সামনে বর্ষা, চট্টগ্রাম জলাবদ্ধতায় আর হাবুডুবু না খাক
Published: 20th, February 2025 GMT
চট্টগ্রাম মহানগরকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে কয়েক বছর ধরে। সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের সহযোগিতা নিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে। এই প্রকল্পের প্রথম সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী কাজগুলো সম্পন্ন হলে বন্দর নগরের বেশি কিছু অঞ্চল জলাবদ্ধতার কবল থেকে রেহাই পাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এই স্বপ্নে দিন গুনছে এখানে বসবাসকারী প্রায় ৭০ লাখ মানুষ।
এখন বসন্তকাল। শুষ্ক মৌসুমের দিন শেষ হতে চলেছে। এবার বৃষ্টির মৌসুম এলে আগের মতো জনজীবন ডুবিয়ে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না বলে স্বপ্ন দেখছে তারা। কিন্তু পরিবেশবাদী, নগর পরিকল্পক ও অভিজ্ঞজনেরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁরা বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ শেষ হলে প্রথম কয়েক বছর হয়তো মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে থাকবেন। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে আবার পুরোনো জটিল অবস্থায় ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। কারণ, জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ বর্জ্য। চট্টগ্রামের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চলছে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খল অবস্থা। এটাকে শৃঙ্খলায় আনতে না পারলে, সুষ্ঠু নিয়মের মধ্যে আনা না গেলে ক্রমবর্ধমান বর্জ্যের বিশাল স্তূপ নদী, খালগুলো অচিরেই ভরাট হয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে। ফলে প্রকল্পের বিশাল কর্মযজ্ঞ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
স্থানীয় একটি পত্রিকার খবর অনুযায়ী চট্টগ্রামে বছরে ১৮ লাখ ৯০ হাজার ৭০০ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। ৯ লাখ ১৩ হাজার ৭০০ টন বর্জ্য সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করলেও বাকি প্রায় ১০ লাখ টন বর্জ্য নালা-খালে পড়ছে। সেখান থেকে যাচ্ছে কর্ণফুলীতে। শুধু নগর নয়, কর্ণফুলী নদী সংলগ্ন গ্রাম এলাকার বর্জ্যও এসে পড়ছে খাল ও নদীতে। বর্জ্যের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এই সব বর্জ্যের বেশির ভাগই অপচনশীল পলিথিন, প্লাস্টিক। শুধু মানুষের ব্যবহার্য বর্জ্য নয়, কর্ণফুলীর তীরে তীরে কাপ্তাই থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার জুড়ে অন্তত ৩০০টি কারখানা বা শিল্প স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৮৪টি কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। কারখানার বিষাক্ত রাসায়নিকের মিশ্রণে সীতাকুণ্ডের কুমিরা খালের পানি মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়েছে। এতে করে জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে রোগে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমন ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডের দিকে নজর না দেওয়ায় কুমিরা খালে কারখানা বেড়েই চলেছে। ফলে বর্জ্যও বাড়ছে। এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্যের কারণে খনন করা খালগুলো ভরাট হতে খুব বেশি দিন সময় লাগার কথা নয়। ইতিমধ্যে আমাদের পরিবেশ–প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করেছে এই সব বর্জ্য। দূষণের কবলে পড়ে কর্ণফুলী, আনোয়ারা, পটিয়া, বাঁশখালী, রাঙ্গুনিয়া, সীতাকুণ্ডসহ বিভিন্ন উপজেলায় খাল নদীগুলোও ভরাট হয়েছে। ক্ষীণ হয়েছে এসবের স্রোতোধারা। শুকনা মৌসুমে সেচ ও গৃহস্থালির কাজের জন্য পানির উৎস কমছে অথচ বর্ষায় শুরু হয় জলাবদ্ধতার ভোগান্তি।
