ইলন মাস্কের কানাডার নাগরিকত্ব বাতিল করতে চান লাখো নাগরিক
Published: 26th, February 2025 GMT
বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক কানাডার স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছেন, এমন অভিযোগ তুলে সে দেশের লাখো মানুষ তাঁর কানাডার নাগরিকত্ব বাতিল করার দাবি তুলেছেন। পাঁচ দিন আগে এ দাবিতে একটি পিটিশন খোলা হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত আড়াই লাখের বেশি মানুষ ওই পিটিশনে সই করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কিছু পদক্ষেপের কারণে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কানাডার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনে প্রভাবশালীর ভূমিকায় রয়েছেন মাস্ক। তাঁর বিরুদ্ধে পিটিশনে বলা হয়, তিনি কানাডার জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছেন এবং দেশটির সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করছেন।
কানাডায় যদি কেউ প্রতারণা করেন, নিজের সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেন অথবা অভিবাসন বা নাগরিকত্ব পাওয়ার আবেদনে ইচ্ছা করে তথ্য গোপন করেন, তবেই কেবল তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করা হতে পারে।
মাস্কের জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায়। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা উভয় দেশের নাগরিক।
মাস্কের কানাডার নাগরিকত্ব বাতিলের দাবিতে পিটিশন খোলা হয়েছে, এমন খবর পাওয়ার পর ধনকুবের মাস্ক নিজের মালিকানায় থাকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে লেখেন, ‘কানাডা সত্যিকারের দেশ নয়।’ যদিও পোস্টটি পরে মুছে ফেলা হয়।
২০ ফেব্রুয়ারি খোলা ওই পিটিশনে বলা হয়, ‘আমাদের নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে মাস্ক তাঁর সম্পদ ও ক্ষমতার ব্যবহার করছেন। তিনি এখন এমন একটি বিদেশি সরকারের অংশ হয়েছেন, যে সরকার কানাডার সার্বভৌমত্বকে মুছে দিতে উদ্যত হয়েছে।’
এখন পর্যন্ত আড়াই লাখের বেশি কানাডীয় নাগরিক ওই পিটিশনে সই করেছেন। ২০ জুন পর্যন্ত পিটিশন খোলা থাকবে এবং সই করা যাবে।
পিটিশনটি মূলত প্রতীকী এবং এর কোনো আইনি জোর নেই। কিন্তু কানাডায় যদি কোনো পিটিশনে অন্তত ৫০০ মানুষ সই করেন এবং কানাডার পার্লামেন্টের অন্তত একজন সদস্যের সমর্থন পায়, তবে সাধারণত সরকার সেটি বিবেচনায় নেয়।
ব্রিটিশ কলম্বিয়ার এক লেখক ওই পিটিশন উত্থাপন করেছেন। নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির পার্লামেন্ট সদস্য চার্লি আনগুস পিটিশনে অনুমোদন দিয়েছেন।
তবে এই পিটিশন হয়তো বিবেচনায় নেওয়া হবে না। কারণ, শিগগিরই কানাডায় নির্বাচন। ভোটের আগে বর্তমান পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হবে।
ট্রাম্প আবার যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসার পর থেকে দুই প্রতিবেশী মিত্রদেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ট্রাম্প বেশ কয়েকবার বলেছেন, কানাডার উচিত যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য হয়ে যাওয়া। ট্রাম্প ক্রমাগত কানাডার পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। কানাডার কয়েকটি পণ্যের ওপর এরই মধ্যে ট্রাম্প শুল্ক আরোপও করেছেন।
কানাডাও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের কথা বলেছে। দুই দেশের সরকারের মধ্যে এই বিভেদ রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়েছে।
কানাডার নাগরিকেরা তাঁদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ বাতিল করছেন, আমেরিকার তৈরি পণ্য বর্জন করছেন, এমনকি খেলার মাঠেও এই অবস্থার উত্তাপ দেখা গেছে।
মাস্ক ১৮ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কানাডায় চলে যান। সেখানে কিংসটনের কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া শুরু করার আগে বিভিন্ন কায়িক শ্রমনির্ভর কাজ করেছেন। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নেন।
২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের নির্বাচনী তহবিলে বড় অঙ্কের অর্থ দান করার পাশাপাশি তাঁর প্রতি সরব সমর্থন দিয়েছেন মাস্ক। এর পুরস্কার হিসেবে ট্রাম্প তাঁর প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মাস্ককে পদ দিয়েছেন, দিয়েছেন অগাধ ক্ষমতা।
যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের কঠোর পদক্ষেপেও জোরালো সমর্থন দিয়েছেন মাস্ক। যদিও এখন গুঞ্জন উঠেছে যে মাস্ক নিজেই যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থী ভিসায় এসে অবৈধভাবে কাজ করতেন।
আরও পড়ুনজন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল, শুল্ক বৃদ্ধিসহ কী কী চমক দিচ্ছেন ট্রাম্প২১ জানুয়ারি ২০২৫ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে মাস্ককে ‘অবৈধ অভিবাসী কীট’ বলেছেন। ট্রাম্প অবৈধ অভিবাসীদের এভাবেই বর্ণনা করেন।
মাস্ক তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে কাজ করেননি। ২০০২ সালে মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পান বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুনপ্রথম দিনেই অভিবাসী তাড়ানোর হুঁশিয়ারি ট্রাম্পের২০ জানুয়ারি ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ত ল কর কর ছ ন ক জ কর করছ ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
চলতি বছর বিশ্বে মন্দার ঝুঁকি বেড়েছে, জরিপে অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা
চলতি বছরে মন্দার ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে গেছে বলে জরিপে দেখা গেছে। ৫০টি দেশের অর্থনীতিবিদ এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতির কারণে ব্যবসায়িক পরিবেশের অবনতি হয়েছে।
চলতি বছরে বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ১৬৭ জন বিশ্লেষকের মধ্যে ১০১ জন ‘উচ্চ’ বা ‘খুব উচ্চ’ ঝুঁকির কথা বলেছেন। ৬৬ জন বলেছেন ঝুঁকি ‘কম’, যার মধ্যে চারজন বলেছেন ‘অত্যন্ত কম’।
জরিপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ অর্থনীতি বিশ্লেষক বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের কারণে (যদিও ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে) ব্যবসায়িক আস্থা নষ্ট হয়েছে; সৃষ্টি করেছে অস্থিরতা। ফলে চলতি বছর মন্দার ঝুঁকি অনেকটা বেড়েছে। মাত্র তিন মাস আগেও এই অর্থনীতিবিদদের অধিকাংশ শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। শুধু তা–ই নয়, তাঁরা বলেছিলেন, প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা থাকবে।
কিন্তু ট্রাম্পের বিশ্ববাণিজ্য ‘নতুনভাবে গঠনের’ উদ্যোগ, বিশেষ করে সব আমদানির ওপর শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত, অর্থনীতিতে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারে বাজার মূলধন কমেছে ট্রিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ। ডলারসহ যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদগুলোয় বিনিয়োগকারীদের আস্থা নড়বড়ে হয়েছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩০০ জনের বেশি অর্থনীতিবিদের মধ্যে কেউই বলেননি, ট্রাম্পের শুল্কনীতির ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ৯২ শতাংশ অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ব্যবসায়ীদের মনোবলে এই শুল্কনীতির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মাত্র ৮ শতাংশ নিরপেক্ষ মত দিয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই ভারত ও অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির প্রতিনিধি।
জরিপে ২০২৫ সালের জন্য বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে আনা হয়েছে। জানুয়ারি মাসের জরিপে এই অর্থনীতিবিদেরাই বলেছিলেন, প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩ শতাংশ। এবার তা ২ দশমিক ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস অবশ্য একটু বেশি—তারা ২ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলেছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৪৮টি অর্থনীতির মধ্যে ২৮টি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে আনা হয়েছে।
২০২৬ সালের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসও আশাব্যঞ্জক নয়। অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে যে অর্থনৈতিক মন্দার আবহ তৈরি হয়েছে, তা সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। জরিপে অংশগ্রহণকারী ১৬৭ অর্থনীতিবিদের মধ্যে ১০১ জন (৬০ শতাংশ) অবশ্য বলেছেন, চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার ঝুঁকি বেশি বা খুব বেশি। মাত্র ৬৬ জন এটিকে কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন।
চীন ও রাশিয়ার অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ভালো করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা মনে করছেন, চীনের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ; রাশিয়ার হতে পারে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে মেক্সিকো ও কানাডার প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে দশমিক ২ ও ১ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসতে পারে, গত কয়েক মাসের মধ্যে যা সবচেয়ে বড় অবনতি।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান স্টেট স্ট্রিটের ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার প্রধান কৌশলবিদ টিমোথি গ্রাফ বলেন, এই পরিবেশে প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশাবাদী হওয়া কঠিন। আজকের মধ্যে সব শুল্ক তুলে নেওয়া হলেও ট্রাম্পের নীতির কারণে দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা চুক্তিতে বিশ্বাসযোগ্যতার যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা কঠিন।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছিল, নীতি সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে তা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন উচ্চ শুল্কের কারণে নতুন করে মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া ও বেকারত্ব বাড়লে স্ট্যাগফ্লেশন (উচ্চ মূল্যস্ফীতি+বেকারত্ব নিম্ন প্রবৃদ্ধি) সৃষ্টি হতে পারে। সেই আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে বলেই মনে করেন গ্রাফ।
জরিপে আরও দেখা গেছে, ২৯টি প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে ১৯টি ব্যাংক চলতি বছর মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে আগামী বছরের জন্য এ সংখ্যা কিছুটা কমে ১৫-তে নামবে বলে পূর্বাভাস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের এই বাণিজ্যনীতির অভিঘাত কেবল যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে নয়, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ও দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। ফলে ভবিষ্যতেও চাপ অব্যাহত থাকবে। এখন দেখার বিষয়, বিশ্বনেতারা কীভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন, অর্থাৎ কীভাবে স্থিতিশীল বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন করতে পারেন।