আল মাহমুদের লেখা ও জুলাই বিপ্লবের প্রেরণা
Published: 17th, February 2025 GMT
‘আমাদের দেহ ক্ষতবিক্ষত।/ আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মূতার প্রান্তর।/
পৃথিবীর যত গোলাপ ফুল ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত,/ তার সুগন্ধ আমাদের নিঃশ্বাস বায়ু।’
রংপুরে যখন ১৬ জুলাই আবু সাঈদের বুক বিদীর্ণ করে দেয় ঘাতক পুলিশের বুলেট, তখন রংপুর থেকে ঢাকায় দেয়ালে-গ্রাফিতিতে, প্রতিবাদী স্লোগানে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে কবি আল মাহমুদের এই পঙ্ক্তিগুলো। কবি আল মাহমুদ জীবনকে দেখেছেন কবিতার ভেতর, কবিতাকে করে তুলেছেন জীবনের ভাষ্য। প্রতিদিনের উচ্চারিত শব্দ-সমবায় থেকে সংগ্রহ করেছেন শব্দ। ফলে তাঁর জটিল চিন্তাও হয়ে উঠেছে সহজবোধ্য। তাঁর লেখনীতে যেমন এসেছে সময়ের গল্প, তেমনি স্বাদেশিকতা ও আন্তর্জাতিকতা বোধও এনেছেন শব্দের গাঁথুনিতে। রাজনৈতিক চেতনা তাঁকে করে তুলেছে জনবান্ধব। আল মাহমুদ মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নে বারবার চেতনাকে জাগ্রত এবং প্রতিবাদী ভূমিকায় নিজেকে অবতীর্ণ করেন। এ ক্ষেত্রে নিজ জন্মভূমি ও ভিন্ন দেশের মানুষের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য বিবেচনায় আনেননি। ফলে পৃথিবীর যে প্রান্তেই মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং স্বাধীনতা বিপন্ন হয়েছে, সেখানেই কবি কবিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। কেননা তিনি রুশোর মতো বিশ্বাস করেন, মানুষের প্রজন্ম জন্মগতভাবে স্বাধীন। তাদের স্বাধীনতা, তাদের নিজেদের অবিচ্ছেদ্য সত্তা। সে সত্তাকে প্রদান করার অধিকার তাদের নিজেদের ব্যতীত অন্য কারও হতে পারে না। অন্য কারও স্বাধীনতাকে বিনষ্ট করার অধিকার প্রাকৃতিক বিধানেরই বিরোধী। চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার প্রতিবাদী মিছিলে অনেকটাই প্রাসঙ্গিক ছিলেন কবি আল মাহমুদ। এমনকি দেয়ালে দেয়ালে প্রতিবাদী স্লোগান ও গ্রাফিতিতে আল মাহমুদের কবিতা শোভা পেয়েছে। মঞ্চে-মিছিলেও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন কবি আল মাহমুদ। শত শত তরুণের আত্মত্যাগের এই অভ্যুত্থানের মাঠে প্রতিবাদী স্মারক হিসেবে এসেছে আল মাহমুদের কবিতা। কবি লিখেছেন– ‘আমাদের এ মিছিল নিকট অতীত থেকে অনন্ত কালের দিকে/
আমরা বদর থেকে ওহুদ হয়ে এখানে,/ শত সংঘাতের মধ্যে এ শিবিরে এসে দাঁড়িয়েছি।.
