মঞ্চে ‘রক্তগন্ধা জুলাই’ দর্শক সারিতে কান্না
Published: 12th, February 2025 GMT
নাটকের মঞ্চে এক তরুণ হাঁকছেন– ‘এই, পানি লাগবে? পানি!’ এমন সময় হঠাৎ তাদের পাশে আন্দোলনে অংশ নেওয়া তরুণ-যুবাদের দিকে নির্বিচার গুলি চালায় পুলিশ ও দুর্বৃত্ত। মঞ্চের আলো ঝাপসা হয়ে যায়। সেখানে দেখা গেল লাল-সবুজের পতাকা পরা তরুণ-তরুণীদের। তারা একটু আগেই বৈষম্যের অবসান চেয়ে নানা স্লোগান দিচ্ছিল।
মঙ্গলবার রাতে কুষ্টিয়ার কুমারখালী পৌর শিশুপার্কের মঞ্চে দেখা যায় এই দৃশ্য। ১০ ফুট দীর্ঘ মঞ্চটিতেই ফুটিয়ে তোলা হয় গত বছরের জুলাই-আগস্টে উত্তাল বাংলাদেশকে। সেখানে তরুণ-তরুণীদের কণ্ঠে ভেসে আসে– ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে/ লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে/ রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়/ আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম-সংগ্রাম/ দালালি না রাজপথ, রাজপথ-রাজপথ/ মেধা না কোটা, মেধা-মেধা/ জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’-এর মতো স্লোগান। তাদের অভিনয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে দেন পৌর শিশুপার্কে আসা অনেক দর্শক।
এক পর্যায়ে ছাত্ররা ‘পলাইছে রে পলাইছে, স্বৈরাচার পলাইছে/ পলাইছে রে পলাইছে, খুনি হাসিনা পলাইছে’ বলে বিজয় মিছিল শুরু করে। তখন মাতোয়ারা দর্শক করতালি দিতে থাকেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে নির্মিত এই নাটকের নাম ‘রক্তগন্ধা জুলাই’। এটির রচয়িতা কবি ও নাট্যকার লিটন আব্বাস। নাটকটিতে অভিনয় করেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া ১৮ শিক্ষার্থী।
কুমারখালী সরকারি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী রাজশ্রী মজত সিজা মনে করেন ‘৩৬ দিনের ঘটনা তো আর ৩৬ মিনিটে শেষ করা সম্ভব নয়। তবে যা কিছু পরিবেশন হয়েছে, এতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রায় পুরো রূপ-চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।’
পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা এক নারী বলেন, ‘আমার ছেলে প্রতিদিনই আন্দোলনে যেত। নাওয়া-খাওয়া, ঘুম ছিল না। তখন তো নিজ চোখে আন্দোলন দেখিনি। শুধু টিভিতে খবর দেখতাম। মঞ্চে যখন আবু সাঈদের ওপর নির্মমভাবে গুলি চালালো, তখন নিজের ছেলের কথা মনে হয়ে কেঁদে ফেলেছি।’
নাটকটি মঞ্চস্থ হয় তারুণ্যের উৎসব উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী নাট্যোৎসব ও গ্রামীণ মেলার অংশ হিসেবে। মঙ্গলবার সকালে এর উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মো.
নাটকে সন্তানহারা মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য ফাবিহা ইবনাথ। তাঁর ভাষ্য, কীভাবে আবু সাঈদ-মুগ্ধরা শহীদ হয়েছেন; তাদের চিন্তাধারা কী ছিল; তাদের স্বজনরা কতটা শোকাহত হয়েছে– সবার মাঝে সেই চেতনা জাগ্রত করতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রেরণা থেকেই মূলত নাটকে অভিনয় করা।
পুলিশ চরিত্রে ছিলেন ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সদস্য আপন আহমেদ। তিনি বলেন, পুলিশের তো জনগণের বন্ধু হওয়ার কথা। কিন্তু হাসিনার নির্দেশে নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে তারা ছাত্রদের হত্যা করেছে। সব যৌক্তিক আন্দোলনে পুলিশকে জনগণের পক্ষে থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেন আপন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উপজেলা শাখার সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান আলী বলেন, এটা শুধু নাটক নয়; জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের বিরুদ্ধে যারা ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী রূপ। সব অপরাধীর বিচার না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন বিভিন্ন মাধ্যমে চলবে।
দেশের অতীত ও বর্তমান ইতিহাস নিয়ে চর্চার গুরুত্ব তুলে ধরেন কবি ও নাট্যকর লিটন আব্বাস। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টের ৩৬ দিনে সারাদেশের মানুষ অন্ধকার ও আতঙ্কে ছিল। হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগ ও অঙ্গহানির মধ্য দিয়ে যে নতুন বাংলাদেশের সূচনা, তা এই নাটকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।
ইউএনও এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, তারুণ্যের উৎসব উপলক্ষে তিন দিনের নাট্যোৎসবের আয়োজন। মঙ্গলবার রাতে ‘রক্তগন্ধা জুলাই’ মঞ্চস্থের মধ্য দিয়ে এ উৎসবের সূচনা হয়। নাটকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। এসব দেখে অনেক দর্শক আবেগে কেঁদেছেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ ল ই গণঅভ য ত থ ন
এছাড়াও পড়ুন:
গণঅভ্যুত্থানে শহীদ রিজভীর ভাইকে কুপিয়ে জখম, গ্রেপ্তার ৩
