চট্টগ্রাম মহানগরকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে কয়েক বছর ধরে। সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের সহযোগিতা নিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে। এই প্রকল্পের প্রথম সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী কাজগুলো সম্পন্ন হলে বন্দর নগরের বেশি কিছু অঞ্চল জলাবদ্ধতার কবল থেকে রেহাই পাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এই স্বপ্নে দিন গুনছে এখানে বসবাসকারী প্রায় ৭০ লাখ মানুষ।

এখন বসন্তকাল। শুষ্ক মৌসুমের দিন শেষ হতে চলেছে। এবার বৃষ্টির মৌসুম এলে আগের মতো জনজীবন ডুবিয়ে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না বলে স্বপ্ন দেখছে তারা। কিন্তু পরিবেশবাদী, নগর পরিকল্পক ও অভিজ্ঞজনেরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁরা বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ শেষ হলে প্রথম কয়েক বছর হয়তো মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে থাকবেন। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে আবার পুরোনো জটিল অবস্থায় ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। কারণ, জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ বর্জ্য। চট্টগ্রামের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চলছে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খল অবস্থা। এটাকে শৃঙ্খলায় আনতে না পারলে, সুষ্ঠু নিয়মের মধ্যে আনা না গেলে ক্রমবর্ধমান বর্জ্যের বিশাল স্তূপ নদী, খালগুলো অচিরেই ভরাট হয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে। ফলে প্রকল্পের বিশাল কর্মযজ্ঞ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

স্থানীয় একটি পত্রিকার খবর অনুযায়ী চট্টগ্রামে বছরে ১৮ লাখ ৯০ হাজার ৭০০ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। ৯ লাখ ১৩ হাজার ৭০০ টন বর্জ্য সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করলেও বাকি প্রায় ১০ লাখ টন বর্জ্য নালা-খালে পড়ছে। সেখান থেকে যাচ্ছে কর্ণফুলীতে। শুধু নগর নয়, কর্ণফুলী নদী সংলগ্ন গ্রাম এলাকার বর্জ্যও এসে পড়ছে খাল ও নদীতে। বর্জ্যের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এই সব বর্জ্যের বেশির ভাগই অপচনশীল পলিথিন, প্লাস্টিক। শুধু মানুষের ব্যবহার্য বর্জ্য নয়, কর্ণফুলীর তীরে তীরে কাপ্তাই থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার জুড়ে অন্তত ৩০০টি কারখানা বা শিল্প স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৮৪টি কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। কারখানার বিষাক্ত রাসায়নিকের মিশ্রণে সীতাকুণ্ডের কুমিরা খালের পানি মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়েছে। এতে করে জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে রোগে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমন ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডের দিকে নজর না দেওয়ায় কুমিরা খালে কারখানা বেড়েই চলেছে। ফলে বর্জ্যও বাড়ছে। এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্যের কারণে খনন করা খালগুলো ভরাট হতে খুব বেশি দিন সময় লাগার কথা নয়। ইতিমধ্যে আমাদের পরিবেশ–প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করেছে এই সব বর্জ্য। দূষণের কবলে পড়ে কর্ণফুলী, আনোয়ারা, পটিয়া, বাঁশখালী, রাঙ্গুনিয়া, সীতাকুণ্ডসহ বিভিন্ন উপজেলায় খাল নদীগুলোও ভরাট হয়েছে। ক্ষীণ হয়েছে এসবের স্রোতোধারা। শুকনা মৌসুমে সেচ ও গৃহস্থালির কাজের জন্য পানির উৎস কমছে অথচ বর্ষায় শুরু হয় জলাবদ্ধতার ভোগান্তি।

কর্ণফুলীর দুই তীরের নগর ও গ্রামের মানুষের একই রকম ভোগান্তি শুরু হলো। বর্জ্যের কারণে ক্রমেই মুমূর্ষু হয়ে পড়ছে নদীটি। তার জীববৈচিত্র্য কমছে। ইতিমধ্যে ৩৫ প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে এই নদীর কোল থেকে। মাছ কমে যাওয়া মানে শুধু জীববৈচিত্র্য কমে যাওয়া নয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে শত শত মানুষের জীবিকা। বহু বছর ধরে কর্ণফুলীর তীরেই গড়ে উঠেছে ৫০টির মতো জেলেপল্লি। কর্ণফুলীর দূষণে সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত এই সব পেশাজীবী মানুষ।