আমরা আজন্ম মিছিলেই আছি।/ এর আদি বা অন্ত নেই। /
পনের শত বছর ধরে সভ্যতার উত্থান-পতনে আমাদের পদশব্দ একটুও থামেনি।/
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে অনেক তরুণকেই বিনা অপরাধে জেলে নেওয়া হয়েছে। যদিও তাদের মনপ্রাণ, ধ্যানজ্ঞানে ছিল বৈষম্যহীন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন। কবি-লেখকরা তরুণদের এই আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পথ দেখান। তারা থাকেন পথপ্রদর্শকের কাতারে। কবি চার্লস সিমিকের কথায়, ‘প্রতিটি ধর্ম, আদর্শ এবং চিন্তার প্রথা ও পন্থা ব্যক্তি মানুষকে পুনর্শিক্ষা দিতে চায়, তাঁকে ভিন্ন একটি মানুষে রূপান্তর করতে চায়। একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক নিজের জন্য ভাবেন না, তারা তোমাকে এ কথাই বলবে।’ ‘জেলগেটে দেখা’ কবিতায় উপস্থিত সেই দেশপ্রেমিক আল মাহমুদ; যিনি চিন্তাকে সক্রিয়তা দিয়ে স্বদেশ দেখেছেন। যখন নাহিদ-আসিফদের আয়নাঘরে নিয়ে নিপীড়ন করা হয়, সে সময়ের কষ্ট যেন অনুরণিত হয়েছে একজন আল মাহমুদের কবিতায়। সেই কথার সত্যকে জীবনের সত্যে সমীকৃত করে দিয়েছেন কবি আল মাহমুদ।
জুলাই অভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার অনেক দেয়ালে যে কবিতার দেয়াল লিখন দেখা গেছে তা হলো–
আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা/
মনে হয় রক্তেই ফয়সালা।/ বারুদই বিচারক।/ আর স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠা।
(বখতিয়ারের ঘোড়া)
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের জনআকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের প্রধানতম কবির নাম আল মাহমুদ। আল মাহমুদ বিগত স্বৈরাচারী শাসনামলে ক্ষমতাসীনদের নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকদের দ্বারা সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হন। চার দশক ধরে আল মাহমুদ সাংস্কৃতিক স্বৈরাচার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনাবিরোধী তৎপরতার বিপক্ষে যে আমৃত্যু লড়াই অব্যাহত রেখেছিলেন, চব্বিশের সফল গণঅভ্যুত্থান তারই ধারাবাহিকতা। তাই নতুন বাংলাদেশে আল মাহমুদ অবশ্য পাঠ্য কবিসত্তা। আল মাহমুদ কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, নিবন্ধকার এবং সাংবাদিক। সবকিছুকে অতিক্রম করে চিরজাগ্রত থাকে তাঁর কবিসত্তা। আজকে আমরা যখন সমাজ বাস্তবতার সর্বত্র নষ্ট রাজনীতির কালো আঁচড় দেখতে পাচ্ছি, এমনকি আমাদের শিল্প-সাহিত্যেও তার করাল প্রভাব দেখা যাচ্ছে, তখন আল মাহমুদ সময়ের কঠিন বাস্তবতার গড্ডলিকা স্রোত অতিক্রম করে নিজেকে চিরায়ত সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সমকালীন সতীর্থ লেখক-সাহিত্যিকদের নির্ভীক-সাহসী উচ্চারণের পথ দেখিয়ে গেছেন।
কেবল তিরিশের দশকে যে বাংলা কবিতা ইউরোপবাহিত আধুনিকতার অনুরণন ‘ক্লেদ কসুম’ হয়ে নাগরিক যন্ত্রণার চিন্তাভাষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল; পঞ্চাশের দশকে এসে বাংলাদেশের কবিতা তা একান্ত বঙ্গজ হয়ে ওঠে। পাশাপাশি বাংলাদেশের বৃহত্তর বাঙালি মুসলমানদের লোকজ জীবনাচার-ধর্ম-ঐতিহ্য ও ভাষার সমৃদ্ধে আলাদা হয়ে উঠতে দেখি আল মাহমুদের কবিতায়, যা তার অন্যান্য সহযাত্রী কবি শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরীসহ নাগরিক কবিদের উন্নাসিক আধুনিকায়নে আমরা দেখতে পাই না। সেক্যুলার তকমা দিতে গিয়ে নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্যচ্যুত হয়ে শিকড়হীন রূপের নাগর হয়ে ওঠে বাংলা কবিতা। কিন্তু কবি আল মাহমুদের এ সচেতনতা আমরা লক্ষ্য করি কবিতায় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। তিনি সম্পূর্ণ সচেতনভাবে ইংরেজি-আরবি-ফারসি শব্দের পাশাপাশি প্রাচীন সংস্কৃত সাধু-চলতি শব্দ নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়।
