গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অনেক দ্বন্দ্ব-বিরোধ তর্ক-বিতর্ককে সঙ্গে নিয়ে আত্মপ্রকাশ করল ছাত্রদের দল হিসেবে পরিচিতি পাওয়া রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। অভিনন্দন তাদের। বাংলাদেশে এই প্রথম তরুণদের নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক দলের সূচনা হলো। 

দলটিকে নিয়ে এখনও চলছে নানা ধরনের আলোচনা; দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে বাজির প্রতিযোগিতা। বিশেষ করে ছাত্রদের এই দলটি দেশের মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে, কত দিন টিকে থাকতে পারবে– সেসব প্রশ্নও রয়েছে। 

নানা ধরনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে বলে কেউ কেউ একে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে অভিহিত করছেন, যদিও দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পদ ছেড়ে এনসিপির হাল ধরে কিংস পার্টির তকমা মোছার চেষ্টা করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা স্বয়ং বিদেশি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে জানিয়েছিলেন, ছাত্ররা রাজনৈতিক দল করছে; তিনিই তাদের উৎসাহ দিয়েছেন। কেন প্রধান উপদেষ্টাকেই এ তথ্য জানাতে হলো? বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা এতদিন নানা ইস্যুতে মব করল; বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নজনের বাড়িঘরে আগুন লাগাল; সরকার চুপ থাকল। বরং অন্যভাবে বললে, সরকার তাদের মব সহিংসতাকে সমর্থনই দিয়েছে। তারাও সরকারের বাহিনী হিসেবে বিভিন্ন সময়ে ত্রাণকর্তা হিসেবে কাজ করেছে। তাই এটি কাদের দল; কারা এর পেছনে আছে; এর উদ্দেশ্যই বা কী– সেগুলো অস্পষ্ট থাকলেও আন্দাজ করা একেবারেই কঠিন নয়। 

আরেকটি জোরালো প্রশ্নও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। সেটি হলো, এই রাজনৈতিক দলের উদ্বোধনী আয়োজনের খরচ দিল কে?

এ আলোচনায় কিছুটা রসদ জোগাতেই সম্ভবত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পিরোজপুর জেলা প্রশাসনের একটি চিঠি ঘুরে বেড়াল। সেই চিঠি সাক্ষ্য দিচ্ছে– ওই জেলা থেকে এনসিপির ঢাকার সমাবেশে যোগদানকারীদের জন্য বাস জোগাড় করে দিয়েছেন স্বয়ং জেলা প্রশাসক। প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক দল গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার সুযোগ কি আছে? ‘বাস ভাড়া’র টাকা না দিলেই কি পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়?

এত প্রশ্নের জন্ম দিয়ে যে দলের সৃষ্টি, সেখানে নেতৃত্ব নিয়ে ঝামেলা হওয়াই স্বাভাবিক, যদিও তাদের ‘মুরব্বি’দের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে বলে ওই ঝামেলা সংঘর্ষের রূপ নেয়নি। কিন্তু দলটির নেতৃত্ব নির্বাচনে কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি– এ অভিযোগ রয়েই গেল। ‘চেনামুখ’দের পাশাপাশি দলীয় ‘মুরব্বি’রাই ঠিক করেছেন সব। তাই ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী’ দলটি ‘গণতন্ত্র’মনস্ক হলো না; হতে পারল না কেন– সেই প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজতে হবে। কারণ দলের ভেতরের গণতন্ত্র নিদেনপক্ষে দলীয় ঐক্য বজায় রাখতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। 

বলে রাখা প্রয়োজন, এই দলের শক্তি আপাতদৃষ্টিতে অনেক। এটি গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের দল। তাই এই দলের কাছে মানুষের আশাও অনেক। বাংলাদেশের প্রধান কয়েকটি রাজনৈতিক দলের শাসনের তেতো অভিজ্ঞতা এ দেশের মানুষের আছে। তাই ওই দলগুলোর বাইরের কোনো দলের প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক।

