সীমান্তে মিয়ানমারের প্রায় ২৭০ কিলোমিটার এলাকা বেশ কিছুদিন ধরেই সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। এর পর থেকেই নাফ নদে মিয়ানমার অংশে নৌ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তারা। এর প্রভাব পড়ে টেকনাফকেন্দ্রিক সীমান্ত বাণিজ্যে। 

এই জানুয়ারিতে এখন পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে কোনো পণ্যবাহী জাহাজ টেকনাফ বন্দরে নোঙর করেনি। উল্টো বাংলাদেশমুখী পণ্যবাহী চারটি কার্গো আটকে রেখেছে আরাকান আর্মির সদস্যরা। মিয়ানমারের ইয়াংগুন থেকে এসব জাহাজ পণ্য নিয়ে রওনা হওয়ার পর টেকনাফে বাংলাদেশ জলসীমায় ঢোকার আগেই জাহাজের ক্রু ও নাবিককে জিম্মি করা হয়। এর পর মংডুর খায়ুংখালী খালে নিয়ে আলাদা জায়গায় এসব জাহাজ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি জাহাজ বৃহস্পতিবার থেকে, বাকি দুটি শুক্রবার থেকে খায়ুংখালি রয়েছে। কবে নাগাদ জাহাজ চারটি ছাড়া পাবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। এসব জাহাজের মালিক মিয়ানমারের হলেও সব পণ্য বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নাফ নদে দেশটির জলসীমানা দিয়ে চলাচলকারী নৌযান থেকে কমিশন পেতে চায় আরাকান আর্মি! এ কারণে তারা পণ্যভর্তি কার্গো আটকে রাখার মতো নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়েছে।  

এ ব্যাপারে টেকনাফের স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক জসিম উদ্দিন সমকালকে বলেন, পণ্যবাহী ৪টি কার্গো আরাকান আর্মি এখনও ছাড়েনি। এ ঘটনার পর থেকে ব্যবসায়ীরা ভয়ে আছেন। কত টাকার পণ্য রয়েছে, এটা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। একাধিক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের পণ্য রয়েছে। আরাকান আর্মি কী কারণে 
পণ্যবাহী জাহাজ আটকে রেখেছে, এটা নিশ্চিত নই। কমিশনের জন্য কিংবা অন্য কারণও থাকতে পারে। কার্গো বন্দরে এলে ক্যাপ্টেন ও ক্রুর সঙ্গে কথা বললে আসল সত্য জানা যাবে। 
তিনি বলেন, এর আগে থেকে মিয়ানমারে সংঘাতের কারণে ব্যবসায়ীদের পণ্য আসা কমেছিল। তবে এ সমস্যা সমাধানে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত। তা না হলে টেকনাফ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন ব্যবসায়ীরা। 

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জিন্নাহ অ্যান্ড ব্রাদার্সের কর্ণধার শওকত আলী বলেন, ইয়াংগুন থেকে এসব কার্গো আসছিল। টেকনাফে আসতে সাধারণত তিন দিন লাগে। কার্গোতে অনেক ব্যবসায়ীর পণ্য রয়েছে। আমারও এক কোটি টাকার শুঁটকি ও আচার আছে। ২০০৩ সাল থেকে টেকনাফ বন্দর ঘিরে ব্যবসা করি। কখনও এ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। শুনেছি, আরাকান আর্মি ১০ শতাংশ কমিশন চায়। এই ধরনের ঝুঁকি নিয়ে কে ব্যবসা করবে?

আব্দুল্লাহ অ্যান্ড সন্সের মালিক মো.

রানা বলেন, চার কার্গোতে একশর বেশি ব্যবসায়ীর ৫০ কোটি টাকার বেশি পণ্য রয়েছে। ট্রান্সশিপমেন্টের ওপর কমিশন চায় আরাকান আর্মি। জাহাজের মালিকরা আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। আমরা উদ্বিগ্ন, কবে নাগাদ জাহাজ ছাড়া পাবে! অনেক ব্যবসায়ী আছেন যাদের পণ্য দীর্ঘদিন আটকে থাকলে পথে বসবে। 

রানা আরও বলেন, টেকনাফের জলসীমানা দিয়ে পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট চার্জ নেয়। এটা নদী খনন বা ব্যবস্থাপনার কাজে খরচ করার কথা। তবে টেকনাফ বন্দর চালু হওয়ার পর থেকে আজও নাফ নদের বাংলাদেশ অংশ খনন করা হয়নি। এটি খনন করা হলে নাফ নদের মিয়ানমার অংশ হয়ে জাহাজ ও ট্রলার চলাচল করতে হতো না। এতে আরাকান আর্মিও জাহাজ আটকে দেওয়ার সুযোগ পেত না। নদী খনন না হলে কেন ‘রিভার ডিউস চার্জ’ দেব?

