বিদেশি বিনিয়োগে চলছে মন্দাদশা। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) পরিমাণ ব্যাপক হারে কমে গেছে। নতুন বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাবেও গতি কম। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক নানা সমস্যা এর বড় কারণ বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা না করে হঠাৎ বিপুল সংখ্যক পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বাড়ানোর মতো নীতি-অনিশ্চয়তায় আরও বেশি হতাশ হচ্ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। এদিকে বিনিয়োগে মন্দাদশা কাটার আপাতত কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
এফডিআই কমছেই
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সম্পর্কিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে দেশে নিট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে মাত্র ২১ কোটি ৩০ লাখ ইউএস ডলারের। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৭৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারের। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় নিট এফডিআই ৫৩ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ৭১ দশমিক ৩৭ শতাংশ কমে গেছে। গত কয়েক মাস ধরেই এফডিআই কমে যাওয়ার প্রবণতা চলছেই।
এমনিতেই গত কয়েক বছর এফডিআইতে ছিল নিম্নমুখী প্রবণতা। ২০২১-২২ অর্থবছরে নিট এফডিআইর পরিমাণ ছিল ১৭১ কোটি ডলার। সেটি কমতে কমতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নেমে আসে ১৪১ কোটি ডলারে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নীতি অনিশ্চয়তার কারণে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তা আরও কমে প্রায় তলানিতে ঠেকেছে।
ইপিজেডেও কমেছে বিদেশি বিনিয়োগ
অবকাঠামো ও অন্যান্য সুবিধার দিক থেকে তুলানমূলক এগিয়ে থাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলেও (ইপিজেড) কমেছে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ। গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে ইপিজেডে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২২ শতাংশের বেশি। গত জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ইপিজেডে বিদেশি বিনিয়োগ নেমেছে ১২ কোটি ৬৩ লাখ ডলারে।
নতুন বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাবেও ভাটা
বিনিয়োগ প্রস্তাব সম্পর্কে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত কয়েক বছর ধরেই নতুন বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব আসার গতি কমে গেছে। ২০১৬ সালে ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি শতভাগ বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন হয় বিডায়। ২০১৭ সালে নিবন্ধন হয় ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রায় প্রতি বছরই তা কমছে। ২০২২ সালে বিডায় ৩০২ কোটি ২৩ লাখ ডলারের শতভাগ বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন হয়। ২০২৩ সালে এটি কমে হয় ২২৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত শতভাগ বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন হয়েছে ২১৮ কোটি ৮০ লাখ ডলারের। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ২০২৪ সালের শেষ অর্ধে বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাবের পরিমাণ আরও ব্যাপক হারে কমে গেছে। গত বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর সময়ে বিডায় শতভাগ বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন হয়েছে ৪৭ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ৬২ শতাংশ কম। ২০২৩ সালের একই সময়ে শতভাগ বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন হয়েছিল ১২৭ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের।
নানা কারণে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ কমে যাওয়ার কথা উঠে এসেছে জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) এক জরিপে। জেট্রোর জরিপ প্রতিবেদেন বলা হয়, বাংলাদেশে বিনিয়োগে থাকা ৬১ দশমিক ২ শতাংশ জাপানি প্রতিষ্ঠান এখানে ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহী। আগের জরিপের তুলনায় এ হার ১০ দশমিক ৪ শতাংশীয় পয়েন্ট কম। দুই বছর আগের একই ধরনের জরিপে এ হার ছিল ৭১ দশমিক ৬ শতাংশ। ‘বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ এবং প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক ওই জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বিনিয়োগে বড় ঝুঁকিগুলো হচ্ছে– রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অস্বচ্ছ নীতি ব্যবস্থাপনা, জটিল কর প্রক্রিয়া, অস্বচ্ছ ও মানহীন আইনি ব্যবস্থাপনা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বিনিয়োগ অনুমতি ও নিবন্ধন সনদ পেতে সময়ক্ষেপণ ইত্যাদি।
নীতি অনিশ্চয়তায় হতাশা
বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, কভিড-১৯-এর প্রভাব কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংঘাতময় পরিস্থিতির প্রভাবে দেখা দেয় উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট। এতে বিপাকে পড়তে হয়েছে তাদের। এ ছাড়া বিভিন্ন খাতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও জ্বালানি সংকটের কারণে গত কয়েক বছর ধরে এমনিতেই বিনিয়োগ পরিস্থিতি খারাপ। এর ওপর সম্প্রতি বিপুল সংখ্যক পণ্যে শুল্ক-ভ্যাট বাড়ানোর বিষয়টি হতাশা বাড়িয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মাঝে।