কর্ণফুলীর দুই তীরের নগর ও গ্রামের মানুষের একই রকম ভোগান্তি শুরু হলো। বর্জ্যের কারণে ক্রমেই মুমূর্ষু হয়ে পড়ছে নদীটি। তার জীববৈচিত্র্য কমছে। ইতিমধ্যে ৩৫ প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে এই নদীর কোল থেকে। মাছ কমে যাওয়া মানে শুধু জীববৈচিত্র্য কমে যাওয়া নয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে শত শত মানুষের জীবিকা। বহু বছর ধরে কর্ণফুলীর তীরেই গড়ে উঠেছে ৫০টির মতো জেলেপল্লি। কর্ণফুলীর দূষণে সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত এই সব পেশাজীবী মানুষ।
গ্রামের খালগুলো মানুষের বর্জ্যে ভরে যাচ্ছে। আর শহরের খালগুলো ভরাট হয়ে এখন রাস্তাও দখল করেছে। শহরের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে কিংবা মোড়ে বর্জ্যের ভাগাড় পরিপূর্ণ থাকে। অনেক সড়কের অর্ধেক অংশ জুড়ে দিনরাত পড়ে থাকে আবর্জনা। ১৮৬৩ সালে নগর হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ১৬২ বছর অতিক্রম করেছে চট্টগ্রাম মহানগর। দেড় শ বছরের বেশি সময়ে একটা নিজস্ব বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারিনি আমরা। এটা আমাদের জন্য লজ্জা ও দুঃখের ব্যাপার।
নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রকল্পের নাম ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন। এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এত বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয়ের পর যদি জলাবদ্ধতার স্থায়ী কোনো সমাধান না হয়, তবে তা হবে সত্যিকারের এক দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। এই দুর্ভাগ্য সহ্য করা যাবে না। সুতরাং আগে থেকেই আমাদের সতর্ক হওয়া খুব জরুরি। জলাবদ্ধতার নিরসন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন। নতুন রাষ্ট্রকাঠামোতে সব ক্ষেত্রে সংস্কারের আওয়াজ উঠেছে। সেই আওয়াজ যেন এ রকম মৌলিক বিষয়গুলোকেও স্পর্শ করলেই সংস্কার মানুষের চোখে মূর্ত হয়ে উঠবে।
আশার কথা, সরকার ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের এই প্রধান সংকট নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছে। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের খাল নদী ও চলমান প্রকল্পের কাজ সরেজমিন দেখে যান। দেখার পর গত ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সড়ক, সেতু ও রেলওয়ে বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সরকারি দপ্তর ও সংস্থা, শিক্ষক, গবেষকসহ অন্য অংশীজনদের সঙ্গে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। তাঁরা জলাবদ্ধতার কারণ চিহ্নিত করেন। কী করতে হবে, তা–ও নির্ধারণ করেন।
নির্ধারিত কাজগুলো হলো চট্টগ্রাম শহরের সব ধরনের পাহাড় কাটা বন্ধ করা, চট্টগ্রাম শহরের প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেনগুলো পরিষ্কারের ব্যবস্থা নেওয়া, পানিনিষ্কাশনের জন্য নির্মাণাধীন স্লুইসগেট–রেগুলেটরগুলোর নির্মাণকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা, চট্টগ্রাম শহরের খালগুলো পরিষ্কার করা, খালগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করে এগুলোর খননকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা, যেখানে–সেখানে ময়লা ফেলা বন্ধ করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া, কর্ণফুলী নদীর প্রয়োজনীয় নাব্যতা ও গভীরতা বজায় রাখার জন্য মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং করা এবং জলাবদ্ধতার হটস্পটগুলোয় পাম্পহাউস চালু করা।
এই বৈঠকে যা আলোচিত হয়েছে, তাতে চট্টগ্রামের মানুষের মনের কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। যদি এই সব অতি জরুরি করণীয় সত্যি সত্যিই বাস্তবায়িত হয়, তবেই হবে প্রকৃত সংস্কার। এ রকম সংস্কারই সবার কাম্য। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে যেকোনো অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলে পারে। এই সব কাজকে সমর্থন দিতে মানুষ সব সময় প্রস্তুত। নতুন শতাব্দীর উপযোগী একটি উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চট্টগ্রামকে পরিণত করতে পারে পরিবেশবান্ধব একটি শহরে। যে শহর অবাধে ঘটবে সবুজের বিস্তার। পাহাড়ে, সমুদ্রে, নদীতে চট্টগ্রাম হয়ে উঠতে পারে পৃথিবীর সেরা শহরগুলোর একটি।
ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রামের বার্তা সম্পাদক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রকল প র ন বর জ য র বর জ য বর জ য র পর ব শ র জন য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিবাদ ও প্রতিবেদকের বক্তব্য
‘কেনাকাটা আটকে দিয়েছিলেন নাহিদ, তোড়জোড় ফয়েজের’ শিরোনামে ২৭ জুলাই প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ‘৫-জি উপযোগীকরণে বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন’ শিরোনামের প্রকল্প নিয়ে প্রতিবেদনটির প্রতিবাদ পাঠানো হয় ২৮ জুলাই।
প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, প্রকল্পটি নিয়ে করা প্রতিবেদনে প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবকে জড়িয়ে যে ‘অভিযোগ ও ব্যাখ্যাহীন অনুমানমূলক’ মন্তব্য করা হয়েছে, তা পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর, একপক্ষীয় এবং ভিত্তিহীন। এতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করে ফয়েজ আহমদের মানহানি করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা সাংবাদিকতার নৈতিকতা বিরুদ্ধ।
টেলিযোগাযোগ বিভাগ প্রতিবাদপত্রে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছে। নিচে সেই সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো উল্লেখ করে প্রতিবেদকের বক্তব্য তুলে ধরা হলো।
আরও পড়ুনদুর্নীতির অভিযোগে কেনাকাটা আটকে দিয়েছিলেন নাহিদ, তোড়জোড় ফয়েজ আহমদের২৭ জুলাই ২০২৫এক. প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে ফয়েজ আহমদ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানাধীন একটি প্রকল্পের কার্যক্রম ‘এগিয়ে নিতে’ বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেছেন। বাস্তবতা হলো, বিটিসিএলের ৫–জি রেডিনেস প্রকল্পে ২৯০ কোটি টাকার ঋণপত্র (এলসি) পূর্ববর্তী সরকারের আমলে চূড়ান্ত হয়েছে। সেই টাকা ফেরত পাওয়ার আর কোনো বাস্তবসম্মত পথ নেই। এবং এসব যন্ত্রপাতি গ্রহণ না করলে সম্পূর্ণ অর্থই রাষ্ট্রের অপচয়ে পরিণত হবে।
টেলিযোগাযোগ বিভাগ আরও বলেছে, ফয়েজ আহমদ শুধু অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে, আইনি কাঠামোর ভেতরে থেকে দুদকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করেছেন, যেখানে দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিও তিনি তুলে ধরেছেন। এটি দুর্নীতির ‘সহযোগিতা’ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষায় দায়িত্বশীল পদক্ষেপ।
প্রতিবেদকের বক্তব্য: প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে বিটিসিএল একটি বেসরকারি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দুদকের অনুসন্ধানাধীন প্রকল্পের বাকি কাজ এগিয়ে দিতে আইনগত মতামত নেয় (২৭ মার্চ, ২০২৫)। যদিও এ ধরনের আইনগত মতামত দেওয়ার জন্য বিটিসিএলের নিজস্ব আইনজীবী প্যানেল রয়েছে। বেসরকারি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রথমে ইতিবাচক মতামত দিলেও পরে (৮ এপ্রিল, ২০২৫) দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে পেরে সতর্ক করে দেয় যে তদন্তাধীন প্রকল্পে কেনাকাটার ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
দুদক চিঠি দিয়ে বিটিসিএলকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় (১৮ জুন, ২০২৫) যে তাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে ক্রয় আইনের লঙ্ঘন পাওয়া গেছে। তাই কেনাকাটার কার্যক্রম এগিয়ে নিলে আইনের ব্যত্যয় হবে এবং অর্থ ব্যয় আইনসিদ্ধ হবে না। দুদক তাদের মতামত জানানোর পরও ফয়েজ আহমদ আবার (২২ জুন) সংস্থাটির চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত মনোযোগ ও আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।
দুদকের নেতিবাচক মতামতের পরও কেনাকাটার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া টেলিযোগাযোগ বিভাগের (প্রতিবাদপত্রে উল্লেখ করা) দাবিকে সমর্থন করে না। ফয়েজ আহমদ দুদককে দ্রুত অনুসন্ধান শেষ করার অনুরোধ করতে পারতেন। অনুসন্ধান শেষ হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারতেন। বিটিসিএলের ওই প্রকল্পে দুদক গত ৯ জানুয়ারি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। এই অনুসন্ধান নিশ্চয়ই বছরের পর বছর চলবে না। কেনাকাটায় আর কিছুদিন দেরি হলে রাষ্ট্রের বিপুল ক্ষতি হয়ে যাবে, এ দাবি যৌক্তিক নয়।
‘দুর্নীতি সহায়ক’ বক্তব্যটি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের মতামত, প্রথম আলোর নয়।
দুই. প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, প্রয়োজনের চেয়ে ৫ গুণ সক্ষমতার যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নিয়ে অর্থ অপচয়ের চেষ্টার অভিযোগ অসত্য। প্রতিবাদপত্রে কারিগরি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলা হয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সমীক্ষায় বিভিন্ন ধরনের চাহিদা বিবেচনা করা হয়নি। সেসব বিবেচনায় নেওয়া হলে যন্ত্রপাতির সক্ষমতা ২৬ টিবিপিএস (টেরাবাইট পার সেকেন্ড) নয়, ১২৬ টিবিপিএসের প্রয়োজন হবে। ফাইভ-জি প্রকল্পে ১২৬ টেরাবাইট ক্ষমতা ‘রিডান্ডেন্ট’সহ নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এখানে কোনো যন্ত্রপাতি বা সক্ষমতা অব্যবহৃত থাকার সুযোগ নেই।
প্রতিবাদপত্রে আরও বলা হয়, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল ২০২১ সালে প্রণীত বিটিসিএলের ফাইভ-জি প্রকল্পের একটি সমীক্ষায় মতামত দেয় যে শুধু আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ যদি ২৬ টিবিপিএস হয়, তাহলে সব মিলিয়ে ‘সিস্টেমের লাইন ক্যাপাসিটি’ ১২৬ টিবিপিএস প্রয়োজন হবে।
প্রতিবেদকের বক্তব্য: এই প্রকল্প নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়বস্তুই হলো ‘দরপত্রের শর্তানুযায়ী দরদাতাদের মূল্যায়ন না করে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি লঙ্ঘনপূর্বক শুধু প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্যের ভিত্তিতে তিনজন দরদাতাকেই কারিগরিভাবে রেসপনসিভ (যোগ্য) ঘোষণা করাসহ নন-রেসপনসিভ দরদাতাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সক্ষমতার পাঁচ গুণ বেশি যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ক্রয় করে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থের ক্ষতিসাধনের অভিযোগ।’ প্রথম আলোর প্রতিবেদনে এ ‘অভিযোগ’ই শুধু তুলে ধরা হয়েছে।
তা ছাড়া ২০৩০ সাল পর্যন্ত যে ২৬ টিবিপিএস চাহিদা নিরূপিত হয়েছিল, কিন্তু কেনা হচ্ছে ১২৬ টেরাবাইট—এটা ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত বিটিসিএলের ২১৩তম পর্ষদ সভার কার্যবিবরণীতে রয়েছে। পাশাপাশি তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে টেলিকম যন্ত্রপাতিও অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল। এ কারণে দীর্ঘ সময় যন্ত্রপাতির খুচরা যন্ত্রাংশ সহজলভ্য থাকে না। সাধারণভাবে টেলিকম যন্ত্রপাতির সর্বোচ্চ ব্যবহারযোগ্য আয়ুষ্কাল সাত বছর ধরা হয়। এই দরপত্রের ক্ষেত্রেও কারিগরি নির্দেশে যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল সাত বছর নির্ধারিত রয়েছে। তিনি সাবধান করেছিলেন যে ২০৪০ সাল পর্যন্ত চাহিদা পূরণে বেশি সক্ষমতার যন্ত্রপাতি চাওয়া হলেও বাস্তবে তা সচল থাকার নিশ্চয়তা ২০৩০ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি কেনা হবে, তার একটি বড় অংশই ২০৩০ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত হবে না এবং ব্যবহারের পূর্বেই মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।
বিগত সরকারের সময় অতিরিক্ত সক্ষমতার যন্ত্র কেনার অনুমোদন না দেওয়ার কারণেই আসাদুজ্জামানকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করা হয় এবং নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
তিন. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, দুদকের ওপর প্রভাব বিস্তারের দাবি তথ্যভিত্তিক নয়। দুদকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করা এবং চিঠি পাঠানো একটি প্রাতিষ্ঠানিক, নীতিগত এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার অংশ। এর মধ্য দিয়ে কোনোভাবেই সংস্থাটির ওপর ‘প্রভাব বিস্তার’ করা হয়নি; বরং তদন্তকাজ চলমান রাখতে এবং যন্ত্রপাতি গ্রহণের অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে একটি প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করা হয়েছে। তা ছাড়া বিশেষ সহকারীর দুদকে প্রেরিত আধা সরকারি পত্রের বক্তব্যকে প্রকল্পের কেনাকাটা করতে বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ বলে প্রচার করা হয়েছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। এটা অপসংবাদিকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রতিবেদকের বক্তব্য: টেলিযোগাযোগ বিভাগের এক নম্বর পয়েন্টেও একই বিষয়ে বলা হয়েছে। সেখানেই প্রতিবেদকের বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। স্বচ্ছতার স্বার্থে টেলিযোগাযোগ বিভাগের এই বক্তব্য আবার উল্লেখ করা হলো। এখানে বলে রাখা দরকার, দুদকের স্পষ্ট মতামত পাওয়ার পরও চেয়ারম্যানকে দ্বিতীয় দফা চিঠি দেওয়া এবং অভিযোগকে ‘সত্য নয়’ বলে দাবি করা স্বাধীন সংস্থাটিকে প্রভাবিত করারই চেষ্টা। দুদকের মতামত যাতে কেনাকাটার পক্ষে পরিবর্তিত হয়, সে জন্যই ফয়েজ আহমদ দ্বিতীয় দফা আধা সরকারি পত্র দিয়েছিলেন এবং তিনি সেখানে দুদক চেয়ারম্যানের ‘ব্যক্তিগত মনোযোগ ও আন্তরিক সহযোগিতা’ কামনা করেন।
চার. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে কারখানা পরিদর্শন ও জিও (সরকারি আদেশ) জারির প্রেক্ষাপট চেপে রাখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকেই জিও অনুমোদন না হওয়ায় চীনে কারখানা পরিদর্শনের জন্য প্রতিনিধিদল পাঠানো সম্ভব হয়নি। সরকারের নির্ধারিত বিধি অনুযায়ী, যখন কারখানা পরিদর্শন সম্ভব নয়, তখন পণ্য সরবরাহ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জাহাজীকরণ করা যেতে পারে—বিষয়টি সচেতনভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
প্রতিবেদকের বক্তব্য: প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরপত্রের নিয়মানুযায়ী কারখানা পরিদর্শনে যাওয়ার কথা বিটিসিএলের চারজন প্রকৌশলীর। সেখানে নিয়মবহির্ভূতভাবে চারজনের জায়গায় পাঁচজনকে কারখানা পরিদর্শনে পাঠানোর জন্য জিও জারির অনুরোধ করা হয়। নতুন দলে বিটিসিএলের প্রকৌশলী রাখা হয় দুজন আর টেলিযোগাযোগ বিভাগের তিনজন। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টেলিযোগাযোগ বিভাগের কর্মকর্তাদের খুশি রাখতে তাঁদের চীন সফরে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। যদিও তাঁদের চীনে যাওয়া হয়নি। কারণ, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জিও (সরকারি আদেশ) জারির বিষয়টি আটকে দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে গত ৯ ডিসেম্বর বিদেশ ভ্রমণসংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করা হয়। সেখানে সাধারণভাবে বিদেশ ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে নির্দেশনার ৯ নম্বরে কেনাকাটা, জাহাজীকরণের আগে কারখানা পরিদর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কেবল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ প্রেরণের বিষয় বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ‘ফ্যাক্টরি একসেপটেন্সের’ জন্য বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ নয়। আরও উল্লেখ্য যে এই কেনাকাটার জন্য কারখানায় যন্ত্রপাতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জিও গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর জারি করা হয়েছিল। কিন্তু পরে ২৪ সেপ্টেম্বর তা বাতিল করা হয়। ২৪ অক্টোবর (২০২৪) বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদ প্রকল্প নিয়ে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এ বছরের ৬ জানুয়ারি সেই তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে পাঠাতে বলে।
