ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি নিয়েছে পশ্চিমা উন্নয়ন অংশীদাররা। বাংলাদেশের স্থবির অর্থনীতি পূর্বের গতি পাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান তারা। ৫ আগস্টের পর যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন যেহেতু সহযোগিতার ঝুলি নিয়ে এগিয়ে এসেছিল, ট্রাম্প প্রশাসনও একই সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে কিনা, সে সংকেতের অপেক্ষায় রয়েছে পশ্চিমা অংশীদাররা।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের অর্থনীতি বড় ধাক্কার মুখে পড়েছে। অর্থনীতির নিম্নমুখী এ ধারা কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পট পরিবর্তনের কারণে বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়ার নজির রয়েছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার কতদিন থাকবে, তাদের নেওয়া সিদ্ধান্ত পরবর্তী সরকার মেনে নেবে কিনা, বিনিয়োগ করলে অর্থনীতির সক্ষমতা রয়েছে কিনা, তা ফেরতের বা বিনিয়োগের পরিবেশসহ কতটা সুরক্ষিত, সে অঙ্ক কষছে দেশগুলো।

এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সঙ্গে বিশ্বের শক্তিগুলো প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কও বিবেচনায় রাখছে। নাম না প্রকাশের শর্তে ইউরোপের একটি দেশের রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সফরের সময় কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাণ নিয়ে সমঝোতা হয়েছিল। এ নিয়ে আলোচনা এগিয়ে নিতে থেলেস এলেনিয়া স্পেসের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসে বৈঠকও করে গেছেন। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি কয়েক কোটি টাকা খরচও করেছে।  বর্তমান বাস্তবতায় আলোচনা স্থবির হয়ে পড়েছে। নিকট ভবিষ্যতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। যেমনটি নেই এ প্রতিষ্ঠানের এয়ারবাসের উড়োজাহাজ বিক্রির বিষয়েও।

গত ৫ আগস্টের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকারকে অভ্যন্তরীণ সংস্কারসহ আর্থিক খাতকে সহযোগিতা করতে তাৎক্ষণিকভাবে এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের প্রতি তাদের রাজনৈতিক সমর্থন দেখাতে মার্কিন অর্থ দপ্তরের সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে দেশটির বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা গত সেপ্টেম্বরে ঢাকা সফর করে গেছেন। সফরে রাজনৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের বার্তাও দেয় দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া ছিল, বাংলাদেশ যাতে আবারও ঘুরে দাঁড়ায় এবং উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। মার্কিন প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর থেকে বিদ্যমান সংকট উত্তরণের চাহিদাগুলো সম্পর্কেও অবহিত হয়।

এ থেকে এক প্রকার স্বস্তি ফিরে আসে উন্নয়ন অংশীদারদের। একটি শক্তিশালী অর্থনীতির দেশের কূটনীতিক সমকালকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তা থেকে অর্থনৈতিক একটি নিশ্চয়তা পাওয়া গিয়েছিল।  মার্কিন নির্বাচনে বাইডেন প্রশাসনের পরাজয় আবারও অনিশ্চয়তা তৈরি করে। এখন আমরা মার্কিন নতুন প্রশাসনের মনোভাবের জন্য অপেক্ষা করছি, বাংলাদেশ নিয়ে তারা আগের স্থানেই থাকে কিনা।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভৌগোলিক চিন্তায় বাংলাদেশ রয়েছে কিনা, সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বিনিয়োগে এখানে অনেক উপাদান রয়েছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগে দক্ষিণ এশিয়ার বাজার চিন্তা করে প্রতিষ্ঠানগুলো। সেই সঙ্গে পণ্যের কাঁচামাল সংগ্রহের বিষয়গুলো থাকে। বাংলাদেশের বাজার ও পণ্যের কাঁচামাল বিবেচনা করলে ভারতের নাম উঠে আসবে। বর্তমানে দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক খুব একটা স্বাভাবিক নেই। যেমন জাপানের বিগ-বি প্রকল্প শুধু বাংলাদেশ নিয়ে নয়, এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। এমনকি জাপানের রাষ্ট্রদূতও সম্প্রতি অর্থনীতি ও বিনিয়োগকে এগিয়ে নিতে ঢাকা-দিল্লির বোঝাপড়ার ওপর জোর দিয়েছেন। ফলে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তায় মার্কিন সংকেতের পাশাপাশি ভারতের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।

বেশ কিছুদিন ধরে আফ্রিকার দেশগুলোর দিকে নজর দিয়েছে বাংলাদেশ। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আফ্রিকা মহাদেশের কয়েকটি দেশ সফরও করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। সরকার পরিবর্তনের পর দেশগুলো খুব একটা ভরসা পাচ্ছে না।

নাম না প্রকাশের শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আফ্রিকার কয়েকটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়েও নিয়েছিল ঢাকা। ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিধায় রয়েছে। তারা মূলত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং ধীরে চলো নীতি নিয়েছে। 