নাফ নদ খনন না হলেও চার্জ নেওয়ার ব্যাপারে টেকনাফের স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক জসিম উদ্দিন বলেন, নাফ নদে বাংলাদেশের অংশে খনন হয়নি কখনও। হয়নি সমীক্ষাও। খনন করা গেলে হয়তো নাফে আমাদের চ্যানেল দিয়ে নৌযান চলাচল করতে পারবে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম বলেন, অনেক দিন ধরেই সীমান্তের এই এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। তাহলে কেন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে ওই রুটে মিয়ানমারের কার্গো চলাচল করেছে? আগে তাদের ‘ক্লিয়ারেন্স’ নেওয়ার দরকার ছিল। এখন কার্গোর মালিকরা আরাকান আর্মির সঙ্গে সমঝোতা করে এগুলো ছাড়াতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যে কোনো সশস্ত্র গ্রুপ কমিশন চাইবে। আরাকান আর্মি তা-ই করছে।

স্থলবন্দরের একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেড় মাস পর শনিবার ইয়াঙ্গুন থেকে কয়েকজন ব্যবসায়ীর পণ্যবাহী কার্গো বোট টেকনাফ স্থলবন্দরের উদ্দেশে রওনা দেয়। পাঁচ দিনের মাথায় প্রথমে দুটি বোট বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় নাফ নদের মোহনায় সে দেশের জলসীমানায় নাক্ষ্যংকদিয়া নামক এলাকায় তল্লাশির নামে আটকে দেয় আরাকান আর্মি। পরদিন আরও দুটি একই কায়দায় আটকে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আচার, শুঁটকি, সুপারি, কপিসহ ৫০ হাজারের বেশি বস্তা পণ্য রয়েছে। এসব পণ্য স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী শওকত আলী, ওমর ফারুক, মো. আয়াছ, এমএ হাসেম, মো. ওমর ওয়াহিদ, আবদুর শুক্কুর সাদ্দামসহ অনেকের।

এ ব্যাপারে টেকনাফ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর বলেন, ‘মিয়ানমারের সংঘাতের পর থেকে ব্যবসায়ীরা খুব বিপদে আছে। অনেকে পণ্যের জন্য ডলার পাঠানোর পরও পণ্য আনতে পারছে না। অনেক ব্যবসায়ী টেকনাফ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছে। সরকারের উচিত মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলে দু’দেশের স্বার্থে সীমান্ত বাণিজ্য সচল রাখা।’ 

২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত আরাকান আর্মি দখলে নেওয়ার পর থেকে ভয়ে ছিলেন ব্যবসায়ীরা। স্থলবন্দরের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘শুরুতে পণ্যবাহী কার্গো ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও এখন আরাকান আর্মি এই পণ্য থেকে লেনদেনের ভাগ চায়।’ 

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘আরাকান আর্মি এখন সীমান্তে বাণিজ্যের মধ্যে ভাগ বসাতে চায়। এ কারণে পণ্যবাহী কার্গো আটকে দিয়েছে। কমিশন পেলে ছেড়ে দেবে। দু’দেশের স্বার্থে সেখানকার ব্যবসায়ীদের উচিত এটার স্থায়ী সমাধান করা। তা না হলে সীমান্ত বাণিজ্যে বড় প্রভাব পড়বে।’ 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পণ্যবাহী ট্রলার আসতে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পর থেকে তাদের জলসীমানা পার হতে হয়, যেটি বর্তমানে আরাকান আর্মির দখলে। তাই তারা পণ্যবাহী কার্গো বোটগুলো আটকানোর সুযোগ পেয়েছে। আরাকান আর্মি তাদের জলসীমানা থেকে পারমিট না দিলে পণ্যবাহী কোনো ট্রলার এখানে (স্থলবন্দর) আসার সুযোগ নেই। সেটিকে কাজে লাগিয়ে তারা সীমান্ত বাণিজ্যের ভাগ বসানোর চেষ্টা করছে। 

টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, টেকনাফ স্থলবন্দরে আসার পথে মিয়ানমারের জলসীমানায় পণ্যবাহী কার্গো বোটে তল্লাশি চালানো হয়েছে বলে শুনেছি। 
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, কার্গো আটকের খবরটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। বিজিবিকেও জানানো হয়েছে।  
মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধে ৮ ডিসেম্বর রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপ আরাকান আর্মির দখলে নেয়। এর পর থেকে কোনো পণ্যবাহী জাহাজ বন্দরে আসেনি।

বন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের জুন-নভেম্বর পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে নানা ধরনের ৮ হাজার ৮০০ টন পণ্য এসেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসেছিল ৭৮ হাজার ৫২৭ টন। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পণ্য এসেছে ১ লাখ ৯৯ হাজার ২২৫ টন। অন্যদিকে, বাংলাদেশ থেকে জুন-নভেম্বর পর্যন্ত টেকনাফ স্থলবন্দর হয়ে মিয়ানমারে পণ্য গেছে মাত্র ৩১০ কেজি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গেছে ১ হাজার ৪০৮ টন। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৫২৩ টন পণ্য।
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের কাঠ, হিমায়িত মাছ, শুকনা সুপারি, পেঁয়াজ, আদা, শুঁটকি, নারকেল, আচার প্রভৃতি পণ্য আমদানি হয়। বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে যায় আলু, প্লাস্টিক পণ্য, সিমেন্ট, তৈরি পোশাক, বিস্কুট, চানাচুর, চিপস ও কোমল পানীয়। 

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আর ক ন আর ম র য় আর ক ন আর ম ন ব যবস য় র ক ব যবস য় র পর থ ক ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

কমপ্লায়েন্সের অভাবে ধুঁকছে চামড়া খাতের রপ্তানি

চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। পণ্য উৎপাদনের প্রধান কাঁচামালের শতভাগ জোগান থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিতে এ খাতে তেমন অগ্রগতি নেই। এ খাতে কমপ্লায়েন্স বা যথাযথ মান প্রতিপালনের অভাবে ধরা যাচ্ছে না বৈশ্বিক বাজার। বাধ্য হয়ে পানির দরে চীনে রপ্তানি করতে হচ্ছে। এ কারণে কোরবানির পশুর কাঁচাচামড়ার দামও পাওয়া যাচ্ছে না। 
বিশেষজ্ঞ ও খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকায় বিদেশি ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ থেকে চামড়া নিতে নিরুৎসাহিত হন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিশোধন ব্যবস্থায় ঘাটতি থাকার কারণে এই সনদ পাচ্ছে না ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে ব্যাপক সুযোগ এবং সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববাজারে জায়গা করে নিতে পারছে না বাংলাদেশের চামড়াশিল্প। এতে একদিকে যেমন দাম না পাওয়ায় প্রতিবছর কোরবানির পশুর চামড়া নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে চামড়াপণ্য রপ্তানির জন্য বছরে অন্তত এক বিলিয়ন ডলারের চামড়া আমদানি করতে হচ্ছে। তারা বলছেন, সরকার কিছু অর্থ ব্যয় করে সাভারের ট্যানারিপল্লিকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে তা বিশ্বে মডেল হিসেবে দাঁড়াবে। এতে বাংলাদেশ যেমন ব্র্যান্ডিং হবে তেমনি রপ্তানিও বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে পণ্যের দাম। তা ছাড়া পরিবেশবান্ধব ট্যানারি গড়ে তুলতে না পারায় বিদেশি বিনিয়োগ টানতেও বাংলাদেশ ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করেন তারা। 
রপ্তানির চিত্র
একসময় পাট, চা ও চামড়া ছিল অন্যতম রপ্তানি খাত। রপ্তানিতে পাট ও চা অনেক আগেই সেই জৌলুস হারিয়েছে। এখন চামড়া খাতও অনেকটা সেই পথে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০২০ সালের দিকে চামড়া ও চামজাড়াত পণ্য থেকে ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু রপ্তানির চিত্র বলছে, সেই পথ এখনও বহু দূর। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করে ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমছে রপ্তানি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলার ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০১ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের রপ্তানি হয়েছে। তবে করোনা অতিমারির কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানিতে বড় ধস নামে। ওই বছর মাত্র ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এরপর কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায় রপ্তানি। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯৪ কোটি ১৭ লাখ ডলারের রপ্তানি হলেও পরের ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ১২৪ কোটি ৫১ লাখ ডলারের। তবে ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ফের কমে যায়। এই দুই বছরে এ খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে যথাক্রমে ১১৭ কোটি ৫৫ লাখ ডলার ও ১০৩ কোটি ৯১ লাখ ডলার। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১১ মাসে রপ্তানি আয় এসেছে ১০৫ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। একসময় ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে চামড়া নিত। প্রতি বর্গফুট চামড়ার দর ছিল অন্তত এক ডলার। কমপ্লায়েন্সের অভাব থাকায় এখন ইউরোপের ক্রেতারা নিচ্ছে না। ফলে এক রকম বাধ্য হয়ে চীনে রপ্তানি করতে হচ্ছে পানির দরে। রপ্তানিকারকরা জানান, দাম কমতে কমতে এখন ৫০ থেকে ৬০ সেন্টে নেমেছে। মূলত আন্তর্জাতিক মান সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকায় রপ্তানি বাজার ধুঁকছে।
কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কেমন
দেশে ২০১৩ সালের কোরবানির গরুর চামড়ার দাম ছিল বর্গফুটপ্রতি ৮৫-৯০ টাকা। এরপর থেকে দাম কমতে থাকে। বড় ধস নামে ২০১৯ সালে। তখন ন্যূনতম দাম না পেয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চামড়া নদী-নালায় ও সড়কে ফেলে ও মাটিতে পুঁতে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ফলে নষ্ট হয় শত শত কোটি টাকার চামড়া। এরপর আরও কমছে দাম। এ বছর ঢাকায় কোরবানির গরুর কাঁচাচামড়া ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকায় চামড়া বিক্রি হলেও ঢাকার বাইরে ছিল হতাশার ছাপ। গ্রামগঞ্জে প্রতিটি চামড়া বেচাকেনা হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। ছাগলের চামড়ার ক্রেতা খুঁজেও পাওয়া যায়নি।
পরিবেশবান্ধব হতে ট্যানারিপল্লি কতটা প্রস্তুত
পরিবেশদূষণ রোধে ২০০৩ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগর স্থাপনের কাজ শুরু হয়। যেখানে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১১শ কোটি টাকা। প্রায় ২২ বছর অতিবাহিত হলেও এটি এখনও পুরোপুরি কার্যকরী শিল্পনগরী হয়ে ওঠেনি। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০১২ সালে। সেটি নির্মাণের পর পুরোপুরি চালু না করেই ২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর করা হয় হেমায়েতপুরে। এখনও কাঁচাচামড়া প্রক্রিয়াজাত করার ফলে সৃষ্ট তরল ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, লবণ বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থা এবং সাধারণ ক্রোমিয়াম পুনরুদ্ধার ইউনিট স্থাপনে তেমন অগ্রগতি হয়নি সেখানে। সাভারে স্থানান্তরিত ট্যানারি মালিকরা জানান, সিইটিপির তরল বর্জ্য পরিশোধনের সক্ষমতা দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ হাজার ঘনমিটার। কোরবানির পর ট্যানারিগুলো পুরোদমে চামড়া প্রক্রিয়াজাত শুরু করলে তখন ৪০ থেকে ৪৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য উৎপাদন হয়, যা সিইটিপির সক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। 
এলডব্লিউজি সনদ পেতে বাধা কোথায়
বিসিক ও বিডার এক গবেষণায় দেখা গেছে, এলডব্লিউজি পেতে হলে চামড়াশিল্পের পরিবেশগত মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ১৭টি বিষয়ে ১ হাজার ৭১০ নম্বর পেতে হয়। যার মধ্যে ৩০০ নম্বর রয়েছে সিইটিপিসংক্রান্ত। বাকি ১ হাজার ৪১০ নম্বর রয়েছে জ্বালানি খরচ, পানির ব্যবহার, রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, চামড়ার উৎস শনাক্তকরণ, দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার মান ইত্যাদি বিষয়। এসব মানদণ্ড পূরণের দায়িত্ব ট্যানারি মালিকদের।  
জানা গেছে, বর্তমানে ১৫ থেকে ২০টি ট্যানারির এলডব্লিউজি সনদের শর্ত পূরণ করার সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু তারা অন্যান্য মানদণ্ডে ভালো নম্বর পেলেও সিইটিপিসংক্রান্ত নম্বরে পিছিয়ে রয়েছে, ফলে সনদও মিলছে না। কারণ তরল বর্জ্য, রাসায়নিক ঠিকমতো পরিশোধন হচ্ছে না, যা দূষিত করছে আশপাশের নদী ও পরিবেশ।  
