Samakal:
2025-08-01@03:01:10 GMT

ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে পৃথিবীর পথে

Published: 21st, February 2025 GMT

ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে পৃথিবীর পথে

ক্ষুদ্রঋণ ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেন সমার্থক শব্দ। একে অপরের সর্বনাম। যিনি ক্ষুদ্রঋণের সম্ভাবনাকে কেবল কেস স্টাডি হিসেবে নেননি, আন্দোলনে পরিণত করেছেন। এ নিয়ে বিশ্বমুক্তির স্বপ্নে হেঁটেছেন পৃথিবীর পথে। বাংলাদেশের চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামের কর্মসূচিকে সীমাবদ্ধ রাখেননি নির্দিষ্ট কোনো ভূগোলে, পৌঁছে দিয়েছেন সারা পৃথিবীতে।

জেমস জে.

নোভাকের বই ‘বাংলাদেশ : জলে যার প্রতিবিম্ব’কে মনে করা হয় এ দেশকে বোঝার জন্য আয়না বিশেষ। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ সবকিছু বুঝতে চেয়েছেন জলের ভাষায়। সত্যি তো, নদীমাতৃক বাংলাদেশ বুঝতে হলে তার জলকে বুঝতে হবে, নদীর ভাষাকে ধরতে হবে। একই কথা বলতে হয় ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রেও। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রবাহ, দারিদ্র্য মুক্তির সংগ্রাম ও নারীর ক্ষমতায়নকে বুঝতে হলে ক্ষুদ্রঋণ সংস্কৃতিকে অনুধাবন করতে হবে। ক্ষুদ্রঋণকে যিনি নতুন ভাষা দিয়েছেন, আন্দোলন হিসেবে জারি রেখেছেন দেশ-বিদেশে– তাঁর সম্পর্কেও জানতে হবে। এসব জানা ও বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এক বই হলো– ‘স্মল লোনস, বিগ ড্রিমস: মুহাম্মদ ইউনূস, গ্রামীণ ব্যাংক এবং দ্য গ্লোবাল মাইক্রোফিন্যান্স রেভ্যুলেশন’। লিখেছেন অ্যালেক্স কাউন্টস।

ক্ষুদ্রঋণের ইতিহাস-ঐতিহ্য নতুন নয়। বগুড়ার মহাস্থানগড়ে ১৯৩১ সালে প্রাপ্ত ব্রাহ্মীলিপিতে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে যার নজির রয়েছে। যেখানে উল্লিখিত হয়েছে, জনসাধারণকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ঋণ দেওয়া ও লিখে রাখার নির্দেশনামা। এতে নতুন ফসল উঠলে শস্য বা গণ্ডক দিয়ে তা পরিশোধের কথাও রয়েছে। মৌর্য যুগে সম্রাট অশোকের ওই নির্দেশনামায় প্রতীয়মান হয়, এই ভূগোলে ক্ষুদ্রঋণের পরম্পরা কয়েক হাজার বছরের। রাষ্ট্রের শাসক-প্রশাসকের ঘেরাটোপের বাইরে যে সমাজ কাঠামো, সেখানেও জারি রয়েছে ক্ষুদ্রঋণের সংস্কৃতি। গ্রামের সাধারণ পরিবারগুলোয় এ ধারা এখনও চর্চিত। ওরা মরিচটা-পেঁয়াজটা থেকে গৃহস্থালির অনেক কিছু কর্জ করে চালায়, মনে রেখে সময়মতো ফেরত দেয়। রাজধানীর বস্তিতে যারা থাকে, রাস্তার পাশে, পাইপের ভেতরে যাদের বাস, তারাও অভ্যস্ত এই রেওয়াজে।

সময়ের পরিক্রমায় কর্মপরিধি বাড়িয়েছে রাষ্ট্র, মনোযোগী হয়েছে নানান ভূমিকায়। বাঁক বদল ঘটেছে সমাজে। সংকট ও অসহায়ত্ব বেড়েছে সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে নারী–মা, ভগিনী, গৃহবধূ যাদের পরিচয়। পুরুষ প্রধান সমাজ হলেও শেষাবধি দুঃখ-কষ্ট সয়ে সংসারটা সচল রাখতে হয় নারীদেরই। এই সচলতায় ক্ষুদ্রঋণ এক মহৌষধের নাম। যার আবিষ্কারক মুহাম্মদ ইউনূস।

