কক্সবাজারে বিমানবাহিনীর নির্মাণাধীন ঘাঁটিতে হামলা ও সংঘর্ষের সময় শিহাব কবির (৩০) নামের এক যুবক নিহত হন। এ ঘটনার সাত দিন পর গত সোমবার রাতে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলা হয়েছে। মামলাটি করেন শিহাবের বাবা নাসির উদ্দিন। তিনি কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সমিতি পাড়ার বাসিন্দা ও প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট কক্সবাজারের সাবেক সুপার।
এজাহারে বলা হয়, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে বিমানবাহিনীর সদস্যরা জাহেদুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক যুবককে ধরে নিয়ে গেছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় স্থানীয় লোকজন জাহেদুল ইসলামকে ছাড়িয়ে আনতে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। রাস্তায় কী ঘটছে, তা দেখার জন্য এগিয়ে গেলে শিহাব গুলিবিদ্ধ হন।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার বিমানবন্দরের পশ্চিম পাশে সমিতি পাড়ায় বিমানবাহিনীর নির্মাণাধীন ঘাঁটিতে হামলা, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে ২৭ ফেব্রুয়ারি সমিতি পাড়ার বাসিন্দা দু’জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত ৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন বিমানবাহিনীর সার্জেন্ট জিয়াউল হক। দুই আসামি হলেন– সমিতি পাড়ার রাহাত ইকবাল ওরফে ইকবাল বাহার ও এজাবত উল্লাহ।
এ মামলায় বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখানো হয় ৬৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এজাহারে বলা হয়, নাশকতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বিনষ্টের উদ্দেশ্যে বিমানবঘাঁটির স্পর্শকাতর স্থাপনার ওপর দেশীয় অস্ত্র, ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ অতর্কিতে হামলা করে দুষ্কৃতকারীরা। তারা বিমানবাহিনীর ছয়-সাতটি সিসিটিভি ক্যামেরা, দুটি মোটরসাইকেল, কয়েকটি সরকারি গাড়ি, একটি অফিস ভবন, নির্মাণাধীন দালান ভাঙচুর করে। নির্মাণ সামগ্রীও লুটপাট করা হয়।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি ইলিয়াস খান বলেন, মামলা দুটির তদন্ত চলছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে এলে নিশ্চিত হওয়া যাবে শিহাব গুলিবিদ্ধ হয়ে নাকি ইটপাটকেলের আঘাতে মারা গেছেন।
এদিকে গুলিতে শিহাবের মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবার ও এলাকাবাসী দাবি করলেও পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে গুলির কথা উল্লেখ নেই।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা
বছর পাঁচেক আগেও ধান কাটার শ্রমিকেরা বৈশাখ মাসের অপেক্ষায় থাকতেন। বৈশাখে হাওরের বুকজুড়ে সবুজ ধান যখন সোনালি রঙ ছড়াতে শুরু করে, তখন থেকেই দূরদূরান্ত থেকে হাওরে আসতে থাকেন ধান কাটার শ্রমিকেরা। কিন্তু, এই চিত্র দ্রুত বদলাচ্ছে। হাওরের কৃষক এখন ধান কাটার জন্য বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করেন। ফলে কৃষকের শ্রম এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হচ্ছে। তবে, কর্মহীন হয়ে পড়ছেন কৃষি শ্রমিকেরা। বাধ্য হয়ে তারা পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।
তিন বছর হলো ধান কাটার পেশা ছেড়েছেন মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের মো. মকবুল মিয়া। এখন তিনি সারাবছর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান।
আরো পড়ুন:
খুলনার বরফশ্রমিক
নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি
ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত
মকবুল মিয়া বলেন, ‘‘আগে বছরের ছয় মাস বর্ষায় নৌকা বাইতাম, আর হুগনা সিজন আইলে নিজের জমি চাষ করতাম, আবার মাইনষের জমিতেও কামলা দিতাম। যা আয় অইতো তাই দিয়া আমরার ছয়জনের সংসার চইল্যা যাইতো। কিন্তু, যহন থেইক্যা নতুন নতুন মেশিন হাওরে আইতাছে, তহন থেইক্যা আমরার আর বেইল নাই।’’
‘‘কেউ আর আমরারে আগের মতন দাম দেয় না। কাম করলেও ঠিকমতো টেহা পাই না, তাই পুষায় না,’’ বলেন এই কৃষিশ্রমিক।
মকবুলের মতো ধান কাটা, মাড়াই, রোদে শুকানো, ঝাড়া, কাঁধে বহন করার মতো স্বাধীন পেশা ছেড়েছেন অষ্টগ্রামের ফয়জুল, ইটনার শামছুল মিয়া, নিকলীর ফরিদ উদ্দিনসহ অসংখ্য শ্রমিক। এক সময় যারা এ পেশায় দলবেঁধে কাজ করতেন, এখন দৃশ্যপট পুরোটাই ভিন্ন। ধান কাটার পেশা বদলে তারা এখন কেউ রিকশাচালক, কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ চটপটি-ফুচকার দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
তারা বলছেন, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির গতির সঙ্গে তারা কখনো তাল মেলাতে পারবেন না। কৃষকরাও তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছেন না। বেশি জমি যাদের আছে তারাও আধুনিক পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। যে কৃষক অল্প জমিতে চাষাবাদ করেছেন, তারাও আর পয়সা খরচ করে কৃষিশ্রমিকের ওপর নির্ভর করছেন না। তারা পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা নিচ্ছেন। ফলে খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা পড়েছেন বিপাকে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সনাতন পদ্ধতিতে এক বিঘা জমির ধান কাটতে প্রচুর সময় লাগে। ফসল কাটার পরে বহন ও মারাই করা, তারপর বস্তায় সংরক্ষণ করার জন্যও অনেক শ্রমিকের দরকার। এটুকু ৬ থেকে ৭ জন শ্রমিকের সারা দিনের কাজ। তার জন্য মজুরি গুনতে হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। কিন্তু, এ কাজে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করলে সময় এবং অর্থ দুটোই কম লাগে।
বৈশাখে বর্ষার পানি ও বৈরী আবহাওয়া না থাকায় কৃষকেরা হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটছেন। বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে ঝড়-তুফান শুরু হলে পাকা ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে তারা যে পদ্ধতিতে ধান কাটা সহজ এবং দ্রুত হয় সেই পদ্ধতি বেছে নিচ্ছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবার পুরো জেলায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওর এলাকাতেই আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলন ভালো হওয়ায় এই ধান থেকে এবার প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে। ধান কাটতে এ বছর হাওর অঞ্চলে ৩৫ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। এই সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কম। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধান কাটতে কৃষক কম্বাইন্ড হারভেস্টারসহ ৪১৩টি ধান কাটার যন্ত্র ব্যবহার করছেন।
জেলা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. খোরশেদ উদ্দিন বলেন, ‘‘মানুষের পেশা পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের বিভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়। কিন্তু, কৃষি এমন একটা পেশা, যারা এ পেশা রপ্ত করেছেন তাদের জন্য নতুন পেশায় আসা খুব কঠিন। বর্তমানে কৃষিকাজে যেভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, তাতে কৃষিশ্রমিকেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।’’
‘‘শুধু কৃষিতেই নয়, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে,’’ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারকেই সুদৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান, মাঠে যদি কৃষক ও শ্রমিক ন্যায্য শ্রমমূল্য না পান, তাহলে কৃষিও একদিন হুমকির মুখে পড়বে।’’
ঢাকা/তারা