সপ্তাহখানেক ধরে চলছে ‘ডেভিল হান্ট’ অপারেশন। ইতোমধ্যে সারাদেশে অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ ধরনের অমর্যাদাকর শব্দ প্রয়োগ করা উচিত নয়। এ ধরনের শব্দ নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ন করে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কিংবা আইন প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক সত্ত্বেও কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রশ্নে যে কোনো নাগরিকের সামাজিক মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করছে। আমাদের রাষ্ট্রকে যেন কোনো পরিস্থিতিতেই কেউ অকার্যকর বলে বিবেচনায় নিতে না পারে, সেদিকটার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রকৃত অর্থে ২০২৪ সালের প্রাক-নির্বাচন পরিস্থিতিতে আমরা ভূরাজনীতিতে গভীর সংকট সৃষ্টি করে রেখেছিলাম। গণতন্ত্র অর্থবহ করে তোলার কোনো ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা অবশিষ্ট ছিল না। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই সংকট নিরসনের কোনো ধরনের সুযোগ না থাকলেও পরিস্থিতি বদলে দেয় ছাত্র-জনতার জুলাই আগস্টের গণঅভ্যুত্থান।
অভ্যুত্থান ছিল অবশ্যম্ভাবী। তৎকালীন সরকার সাধারণ মানুষের মনোভাব এবং একই সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিপ্রায় বুঝতে ব্যর্থ ছিল। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিপুল জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ তরুণ। তারুণ্যনির্ভর সমাজ যে কোনো কিছু বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তারুণ্যের শক্তি, তারুণ্যের সাহসকে দমিয়ে রাখা যায় না।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস উতরে গেছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ, সাধারণ মানুষের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিজনিত নিরাপত্তাহীনতা, হেফাজতে মৃত্যুর মতো ঘটনাসহ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের শীতলতায় সরকার বিচলিত না হলেও সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এক ধরনের অস্বস্তি সহজে অনুমেয়। এমন পরিস্থিতিতে ৫-৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক ধরনের তাণ্ডব দেখা গেছে। বিশেষত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর দিয়ে শুরু করে সারাদেশে বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর বাড়িঘরে যে প্রক্রিয়ায় বুলডোজার আর অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে, তা এক কথায় অগ্রহণযোগ্য। যদিও তাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ; তথাপি তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ ব্যতিরেকে এ ধরনের তাণ্ডব চালানোর বিষয় ভালোভাবে নেওয়া যায় না। মনে রাখতে হবে– প্রফেসর ইউনূস শান্তিতে নোবেলজয়ী। তাঁর সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে স্বনামধন্য মানবাধিকার কর্মীরা অন্তর্ভুক্ত। উদ্বেগের বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর বাড়িঘরে হামলার পাশাপাশি আমরা লক্ষ্য করেছি, সুনামগঞ্জে কৃষান চত্বরের ম্যুরালও ভেঙে ফেলা হলো। নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের আচরণকে অগ্রহণযোগ্য বলেই বিবেচনায় নিতে হবে।
আমরা সব অনিয়ম দূর করার পক্ষে। দুর্নীতি নির্মূল করা না গেলেও প্রতিকারের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সমাজে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা সময়ের দাবি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী সবার আইনের সমান আশ্রয় লাভ, আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকার ও আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের অধিকার রয়েছে। এই অধিকারগুলোর প্রয়োগ নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তায়।
চলমান ‘ডেভিল হান্ট’ অপারেশন নামটা কীভাবে নির্ধারিত হয়েছে, জানি না। তবে যে শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে নাগরিকের মর্যাদার বিষয়টির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে হচ্ছে। আমরা কাউকে এ ধরনের ‘শব্দ’ বিশেষণে নির্ণয় করে দিতে পারি কিনা– বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে।
আবু আহমেদ ফয়জুল কবির: মানবাধিকার কর্মী
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর স থ ত ত এ ধরন র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
অজ্ঞাতনামা লাশ আর কারা হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে, শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় জনমনে সন্দেহ: এমএসএফ
চলতি অক্টোবর মাসে দেশে অজ্ঞাতনামা লাশ এবং কারা হেফাজতে মৃত্যু সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় বেশ খানিকটা বেড়েছে। এ তথ্য তুলে ধরেছে মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। প্রতিষ্ঠানটির অক্টোবর মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এমএসএফ বলেছে, এসব ঘটনায় জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ দুই ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে।
