আলু লইয়া কৃষক এইবারও দুর্দশায় নিপতিত হইল। রবিবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদন বলিতেছে, এক কেজি আলুর উৎপাদন ব্যয় ১৪ হইতে ১৬ টাকা হইলেও কৃষককে উহা বিক্রয় করিতে হইতেছে মাত্র ১০-১২ টাকায়। ফলে প্রতি কেজি আলুতে কৃষককে লোকসান গুনিতে হইতেছে ৫ টাকা অবধি। শুধু উহাই নহে, লোকসান হইতে বাঁচিতে বর্তমানে বিভিন্ন এলাকার কৃষকের হিমাগারে আলু সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও নূতন সংকট সৃষ্টি হইয়াছে। প্রথমত, দেশে চলতি বৎসর আলু উৎপাদন ১ কোটি ২০ লক্ষ টন হইবে বলিয়া ধারণা করা হইতেছে। কিন্তু বিদ্যমান হিমাগারসমূহের মোট ধারণক্ষমতা মাত্র ৪৫ লক্ষ টন। সেই হিসাবে বিপুল পরিমাণ আলু হিমাগারের বাহিরে থাকিবে। দ্বিতীয়ত, গত বৎসর অপেক্ষা এইবার কেজিতে ১ টাকা বৃদ্ধি করিয়া হিমাগার ভাড়া ৮ টাকা করা হইয়াছে, যাহা বহন করা বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের পক্ষে কঠিন। উপরন্তু, পূর্বে এক বস্তায় ৭০-৮০ কেজি আলু রাখা গেলেও এইবার ৫০ কেজির অধিক রাখা যাইবে না বলিয়া হিমাগার মালিক সমিতি জানাইয়া দিয়াছে। এইদিক হইতেও আলু সংরক্ষণে কৃষকের ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাইবে। মোদ্দা কথা, আলু লইয়া কৃষকদের উভয় সংকটে পড়িতে হইতেছে। হিমাগারে না রাখিতে পাইলে উহা একেবারে জলমূল্যে বিক্রয় করিতে হইবে; আর হিমাগারে রাখিলেও উৎপাদন ও সংরক্ষণ ব্যয় মিলাইয়া প্রতি কেজিতে কৃষকের ব্যয় এতই বৃদ্ধি পাইতে পারে, যাহা উসুল করা ভীষণ ত্রুটিযুক্ত বিদ্যমান বিপণন ব্যবস্থায় অসম্ভব হইতে পারে।
দেশে বাৎসরিক আলুর চাহিদা প্রায় ৯০ লক্ষ টন। সেই হিসাবে এইবার আলুর বাম্পার ফলন হইয়াছে, বলা যায়। দেশের প্রধান সবজির বাম্পার ফলন নিঃসন্দেহে আনন্দের সংবাদ। কিন্তু পরিস্থিতি বলিতেছে, আলুর এই বাম্পার ফলন কৃষকের জন্য তো বটেই, ভোক্তাদের জন্যও এক দুঃস্বপ্ন হইতে চলিয়াছে। এই কথা বলিবার কারণ, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে একদিকে কৃষককে সস্তা দরে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফল বিক্রয় করিয়া দিতে হইবে, অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগীরা সমুদয় আলু ক্রয় করিয়া মৌসুম অন্তে বাজারে তাহাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করিতে পারে। ফলে বর্তমানে সাময়িক সময়ের জন্য ভোক্তারা স্বল্প দরে আলু ক্রয় করিতে পারিলেও মৌসুম অন্তে অতি উচ্চমূল্যে তাহাদের অপরিহার্য এই সবজিটি ক্রয় করিতে হইবে, যেই পরিস্থিতি সাম্প্রতিক অতীতেও দেখা গিয়াছে। যাহা অধিকতর আশঙ্কার, অমানুষিক পরিশ্রমের সহিত রীতিমতো ধারকর্জ করিয়া এহেন বাম্পার ফলনের পর কৃষকদের যদি লোকসান গুনিতে হয়, তাহা হইলে একসময়ে হতাশ হইয়া কৃষক আলু চাষই বন্ধ করিয়া দিতে পারে, যাহা জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও হুমকি সৃষ্টি করিবে।
বাম্পার ফলনের কারণে আলুচাষির দুর্দশা এই বৎসরই নূতন নহে। আলু, তৎসহিত ধান এবং অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও প্রায়শ সমপরিস্থিতি দৃশ্যমান। কিন্তু দুঃখজনক, অতীতের কোনো সরকার বিষয়টি লইয়া গভীর কোনো ভাবনা ভাবে নাই। বিশেষজ্ঞরা বহু বৎসর যাবৎ উদ্বৃত্ত আলু রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণের উপর গুরুত্ব দিলেও খুব একটা পাত্তা পায় নাই। বিশেষত রপ্তানিযোগ্য আলু উৎপাদন ও বিপণনের পথে যেই সকল বাধা ইতোমধ্যে চিহ্নিত, সেইগুলি দূরীকরণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় নাই। তবে ইচ্ছা করিলে সরকার আলু সংরক্ষণ প্রশ্নে কৃষকের পার্শ্বে সহজেই দাঁড়াইতে পারে বলিয়া আমরা মনে করি। এই লক্ষ্যে সরকার বিশেষত প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণ ব্যয় লইয়া হিমাগার মালিকদের সমিতির সহিত আলোচনায় বসিতে পারে। প্রয়োজনে গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল, বর্ধিত ব্যাংক ঋণের সুদ, বীমা ব্যয় ইত্যাদি বিষয়ে তাহাদের উদ্বেগ হ্রাসে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে হইবে। জাতীয় স্বার্থেই দ্রুত এই সকল পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করিবে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব ম প র ফলন পর স থ ত র জন য সরক র হইত ছ
