প্রধান উপদেষ্টা ২৬ মার্চ চীনে যাচ্ছেন
Published: 6th, March 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ২৬ মার্চ চীন সফরে যাচ্ছেন। এ সফরে দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের প্রস্তুতি চলছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, চীনের হাইনান প্রদেশে অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার ২৫ দেশের জোট বিওএও ফোরাম ফর এশিয়ার সম্মেলন আগামী ২৫ থেকে ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ সম্মেলনে যোগ দিতে ২৭-২৮ মার্চ প্রধান উপদেষ্টাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে চীন। এর পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসারও আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আগামী ২৮ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.
কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, সপ্তাহখানেক ধরে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার সফরের আয়োজন নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে। তবে চূড়ান্ত সফরসূচি এবং আলোচ্যসূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পাশাপাশি সম্মেলনে যোগ দেওয়া নিয়ে বাংলাদেশ অনিশ্চয়তায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি সমকালকে বলেন, ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। এ সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার জন্য চার্টার ফ্লাইটের ব্যবস্থার কথাও আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে বেইজিং। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আসন্ন দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বিষয়টি আলোচনায় আসবে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে ঢাকা।
উপদেষ্টার সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক এগিয়ে নিতে অর্থনীতির পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। ঢাকায় একটি আধুনিক চীন-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল নির্মাণে চীনকে আহ্বান জানান হবে। আর এ বিষয়টিতে ইতোমধ্যে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে দেশটি। এ ছাড়া ঢাকার একটি হাসপাতালে ‘রিহ্যাবিলিটেশন ও ট্রমা সেন্টার’ স্থাপন করতে চায় চীন। আসন্ন সফরে বাংলাদেশিদের বিদেশে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে চীনের সহযোগিতা চাইবে ঢাকা। কুনমিংয়ে কিছু হাসপাতাল সুনির্দিষ্ট করে দেওয়ার আহ্বান জানানো হবে। যাতে দিল্লির পরিবর্তে সেখান থেকে চিকিৎসাসেবা নিতে পারে বাংলাদেশিরা।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ২০১৬ সালের টেকসই পানি ব্যবস্থাপনাবিষয়ক সমঝোতা নবায়ন করবে দুই দেশ। এ সমঝোতার আওতায় তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিল চীন। এর মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর অংশে চীনের মেগা বাঁধ নির্মাণ নিয়ে আলোচনা হবে। তিব্বতে প্রায় ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে দেশটি। ফলে নদীর ভাটির দেশগুলোর পানির প্রাপ্যতা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়। ইতোমধ্যে এ বাঁধ নির্মাণ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ভারত। বিষয়টি আলোচনায় থাকবে। আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ রাখা হয়েছে।
চীনের অর্থায়নে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে ঢাকার চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের কাছে জানতে চাইলে লিখিত উত্তরে দূতাবাস থেকে সমকালকে জানানো হয়, তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে কমপক্ষে দুই কোটি বাংলাদেশি উপকৃত হবে। বাংলাদেশের অনুরোধে চীন এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে এবং এর বিস্তারিত বাস্তবায়ন পরিকল্পনা তৈরি করেছে। তিস্তার যৌথ প্রকল্পে নদী ব্যবস্থাপনা ও এর প্রযুক্তি নিয়ে চীনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সঙ্গে বিনিময় করতে প্রস্তুত বেইজিং। এখন এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে কিনা– সে সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বাংলাদেশের। চীন বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে সম্মান করবে।
সফরের আগে গত ১৯ জানুয়ারি উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। বৈঠক শেষে তিব্বতে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে জানতে চাইলে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এ বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর ভাটির দেশগুলোর ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।’
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও প্রকল্প অর্থায়নের গুরুত্ব দেওয়া হবে। সুদের হার ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসার পাশাপাশি ঋণের প্রতিশ্রুতি ফি দশমিক ৫ শতাংশ বাতিল চাইবে ঢাকা। এ ছাড়া আগের সমঝোতা অনুযায়ী চারটি জাহাজ সংগ্রহসহ বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে। বিশেষ করে যে প্রকল্পগুলোতে বর্তমানে অর্থায়ন বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের সহযোগিতা চাইবে ঢাকা। বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে রোহিঙ্গাদের পক্ষে থাকার আহ্বান জানানো হবে চীনকে। সেই সঙ্গে চীন থেকে আরও বিনিয়োগ প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর চীনই ২০ কোটি ডলারের ওপর বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার দেশটি। বিলম্বিত অর্থ দেওয়াসহ পণ্য ও এর কাঁচামালের অবাধ বাণিজ্যে সহযোগিতা চাইবে ঢাকা। সেই সঙ্গে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে উত্তরণের পর অতিরিক্ত আরও তিন বছর চীনের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা চাইবে।
আসন্ন বৈঠকে কোন কোন বিষয় গুরুত্ব পাবে– জানতে চাইলে দূতাবাস থেকে লিখিত উত্তরে সমকালকে জানানো হয়, এটি ২০২৫ সালে দুই দেশের প্রথম উচ্চ পর্যায়ের সফর এবং দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। সফরটি দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, রাজনৈতিক সহযোগিতা, সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তির যৌথ উদযাপন, দুই দেশের জনগণ পর্যায়ে বছরজুড়ে সফর এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়গুলোতে আলোচনা হবে।
এবারের বৈঠকে ব্রিকস ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থায় (এসসিও) বাংলাদেশের সদস্য পদ এবং সার্ককে সচল করতে চীনের সহযোগিতা চাইবে ঢাকা। বিশেষ করে সার্কে ২০০৫ সাল থেকে পর্যবেক্ষক সদস্য হিসেবে রয়েছে বেইজিং। সার্ককে সচল করতে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম জোরদার করতে পারে। সেই সঙ্গে কারিগরি সহযোগিতা ও অবকাঠামোগত বিনিয়োগের প্রস্তাব করবে বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের উষ্ণতা কমে গেলেও সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার দরজা খোলা রেখেছে বেইজিং। গত ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বকে এগিয়ে নিতে একত্রে কাজ করার কথা ব্যক্ত করেছে। ফলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সফরটি আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে দুই দেশ। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির পাশাপাশি গুরুত্ব পাবে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক কৌশল। সফরে বাংলাদেশ নিজ স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি আঞ্চলিক স্বার্থগুলোও বিবেচনায় রাখবে। চীনের পক্ষ থেকে বৈঠকে বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) বাংলাদেশকে যুক্ত করার বিষয়টি জোর দেওয়া হবে।
পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া নিয়ে সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের জন্য তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। আমরা অবশ্যই একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখব। কাউকে অসন্তুষ্ট করতে চাই না। তবে অবশ্যই নিজ স্বার্থ রক্ষা করে তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখব।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ড ইউন স উপদ ষ ট র পরর ষ ট র ব যবস থ প রকল প সহয গ ত র সফর ব ষয়ট সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ
এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।
সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।
ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।
‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।
ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।
খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।
এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরীডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।
প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।
পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।
ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।
বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।
নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউবইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।
ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।
২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।