মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করে খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অনেকে। কেউ কেউ মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে খসড়া অধ্যাদেশের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে অংশীজন নিয়ে আগামী বুধবার সভা ডেকেছে মন্ত্রণালয়। এতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টাও উপস্থিত থাকবেন।

বিদ্যমান আইন সংশোধন করে প্রণীত এই খসড়ায় রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচিতি ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ রাখা হয়েছে। অন্য সবার পরিচয় ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানের বিষয়টি। এ ছাড়া পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী হিসেবে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের ক্রমবিন্যাসও পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।
জানা গেছে, গত ২০ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন সংশোধন-সংক্রান্ত খসড়া অধ্যাদেশ জনমত যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ জন্য গত ২ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খসড়া অধ্যাদেশের বিষয়ে ই-মেইলের মাধ্যমে মতামত সংগ্রহ করে মন্ত্রণালয়। গতকাল রোববার এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২৬টি মতামত মন্ত্রণালয়ে জমা হয়েছে। এতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ করার প্রস্তাবকে ‘অপমানজনক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ খসড়া অধ্যাদেশের পক্ষে মত দিয়েছেন।

অন্যদিকে খসড়া অধ্যাদেশের ওপর মতামত সংগ্রহ করা হয়েছে– এমন তথ্য জানা নেই বলে সমকালের কাছে দাবি করেছেন অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা। তারা জানান, ইন্টারনেট (ই-মেইল) ব্যবহারে অভ্যস্ত নন। কখন কীভাবে মতামত চাওয়া হয়েছে, জানা নেই। আর আইন সংশোধন করে পরিচয় পরিবর্তনকে সমাজে হেয় করার অপচেষ্টা বলে মনে করছেন। এতে তাদের বিভেদ বাড়বে। জনগণের কাছে ভুল বার্তা যাবে। অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করার আগে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সংগঠনগুলোর মতামত নেওয়া উচিত। প্রতিটি জেলা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে খসড়াটি টানিয়ে দিতে হবে। নয় তো খসড়াটি অধ্যাদেশে পরিণত হলে তা আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক সমকালকে বলেন, ‘নৌ কমান্ডোসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে মন্ত্রণালয়ে আলাপ হয়েছে। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা বহির্বিশ্বে সংগঠক হিসেবে বা যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি বা অন্য কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন, তাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। সেই মতামতের আলোকে খসড়াটি প্রণয়ন করা হয়েছে। রণাঙ্গনের বাইরে যারা বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন, তাদের আমরা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী প্রস্তাব করেছি। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের আপত্তি থাকলে সেটা পর্যালোচনা করে দেখা হবে। এ জন্য বুধবার সভা ডাকা হয়েছে।’
বীর মুক্তিযোদ্ধারা অনলাইন ব্যবহারে অভ্যস্ত নন– প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, এই প্রশ্ন তোলা যৌক্তিক। প্রতিটি জেলা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে খসড়া টানিয়ে দিয়ে মতামত সংগ্রহ করা গেলে ভালো হতো। সেই চেষ্টা করা হবে।
মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের ভাতা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে ফারুক-ই-আজম বলেন, ভাতা হিসেবে এখন যেটা আছে, তারা সেটা পাবেন। শুধু স্বীকৃতির শ্রেণি পরিবর্তন হবে। তবে সেটাও খসড়া অধ্যাদেশে পরিণত হওয়ার পর।

খসড়ায় ২এর ১০ উপধারা সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা অর্থ যাহারা ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে গ্রামেগঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করিয়াছেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাহাদের এ দেশীয় সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল শামস, মুসলীম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামী ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছেন– এইরূপ সকল বেসামরিক নাগরিক উক্ত সময়ে যাহাদের বয়স সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে ছিল এবং সশস্ত্র বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, বিএলএফ ও অন্যান্য স্বীকৃত বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট (ইপিআর), নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স এবং আনসার সদস্য, তাহারা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হইবেন।’

মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় ২ ধারার ১২ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধ অর্থ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় হানাদার ও পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাহাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামী ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’ অথচ বিদ্যমান আইনের সংজ্ঞায় বলা রয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধ অর্থ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়া দখলদার ও হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগ এবং তাহাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুজাহিদ বাহিনী ও পিস কমিটির বিরুদ্ধে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধ।’ দুটি সংজ্ঞা পর্যালোচনায় দেখা যায়, খসড়ায় রাষ্ট্রের নাম ও মূলনীতি পরিবর্তনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর অবদান বাতিল এবং পাকিস্তান বাহিনীর দোসর হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগী বাহিনীগুলোর নাম আগে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।

খসড়ায় ২ ধারার ১৫ উপধারায় মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের সংজ্ঞা সংযোজন করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী অর্থ যাহারা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশের অভ্যন্তরে বা প্রবাসে অবস্থান করিয়া মুক্তিযোদ্ধাগণকে উদ্দীপিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করিবার প্রয়াসে সংগঠকের ভূমিকা পালন, বিশ্বজনমত গঠন, কূটনৈতিক সমর্থন অর্জন এবং মনস্তাত্ত্বিক শক্তি অর্জনের প্রেক্ষাপটে নিম্নবর্ণিত যে সকল বাংলাদেশের নাগরিক প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করিয়াছেন’ তাদের বোঝাবে। এর মাধ্যমে বিশ্বজনমত গঠনে পেশাজীবী, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, গণপরিষদের সদস্য, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী-কলাকুশলী ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কর্মরত সব সাংবাদিক এবং স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ২ লাখ ৮ হাজার ৫০ জন। জীবিত ৯১ হাজার ৯৯৮ জন।

খসড়া অধ্যাদেশ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আব্দুল আহাদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তন হচ্ছে বা এ নিয়ে খসড়া তৈরি হয়েছে– এমন তথ্য জানা নেই। এটি অবাক করার বিষয়। সব মুক্তিযোদ্ধাকে বিষয়টি জানানো উচিত। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি এ সময় এই প্রতিবেদকের কাছ থেকে খসড়া অধ্যাদেশটি সংগ্রহ করেন।
অধ্যক্ষ আব্দুল আহাদ চৌধুরী আরও বলেন, অনলাইনে খসড়া দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে মতামত চাওয়াটা লোক দেখানো। এই বয়সে ফেসবুক ও টিভি ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে আমাদের কাছে তথ্য পৌঁছায় না।

খসড়া অধ্যাদেশ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব সমকালকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর বীর মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ কতটুকু যুক্তিসংগত তা সময় নির্ধারণ করবে। রণাঙ্গনের নগণ্য অংশীদার হিসেবে আশা করব বৃদ্ধ বয়সে মুক্তিযোদ্ধারা যেন আর নতুন করে হয়রান না হন। যদি হন, তা হবে দুর্ভাগ্যজনক।’
তাঁর মতে, মুক্তিযুদ্ধ জাতির ইতিহাসে মীমাংসিত সত্য। তাই এ বিষয় নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টির অবকাশ নেই। বহু দলমতে বিভক্ত হয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ, মত ও মতের অমিলের যৌথ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে– এটাই প্রত্যাশা।
‘খসড়ার বিষয়ে কিছু জানা নেই’ জানিয়ে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো.

শাহজাহান কবির বীরপ্রতীক সমকালকে বলেন, ‘দেশের যে অবস্থা তাতে মুক্তিযোদ্ধারা এখন অসহায়। মন্ত্রণালয়ে গিয়ে খসড়ার বিষয়ে খোঁজখবর করতে হবে।’

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ম ক ত য দ ধ র সহয গ মত মত আপত ত সমক ল ইসল ম খসড় য়

এছাড়াও পড়ুন:

আগামীকাল ফের সংস্কারের সংলাপ

ঈদুল আজহার ছুটির পর আগামীকাল মঙ্গলবার ফের শুরু হচ্ছে সংস্কারের জন্য গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ। চলবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। এর পর বিরতি দিয়ে আবার শুরু হবে।

গত ২ জুন প্রধান উপদেষ্টা এবং কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূস সংলাপের উদ্বোধন করেন। পরদিন শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ। প্রথম দিনে ৭০ অনুচ্ছেদ, নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটি নিয়ে ঐকমত্য গঠনে ৩০ রাজনৈতিক দল এবং জোটের প্রতিনিধিদের আলোচনা হয়। প্রথম দিনের আলোচ্য সূচিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ নিয়ে আলোচনার কথা থাকলেও সময় স্বল্পতায় তা হয়নি। প্রথম তিন ইস্যুতেও আলোচনা অসমাপ্ত থাকে।

আগামীকাল শুরু হতে যাওয়া সংলাপে এই তিন ইস্যুতেও আলোচনা হবে। আলোচ্য সূচিতে রয়েছে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠন ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া। সংলাপ সরাসরি সম্প্রচার করা হবে বিটিভিতে। সভাপতিত্ব করবেন ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