গ্রামের খালগুলো মানুষের বর্জ্যে ভরে যাচ্ছে। আর শহরের খালগুলো ভরাট হয়ে এখন রাস্তাও দখল করেছে। শহরের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে কিংবা মোড়ে বর্জ্যের ভাগাড় পরিপূর্ণ থাকে। অনেক সড়কের অর্ধেক অংশ জুড়ে দিনরাত পড়ে থাকে আবর্জনা। ১৮৬৩ সালে নগর হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ১৬২ বছর অতিক্রম করেছে চট্টগ্রাম মহানগর। দেড় শ বছরের বেশি সময়ে একটা নিজস্ব বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারিনি আমরা। এটা আমাদের জন্য লজ্জা ও দুঃখের ব্যাপার।

নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রকল্পের নাম ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন। এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এত বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয়ের পর যদি জলাবদ্ধতার স্থায়ী কোনো সমাধান না হয়, তবে তা হবে সত্যিকারের এক দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। এই দুর্ভাগ্য সহ্য করা যাবে না। সুতরাং আগে থেকেই আমাদের সতর্ক হওয়া খুব জরুরি। জলাবদ্ধতার নিরসন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন। নতুন রাষ্ট্রকাঠামোতে সব ক্ষেত্রে সংস্কারের আওয়াজ উঠেছে। সেই আওয়াজ যেন এ রকম মৌলিক বিষয়গুলোকেও স্পর্শ করলেই সংস্কার মানুষের চোখে মূর্ত হয়ে উঠবে।

আশার কথা, সরকার ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের এই প্রধান সংকট নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছে। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের খাল নদী ও চলমান প্রকল্পের কাজ সরেজমিন দেখে যান। দেখার পর গত ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সড়ক, সেতু ও রেলওয়ে বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সরকারি দপ্তর ও সংস্থা, শিক্ষক, গবেষকসহ অন্য অংশীজনদের সঙ্গে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। তাঁরা জলাবদ্ধতার কারণ চিহ্নিত করেন। কী করতে হবে, তা–ও নির্ধারণ করেন।

নির্ধারিত কাজগুলো হলো চট্টগ্রাম শহরের সব ধরনের পাহাড় কাটা বন্ধ করা, চট্টগ্রাম শহরের প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেনগুলো পরিষ্কারের ব্যবস্থা নেওয়া, পানিনিষ্কাশনের জন্য নির্মাণাধীন স্লুইসগেট–রেগুলেটরগুলোর নির্মাণকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা, চট্টগ্রাম শহরের খালগুলো পরিষ্কার করা, খালগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করে এগুলোর খননকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা, যেখানে–সেখানে ময়লা ফেলা বন্ধ করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া, কর্ণফুলী নদীর প্রয়োজনীয় নাব্যতা ও গভীরতা বজায় রাখার জন্য মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং করা এবং জলাবদ্ধতার হটস্পটগুলোয় পাম্পহাউস চালু করা।

এই বৈঠকে যা আলোচিত হয়েছে, তাতে চট্টগ্রামের মানুষের মনের কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। যদি এই সব অতি জরুরি করণীয় সত্যি সত্যিই বাস্তবায়িত হয়, তবেই হবে প্রকৃত সংস্কার। এ রকম সংস্কারই সবার কাম্য। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে যেকোনো অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলে পারে। এই সব কাজকে সমর্থন দিতে মানুষ সব সময় প্রস্তুত। নতুন শতাব্দীর উপযোগী একটি উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চট্টগ্রামকে পরিণত করতে পারে পরিবেশবান্ধব একটি শহরে। যে শহর অবাধে ঘটবে সবুজের বিস্তার। পাহাড়ে, সমুদ্রে, নদীতে চট্টগ্রাম হয়ে উঠতে পারে পৃথিবীর সেরা শহরগুলোর একটি।

ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রামের বার্তা সম্পাদক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রকল প র ন বর জ য র বর জ য বর জ য র পর ব শ র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ

এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।

ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।

‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।

ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।

খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।

এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী

ডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।

প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।

পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।

ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।

নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউব

ইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।

ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।

ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।

২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।

মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