এছাড়াও পড়ুন:
জীবনের অপচয় রোধ জরুরি
দেশে পানিতে ডুবিয়া শিশুর প্রাণহানির যেই চিত্র শনিবার সমকালের এক প্রতিবেদনে উঠিয়া আসিয়াছে, উহা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। ঈদুল আজহার ছুটি আরম্ভ হইবার পূর্বের ১০ দিবসেই বিভিন্ন স্থানে ১৫ জন পানিতে ডুবিয়া প্রাণ হারাইয়াছে, যাহাদের মধ্যে ১৩ জন ছিল শিশু। উপরন্তু, ঈদুল ফিতরের পূর্বাপর ১২ ছুটিতে মোট ৪৯ জন অনুরূপভাবে প্রাণ হারাইয়াছে, যথায় শিশুর সংখ্যা ৪৭। এদিকে ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ঈদুল ফিতরে ৫৮ জন ও ঈদুল আজহায় ৬৫ শিশু পানিতে ডুবিয়া প্রাণ হারাইয়াছিল। এই ধারণা অমূলক নহে যে ঈদের ছুটিতে শহরবাসী অনেকে ছুটিয়া যায় গ্রামাঞ্চলে, যেইখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ শিশুদের আকৃষ্ট করিয়া থাকে। তাহারা পানির আশপাশে খেলার বিপদ সম্পর্কে সচেতন থাকে না, জানে না খাল-বিল, ডোবা-পুকুর কতটা বিপজ্জনক পরিণতি ডাকিয়া আনিতে পারে। গ্রামের বিস্তৃত ও অপেক্ষাকৃত নির্জন পরিবেশে শিশুদের তদারকির অভাবও প্রকট। অভিভাবকগণ সাধারণত গৃহকর্মে ব্যস্ত থাকেন, তেমন নজর থাকে না শিশুর গতিবিধির উপর। এই সকল কিছু মিলাইয়া সংশ্লিষ্ট শিশুর জন্য সৃষ্টি হয় মৃত্যুফাঁদ। দুর্ভাগ্যজনক হইল, এই সকল বিয়োগান্তক ঘটনার কারণে গ্রামের মুক্ত পরিবেশে অনেক পরিবারে ছুটির উচ্ছ্বাস নিমেষে মাটি হইয়া যাইবার পরও জনচেতনতা পরিলক্ষিত হইতেছে না। ফলস্বরূপ, এহেন হৃদয়বিদারক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়াই চলিয়াছে।
প্রতিটি শিশুর প্রাণই মূল্যবান। একটি জীবন অকালে ঝরিয়া যাইবার অর্থ একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু, একটি ভবিষ্যতের হারাইয়া যাওয়া। এই ক্ষতি শুধু সংশ্লিষ্ট পরিবারের নহে, সম্পূর্ণ সমাজের এবং রাষ্ট্রের। অথচ এহেন মৃত্যু রোধে রাষ্ট্রীয়ভাবেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নহে। প্রতিবেদনমতে, ২০১১ সালের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে পানিতে ডুবিয়া শিশুমৃত্যুর ঘটনাকে জনস্বাস্থ্য সমস্যারূপে চিহ্নিত করিবার পর ২০২২ সালে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৮ সহস্র কমিউনিটিবেজড চাইল্ড কেয়ার সেন্টার স্থাপনের ঘোষণা দেয়। উদ্দেশ্য ছিল এক হইতে পাঁচ বৎসর বয়সী শিশুর জন্য নিরাপদ পরিবেশ ও সাঁতার শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি। বাস্তবে কয়েকটি প্রশিক্ষণ ব্যতীত কিছুই হয় নাই। ২০১৫ সালে স্কুল-কলেজে সাঁতার শিখাইবার নির্দেশনা প্রদান করা হইলেও তাহা এখনও উপেক্ষিত। জেলা প্রশাসকদের ভূমিকা নির্ধারিত থাকিলেও বাস্তবায়নের চিত্র প্রায় শূন্য। এই অবস্থায় দ্য সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এবং আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় ধরা পড়িয়াছে, দেশে প্রতিবৎসর প্রায় ১৪ সহস্র শিশু পানিতে ডুবিয়া মারা যায়। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৪০টি শিশু প্রাণ হারায়। তাদের ৭৫ শতাংশের বয়স পাঁচ বৎসরের নিচে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে পানিতে ডুবিয়া প্রতিবৎসর আহত হয় অন্তত এক লক্ষ শিশু। ইহাদের মধ্যে প্রায় ১৩ সহস্র পঙ্গু হইয়া যায়। পরিণামে ঐ শিশুরা পরিবারের পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজের বোঝা হইয়া দাঁড়ায়।
বিশেষজ্ঞগণ বলিয়াছেন, দেশে অপঘাতজনিত শিশুমৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ পানিতে ডুবিয়া যাওয়া। এমনকি নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় যত শিশু মৃত্যুবরণ করে, ততোধিক শিশু মারা যায় পানিতে ডুবিয়া। এতদসত্ত্বেও এই প্রাণহানি লইয়া কোনো তথ্যপ্রবাহ ব্যবস্থা নাই, অতএব সরকারি কোনো তথ্যভান্ডারও গড়িয়া উঠে নাই। অথচ ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে তথ্যাদি নথিভুক্তি শুরু হইলে বৎসরান্তে ইহার অন্তত হিসাব মিলিত। বিলম্বে হইলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বোধোদয় ঘটুক, ইহাই আমাদের প্রত্যাশা। এই বিষয়ে প্রয়োজনে ইউনিসেফের ন্যায় সংস্থাসমূহকেও কাজে লাগানো যায় বলিয়া আমরা মনে করি।