তবে এনসিপিতে নেতৃত্বের বিরোধকেন্দ্রিক সংশয় জারি থাকতে পারে। এ দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বেশির ভাগই বিভিন্ন দলের ছাত্র সংগঠন থেকে আসা। এখানে যেমন সাবেক বাম আছেন, তেমনি আছেন ইসলামবাদী দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত সংগঠনের সাবেক নেতাকর্মী। তারা তাদের আগের দলীয় আদর্শ বা দলীয় কর্তৃত্ব নতুন করে এখানে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করতে পারেন। দলটি নিজেদের মধ্যপন্থা হিসেবে দাবি করেছে। তবে মধ্যপন্থার মানে কী– এখনও খোলাসা করা হয়নি। দলটির ইশতেহার, সাংগঠনিক কাঠামো, গঠনতন্ত্র সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়নি। যদিও দলটি সেকেন্ড রিপাবলিক এবং নতুন গণপরিষদ গঠনের কথা বলেছে, এগুলোর মর্ম উদ্ধার করতে গণমাধ্যমকর্মীদের ঘাম ঝরে যাচ্ছে। আলোচনা চলছে তাদের ব্যবহৃত ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান নিয়েও। 

সাধাসিধে কথা আমার। যে কোনো দলকেই জনমুখী হতে হবে। জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। তবে গণঅভ্যুত্থান ছাত্র-জনতা করলেও এনসিপির নেতৃত্ব মূলত এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাদ পড়েছে শ্রমিক-জনতা। সমাজের অন্যান্য অংশের প্রতিনিধিত্বশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি, যদিও তারা বারবার বহুত্ববাদের কথা বলেছে। দল গঠনের এক দিনের মাথায় যৌন ও লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষের দলে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে টানাপোড়েনে পড়েছেন তারা। দলের দুই শীর্ষ নেতা ইতোমধ্যে এ বিষয়ে নেতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন ধর্মীয় মূল্যবোধের খোলসে। অথচ গণঅভ্যুত্থানে যৌন ও লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যের মানুষও ছিলেন দৃশ্যমান। এমনকি তখন সরকারের নিপীড়ন থেকে বাঁচাতে আজকের এনসিপির কয়েক নেতাকে নিরাপদ আশ্রয়ও দিয়েছিলেন। ‘আমি আগে মুসলিম’ বা ‘আগে পুরুষ’– এসব বলে আর যা-ই হোক, বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। 

বাংলাদেশে দু’ধরনের রাজনৈতিক দল আছে। একটি নির্বাচনমুখী, আরেকটা মাঠে থাকা দল। এসব দলও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আংশ নেয়, তবে তাদের মূল জায়গা প্রতিবাদের সংস্কৃতি জারি রাখা। এনসিপিকে আপাতভাবে নির্বাচনকেন্দ্রিক দল মনে হচ্ছে, যদিও তারা বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাল্টে দেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছে। বিদ্যমান আইনে একক দলরূপে সামনের নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ কঠিন হবে। এই কঠিন কাজ সহজ করার জন্য আইনের পরিবর্তন হয়তো আসবে। মাঠে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোও শক্ত এবং তাদেরও জনসমর্থন রয়েছে। তাই মাঠের রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে দলের ভিত্তিকে মজবুত করতে হবে, যা সময়সাপেক্ষ। ইতিবাচক সময়ে তাদের জন্য রাজনীতি করা সহজ হবে হয়তো, কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকলে টিকে থাকার জন্য তারা জনগণকে কতটুকু পাবে– সেটিই এখন দেখার বিষয়। 

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  
zobaidanasreen@gmail.

com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জ ত য় ন গর ক প র ট এনস প র র র জন র জন য ধরন র সরক র দলট র

এছাড়াও পড়ুন:

৩৬ জুলাইকে জাতীয় মুক্তি দিবস ঘোষণাসহ ১৩ দাবি ইনকিলাব মঞ্চের

ছাত্র আন্দোলনের ৩৬ জুলাইকে জাতীয় মুক্তি দিবস ঘোষণাসহ ১৩ দফা দাবি জানিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ।

সোমবার (১৬ জুন) বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবির কথা জানায় সংগঠনটি।