এমএসএফ প্রতি মাসে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে। আজ শুক্রবার অক্টোবর মাসের প্রতিবেদন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজস্ব তথ্যানুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এমএসএফ মানবাধিকার প্রতিবেদন তৈরি করে।
বেড়েছে অজ্ঞাতনামা লাশএমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসে মোট ৬৬টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়; বরং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মাসে (সেপ্টেম্বর) এর সংখ্যা ছিল ৫২। এসব অজ্ঞাতনামা লাশের বেশির ভাগই নদী বা ডোবায় ভাসমান, মহাসড়ক বা সড়কের পাশে, সেতুর নিচে, রেললাইনের পাশে, ফসলি জমিতে ও পরিত্যক্ত স্থানে পাওয়া যায়। অল্পসংখ্যক মৃতদেহ গলাকাটা, বস্তাবন্দী ও রক্তাক্ত বা শরীরে আঘাতের চিহ্নসংবলিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
এমএসএফ বলেছে, অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েই চলেছে এবং তা জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় উদ্ধারে অপারগতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১টি শিশু, ১ কিশোর, ১১ জন নারী ও ৫৩ জন পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭ বছর বয়সী শিশু; ১৫ বছর বয়সী কিশোর; ২০ থেকে ৩০ বয়সী ১৫ জন পুরুষ ও ২ জন নারী; ৩১ থেকে ৪০ বয়সী ১৯ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী; ৪১ থেকে ৫০ বয়সী ১ নারী ও ৫ জন পুরুষ এবং ৫০ বছর বয়সের বেশি ১১ জন পুরুষ ও ১ নারী রয়েছেন। এর মধ্যে অজ্ঞাতনামা তিনজনের বয়স শনাক্ত করা যায়নি।
এমএসএফ বলেছে, শুধু অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; বরং পরিচয় জানার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
কারা হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছেইএমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে কারা হেফাজতে মোট ১৩ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এ সংখ্যা ছিল মোট ৮। এ মাসে ছয়জন কয়েদি ও সাতজন হাজতির মৃত্যু হয়েছে।
কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চারজন কয়েদি ও দুজন হাজতি, গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন কয়েদি ও শেরপুর জেলা কারাগারে একজন কয়েদি মারা যান। এ ছাড়া খুলনা জেলা কারাগারে, টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে, চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে, সিরাজগঞ্জ কারাগারে ও মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে একজন করে হাজতি বন্দী মারা যান। সব বন্দীর মৃত্যু হয় কারাগারের বাইরে হাসপাতালে।
এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কারা হেফাজতে মৃত্যু এবং অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের সংখ্যা বৃদ্ধি মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্র তুলে ধরে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই লাশ উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে। কিন্তু এসব লাশ উদ্ধার করে তার পরিচয় শনাক্ত করা এবং সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করাই শুধু নয়, এসব লাশ আত্মীয়-পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া এসব বাহিনীর কাজ। কিন্তু একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা করা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আর কোনো কাজ নেই।
সাইদুর রহমান বলেন, অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং হেফাজতে মৃত্যু বৃদ্ধি জনমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে।
গণপিটুনিতে হত্যা চলছেই, বেড়েছে রাজনৈতিক সহিংসতাঅক্টোবর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার শিকার হয়েছেন ৫৪৯ জন। এর মধ্যে ২ জন নিহত এবং ৫৪৭ জন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন গুলিবিদ্ধ এবং নিহত ব্যক্তিরা বিএনপির কর্মী–সমর্থক। সেপ্টেম্বর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৩৮টি ঘটনা ঘটেছিল।
সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার মধ্যে ১১টি ঘটনায় রাজনৈতিক বিরোধ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে পার্টি অফিস, বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিকাণ্ড এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
অক্টোবর মাসে মোট গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি। আগের মাসে এ ঘটনা ঘটেছিল ৪৩টি। এ মাসে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১২। আগের মাসে নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন।