১৩ তারিখ গেল, কিছু তো ওল্টাল না!
Published: 15th, February 2025 GMT
ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে আমার এক ফেসবুক বন্ধু স্ট্যাটাস দিলেন, ‘১৩ তারিখের পর সব বদলে যাবে।’
আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক ওই বন্ধু ১২ ফেব্রুয়ারি লিখলেন, ‘কাল বিরাট সুসংবাদ আসছে।’
শুধু আমার ওই বন্ধু নন, আরও অনেক ফেসবুক বন্ধুকে দেখলাম একই ধরনের কথা লিখতে। কেউ কেউ খুব মারমুখী কথাও লিখেছিলেন।
যেমন, ‘কাল সব উল্টে যাচ্ছে। একজনও পালানোর পথ পাবে না’; ‘কাল ইউনূস সরকারের বিদায় ঘণ্টা বাজবে’; ইত্যাদি।
কেন তাঁরা ‘সব উল্টে যাবে’ বলে অতি আশায় উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলেন, তা বোঝা যাচ্ছিল। কারণ ১৩ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হওয়ার কথা ছিল।
আরও পড়ুনদিল্লিতে কেজরিওয়াল ‘ডাউন’, কিন্তু এখনো ‘আউট’ নন১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫বৈঠকের আগের দিন আমেরিকায় বসবাসকারী আওয়ামী সমর্থকেরা ‘ওয়েলকাম, মোদিজি!’ লেখা প্ল্যাকার্ড ফেসবুকে পোস্ট করেছেন এবং সবাইকে মোদিকে স্বাগত জানানোর জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এরপর ‘মোদিজি’ ওয়াশিংটনে এলেন। ফেসবুকে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখলাম, এক বয়স্ক লোক স্লোগান দিচ্ছেন, ‘অয়েলকাম! অয়েলকাম!’ (সম্ভবত তিনি বলতে চেয়েছেন, ‘ওয়েলকাম’) বাকিরা বলছেন, ‘মোদিজি! মোদিজি!’ এরপর তিনি বলছেন, ‘উই সাপোর (সম্ভবত তিনি বলতে চেয়েছেন, ‘উই সাপোর্ট’), উই সাপোর!’ বাকিরা সম্মিলিতভাবে বলছেন, ‘মোদিজি! মোদিজি!’ এরপর ভদ্রলোক স্লোগান দিচ্ছেন, ‘উই আর ফর, উই আর ফর!’ বাকিরা তখন বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা! শেখ হাসিনা!’
এরপর ট্রাম্প-মোদি বৈঠকটি হলো। কিন্তু কিছুই ওল্টাল না।
আরও পড়ুনবিগ টেক যেভাবে ট্রাম্পের অভিবাসন দমননীতিকে শক্তিশালী করছে৪৭ মিনিট আগেতবে কিছু একটা উল্টাল তাঁদের বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে। সেখানে ট্রাম্পকে একজন ভারতীয় সাংবাদিক বললেন, ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইস্যুতে আপনার বলার কী আছে? কারণ আমরা দেখেছি, আমেরিকার ডিপ স্টেট বাইডেন আমলে দেশটির সরকার পরিবর্তনে জড়িত ছিল—এটি স্পষ্ট। এরপর মুহাম্মদ ইউনূস জুনিয়র সোরোসের সঙ্গেও দেখা করেন। বাংলাদেশ নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?’
জবাবে ট্রাম্প যা বললেন, তার মানে দাঁড়ায় ‘না, আমাদের ডিপ স্টেটের কোনো ভূমিকা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী (ভারতের প্রধানমন্ত্রী) এ নিয়ে বহু বছর কাজ করেছেন। আমার যা পড়াশোনা তাতে জেনেছি, এটা নিয়ে শত শত বছর ধরে (ভারতের দিক থেকে) কাজ করা হয়েছে। (এ কারণে) বাংলাদেশ (ইস্যুতে কথা বলার ভার) আমি প্রধানমন্ত্রীর (মোদির) ওপর ছেড়ে দিচ্ছি।’
এই বলে ট্রাম্প পাশে বসা নরেন্দ্র মোদির দিকে ইঙ্গিত করলেন। মোদি ট্রাম্পের এই কথার মানে বুঝতে পেরেছিলেন কিনা তা বোঝা গেল না।
তবে তাঁর চেহারায় যে বিষণ্নতা ও বিরক্তির ছাপ ছিল, তা যে কারও কাছে স্পষ্ট হবে।
আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কাছে মোদি-পুতিনের বন্ধুত্বের অর্থ কী০২ আগস্ট ২০২৪যা হোক, মোদি বাংলাদেশ নিয়ে একটি শব্দও বললেন না। তিনি প্রসঙ্গটিকে সোজা ইউক্রেনে নিয়ে ফেললেন এবং যুদ্ধ যে কোনো সমাধান আনতে পারে না—সেই চিরায়ত বাণীটি ঋষি বাক্যের মতো করে সাংবাদিকদের কাছে পরিবেশন করলেন।
বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্পের এমন জবাব এবং মোদির এমন পাশ কাটানো কায়দা ভারতের মোদি সমর্থকদের কতটা হতাশ করেছে, তা বোঝা না গেলেও ‘মোদিজি! মোদিজি!’ বলে গগনবিদারী আর্তনাদ করা আমার সেই বন্ধুরা যে মুষড়ে পড়েছেন, তা বুঝতে পারছি।
মোদির ডাউন পারফরম্যান্সে যতই তাঁদের হতাশ হতে দেখছি, ততই লজ্জা পাচ্ছি।
অবাক বিস্ময়ে ভাবছি, আওয়ামী লীগের রাজনীতি কোন পর্যায়ে নামলে দলটির কর্মী সমর্থকেরা ভিন্ন একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে আরেকটি দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে এভাবে ‘উই সাপোর! উই সাপোর! মোদিজি মোদিজি!’ বলে স্লোগান দেন।
বোঝা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ এখন তার সবচেয়ে বড় ত্রাতা মনে করছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, মোদি ট্রাম্পকে কিছু একটা বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাংলাদেশের ‘সব উল্টে’ দেবেন। কিন্তু ট্রাম্প তাঁদের আশার বাটি উল্টেই দিলেন।
অনুশোচনাহীনতা ও লজ্জার ঘাটতিই সম্ভবত আওয়ামী লীগের বন্ধুদের এই অপরিপক্ব আশার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। রাজনীতিতে নাকি সব চলে। তাই বলে রাজনীতি ব্যক্তির নিম্নতম ব্যক্তিত্ববোধও কেড়ে নেবে? হয়তো নেয়।
মানুষের নৈতিক বোধের অন্যতম পরিচয় তার লজ্জা। এই লজ্জা বেপরোয়াকে সংযত করে। আর লজ্জাবোধ হারিয়ে গেলে মানুষ হয়ে ওঠে নির্লজ্জ। নির্লজ্জতার সঙ্গে অনুশোচনাহীনতার যোগ ব্যক্তিত্ববোধকে হত্যাই করে ফেলে।
অনুশোচনাহীন ও লজ্জাহীনের শক্তিলাভ যে কত ভয়ানক হতে পারে তার প্রথম উদাহরণ হলেন সম্রাট নিরো। তিনিই দেখিয়েছিলেন, বেহালার সুরেলা বাদ্যও চরম মেজাজ খারাপ করার কারণ হতে পারে, যদি তা রোম পোড়ার সময় বাজানো হয়।
মোসাহেবরা নিরোকে একবার বলল, ‘গান তো আছেই। এবার খেলাধুলা করুন সম্রাট!’ নিরো তাই শুনে অলিম্পিকে নামলেন। তিনি যতবার, যত ইভেন্টে নেমেছেন, ততবারই জিতেছেন। কেউ জেতার সাহস পায়নি। তাঁর কাজকারবারের সমালোচনা করায় তিনি তাঁর মা আগ্রিপিনা, প্রথম স্ত্রী অক্তাভিয়া এবং অনেক শীর্ষ পর্যায়ের সিনেটরকে হত্যা করেছিলেন।ইতিহাস বলছে, নিরো (৩৭-৬৮ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন রোমান সাম্রাজ্যের পঞ্চম সম্রাট। তিনি বেহালা বাজাতেন। গানও গাইতেন।
সামনে বসে মোসাহেবরা বলতেন, ‘দুর্দান্ত সম্রাট! ওয়ান মোর! ওয়ান মোর!’ তাই শুনে নিরো নিজেকে মহান শিল্পী ঠাওরে মঞ্চে গাওয়া শুরু করলেন। তাঁর গানের সময় কেউ দর্শকের আসন থেকে নড়তে পারত না। সেনারা নজর রাখত, তাঁর গান শুনে কেউ বিরক্তি প্রকাশ করে কিনা। করলেই তাঁর কল্লা যেত।
মোসাহেবরা নিরোকে একবার বলল, ‘গান তো আছেই। এবার খেলাধুলা করুন সম্রাট!’ নিরো তাই শুনে অলিম্পিকে নামলেন। তিনি যতবার, যত ইভেন্টে নেমেছেন, ততবারই জিতেছেন। কেউ জেতার সাহস পায়নি।
তাঁর কাজকারবারের সমালোচনা করায় তিনি তাঁর মা আগ্রিপিনা, প্রথম স্ত্রী অক্তাভিয়া এবং অনেক শীর্ষ পর্যায়ের সিনেটরকে হত্যা করেছিলেন।
৬৮ খ্রিষ্টাব্দে নিরোর বিরুদ্ধে জনগণ বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল তাঁর অত্যাচারী শাসন, বিভিন্ন মেগা প্রজেক্ট হাতে নেওয়া এবং রাজ্যের অব্যবস্থাপনা। পাবলিক খেপে যাওয়ার পর সেনাবাহিনীও সরে পড়ে। নিরো তখন পালিয়ে যান।
শেষ পর্যন্ত নিরো বুঝতে পারেন, রোম তার হাতে নেই। তিনি পালিয়ে একটি গ্রাম্য ভিলায় আশ্রয় নেন। এ সময়ও কোনো অনুশোচনা ছিল না তাঁর।
তাঁর মধ্যে কোনো অপরাধবোধ কাজ করেনি। শুধু প্রতীক্ষা করেছেন, কখন অন্য দেশের কোনো শাসক এসে তাঁর গদি উদ্ধার করে দেবেন। শেষ পর্যন্ত কেউ আসেনি।
অনুশোচনাহীন ও লজ্জাহীনের শক্তিলাভ ও পতনের দ্বিতীয় উদাহরণের কথা চাইলে বলতে পারি। কিন্তু থাক, বলব না।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক জ কর ষ পর য ফ সব ক আওয় ম প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
রোহিতের পর কোহলির রেকর্ডও কাড়লেন বাবর, পাকিস্তানের সিরিজ জয়
আগের দিন রোহিত শর্মার রেকর্ড ভেঙেছিলেন বাবর আজম। লাহোরে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অপরাজিত ১১ রানের ইনিংস খেলেই ভারতের সাবেক অধিনায়ককে টপকে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড গড়েছিলেন বাবর। পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক আজ তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে ৬৮ রানের ইনিংস খেলে কেড়েছেন আরেক ভারতীয় কিংবদন্তি বিরাট কোহলির রেকর্ড। ২০ ওভারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাবরের এটি ৪০তম ৫০ ছোঁয়া ইনিংস। ৩৯টি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলে এত দিন বাবরের সঙ্গে রেকর্ডটির যৌথ মালিক ছিলেন কোহলি।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ১৩ ইনিংস পর ফিফটি পাওয়া বাবরের ইনিংসে ভর করেই লাহোরে তৃতীয় টি-টোয়েন্টিটা ৪ উইকেট জিতেছে পাকিস্তান। তাতে তিন ম্যাচের সিরিজটা পাকিস্তান জিতল ২-১ ব্যবধানে। প্রথম ম্যাচ হারার পর ঘুরে দাঁড়িয়েই সিরিজ জিতল পাকিস্তান।
টসে হেরে ব্যাটিং পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকা পুরো ২০ ওভার খেলে ৯ উইকেটে করে ১৩৯ রান। রানটা ৬ বল হাতে রেখেই পেরিয়ে গেছে পাকিস্তান।
রান তাড়ায় ইনিংসের ১১তম বলে ৮ রানে প্রথম উইকেট হারায় পাকিস্তান। বাবর ব্যাটিংয়ে নামেন এরপরই। দ্বিতীয় উইকেটে সাহিবজাদা ফারহানকে নিয়ে ৩৬ রান জুটি গড়া বাবর তৃতীয় উইকেটে সালমান আগাকে নিয়ে ৫২ বলে যোগ করেন আরও ৭৬ রান। ২৬ বলে ৩৩ রান করে পাকিস্তান অধিনায়ক সালমান যখন ফেরেন ২৭ বলে ২০ রান দরকার পাকিস্তানের।
৫ রান যোগ হওয়ার পর চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে বিদায় নেন বাবর ৪৭ বলে ৯ চারে ৬৮ রান করা বাবর ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন। এরপর ১৫ রানের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে আরও ২ উইকেট হারিয়ে জয়ের অপেক্ষা একটু লম্বা করেছে পাকিস্তান।
এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসে ৩৬ বলে সর্বোচ্চ ৩৪ রান করেন ওপেনার রিজা হেনড্রিকস। এ ছাড়া অধিনায়ক ডোনোভান ফেরেইরা ১৪ বলে ২৯ ও অলরাউন্ডার করবিন বশ ২৩ বলে করেন ৩০ রান। পাকিস্তানি পেসার শাহিন আফ্রিদি ২৬ রানে নিয়েছেন ৩ উইকেট।
দুই দল এরপর তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলবে। সিরিজের প্রথম ম্যাচ মঙ্গলবার ফয়সালাবাদে।
সংক্ষিপ্ত স্কোরদক্ষিণ আফ্রিকা: ২০ ওভারে ১৩৯/৯ (হেনড্রিকস ৩৪, বশ ৩০*, ফেরেইরা ২৯, ব্রেভিস ২১; আফ্রিদি ৩/২৬, তারিক ২/২৬, ফাহিম ২/২৮)।পাকিস্তান: ১৯ ওভারে ১৪০/৬ (বাবর ৬৮, সালমান ৩৩, ফারহান ১৯; বশ ২/২৪, উইলিয়ামস ২/২৬)।
ফল: পাকিস্তান ৪ উইকেটে জয়ী।
সিরিজ: ৩-ম্যাচ সিরিজে পাকিস্তান ২-১ ব্যবধানে জয়ী।