তিনি দেখলেন যারা ঋণ পেলে সমাজ-রাষ্ট্রে বড় অবদান রাখতে পারেন। অর্থনীতির চেনা চরিত্র বদলে দেওয়ার সক্ষমতা রাখেন। তারা ঋণ পান না, বিশেষ করে রাষ্ট্রের তরফে। কারণ বন্ধক রাখার সামর্থ্য নেই। আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রে বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়ার নিয়ম পুরোনো। যারা সাধারণ, যাদের বন্ধক রাখার সামর্থ্য নেই, বিশেষ করে মেয়েদের– তাদের কী হবে? যদি কিছু বন্ধক রাখার সক্ষমতা থাকেও তার মালিকানা বা কর্তৃত্ব খাটানোর সুযোগ তো তাঁর নেই। তা হলে কী হবে ওদের? ওরা ব্যর্থ হলে, পতিত থাকলে কি দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব? হবে না, অথচ সামান্য একটু ঋণ পেলে তাদের পক্ষেও ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। এসব বিষয় অবলোকন করলেন মুহাম্মদ ইউনূস। কেবল অবলোকন নয়, অনুসন্ধান করলেন দারিদ্র্য দূর করার পথ। তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ক্যাম্পাসের পাশে জোবরা গ্রামে শুরু করলেন ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি। এর পর যে অধ্যায় সূচিত হলো তাঁর জীবনে, তা রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। সেই রূপকথা হাজির করেছেন অ্যালেক্স কাউন্টস।

এই বইয়ের বিশেষত্ব হলো, শুধু ক্ষুদ্রঋণের গল্প হাজির করা হয়নি, সমাজ-রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সামাজিক ব্যবসায় বড় রকমের রূপান্তরের দিকটিকেও উপস্থাপন করা হয়েছে। অ্যালেক্স দেখিয়েছেন, মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণের ধারণা ও প্রয়োগ কীভাবে সাধারণ মানুষের বিশেষ করে নারীদের ক্ষমতায়নের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক ব্যবসাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।

অ্যালেক্সের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন এই বই পাঠকে অনিবার্য করেছে। বিশেষ করে যারা ক্ষুদ্রঋণ, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, সামাজিক ব্যবসা ও মুহাম্মদ ইউনূসকে বুঝতে চান। লেখক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়েছেন গ্রামীণ ব্যাংকের দীর্ঘ যাত্রায় যুক্ত হয়ে। যার অংশ হিসেবে মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে কাটিয়েছেন ১৫ মাস।

বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে দেওয়া লেখকের বক্তব্যে আমরা জানতে পারি, ‘ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রভাব কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী গভীর। গ্রামীণ মডেল যুক্তরাষ্ট্রে সফল হয়েছে, যেখানে ধনী এলাকা থেকে শুরু করে সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায় পর্যন্ত ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।’

ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। একজন মানুষ কীভাবে দেশের মাটিতে পা রেখে বিশ্বমুক্তির স্বপ্ন দেখতে পারেন, তিনি তাঁর অনন্য উদাহরণ। এই বই ইউনূসের এবং বাংলাদেশের বায়োগ্রাফি বিশেষ। অ্যালেক্সের পরিশ্রম-নিষ্ঠা ও গবেষণায় তা চমৎকার এক ভাষা পেয়েছে। বাংলাদেশের পরিবর্তন ও একজন বিশ্বচিন্তকের পরিভ্রমণ এবং আকাঙ্ক্ষাকে বুঝতে এই বইয়ের নিবিড় পাঠ জরুরি। ভাষা শহীদের মাস একুশে ফেব্রুয়ারিতে যা হতে পারে দুর্দান্ত এক অভিজ্ঞতা।

স্মল লোনস, বিগ ড্রিমস: মুহাম্মদ ইউনূস, গ্রামীণ ব্যাংক এবং দ্য গ্লোবাল মাইক্রোফিন্যান্স রেভ্যুলেশন, অ্যালেক্স কাউন্টস, প্রচ্ছদ পরাগ ওয়াহিদ, ইউপিএল, প্রকাশ জানুয়ারি ২০২৫, পৃষ্ঠা ৪০৮, দাম ১২০০ টাকা।

