মেঘমল্লারের ফেসবুক পোস্ট এবং বামপন্থিদের সংবিৎ
Published: 22nd, January 2025 GMT
বাম ছাত্রনেতা মেঘমল্লার বসুর ফেসবুক পোস্ট ঘিরে বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েক দিনে যা ঘটল, তা বেশ বার্তাবহ। এমনকি যদি বলা হয়, মেঘমল্লারের ফেসবুক পোস্ট এবং পরবর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া গোটা বাম রাজনীতিকেই নতুন পরীক্ষায় ফেলল, তাহলেও হয়তো ভুল হবে না।
গত ১৭ জানুয়ারি রাত ১১টার দিকে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে মেঘমল্লার বসু পোস্টটিতে লেখেন, ‘দ্য অনলি অপশন ইজ রেড টেরর’ (একমাত্র পথ লাল সন্ত্রাস)। মূলত এ কথাটাই প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। তাই পোস্টটি দেওয়ার ঘণ্টাখানেক পর তাঁকে গ্রেপ্তারের দাবিতে কয়েকটি হলের ‘শতাধিক’ শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল করেন। তারা রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেঘমল্লারকে গ্রেপ্তারের আলটিমেটাম দেন।
ঘটনা এখানেই থেমে গেলে হয়তো তা বড় কোনো শিরোনাম পেত না। কারণ, বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম মেঘমল্লারকে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেও তিনি মূলত ছাত্র সংগঠনটির ‘বিদ্রোহী’ অংশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি। দেশের অন্য কোথাও তাদের তেমন তৎপরতা নেই। তাই ঘটনার প্রভাব অন্য কোথাও পড়ার আশঙ্কা তেমন ছিল না।
আর মেঘমল্লারের ফেসবুক পোস্টের বিরুদ্ধে যেসব শিক্ষার্থী মিছিল করেছেন; ছাত্র ইউনিয়নসহ বাম সংগঠনগুলোর অভিযোগ, তারা ছিল মূলত ছাত্রশিবিরের কর্মী-সমর্থক। সংগঠনটির সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নসহ সব বাম ও উদারমনা ছাত্র সংগঠনের বৈরিতা সর্বজনবিদিত হলেও মেঘমল্লার ও তাঁর সহযোগীরা এদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই সেদিনও আন্দোলন করেছেন। সেই হিসেবে মেঘমল্লারের ওই পোস্ট ও তাঁর প্রতিক্রিয়াকে বড়জোর মিলনাত্মক দ্বন্দ্বরত দুই গোষ্ঠীর মনকষাকষির ফল হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা না করলে ভুল বোঝার অবকাশ থেকে যায়।
পদপদবি-সংক্রান্ত দ্বন্দ্বের কথা বলা হলেও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে মেঘমল্লারদের বিদ্রোহের আসল কারণ ছিল রাজনৈতিক। অভিভাবক সংগঠন সিপিবির মতোই ছাত্র ইউনিয়নের মূল নেতৃত্ব তৎকালীন সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকলেও বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে ঐক্যের প্রশ্নে ছিল দ্বিধান্বিত। এটাকেই ‘নিষ্ক্রিয়তা’ আখ্যা দিয়ে সিপিবিরই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটা অংশের আশীর্বাদ নিয়ে মেঘমল্লাররা ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক কমিটি গঠন করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই প্রধান শক্তি ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতেও তাদের ‘ছুঁতমার্গ’ ছিল না।
মনে আছে, গত বছর ‘জাতীয় শোক দিবস’ পালনের প্রশ্নটি যখন ওঠে, তখন ১৫ আগস্ট সামনে রেখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরসহ মোট ৩৪টি সংগঠন নিয়ে বৈঠক করে। সে সভায় সব ছাত্র সংগঠন ঐক্যবদ্ধ ঘোষণা দেয়– দিবসটি পালনের যে কোনো উদ্যোগ প্রতিহত করা হবে। ওই সভায় মূলধারার ছাত্র ইউনিয়ন ও বাসদের একাংশের ছাত্র সংগঠন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট না থাকলেও অন্য সব বাম সংগঠনের সঙ্গে বাসদের আরেক অংশের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফ্রন্ট (মার্কসবাদী) ও মেঘমল্লারের ছাত্র ইউনিয়নও ছিল। প্রগতিশীল মহল এ নিয়ে ভ্রু কুঁচকালে তখন ছাত্র ফ্রন্টের মতো ছাত্র ইউনিয়নের মূলধারাকেও রীতিমতো পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হয়েছিল।