বাংলাদেশের কবিতার পঞ্চাশের দশকে এসেছিল পাকিস্তানবাদ ও বামপন্থি কমিউনিস্ট ধারার বিপরীতে দেশাত্মবোধক রোমান্টিকতা। বাংলাদেশের পঞ্চাশের কবিরাই সমাজ সচেতনতার সঙ্গে নান্দনিকতার একটি মিশেল ঘটাতে পেরেছিলেন। এরা কবিতাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন রোমান্টিকতার কাছে। এ দশকে, বিশেষ করে আল মাহমুদ, হাসান হাফিজুর রহমান ও ওমর আলীর কবিতা দেশ-মা-মাটি প্রত্যয়ে অভিন্ন প্রতীক হয়ে উপমা-উৎপ্রেক্ষার সমন্বিত শিল্পভাষ্য হয়ে ওঠে।
সনেট দশ-এ কবির উচ্চারণ:
‘শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতের উঠিয়াছে হাত/
হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,/
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত/
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকমা/
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,/
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,/
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ/
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।’
পশ্চিমা পুঁজিবাদী অর্থনীতি দ্বারা নতুন বিশ্বব্যবস্থা চলছে মাৎস্যন্যায় পন্থায়। বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে গিলে খায়, তেমনি ছোট অর্থনীতি ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে বড় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তিগুলো গিলে খেতে চাইছে। এভাবেই গত শতাব্দীতে বহু ভাষা ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর বিলুপ্তি ঘটেছে। বায়ান্ন সালে তরুণ প্রজন্ম মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় এবং একাত্তরে রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের উদাহরণ সৃষ্টি করেও আমরা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষা করতে পারছি না। এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের লক্ষ্য হচ্ছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকে অধীনস্থ করা। তিরিশের দশকে ইতালীয় কবি ও মার্ক্সবাদী দার্শনিক অ্যান্তোনিও গ্রামসি পুঁজিবাদী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আগ্রাসনের এই প্রবণতাকে কালচারাল হেজিমনি বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী সরকারের বাহিনীর হাতে বন্দি গ্রামসি জেলখানায় বসেই তাঁর শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো লিখেছিলেন।
সব ধর্ম-বর্ণ ও রাজনৈতিক মতাদর্শের সম্মিলন ও সহাবস্থানই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সৌন্দর্য। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও চেতনায় এই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির আকাঙ্ক্ষা ছিল সবচেয়ে অগ্রগণ্য। সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে পরস্পর বৈরী ও বিভাজিত মানুষ নিয়ে কোনো জাতিরাষ্ট্র মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। যারা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে আল মাহমুদের মতো কবিকে সামাজিকভাবে কোণঠাসা করতে চেয়েছে, তাঁকে অস্বীকৃতি জানাতে ও রাজাকার বলে গালি দিতেও কুণ্ঠিত হয়নি, তারা আসলে কারা? নিশ্চয়ই বহুমত ও পথের সহাবস্থানমূলক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ তাদের প্রত্যাশা নয়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে কবি আল মাহমুদ সকলের কাছে পৌঁছতে চেয়েছেন। শিকড়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা ও শক্তি সঞ্চয়ের মধ্য দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রেরণা মানুষ বড় কবি-লেখকদের কাছ থেকেই পেয়ে থাকে। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক গতিপথ নির্মাণে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো কবি আল মাহমুদও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, তিনি আমাদের বাংলাদেশ পন্থারও দিকপাল। ১৫ ফেব্রুয়ারি ছিলো কবি আল মাহমুদের ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী।