দেশের মোট এফডিআইর ৯০ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি)। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক টি আই এম নুরুল কবীর বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা গত কয়েক বছর ধরেই নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্থিতিশীলতা চান। একটা নিশ্চয়তা চান। আজকে শুল্ক-কর নিয়ে এক নীতি, কালকে আরেকটা– এমন হলে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা দেখেছি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, ডলার সংকট, প্রশাসনিক নানা জটিলতা ইত্যাদি এফডিআইর পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পর এলো শুল্ক-করে বড় পরিবর্তন। এফেক্টিভ ট্যাক্স রেট অনেক বেশি। অংশীজনের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই এতগুলো পণ্যে ট্যাক্স-ভ্যাট বাড়ানো হলো। এটা আনপ্রেডিক্টেবল। বিনিয়োগকারীরা প্রেডিক্টিবিলিটি চায়। সেটার অভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি। বাজেটের আগেই কারও সঙ্গে আলোচনা না করে এতগুলো পণ্যের ট্যাক্স-ভ্যাট বাড়ানো হলো। সবার তো একটা বিজনেস প্ল্যান আছে। শুল্ক-কর নিয়ে কোনো ইমপ্যাক্ট অ্যানালাইসিস নেই। যারা সিদ্ধান্ত নেন, তাদের তো এটা ভাবতে হবে।’
একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সাম্প্রতিক বছরগুলাের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি এফডিআই নিয়ে এসেছে জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল (জেটিআই)। কারও সঙ্গে আলোচনা না করে বিপুল সংখ্যক পণ্যে হঠাৎ শুল্ক-কর বাড়ানোয় উদ্বিগ্ন প্রতিষ্ঠানটিও। সম্প্রতি এক বিবৃতিতে জেটিআই বাংলাদেশের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পল হোলোওয়ে বলেন, জেটিআই বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগকারী। জেটি গ্রুপ গত ছয় বছরে এখানে প্রায় ২ বিলিয়ন ইউএস ডলারের বিনিয়োগ করেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও ধরে রাখার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো একটি টেকসই ও পূর্বানুমানযোগ্য ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করা। শিল্পসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া হঠাৎ করে করের হার পরিবর্তন করা ও তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করা এ সম্পর্কিত মৌলিক নীতি পরিপন্থি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বছর র একই সময় শতভ গ ব দ শ ড স ম বর র জন ত ক শ ল ক কর ন শ চয়ত ব যবস দশম ক সময় র
এছাড়াও পড়ুন:
কর্মস্থলে অনুপস্থিত, পাঁচ প্রকৌশলী ও এক স্থপতি বরখাস্ত
বিনা অনুমতিতে দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের পাঁচজন প্রকৌশলী ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের একজন স্থপতিকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। তাঁদের বিরুদ্ধে ‘অসদাচরণ’ ও ‘পলায়ন’–এর অভিযোগ ছিল। বিভাগীয় তদন্তে তাঁরা দোষী প্রমাণিত হওয়ার পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আজ বুধবার গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বরখাস্ত করা কর্মকর্তারা হলেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (সিভিল) মনিরুজ্জামান মনি, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (ই/এম) আবদুল্লা আল মামুন, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (সিভিল) রাহানুমা তাজনীন, নির্বাহী প্রকৌশলী (ই/এম) ফারহানা আহমেদ ও সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) মফিজুল ইসলাম। এ পাঁচজন গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তা। একই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় স্থাপত্য অধিদপ্তরের সহকারী স্থপতি শিরাজী তারিকুল ইসলামকেও বরখাস্ত করা হয়।
কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মনিরুজ্জামান মনি কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের ডক্টরাল প্রোগ্রামে অংশ নিতে ২০১৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ছুটি (মঞ্জুরীকৃত প্রেষণ) নেন। প্রেষণ শেষে ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে অনুমতি ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার আলোকে তাঁকে গত ২১ এপ্রিল বরখাস্ত করা হয়।
আবদুল্লা আল মামুন পিএইচডি করতে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে দুই বছরের জন্য ছুটিতে যান। কিন্তু ছুটি শেষে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কর্মস্থলে উপস্থিত না হওয়ায় গত ১৫ মে বরখাস্ত হন।
রাহানুমা তাজনীন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইওমিংয়ে স্নাতকোত্তর কোর্সে পড়তে ২০২১ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০১৩ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত ছুটিতে ছিলেন। এরপর কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। তাই চলতি মাসের ২ তারিখ তাঁকে বরখাস্ত করা হয়।
ফারহানা আহমেদ কানাডার রায়ারসন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর কোর্সে পড়তে ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছুটিতে যান। ছুটির মেয়াদ শেষ হলেও বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। তাই তাঁকে চলতি মাসের ৮ তারিখ বরখাস্ত করা হয়।
মফিজুল ইসলাম সাউথ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএস পড়তে ২০২৩ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছুটিতে ছিলেন। কিন্তু এর পর থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় তাঁকে ২৭ জুলাই বরখাস্ত করা হয়।
অন্যদিকে শিরাজী তারিকুল ইসলাম ২০২২ সালের ১২ মে থেকে অনুমতি ছাড়া অনুপস্থিত রয়েছেন। তাই তাঁকে চলতি বছরের ২১ মে বরখাস্ত করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তদন্ত শেষে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মতামত ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে কর্মকর্তাদের বরখাস্তের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়।