সংগঠনটির মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদী বলেন, “আমাদের স্বাধীনতা দিবস আছে, বিজয় দিবস আছে, কিন্তু আমাদের মুক্তি ঘটেনি। তাই ঐতিকহাসিক ৩৬ জুলাইকে জাতীয় মুক্তি দিবস ঘোষণা করতে হবে। এ ছাড়াও জুলাই সনদ চূড়ান্ত করার আগে জনগণের মতামতের জন্য তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।”

আরো পড়ুন:

বেগম রোকেয়া পদকের জন্য আবেদনপত্র আহ্বান

নিরাপদ খাদ্য দিবস শনিবার: ‘নিরাপদ খাদ্য উচ্চ রক্তচাপ ঝুঁকি কমায়’

তিনি বলেন, “গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মৌলিক সংস্কার এবং ২০২৪ সালের গণহত্যার বিচার নিশ্চিত না করে দেশে যদি নির্বাচন আয়োজন করা হয়, তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘গাদ্দার’ হিসেবে ঘোষণা করা হবে। এই সনদে ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের নিরিখে বৈষম্যবিরোধী ইনসাফভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণের সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে।”

তিনি আরো বলেন, “সংবিধান থেকে জনবিরোধী ও জুলাই সনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সব ধারা উপধারা বাতিল করে জুলাই সনদকে সাংবিধানের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব দল, মত এবং লিঙ্গের ন্যায্য শরিকানা নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে বলা হবে- আমরা বাংলাদেশের জনগণ এই ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান সম্পল্প করেছি।”

সংবাদ সম্মেলনে ইনকিলাব মঞ্চ ১৩টি প্রস্তাবনা তুলে ধরে, যা জুলাই সনদের কার্যকর প্রয়োগ ও জাতীয় ঐক্যের ওপর গুরুত্বারোপ করে।

প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করা সব শহীদকে রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ সন্তান ঘোষণা করতে হবে;  যেসব জুলাই যোদ্ধার স্থায়ী অঙ্গহানি হয়েছে, তাদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে; ফ্যাসিবাদী আমলে সংঘটিত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ভোটারবিহীন অবৈধ নির্বাচন বাতিল করে সংশ্লিষ্ট দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

এছাড়া ফ্যাসিবাদী আমলের সকল মন্ত্রী, এমপি ও দোষী আমলাসহ রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের বিচারের আওতায় এনে অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ জব্দ করে তা শহীদ ও আহতদের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে; দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা রক্ষায় ভারতীয় আধিপত্যবিরোধী ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে; জুলাই, পিলখানা ও শাপলা গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করে দেশি-বিদেশি অপশক্তি চিহ্নিত করতে হবে; রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক সংস্কার করতে হবে যাতে ফ্যাসিবাদ আর স্বৈরতান্ত্রিকতা কখনও ফিরে না আসে; ৩৬ জুলাইকে জাতীয় মুক্তি দিবস ঘোষণা করতে হবে।

বাকি দাবিগুলো হলো- জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের ভিত্তিতে বৈষম্যবিরোধী কল্যাণ রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে; সংবিধান থেকে জনবিরোধী ও জুলাই সনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সব ধারা বাতিল করে জুলাই সনদকে সংবিধানের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব দল, মত ও লিঙ্গের ন্যায্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; জুলাই সনদের ভাষাগত দুর্ব্যবহার পরিহার করে জনসাধারণের জন্য সহজ ভাষায় উপস্থাপন করতে হবে এবং সনদ চূড়ান্ত করার পূর্বে জনগণের মতামতের জন্য তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।

আগামী ২৫ জুনের মধ্যে জুলাই সনদ ঘোষণা করা না হলে রাজধানীর শাহবাগ মোড় থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ অভিমুখে ‘লাল মার্চ’ করার ঘোষণাও দিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ।

ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৩৬ জুলাইকে জাতীয় মুক্তি দিবস ঘোষণাসহ ১৩ দাবি ইনকিলাব মঞ্চের
  • নাগরিক সমাজ শাসকদের পক্ষে থাকে কেন?
  • আবু সাঈদ হত্যা: এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের
  • রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা: এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের
  • গণঅভ্যুত্থানে আহত সামিউলের দিন কাটছে অনিশ্চয়তায়