নোয়াখালী জেলায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ মাহমুদুল হাসান রিজভীর ছোট ভাই স্কুলছাত্র শাহরিয়ার হাসান রিমনকে (১৬) এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে আহতের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। রবিবার (২৮ এপ্রিল) রাতে সুধারাম মডেল থানায় রিমনের মা বাদী হয়ে দায়ের করেন। পুলিশ এ ঘটনায় তিন কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম ও ছবি প্রকাশ করেনি।
এদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে রিমনের স্কুলের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছে।
আহত শাহরিয়ার হাসান রিমন জেলা শহরের বসুন্ধরা কলোনি বাসিন্দা মো. জামাল উদ্দিন ও ফরিদা ইয়াছমিন দম্পত্তির ছেলে। সে স্থানীয় হরিনারায়ণপুর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
আরো পড়ুন:
কুমিল্লায় বজ্রপাতে ৪ জনের মৃত্যু
ধর্ষণের অভিযোগে গণপিটুনি, কারাগারে ইমামের মৃত্যু
বিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে রোববার (২৮ এপ্রিল) বিকেলে কিশোর গ্যাং সদস্যরা শাহরিয়ার হাসান রিমনকে ধারালো ছুরি এলোপাতাড়ি আঘাত করে। এতে সে গুরুতর আহত হয়। পরে স্থানীয়রা তাকে নোয়াখালী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। তবে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়।
এ ঘটনায় রাতে আহত রিমনের মা ফরিদা ইয়াছমিন ২১ জনকে এজহারভুক্ত ও ১০-১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দায়ের করেন। পুলিশ রাতেই অভিযান পরিচালনা করে তিন কিশোরকে গ্রেপ্তার করে।
রিমনের মা ফরিদা ইয়াছমিন জানান, রিমনের পিঠে, মাথায়সহ মোট ছয়টি ছুরির আঘাত করা হয়। তার অপারেশন ঢাকা মেডিকেল কলেজে করানো হয়েছে। বর্তমানে সেখানে চিকিৎসা চলছে। তার পিঠের আঘাতগুলো ফুসফুস পর্যন্ত চলে গেছে বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন।
তিনি আরো জানান, হামলাকারীরা ভেবেছিল রিমন মারা গেছে। যখন জানতে পারে সে বেঁচে আছে, তখন তারা ফের হামলা করতে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল পর্যন্ত যায়। রিমনের অপরাধ দুই দল কিশোরের মাঝে চলমান দ্বন্দ্ব মিমাংসা করে দেওয়া। একপক্ষ মানলেও অপরপক্ষ মিমাংসার বিষয়টি মন থেকে মানতে পারেনি। তারাই আমার ছেলের উপর হামলা করেছে।
রিমনের বাবা জামাল উদ্দিন বলেন, রিমনকে ধারালো ছুরি দিয়ে মোট ছয়টি আঘাত করা হয়েছে। নোয়াখালী জেনারেল হাসপতালে নেওয়া হলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তিনি রিমনের সুস্থতার জন্য দোয়া চেয়েছেন।
ঢাকায় রিমনের সঙ্গে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদা সুলতানা ইতু জানান, রাতেই রিমনের সিটিস্ক্যান করা হয়েছে। এরপর তার অপারেশন হয়েছে। চিকিৎসকরা বলেছেন, রিমনের পিঠের আঘাতগুলো গুরুতর। ছুরির আঘাত প্রায় ফুসফুস পর্যন্ত চলে এসেছে। তার সুস্থ হতে অনেক সময় লাগবে।
রবিবার (২৮ এপ্রিল) বিকেলে স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে জেলা শহরের বার্লিংটন মোড়ে একদল কিশোর রিমনকে ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আহত করে।
স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নোয়াখালী পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের বার্লিংটন এলাকাটি কিশোর গ্যাংয়ের আখড়া। এই এলাকা দিয়ে প্রতিদিন সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, হরিনারায়ণপুর স্কুল, সরকারি মহিলা কলেজসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরা যাতায়াত করে। প্রতিদিন তাদের উত্ত্যক্ত করা হয়। কিন্তু ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না। প্রশাসনেরও নজরদারি নেই।
এদিকে, রিমনকে ছুরিকাঘাত করে আহত করার প্রতিবাদে তার স্কুলের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে স্কুলের সামনে প্রধান সড়কে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
মানববন্ধনে রিমনের স্কুলের শিক্ষার্থী ছাড়াও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী, স্কুলের শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বক্তারা অবিলম্বে রিমনের উপর যারা হামলা করেছেন, তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) আবু তৈয়ব মো. আরিফ হোসেন জানান, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলা দায়েরের পর সিসিটিভি ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এজহারভুক্ত একজনসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনায় আমাদের আরো অনুসন্ধান চলছে। সিসি ক্যামেরা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। অপরাধীদের খুব দ্রুতই আইনের আওতায় আনতে পারবেন বলে আশা করেন তিনি।
ঢাকা/সুজন/বকুল