আমরা দেখেছি, ফেসবুকে পোস্ট নিয়ে উল্লিখিত প্রতিক্রিয়া দেখে মেঘমল্লার দ্রুত তা প্রত্যাহার করে নেন। তিনি পোস্টের একটা ব্যাখ্যাও দেন। তিনি বলেন, স্ট্যাটাসটা এক ধরনের ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রভোকেশন’-এর জায়গা থেকে দিয়েছিলাম। তার মানে এই না, আগামীকাল আমি একটা লাল বাহিনী গঠন করে পরশু দিন থেকে মারামারি শুরু করব (সমকাল, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫)।
এই ব্যাখ্যার পরই হয়তো বিষয়টির নিষ্পত্তি ঘটত, যদি মেঘমল্লারের পোস্টকে প্রতিবাদকারীরা তাদের চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী গোটা বাম মহলকেই আক্রমণের সুযোগ হিসেবে না নিত।
সমকালেরই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উল্লিখিত শিক্ষার্থীরা সমাবেশ শেষে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি এলাকায় সিরাজ সিকদারের গ্রাফিতিতে জুতা নিক্ষেপ করেন এবং গ্রাফিতিটি মুছে ফেলেন। সত্তর দশকের প্রথম ভাগে শ্রেণিশত্রু খতমের মাধ্যমে অধিপতি শ্রেণির মধ্যে ‘লাল সন্ত্রাস’ আতঙ্ক ছড়িয়ে এ দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্যতম সক্রিয় দল ছিল সর্বহারা পার্টি। সেই দলের প্রতিষ্ঠাতা ও মূল তাত্ত্বিক ছিলেন সিরাজ সিকদার, যাঁকে সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়ন তো বটেই, মূলধারার অন্যান্য বাম দলও হাজার হাজার তরুণ-তরুণীকে বিভ্রান্ত করার জন্য দায়ী করে এসেছে। সেই হিসেবে বিদ্রোহী হলেও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে উদ্ভূত মেঘমল্লারের ‘অপরাধ’-এর দায় সিরাজ সিকদারের ওপর চাপানো যায় না।
এটাও ঠিক, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে না গিয়ে দেশের ভেতরে থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সিরাজ সিকদার তাঁর নেতৃত্বাধীন বাহিনী দিয়ে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৭২ থেকে ’৭৫ সালে তিনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আগ পর্যন্ত নিপীড়িত মানুষের মনে সাহস জোগানোর কারণে সিরাজ সিকদার এখনও গোটা বাম মহলে শ্রদ্ধার পাত্র। ফলে তাঁর গ্রাফিতিতে সাম্প্রতিক হামলা বাম পক্ষকে নাড়া দিয়েছে। অন্তত মঙ্গলবার রাতে তাঁর মুছে দেওয়া গ্রাফিতি যেভাবে বিভিন্ন বাম সংগঠনের কর্মীরা একসঙ্গে আবারও আঁকল, তাতে এটা স্পষ্ট।
এদিকে মেঘমল্লারের পোস্টের প্রতিবাদকারীরা বিভিন্ন স্থানে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফ্রন্টের দেয়াল লিখনও মুছে দেয়। এখানে পাঠ্যবই থেকে আদিবাসী শব্দযুক্ত একটি গ্রাফিতি সরিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ মিছিলে হামলার পরই যে মেঘমল্লার ওই পোস্টটি দেন, তাও বলা দরকার। আদিবাসী ছাত্র-জনতার মিছিলটি সংগঠিত করেছিল মূলত বিভিন্ন বাম ও আদিবাসী ছাত্র সংগঠন। এতে যারা হামলা করেছিল, তাদেরই চাপের কারণে পাঠ্যবই থেকে ওই গ্রাফিতি সরিয়ে দেওয়া হয়। এটাও অস্বীকার করা যাবে না, বর্তমানে শুধু সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে নয়, সমাজেও বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতের দাপট সবচেয়ে বেশি।
আমার বলার বিষয়, সমস্যাটা নিছক মেঘমল্লারের ফেসবুক পোস্ট নয়, বরং বাম শক্তির সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর পাশাপাশি নিপীড়িত মানুষের পক্ষে সক্রিয়তাই আলোচ্য বিক্ষোভকারীদের মাথাব্যথার কারণ। তবে আশার বিষয় হলো, বামপন্থিরাও শত্রু ঠিকমতো চিনতে পারছে বলে মনে হয়। ইতোমধ্যে বর্ধিত কর-শুল্ক প্রত্যাহারের দাবিতে দলগতভাবে এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে তারাও প্রতিবাদ-বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে।
অবিলম্বে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা, বর্ধিত ভ্যাট প্রত্যাহারসহ কিছু সুনির্দিষ্ট দাবিতে সিপিবি দেশব্যাপী যে গণতন্ত্র অভিযাত্রা করছে, তাও বেশ নজর কেড়েছে। জানমালের নিরাপত্তাহীনতা ও অর্থনৈতিক তীব্র সংকটের সঙ্গে মহলবিশেষের বিভাজনের রাজনীতির শিকার হয়ে যে জনগণ আজ ত্রাহি রব তুলছে, বামপন্থিরা তাদের পাশে থাকবে– এটাই প্রত্যাশা।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল; সাবেক ছাত্রনেতা