বাংলাদেশের নির্বাচন, সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া ও বিনিয়োগ নিয়ে আলাপচারিতায় পশ্চিমা এক উপরাষ্ট্রদূত বলেন, এখানে নির্বাচন নিয়ে এখনই কিছু ভাবছি না আমরা। বাংলাদেশের মানুষ ঠিক করবে কবে নির্বাচন হবে। তবে বিদ্যমান যে বিনিয়োগগুলো রয়েছে, তা নিয়ে আমরা চিন্তিত। আমরা চাই অনিশ্চয়তা কেটে যাক এবং সার্বিক পরিস্থিতির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকুক। 

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে ব্রিটিশ সংসদ সদস্য রুপা হক বলেছেন, যুক্তরাজ্য চায় বাংলাদেশে একটি সত্যিকারের স্বচ্ছ নির্বাচন হোক। এর জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামোগুলো থাকতে হবে। যদি খুব তাড়াহুড়া করা হয়, সেটি বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক হবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির সমকালকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার মানেই সাময়িক। কেউ সাময়িক প্রশাসনের আওতায় বিনিয়োগ করবে না। এ ক্ষেত্রে সবাই অপেক্ষা করে। দেশের বর্তমান অর্থনীতি যেভাবে নিম্নগামী হচ্ছে, তা থেকে একে তুলে ধরতে ও সচল করতে বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিনিয়োগ ব্যবসায়ীরা তখনই করবেন, যখন তারা নিশ্চয়তা পাবেন। এ নিশ্চয়তা তৈরি করতে হলে লাগবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন।

জাতীয় ঐকমত্য ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক এ কূটনীতিক। তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঐকমত্যের কাঠামো তৈরি করতে হবে। একটি জাতীয় ঐক্য এলে দেশে ও বিদেশে আস্থা ফিরে আসবে।

কূটনীতিকরা বলছেন, বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়াতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণভাবে মানুষের আস্থা ফেরানো যেমন জরুরি, তেমন মার্কিন নতুন প্রশাসন কী ধরনের সহযোগিতার হাত নিয়ে এগিয়ে আসে, তা দেখাও জরুরি। বর্তমান পরিস্থিতিতে মার্কিনিরা হয়তো নিয়মিত সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন একটু অতিরিক্ত সহযোগিতা। এ সহযোগিতা যুক্তরাষ্ট্র থেকে হোক বা অন্য কোথাও থেকে হোক, নিশ্চিত করতে পারে কিনা, সেটির অপেক্ষায় অংশীদাররা। সে নিশ্চয়তা পেলে অংশীদাররাও নিজ থেকে এগিয়ে আসবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব দ শ ঋণ পর স থ ত র জন ত ক সহয গ ত ন শ চয়ত সরক র র র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই: এবি পার্টি

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে অংশ নিয়ে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে আজ বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক হয়। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এবি পার্টির চেয়ারম্যান এ কথা বলেন।

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মজিবুর রহমান বলেছেন, ‘সংবিধান পরিবর্তন, সংস্কার, সংশোধন, নতুন করে লেখা বা বাতিলের চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের। আমরা ঐক্যবদ্ধ মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদ তৈরি করেছি, হয়তো কয়েকটি বিষয়ে কারও কারও “নোট অব ডিসেন্ট” (দ্বিমত) আছে। কিন্তু চূড়ান্ত কোনটা হবে, তা নির্ধারণের মূল ক্ষমতা জনগণের।’

কমিশনের আজকের প্রস্তাবে জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদকে রেফারেন্স আকারে উল্লেখ করায় কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ও নেতা জুলাই ঘোষণাপত্রের বৈধতা নিয়ে মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে এবি পার্টির চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে যাঁরা আজ প্রশ্ন তুলছেন, কাল তাঁরা সংসদে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবেন এবং এই সনদকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না, তার নিশ্চয়তা কী?

এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সানী আবদুল হক বলেন, সংবিধানে এটা নেই, ওটা নেই বলে সংবিধান সংস্কার করা যাবে না—এই ধারণা অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাপরিপন্থী। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতির প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান থেকে নমনীয় না হয়, তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পুরো প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়বে।

আশঙ্কা প্রকাশ করে এবি পার্টির এই নেতা বলেন, এমন পরিস্থিতি জাতিকে এক গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। সুতরাং জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি; অন্যথায় গণভোট ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

আরও পড়ুনবর্ধিত মেয়াদের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন: আলী রীয়াজ৪ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের সুপারিশ, একমত নয় দলগুলো
  • ‘সংবিধান আদেশ’ জারির সুপারিশ করতে পারে কমিশন: আলী রীয়াজ
  • জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে: জামায়াত নেতা রফিকুল
  • কমিটি গঠন, প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত 
  • বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই: এবি পার্টি
  • বর্ধিত মেয়াদের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন: আলী রীয়াজ
  • বিএনপি নির্বাচনমুখী কর্মসূচিতে যাবে
  • দলগুলোর সঙ্গে বুধবার আবার আলোচনায় বসছে ঐকমত্য কমিশন
  • ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হতে হবে
  • জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ ফের এক মাস বাড়ল