কবি ও সাংবাদিক
shakilmahmud.bd@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ক শ র দশক আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস
বাবা সন্তানের ওপর ছায়ার মতো স্নেহময় এক উপস্থিতি। নিঃশর্ত ভরসার প্রতীক। সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনের প্রয়োজনে নিজের বর্তমান, এমনকি নিজের স্বপ্নও নীরবে উৎসর্গ করে দিতে পারেন যিনি– আজ তাদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর দিন। বাবা দিবস উপলক্ষে সমতা’র বিশেষ আয়োজন। গ্রন্থনা শাহেরীন আরাফাত
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা বৃহত্তর বরিশালে। এখন সেই জায়গাটা পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি পৌরসভার সমুদয়কাঠি গ্রাম। তখনকার সামাজিক পরিসরে আমাদের পরিবারের অবস্থা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ভালো ছিল। আমার বাবা বিজয় কুমার আইচ তখন পিরোজপুরে কাজ করতেন। তাঁর রেশনের দোকান ছিল। প্রতি শনিবার বাড়ি আসতেন। আমরা বাবার আশায় বসে থাকতাম। এটি ছিল আমাদের জন্য একরকম আশীর্বাদের মতো।
বাবার একটি ব্যবসাও ছিল। এ থেকে মূলত আমাদের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের চেয়ে সম্ভবত বাবার জ্ঞান বা বোধ উন্নততর ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য দশ গ্রামের লোকজন তাঁকে মানত। গ্রামে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকত। বাবার সঙ্গে কথা না বলে কেউ থানা-পুলিশ করতে যেত না। বাবা সবাইকে খুব বুঝিয়ে বলত– মামলা করলে কে জিতবে, কে হারবে– এটি অনেক পরের কথা। মামলা নিয়ে বরিশাল-পিরোজপুরে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে দুই পক্ষই নিঃস্ব হয়ে পড়বে। তারচেয়ে বরং তোমরা নিজেরা মিটমাট করে ফেল।
গ্রামের পণ্ডিতরা তখন তালপাতায় অ-আ-ক-খ শেখাতেন হাত ধরে ধরে। আমার সেটি একদম পছন্দ হতো না। বাবা কী করলেন, তিনি একটা স্লেট ও পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। অ-আ-ক-খ দিয়ে যত ছবি আঁকা হয়, তা শেখাতেন। এর মধ্যে আমার যে ছবিটা পছন্দ হতো, সেটি আমি মনের মধ্যে গেঁথে নিতাম। যার ফলে বাবার মাধ্যমে অত্যন্ত আনন্দদায়ক এক শিক্ষা পেয়েছি আমি।
আমার বাবারা ছিলেন ৪ ভাই। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দু’জন পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। আমার বাবা ও এক কাকা বাড়ি ছেড়ে যাননি। আমরা ছিলাম ৬ ভাই ৩ বোন। কাকাতো ভাই ৪ জন, বোন একজন। মোট ১৪ ভাইবোন। কাকা কম বয়সেই গত হন। বিলাসী জীবন আমাদের ছিল না। তবে গ্রামের মানুষের কাছে আমরা ছিলাম বড়লোক। পরিবারে অনেক সদস্য থাকলেও খাবারের অভাব হতো না কখনোই। এমনকি দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থায়ও খাবারের কষ্ট করতে হয়নি। আমাদের একটা গুদামঘর ছিল। সেখানে বাবা পাশের বন্দর কাউখালী থেকে সারা বছরের চাল, ডাল, পাউডার দুধ, চিনি, লবণ, গুড় এনে ড্রামে ভরে রাখতেন। বাইরে যত সংকটই থাকুক না কেন, বছরজুড়ে খাবারের অভাব হতো না। সমস্যা হতো ঝড়ের সময়। উপকূলীয় অঞ্চলে এমন ঝড় মাঝে মাঝেই আসত। কখনও ঘরের চাল উড়ে গেলে আমরা সমস্যায় পড়ে যেতাম।
অন্যদের সামনে বাবা নিজের অবস্থানের জন্যই বেশি হাসি-তামাশা করতেন না। যখন আমাদের সঙ্গে থাকতেন, তখন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো হাসি-খুশি থাকতেন। তখনকার বাবাদের আমরা মারধর করতে দেখেছি, এমনকি খড়ম দিয়ে পেটাতে দেখেছি। বাবা আমার গালে জীবনেও একটা চড় মারেনি। কোনো ভাইবোনকেও মারধর করতে দেখিনি। তখন হয়তো আরও এমন বাবা ছিলেন। তবে গ্রামে আমি এমন বাবা আর দেখিনি। সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলেও তিনি কখনও জিজ্ঞেস করতেন না, কেন দেরি করে ঘরে ফিরেছি।