কাজল রশীদ শাহীন : সাংবাদিক ও গবেষক

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: বইম ল ব শ ষ কর ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

বৃষ্টিস্নাত রমনায় সবুজের উল্লাস

রমনা উদ্যানের গাছগুলো বৃষ্টিতে ভিজছে, ভিজছে মাটি ও মাটির ওপরের ঘাসগুলো। বর্ষায় রমনার রূপ হয় দেখার মতো। চারদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ। বসন্তের মতো ফুল নেই তো কী হয়েছে? আছে শ্যামল রূপ, আছে অপার স্নিগ্ধতা। বুকভরে ধুলাহীন নিশ্বাস নেওয়ার অবকাশ, প্রকৃতির উদার আমন্ত্রণ।

‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে’ ঢাকার রমনা পার্কের গাছের পাতাগুলো এখন আরও সবুজ। টলটলে জলের নয়নাভিরাম ঝিলটা টইটম্বুর। ধুলাময়লাহীন পায়ে চলার পথ। আর গাছের পাতার ফাঁকে রয়েছে অজস্র ফুল। কোনোটা লাল, কোনোটা বেগুনি আবার কোনোটা সাদা। বৃষ্টির মধুর আশকারা পেয়ে রমনা পার্কে এখন সবুজের উল্লাস।

এই পার্কটিকে ঢাকার ফুসফুস বলা হয়। এর যথেষ্ট কারণ আছে অবশ্য। এ রকম প্রগাঢ় নিরেট সবুজ এ শহরে কমই আছে। রমনা তাই ঢাকার জনজীবনের স্পন্দন। এটি কেবল একটি পার্ক নয়, বরং নাগরিক জীবনের পরম আনন্দ-আশ্রয়।

সম্প্রতি ‘বৃষ্টি নেশাভরা’ এক বিকেলে অরুণোদয় ফটক দিয়ে রমনা পার্কে প্রবেশ করলাম। অনেকে শরীরচর্চায় ব্যস্ত। কেউ দল বেঁধে করছেন, কেউ একাকী। কোনো দল ব্যায়াম করে ভোরে, কেউ আবার বিকেলে বা সন্ধ্যায়। আবার অনেকে আছেন দুই বেলাই হাঁটাহাঁটি করেন। হাঁটা সেরে কেউ কেউ লেকের পাশে এসে দুদণ্ড জিরিয়ে নেন। লেকে চলছিল বোট।

বর্ষার ফুলের উৎসব

বর্ষা এলেই রমনা পার্ক যেন রঙের নতুন ভাষা শেখে। আমাদের ঋতুচক্র অনুযায়ী, বসন্ত ও গ্রীষ্মকালেই এ দেশে ফোটে অধিকাংশ ফুল। তবে বর্ষারও নিজস্ব কিছু ফুল আছে, আর গ্রীষ্মের কিছু ফুল টিকে থাকে বর্ষা পর্যন্ত। সেদিন রমনায় গিয়ে এমনই কিছু ফুল চোখে পড়ল—বৃষ্টিভেজা পাতার ফাঁকে তাদের রং যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। মনে হলো, প্রকৃতির এই নিঃশব্দ উৎসবেও কত কথা লুকিয়ে থাকে!

রমনার গোলাপবিথি সেদিন দর্শনার্থীদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ কাড়ছিল। সারি সারি ঝোপে ফুটে আছে হরেক রঙের গোলাপ—লাল, সাদা, হলুদ, কমলা, গাঢ় গোলাপি। বর্ষার ভেজায় যেন আরও সতেজ, আরও তাজা হয়ে উঠেছে প্রতিটি পাপড়ি। নরম আলো আর বৃষ্টিজলে ভেজা ফুলগুলোর সৌন্দর্য মোহিত করেছে পথচলার মানুষকে। কেউ থেমে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন—মুঠোফোনে বন্দী হচ্ছে বর্ষার রঙিন রমনা।

এটি কেবল একটি পার্ক নয়, বরং নাগরিক জীবনের পরম আনন্দ-আশ্রয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