পাঁচ. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ফয়েজ আহমদের চীন সফর নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। এতে চীন সফরের ব্যাখ্যা এবং এর সরকার অনুমোদিত বৈধতা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এটিকে ‘অপরিচিত সংস্থার অর্থে’ পরিচালিত বলে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ এটি ছিল সরকারি অনুমোদিত সফর, যার উদ্দেশ্য ছিল তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অর্জন ও অবকাঠামোগত সক্ষমতা পর্যালোচনা।
প্রতিবেদকের বক্তব্য: এ সফর সরকারের অনুমোদনহীন, তা প্রথম আলোর প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি। বলা হয়েছে, জিওতে উল্লিখিত ‘চায়নিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন মেম্বারস ইন বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনটি অপরিচিত। তবে ‘চায়নিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন রয়েছে। উল্লেখ্য, ওই সফরে বিশেষ সহকারীর একান্ত সচিব সফরসঙ্গী ছিলেন, যা সরকারের বিদেশ ভ্রমণবিষয়ক নির্দেশনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ নির্দেশনায় একান্ত সচিবদের জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত সঙ্গে নেওয়া পরিহার করতে বলা হয়েছে।
ছয়. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত বাস্তবতা বিশ্লেষণ না করে শুধু প্রাক্তন আমলাদের বক্তব্য, বাতিল হওয়া দরপত্র এবং অনুমাননির্ভর ব্যাখ্যা দিয়ে ফয়েজ আহমদের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে নিজের অবস্থান গণমাধ্যমে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যার কিছু অংশ প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকলেও প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের প্রতি উত্তরের অনুপস্থিতিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
প্রতিবেদকের বক্তব্য: বক্তব্য জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ১৬ জুলাই ফয়েজ আহমদ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তাকে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠানো হয়। পরে ফয়েজ আহমদকে ফোন করা হয় এবং খুদে বার্তা পাঠানো হয়। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তাকে ফোনে বিষয়টি জানানো হয়। ২০ জুলাই আইসিটি বিভাগে গেলে অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে জানানো হয়, ফয়েজ আহমদ অফিসে উপস্থিত নেই। তখন আইসিটি বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহম্মদ জসীম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি লিখিত বক্তব্য পাঠাবেন বলে জানান। তিনি পাঠাননি। পরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে ৭ জুলাই ফয়েজ আহমদ সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সেটাই তাঁর বক্তব্য। উল্লেখ্য, ফয়েজ আহমদের আগের বক্তব্যের চুম্বক অংশ প্রতিবেদনে রয়েছে। পাশাপাশি ৭ জুলাই তা প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে অনুমাননির্ভর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
সাত. টেলিযোগাযোগ বিভাগ জানিয়েছে, ইতিমধ্যে দুজন কারিগরি ও দুজন ক্রয় বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে ‘কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস’ (ব্যয়ের বিপরীতে সুফল পর্যালোচনা) কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রতিবেদকের বক্তব্য: ‘কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস’ করা হয়েছে কি না, সেটা প্রথম আলোকে দেওয়া বক্তব্যে জানতে চেয়েছিলেন টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান।
আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছি, প্রথম আলোর প্রতিবেদন মোটেও ‘ব্যাখ্যাহীন অনুমানমূলক’ নয়, এটা ‘বিভ্রান্তিকর, একপক্ষীয় এবং ভিত্তিহীন’ও নয়; বরং প্রথম আলোর প্রতিবেদন সঠিক এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র প্রথম আলোর কাছে আছে।