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাত করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
 
জুলাই বিপ্লবে আহতদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে গুরুতর আহত রোগীদের বিভিন্ন দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রেরণে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান মুখপাত্র। তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনসমূহ নিরলস পরিশ্রম করে এই প্রক্রিয়ায় দ্রুত ভিসা পাচ্ছে। এ পর্যন্ত ১৩ জন আহতকে দেশের বাইরে উন্নত চিকিৎসা প্রদানের জন্য পাঠানো সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে ২ জন চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে দেশে ফেরত এসেছে। এছাড়াও ৮ জানুয়ারি থেকে ১৬ জানুয়ারি তারিখ পর্যন্ত মোট ১৯ জনের ভিসা প্রক্রিয়া করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে ১৪ জন ভিসা পেয়েছে। এই ১৪ জনকেও উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে দ্রুত পাঠানো সম্ভব হবে। উল্লেখ্য, মুমূর্ষু ৪ জনকে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে পাঠানো হয়েছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

আমার জন্মঋতু

আমি বন্ধনহীন মৌসুমী বায়ু—, ভ্রমি দেশে দেশে দেশে

শেষে পৌঁছেছি এনে আমার প্রিয় বাংলাদেশে।

তোমার স্পর্শ পেয়ে পেয়ে আমাকে ঝরতে হবে জানি।

তোমার প্রতিটি নদী-নালা, পথ-ঘাট, পুকুর-প্রান্তর,

খাল-বিল, গুহা-গিরি আমাকে করতে হবে জানি।

শরৎ আসার পরে আমাকে মরতে হবে জানি।

(বর্ষার মতো প্রেমিক)

প্রতিটি বর্ষায় আমি কিছু না কিছু কবিতা লিখি। আমাদের পত্রিকাগুলো বর্ষার ওপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। ওই সব পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদকদের মধ্যে কেউ কেউ আমার কাছে বর্ষার ওপর রচিত নতুন কবিতা চান। আমি পারতপক্ষে তাদের নিরাশ করি না। বিষয়ভিত্তিক কবিতা রচনায় আমার মন আজকাল আগের মতো সাড়া দেয় না। তবে বর্ষার কথা ভিন্ন। বর্ষার আগমনে আমার কবিচিত্ত মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা ব্যাঙের মতোই মহানন্দে আত্মপ্রকাশ করে তার প্রিয় সঙ্গমসঙ্গিনীকে খুঁজে বেড়ায়। ফলে প্রতিটি বর্ষায়, তা কোনো পত্রিকা আমার কাছে বর্ষার ওপর কবিতা চান বা না চান, আমি লিখি।

না লিখে পারি না আমার কবিতার সতর্ক পাঠক যদি থেকে থাকেন, তো মানলেন যে, আমার কবিতায় যে ঋতুটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছে, বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে, তার নাম বর্ষা। আমার আরেক প্রিয় ঋতু হলো বসন্ত। বাংলার অন্য সকল কবির মতোই বসন্তেও আমি কম উন্মাদ হই না। তবে বর্ষার তুলনায় কম। এর কারণ, নিশ্চিত জানি আমার জন্মের মধ্যে নিহিত। বর্ষা আমার জন্মসূত্রে পাওয়া ঋতু। আষাঢ় মাসের সপ্তম দিনের এক বৃষ্টিঝরা সকালে আমার জন্য হয়েছিল। এ শুধুই আমার শোনা কথা নয়, আমার স্মৃতিকথাও। আমি কান পাতলেই আমার জন্মগ্রামের আকাশ কালো করে নামা সেই আষাঢ়ীবর্ষণের মার্গসংগীতধ্বনি এখনো স্পষ্ট শুনতে পাই।

বর্ষার ওপর রচিত আমার কবিতাসমূহের একটি পৃথক কাব্যসংকলন আমি প্রকাশ করেছি। বসন্তের ওপরও একটি কাব্যসংকলন আছে। তবে বর্ষার ওপর লেখা আমার কবিতার সংখ্যা যেমন বেশি, মান বিচারেও তারা অধিক গুণী। যে কবিতাটি ওপরে উদ্ধৃত করেছি, কোনো পত্রিকার সাহিত্য পাতার চাহিদা পূরণের জন্য নয়, বর্ষাসিক্ত কবিচিত্তের অন্তর্গত চাহিদা মেটাতেই সেটি সম্প্রতি রচিত হয়েছে। কবিতাটিতে বাংলাদেশকে কল্পনা করা হয়েছে গ্রীষ্মতপ্ত প্রেয়সীরূপে, কবি যেন বিরহী যক্ষ। মৌসুমি বায়ুরূপে বিশ্বভ্রমণ শেষে সে ফিরে এসেছে তার প্রেয়সীর দেহসীমায়। যক্ষপ্রিয়ার দেহের সকল তৃষিত অঞ্চলে সে ঢালবে তার সঙ্গে করে নিয়ে আসা মেঘজলধারা। আকাশ কাঁপিয়ে, শুকনো মাটি ভিজিয়ে নামবে বৃষ্টি। অবিচ্ছিন্ন লয়ে বাংলার তপ্তশুষ্ক মাটি আর মেঘভারেনত আকাশকে সে বেঁধে দেবে অন্তহীন অঝোর বর্ষণে।

এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, যা হয়েছিল নূহের প্লাবনের সময়; এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, মানবমনের ভেতরের সুপ্ত কাম ও বিরহবোধকে যে জাগ্রত করে, ববীন্দ্রনাথের মতো নমিতকামের কবিও তখন বিশ্বাস করেন—এমন দিনেই তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়, এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, পবিত্র বেদে যাকে কল্পনা করা হয়েছে মহান মৃত্যুর সঙ্গে। এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, কবি শহীদ কাদরী যাকে তুলনা করেছেন সন্ত্রাসের সঙ্গে।

আমার জীবনের প্রথম ষোল বছর প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবে আমি আমার জন্মগ্রামে কাটিয়েছি। শহরে যারা জন্মগ্রহণ করেন তাদের জন্মকে সামান্যতম খাটো না করেও বলি, গ্রামে জন্মগ্রহণ করার জন্য আমি নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান বলে মনে করি। প্রকৃতির সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক, তাকে যে আমি খুব কাছের করে চিনেছি, আপন বলে জেনেছি, সেটা সম্ভব হয়েছে অবিচ্ছিন্নভাবে আমি আমার শৈশব-কৈশোর গ্রামের বন-জঙ্গলে কাটাতে পেরেছি বলেই। বাংলার ষড়ঋতুর রূপবৈচিত্র্যকে আমি খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করার যে সুযোগ পেয়েছি, তাকে আমি যে আমার কবিতায় সেভাবে ধরতে পারিনি, তার জন্য দায়ী আমার প্রয়োজনীয় কারাশক্তির অভাব। সে কারণে আমার আত্মগ্লানি আছে বটে, কিন্তু তার নিবিড় সান্নিধ্যলাভের স্মৃতি আমার চির গৌরবের ধন। প্রকৃতিকে আমি কখনো পেয়েছি প্রেয়সীরূপে, কখনো দেখেছি জননীরূপে। আমি বুঝেছি, তার সঙ্গে আমার অস্তিত্ব এক অন্তহীন লীলায় জড়ানো। ফলে বলা যায় একেবারে খোলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে বর্ষার আগমন, অবতরণ ও তার প্রত্যাগমনকে দেহেমনে মিলিয়ে খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। গুনেছি আকাশে আকাশে মেয়ের গুরুগুরু ডাক। বুঝেছি, গ্রীষ্ম-অবসানে আসছে আমার। জন্মসহোদর, আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু বর্ষা। আসছে আষাঢ়। আমার বেসুরো কণ্ঠেও লতিয়ে উঠেছে গান— 'আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।' আহ, কী চমৎকার।

বর্ষা আমাকে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তার সঙ্গে করে। দু কূল প্লাবিত করা নদীর আনন্দে, মাঠে-ঘাটে, ঝালে-বিলে, পুকুরে প্রান্তরে আমি বর্ষাকে তার জলজগৎ বিস্তার করতে দেখেছি। সে আমার কানে কানে বলেছে, আমি কীভাবে আমার দেশপ্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গম করি দেখো। আমি দেখেছি। প্রাণ ভরে

দেখেছি বর্ষার রূপ।

আমি যখন এই বর্ষাবন্দনা লিখছি, তখন আষাঢ় গত হয়েছে। চলছে শ্রাবণ। শ্রাবণের পুরোটাই সামনে পড়ে আছে। বলা যায় এখন বর্ষার ভরা যৌবন। ঢাকায় বসে তার রূপ দেখছি টিভির পর্দা আর পত্রিকার পাতায়। তার প্রকৃত চেহারাটা দেখতে পাচ্ছিনে এখানে। এই নিয়ে কবিতাও লিখেছি। গ্রামে ছোট ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, বর্ষা, কতটা জাঁকিয়ে বসেছে সেখানে। সে জানিয়েছে, যদি বর্ষা বিষয়ে নতুন করে কিছু লিখতেই চাও তো গ্রামে চলে এসো। বর্ষা দেখে যাও। আজ তিন দিন হলো দিন-রাত বৃষ্টি। নদী-নালা, মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর ডুবিয়ে সে মেলে ধরেছে তার চোখজুড়ানো রূপ। আমি চোখ বন্ধ করে, কল্পনায় তার রূপ দেখলাম। মনে পড়ল, কত অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লীজননী।

বাংলার কবির কাছে, কবির চোখে বর্ষার কি আলাদা কোনো রূপ আছে? এর উত্তর সহজ নয়। জীবনানন্দ বলেছেন—সকলেই পবি নয়, কেউ কেউ করি। তার এই স্মরণীয় উক্তিটি ছোট কবিদের ভিড় থেকে বড় কবিদের পৃথক করার প্রয়োজন মেটায়। কিন্তু প্রকৃতির রাজ্যে সব মানুষই যে কমবেশি করি, আমার এই উপলব্ধিকে বাতিল করে না। বাংলার লোককবিদের রচিত কাব্যে, গানে তারই পরিচয় দেখতে পাই। অন্য কবিদের জন্মকথা বলতে পারিনে, তবে আমার কবিজন্ম যে বর্ষামায়ের গর্ভে, সে কথা না বললে নিশ্চিত জানি, স্বর্ণে বসে চিত্রগুপ্ত অকৃতজ্ঞের তালিকায় আমার নামটিও লিপিবদ্ধ করবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