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ফ সব ক ছ ত র স গঠন স গঠন র
এছাড়াও পড়ুন:
ইসরায়েলে মার্কিন অস্ত্র বিক্রি ঠেকানোর চেষ্টা সিনেটে ব্যর্থ
গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক নিন্দার মধ্যে, ইসরায়েলের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি আটকাতে মার্কিন সিনেটে তোলা একটি বিল পাস হতে ব্যর্থ হয়েছে।
ব্যর্থ হলেও, বুধবারের ভোটে দেখা গেছে, মার্কিন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভেতরে ইসরায়েলের যুদ্ধের বিরোধিতা জোরদার হয়ে উঠেছে।
আজ বৃহস্পতিবার কাতারভিত্তিক আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রি ঠেকানোর প্রচেষ্টায় এবারের ভোটে উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক ডেমোক্র্যাট যোগ দিয়েছেন।
ইসরায়েলের কাছে ২০ হাজার স্বয়ংক্রিয় অ্যাসল্ট রাইফেল বিক্রি বন্ধ করার প্রস্তাবের পক্ষে ২৭ জন ডেমোক্র্যাট ভোট দিয়েছেন, আর ৬৭৫ মিলিয়ন ডলারের বোমার চালান বন্ধ করার পক্ষে ২৪ জন ভোট দিয়েছেন।
অন্যদিকে, ভোটদারকারী সব রিপাবলিকান সিনেটররা প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের চলমান হামলার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির দুটি চুক্তি আটকে দিতে প্রস্তাবগুলো সিনেটে আনেন ভার্মন্টের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। তিনি প্রগতিশীল ঘরানার স্বতন্ত্র সিনেটর।
ভোটের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে স্যান্ডার্স বলেন, “ওয়াশিংটন ইসরায়েলের ‘বর্ণবাদী সরকার’কে এমন অস্ত্র সরবরাহ করা চালিয়ে যেতে পারে না, যা নিরীহ মানুষদের হত্যা করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।”
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে একজন ‘জঘন্য মিথ্যাবাদী’ হিসেবে উল্লেখ করে স্যান্ডার্স ‘এক্স’ পোস্টে আরো বলেন, “গাজায় শিশুরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে।”
প্রথমবারের মতো স্যান্ডার্সের প্রস্তাবকে সমর্থনকারী আইন প্রণেতাদের মধ্যে, ওয়াশিংটন রাজ্যের সিনেটর প্যাটি মারে বলেছেন, প্রস্তাবগুলো ‘নিখুঁত’ না হলেও, তিনি গাজার নিষ্পাপ শিশুদের অব্যাহত দুর্ভোগকে সমর্থন করতে পারেন না।
মারে এক বিবৃতিতে বলেন, “ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও আমি প্রস্তাবের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিচ্ছি এই বার্তা দিতে: নেতানিয়াহু সরকার এই কৌশল চালিয়ে যেতে পারবে না।”
তিনি বলেন, “নেতানিয়াহু ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রতিটি পদক্ষেপে এই যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করেছেন। আমরা গাজায় মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করছি- সীমান্তের ওপারে যখন প্রচুর পরিমাণে সাহায্য ও সরবরাহ পড়ে আছে, তখন শিশু এবং পরিবারগুলোর অনাহার বা রোগে মারা যাওয়া উচিত নয়।”
মার্কিন জনগণের মধ্যে গাজা যুদ্ধের বিরোধিতা ক্রমবর্ধমান হওয়ার পাশাপাশি ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন নিয়ে ব্যাপক আকারে বিভক্তি দেখা দিয়েছে।
মঙ্গলবার প্রকাশিত গ্যালাপের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৩২ শতাংশ আমেরিকান বলেছেন, তারা গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান সমর্থন করেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৪২ শতাংশ আমেরিকান ইসরায়েলের অভিযান সমর্থন করেছিলেন।
গ্যালাপের মতে, পরিচয় প্রকাশ করে মাত্র ৮ শতাংশ ডেমোক্র্যাট বলেছেন যে তারা ইসরায়েলের অভিযানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, যেখানে ৭১ শতাংশ রিপাবলিকান বলেছেন জানিয়েছেন যে, তারা ইসরায়েলি পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন।
ঢাকা/ফিরোজ