চট্টগ্রাম নগরের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে প্রত্যাশা অনুযায়ী গাড়ি চলছে না। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০২৫ সালে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে প্রতিদিন ৬৬ হাজারের বেশি গড়ে চলবে। বাস্তবে চলছে ৭ হাজারের কম।

এই এক্সপ্রেসওয়ে থেকে বছরে শতকোটি টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখলেও তা পূরণ হচ্ছে না। মাসে আট থেকে সাড়ে আট কোটি টাকা আয় করার কথা, কিন্তু চালুর পর প্রথম মাসে টোল আদায় হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। গত ৩ জানুয়ারি এক্সপ্রেসওয়েতে আনুষ্ঠানিকভাবে যানবাহন চলাচল শুরু হয়।

শুরুতে খরচ কম দেখিয়ে তথ্য লুকিয়ে অর্থাৎ গোঁজামিলের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এসবের ভিত্তিতে প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়। উন্নত বিশ্বে একটি প্রকল্প নেওয়ার আগে দশবার চিন্তা করে।সামছুল হক, অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

এ অবস্থায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটির দশা কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের মতো হচ্ছে কি না, সেই আলোচনা শুরু হয়েছে। কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেলেও যতসংখ্যক গাড়ি চলাচল এবং আয়ের হিসাব দেখানো হয়েছিল, বাস্তবে তার কিছুই নেই। টানেল দিয়ে প্রতিদিন গাড়ি চলার কথা ১৮ হাজার ৪৮৪টি। চলছে ৪ হাজারের মতো। টানেল রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিদিন ব্যয় হচ্ছে ৩৭ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। আয় হচ্ছে ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনুমানের ভিত্তিতে তড়িঘড়ি করে যেনতেনভাবে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) বানিয়ে প্রকল্প অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ভুল পরিকল্পনা, দফায় দফায় নকশা ও গন্তব্য পরিবর্তন, এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে যুক্ত র‍্যাম্পগুলোর কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারার কারণে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী গাড়ি চলাচল করছে না। এমন পরিস্থিতি বজায় থাকলে সরকার থেকে নেওয়া ঋণ যথাসময়ে পরিশোধের বিষয়ে জটিলতা তৈরি হবে।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সমীক্ষা করা হয়েছিল। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্ণফুলী টানেলের মতো হবে না। এটি এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়নি। র‍্যাম্পসহ পুরোপুরি চালু হলে তখন গাড়ির পরিমাণ আরও বাড়বে। সিডিএর আয়ও বাড়বে।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর মধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে প্রথম প্রকল্প। নগরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘শহীদ ওয়াসিম আকরাম’ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ১১ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত।

গাড়ি চলছে অনেক কম

প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে করা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ২০২৫ সালে প্রতিদিন গড়ে ৬৬ হাজার ৩২৩টি গাড়ি চলাচল করবে। সবচেয়ে বেশি ৩৯ হাজার কার ও তিন চাকার অটোরিকশা চলার কথা। টোল আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৯৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা। 

সিডিএর তথ্য অনুযায়ী, প্রথম মাসে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে ২ লাখ ৫ হাজার। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে চলছে ৬ হাজার ৮৩৩টি। এসব গাড়ি থেকে টোল আদায় হয়েছে ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। দিনে আয় হচ্ছে ৪ লাখ ৮৪ হাজার টাকা।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টাইগারপাস অংশে সরেজমিনে দেখা যায়, নিচের সড়কে গাড়ির দীর্ঘ জট। সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে বাস, কার, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি। আর এক্সপ্রেসওয়ের চিত্র বিপরীত। প্রায় ফাঁকা। মাঝেমধ্যে দু-তিনটি করে কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলতে দেখা যায়। কোনো বাস চলতে দেখা যায়নি।

পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি ও সড়ক পরিবহনবিশেষজ্ঞ সুভাষ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, এক্সপ্রেসওয়েকে কার্যকর করতে হলে যে র‍্যাম্প লালখান বাজারে নামানো হয়েছে, সেটিকে শুধু ওঠার র‍্যাম্প হিসেবে (বর্তমানে এটি দিয়ে পতেঙ্গা থেকে লালখান বাজারমুখী গাড়ি নামতে পারে) এবং আমবাগানমুখী যে র‍্যাম্প নামানো হয়েছে, তা দিয়ে লালখান বাজারমুখী গাড়িও নামানো যায়। কিন্তু তা না করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন জায়গায় র‍্যাম্প নামাচ্ছে ও ওঠাচ্ছে।

গোঁজামিলের মাধ্যমে ডিপিপি

সিডিএর এই প্রকল্প পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মূল ডিপিপিতে এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রথমে নগরের লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শাহ আমানত বিমানবন্দরে না গিয়ে পতেঙ্গায় শেষ হয়। এ ছাড়া নগরের লালখান বাজার প্রান্তে নামার সুযোগ থাকলেও ওঠার সুযোগ রাখা হয়নি। এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে হচ্ছে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে গিয়ে আখতারুজ্জামান চৌধুরী উড়ালসড়কের বেবি সুপার মার্কেট ও মুরাদপুরের শুলকবহর প্রান্ত ব্যবহার করে। এতে নগরের অন্য এলাকার বাসিন্দারা এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার সুযোগ পাচ্ছেন না।

এদিকে এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার উপযোগী করতে এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা যাতে ব্যবহারের সুযোগ পান, সে জন্য ২৪টি র‍্যাম্প নির্মাণ করার কথা ছিল। তবে প্রথম দফা ডিপিপি সংশোধন করে ৯টি র‍্যাম্প বাদ দেওয়া হয়। সরকার পরিবর্তনের পর আরও ছয়টি র‍্যাম্প নির্মাণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিডিএ। বাকি নয়টির মধ্যে একমাত্র টাইগারপাসে আমবাগানমুখী র‍্যাম্পটির কাজ শেষ হলেও এখনো চালু হয়নি। বাকিগুলোর কাজ চলছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহনবিশেষজ্ঞ সামছুল হক সম্ভাব্যতা সমীক্ষার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, শুরুতে খরচ কম দেখিয়ে তথ্য লুকিয়ে অর্থাৎ গোঁজামিলের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এসবের ভিত্তিতে প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়। উন্নত বিশ্বে একটি প্রকল্প নেওয়ার আগে দশবার চিন্তা করে। এখানে কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই বলে বারবার এ ধরনের প্রকল্প নেওয়া হয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রকল প অন ম দ স ড এর হয় ছ ল প রথম নগর র

এছাড়াও পড়ুন:

যমুনা সেতুর যানজট এড়াতে কাজীরহাট-আরিচা নৌপথে যানবাহনের চাপ

ঈদের ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরতি পথে যমুনা সেতু-সংলগ্ন মহাসড়কে তীব্র যানজট। তাই অনেকে পাবনার কাজীরহাট ফেরিঘাট দিয়ে ঢাকায় যাচ্ছেন। কাজীরহাট-আরিচা ফেরিঘাটে ভোগান্তি ছাড়াই যানবাহন পারাপার হচ্ছে। আগের ৪টি ফেরির সঙ্গে আরও ২টি যুক্ত হওয়ায় এই নৌপথে মোট ৬টি ফেরি চলাচল করছে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি) ও বাস কাউন্টারগুলোর সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে যমুনা সেতু-সংলগ্ন সড়কে যানজট শুরু হয়। শুক্র ও গতকাল শনিবার যানজট তীব্রতর হয়। এর মধ্যে শনিবারের যানজটে পাবনা-ঢাকা পথে যাতায়াতকারী অনেক বাস আটকে পড়ে। এতে পাবনা, বেড়াসহ বিভিন্ন বাস কাউন্টারে ঢাকাগামী বাসের সংকট দেখা দেয়। বৃহস্পতিবার থেকে ঢাকাগামী বাস ও ব্যক্তিগত ছোট গাড়িগুলো যমুনা সেতুর যানজট এড়াতে কাজীরহাট-আরিচা নৌপথের ফেরি পারাপার বেছে নেয়। এতে আজ রোববার দুপুর পর্যন্ত কাজীরহাট ফেরিঘাটে ঢাকাগামী বিভিন্ন যানবাহনের চাপ আছে।

বিআইডব্লিউটিসির কাজীরহাট ফেরিঘাট কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘আগে কাজীরহাট-আরিচা নৌপথে ৪টি ফেরি চলাচল করত। ঈদ উপলক্ষে এখন আরও ২টি ফেরি বাড়িয়ে মোট ৬টি ফেরি করা হয়েছে। এগুলো হলো ২টি রো রো ফেরি শাহ আলী ও বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান এবং ৪টি সেমি রো রো ফেরি বাইগার, গৌরী, চিত্রা ও ধানসিঁড়ি। এই ৬টি ফেরি দিয়ে নির্বিঘ্নে যানবাহনের চাপ সামলানো যাচ্ছে। বাসসহ যানবাহনগুলোকে ফেরিঘাটে বেশি দেরি করতে হচ্ছে না।’

কাজীরহাট ফেরিঘাট হয়ে ঢাকামুখী আলহামরা পরিবহনের যাত্রী আবু হানিফ বলেন, ফেরিতে ওঠানামা মিলিয়ে আড়াই ঘণ্টার মতো সময় লেগেছে। আর আরিচা থেকে ঢাকা পর্যন্ত তেমন যানজট ছিল না। খুব ভালোভাবে ঢাকা পৌঁছাতে পেরেছেন। অথচ আরও দুই ঘণ্টা আগে রওনা দিয়েও তাঁর পরিচিত একটি পরিবারকে যমুনা সেতু-সংলগ্ন সড়কে ৫-৬ ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়।

বিআইডব্লিউটিসির কাজীরহাট ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে যানবাহনের চাপ বাড়তে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি চাপ ছিল শনিবার। আমাদের বেশ বেগ পোহাতে হলেও যানবাহনগুলো ভালোভাবে পার করে দিয়েছি। শনিবার আমাদের এই ঘাট হয়ে ফেরিতে ১০১টি বাস, ৪০১টি ছোট গাড়ি ও ৮০টি ট্রাক পার হয়েছে। আর আজ রোববার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১৫টি বাস, ১৬টি ট্রাক, ৪২টি ছোট গাড়ি ও ২০০টি মোটরসাইকেল পার হয়েছে।’

বেড়া ও ঢাকার মধ্যে চলাচলকারী আলহামরা পরিবহনের বেড়া শাখার ব্যবস্থাপক বরকত আলী বলেন, ‘যমুনা সেতুর যানজটে আমাদের কয়েকটি বাস এখনো আটকে আছে। এতে নির্ধারিত সময়ে শুধু আমাদের বাসই নয়, অন্য কোম্পানির বাসগুলোও ঢাকার উদ্দেশে ছাড়তে পারছে না। আর কোনো বাস ঢাকা থেকে বেড়া এসে পৌঁছানোর পর সেই বাস এখন থেকে আমরা কাজীরহাট ফেরিঘাট হয়ে ঢাকায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। বতর্মান অবস্থায় এই পথে যাতায়াতে যাত্রীরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