এখন পর্যন্ত এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে মাত্র সাতটি প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হচ্ছে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, রিফ লেদার, এবিসি লেদার, সুপারেক্স লেদার, সাফ লেদার, সিমোনা ট্যানিং এবং অস্টান লিমিটেড। এগুলোর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠান ফিনিশড লেদার উৎপাদন করে। তবে সাভারের ট্যানারি পল্লিতে এই সনদ পেয়েছে একমাত্র সিমোনা ট্যানিং। প্রতিষ্ঠানটি ক্রাস্ট ও ফিনিশড লেদার উৎপাদন করে। 
কী বলছেন ট্যানারি মালিক ও রপ্তানিকারকরা
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সহসভাপতি ও ভুলুয়া ট্যানারির চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল সমকালকে বলেন, একসময় চীনে রপ্তানির আগ্রহ ছিল না রপ্তানিকারকদের। এখন বাধ্য হয়ে চীনকে দিতে হচ্ছে। প্রতি বর্গফুট চামড়া রপ্তানি করতে হচ্ছে এক ডলারে। ইউরোপের ক্রেতা না থাকায় কখনও কখনও ৪০ সেন্টেও রপ্তানি করতে হয়। এর মূল কারণ এলডব্লিউজি সনদ না থাকা।
তিনি বলেন, ২০১৭ সালে ট্যানারিগুলোকে সরকার বাধ্য করেছিল সাভারের ট্যানারি পল্লিতে যেতে। সেখানে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশবান্ধব ট্যানারি গড়ে তোলা। পরিপূর্ণ কমপ্লায়েন্স হওয়া। যাতে চামড়ার ভালো দাম পাওয়া যায়। সেই আশা বিফলে গেছে। সাভারে সরকার পরিপূর্ণ সিইটিপি গড়ে তুলতে পারেনি। 
জুতা উৎপাদনকারীরা জানান, জুতা তৈরি করার জন্য মাসে ১২ থেকে ১৫ লাখ বর্গফুটের মতো চামড়া আমদানি করতে হয় বাংলাদেশকে। ফলে চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য রপ্তানি করে যে পরিমাণ আয় হয়, তা চলে যায় আমদানিতে। বেঙ্গল লেদার কমপ্লেক্সের মালিক ও বিএফএলএলএফইএর উপদেষ্টা টিপু সুলতান বলেন, চামড়ার রপ্তানি মূল্যের চেয়ে আমদানি মূল্য কয়েক গুণ বেশি। একসময় প্রতি বর্গফুট চামড়া রপ্তানি হতো কমপক্ষে এক ডলারে। এখন ৫০ থেকে ৬০ সেন্টের বেশি পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রতি বর্গফুট চামড়া আমদানি করতে হয় দুই থেকে আড়াই ডলারে। তবে আমদানি করা চামড়া উন্নত মানের। সালমা ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সিনিয়র সহসভাপতি সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও ট্যানারিপল্লিকে কমপ্লায়েন্স করতে পারেনি সরকার। এ কারণে এলডব্লিউজি সনদ মিলছে না। রপ্তানির সম্ভাবনাকেও কাজে লাগানো যাচ্ছে না। 
বিশেষজ্ঞ মত
এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় চামড়ার রপ্তানি মূল্য পাওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করেন ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক ড. সবুর আহমেদ। তিনি বলেন, দেশে যেমন কাঁচাচামড়ার দাম পাওয়া যাচ্ছে না, তেমনি ফিনিশড লেদার বা প্রক্রিয়াজাত চামড়ারও রপ্তানি মূল্য মিলছে না। বাধ্য হয়ে পানির দরে রপ্তানি করতে হচ্ছে। সে জন্য সিইটিপি কার্যকর করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। ড. সবুর আহমেদ বলেন, যেহেতু রপ্তানি মূল্য কম সে ক্ষেত্রে চামড়া দিয়ে বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য উৎপাদন করে তা রপ্তানি করা যায়। তাতে কর্মসংস্থানও বাড়বে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফ্ল্যাটের নিবন্ধন খরচ ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি রিহ্যাবের
  • সোনামসজিদ বন্দরে আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক
  • ‘১০০ টাকার’ বাজেটের নতুনত্ব কোথায়
  • পাঁচ বছরে বাড়বে ৬৫ শতাংশ
  • ঈদের ছুটি শেষ হলেও সোনামসজিদ স্থলবন্দরে আসেনি আমদানি পণ্য
  • ভোমরা স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম শুরু
  • ১০ দিন পর আমদানি-রপ্তানি শুরু বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে
  • ১০ দিন পর বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে বাণিজ্য শুরু 
  • বেসরকারি খাত পিপিপিতে আকৃষ্ট নয়, বরাদ্দ ৫ হাজার কোটি টাকা
  • কমপ্লায়েন্সের অভাবে ধুঁকছে চামড়া খাতের রপ্তানি