জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে দলকে প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত
Published: 1st, March 2025 GMT
জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে বিএনপিকে প্রস্তুত করা হবে। এ জন্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীকে জনবান্ধব কর্মসূচি নিয়ে সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি কথা ও কাজে মানুষের ভালোবাসা অর্জনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দলের নীতি-আদর্শ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে অবহেলা সহ্য করা হবে না। দুর্নীতি-অনাচারসহ গণবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দল থেকে সবাইকে বিরত থাকতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে হাইকমান্ড।
বিএনপির বর্ধিত সভায় গৃহীত ১০ দফা প্রস্তাবনা ও সিদ্ধান্তের আলোকে গতকাল শুক্রবার দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব নির্দেশনার কথা জানানো হয়। বৃহস্পতিবার সংসদ ভবনের এলডি হল-সংলগ্ন মাঠে সকাল থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বর্ধিত সভা হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ঘোষিত– ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’ আদর্শ ধারণ করে বর্ধিত সভা সৎ ও ত্যাগী নেতাকর্মীর যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে বিজয়ের পথে এগিয়ে চলার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। এতে বলা হয়, ২০১৫ সালে খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০ এবং ২০২৩ সালে তারেক রহমান ঘোষিত ৩১ দফা রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখার আলোকে রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে ফ্যাসিবাদবিরোধী দল ও সংগঠন কাজ করবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যেসব সংস্কার প্রস্তাব নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন সম্ভব, তা অবিলম্বে বাস্তবায়ন এবং যেগুলো আইন কিংবা সংবিধান পরিবর্তন প্রয়োজন তা নির্বাচিত সংসদে অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব করছে সভা।
সবার আগে সংসদ নির্বাচন
বর্ধিত সভা মনে করে, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ ভোট দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। মৌলিক এ অধিকার থেকে জনগণকে প্রায় দেড় যুগ বঞ্চিত রাখা হয়। এ বঞ্চনার মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না। সভা থেকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে সবার আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়।
সভায় নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে সরকারের কাছে কার্যকর ব্যবস্থার আহ্বান জানানো হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া সব দল ও শ্রেণি-পেশার সংগঠনকে আস্থায় নিয়ে সম্মিলিতভাবে পতিত সরকারের সৃষ্ট এবং সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের পাশাপাশি অযৌক্তিক কারণে আন্দোলনের নামে জনজীবন বিপর্যস্ত করার অপচেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও বিশৃঙ্খলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের ব্যর্থতা গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানানো হয়।
বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার অঙ্গীকার
বর্ধিত সভায় বিএনপি, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনকে আরও ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী, কার্যকর ও জনপ্রিয় করার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। ফ্যাসিবাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের ভিত্তিস্থাপন ও শক্তিশালী করে বিজয়ী হওয়ার লড়াইয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কৌশলী, সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রশংসা করা হয় সভায়। একই সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনে নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীকে সহায়তার মাধ্যমে তারেক রহমান যে মানবিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার প্রশংসা করা হয়।
বর্ধিত সভায় দীর্ঘ ১৬ বছরের আন্দোলন, তার ধারাবাহিকতায় চব্বিশের অভ্যুত্থানে শহীদ ছাত্র-শ্রমিক-জনতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং আহত, পঙ্গু, দৃষ্টিহীন ও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়। একই সঙ্গে প্রকৃত শহীদদের তালিকা, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, শহীদদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানায় বর্ধিত সভা।
হাসিনার পলায়নে সরকারের ব্যাখ্যা দাবি
সহযোগীসহ শেখ হাসিনার নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাওয়া এবং অসংখ্য অপরাধীর অবাধে বিচরণের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাখ্যা চেয়েছে বিএনপির বর্ধিত সভা। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলা হয়, বিদেশে অবস্থান করে যারা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও শান্তি-শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, অপপ্রচার চালাচ্ছেন, তাদের দেশীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কূটনৈতিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সরকারের উদ্যোগী হওয়া দরকার বলে মনে করে বিএনপি। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও এক-এগারোর সরকারের সময়ে করা মিথ্যা এবং গায়েবি মামলা দ্রুত প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয় সভায়।
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ সরক র র সহয গ ব যবস ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন
দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা এলাকার কৃষক মো. মোস্তফা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি উদ্ভাবিত এই জাতের প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৯ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন, যা বাজারে থাকা যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বেশি।
নিজের খেতে চোখজুড়ানো সোনালি ধান দেখে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত কৃষক মোস্তফা। কারণ, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড ধান থেকে বীজ করা যায় না। কিন্তু ব্রি উদ্ভাবিত এই ধান থেকে অনায়াসে বীজ তৈরি করতে পারবেন তিনি। এতে থাকবে না বীজ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সেই সঙ্গে ধানগুলো জিংকসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিবারের জিংকের ঘাটতিও দূর হবে। মোস্তফা বলেন, আগামী দিনে তিনি আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ করবেন।
মোস্তফার মতো একই এলাকার আরেক কৃষক ওমর ফারুকও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-৯২ চাষ করেছেন দুই একর জমিতে। বীজ ও সারসহ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। খেতের ধান এরই মধ্যে পাকা শুরু করেছে। ফলনের যে অবস্থা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে, একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ। যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি।
ওমর ফারুকের খেতে ব্রির এই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ দেখে এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার অনেক কৃষক যোগাযোগ করেছেন বীজ নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা হাইব্রিড চাষ করে ঝুঁকিতে পড়তে চান না। নিজের বীজে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন হতে চান। তাই ওমর ফারুক ঠিক করেছেন, উৎপাদিত ধান থেকে ২৫ মণ রেখে দেবেন বীজের জন্য। এই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় হবে তাঁর।
শুধু কৃষক হাজি মোস্তফা কিংবা ওমর ফারুকই নন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। পাচ্ছেন হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি ফলন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন দম্পতির খেতে চাষ করা ডায়াবেটিক রোগীদের সহনীয় ব্রি-১০৫ জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন, যা বাজারের হাইব্রিড বীজের সমান। এই ধানেরও বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকেরা।
চলতি বোরো মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নতুন জাতের ব্রি ধানের ৪৯০টি প্রদর্শনী খামার করেছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত ৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এই জাতের ধানগুলো উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।
কৃষকেরা জানান, এত দিন তাঁরা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড ও দেশীয় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধানের বীজ কিনে আবাদ করে আসছেন। এবার এসবের বাইরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধান আবাদ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের প্রতি কেজির দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ব্রির উফশী ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে চাষ করতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশী জাতের বীজ লাগে ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০ মণ, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মণ।
পিকেএসএফের কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকেন। আর দেশীয় উদ্ভাবিত ব্রি ধান জাত আবাদ করেন মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অনেক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ব্রি-ধানগুলোর ফলন হাইব্রিডের মতো ফলন দেয় এবং কিন্তু রোগবালাই নেই বললেই চলে। এতে কৃষকের খরচ কমে। লাভ হয়, আর বীজও থাকে নিজের হাতে।
ব্রির উচ্চফলনশীল জাতের নতুন জাতের ধান চাষের কথা বলতে গিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রি-উদ্ভাবিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ধানগুলো চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করছেন। এর প্রধান কারণ হলো, এসব ধান চাষ করলে একদিকে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে, অন্যদিকে কৃষকেরা নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। তা ছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত এসব ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিডের তুলনায় কম এবং ফলন হাইব্রিডের সমান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাইব্রিড থেকেও বেশি।
এ বিষয়ে ব্রির ফেনীর সোনাগাজীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি জাত আবিষ্কার করেছে। আগে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যের অভাব দূর করা, ফলন বাড়ানো। বর্তমানে আমাদের উদ্দেশ্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা। খাবার যাতে পুষ্টিমানসম্পন্ন হয়। অধিকাংশই আমিষ ও ভিটামিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূল। কিন্তু এসব সবাই কিনে খেতে পারেন না। যেহেতু ভাত প্রধান খাদ্য, এখন আমাদের যে জাতগুলো, এগুলো উদ্ভাবনে পুষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন জাতগুলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই সঙ্গে হাইব্রিডের প্রতি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।