অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ২৬ মার্চ চীন সফরে যাচ্ছেন। এ সফরে দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের প্রস্তুতি চলছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, চীনের হাইনান প্রদেশে অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার ২৫ দেশের জোট বিওএও ফোরাম ফর এশিয়ার সম্মেলন আগামী ২৫ থেকে ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ সম্মেলনে যোগ দিতে ২৭-২৮ মার্চ প্রধান উপদেষ্টাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে চীন। এর পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসারও আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আগামী ২৮ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.

ইউনূসের সঙ্গে সি চীন পিংয়ের বৈঠক আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে।

কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, সপ্তাহখানেক ধরে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার সফরের আয়োজন নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে। তবে চূড়ান্ত সফরসূচি এবং আলোচ্যসূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পাশাপাশি সম্মেলনে যোগ দেওয়া নিয়ে বাংলাদেশ অনিশ্চয়তায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি সমকালকে বলেন, ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। এ সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার জন্য চার্টার ফ্লাইটের ব্যবস্থার কথাও আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে বেইজিং। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আসন্ন দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বিষয়টি আলোচনায় আসবে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে ঢাকা।

উপদেষ্টার সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক এগিয়ে নিতে অর্থনীতির পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। ঢাকায় একটি আধুনিক চীন-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল নির্মাণে চীনকে আহ্বান জানান হবে। আর এ বিষয়টিতে ইতোমধ্যে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে দেশটি। এ ছাড়া ঢাকার একটি হাসপাতালে ‘রিহ্যাবিলিটেশন ও ট্রমা সেন্টার’ স্থাপন করতে চায় চীন। আসন্ন সফরে বাংলাদেশিদের বিদেশে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে চীনের সহযোগিতা চাইবে ঢাকা। কুনমিংয়ে কিছু হাসপাতাল সুনির্দিষ্ট করে দেওয়ার আহ্বান জানানো হবে। যাতে দিল্লির পরিবর্তে সেখান থেকে চিকিৎসাসেবা নিতে পারে বাংলাদেশিরা।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ২০১৬ সালের টেকসই পানি ব্যবস্থাপনাবিষয়ক সমঝোতা নবায়ন করবে দুই দেশ। এ সমঝোতার আওতায় তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিল চীন। এর মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর অংশে চীনের মেগা বাঁধ নির্মাণ নিয়ে আলোচনা হবে। তিব্বতে প্রায় ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে দেশটি। ফলে নদীর ভাটির দেশগুলোর পানির‍ প্রাপ্যতা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়। ইতোমধ্যে এ বাঁধ নির্মাণ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ভারত। বিষয়টি আলোচনায় থাকবে। আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ রাখা হয়েছে।

চীনের অর্থায়নে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে ঢাকার চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের কাছে জানতে চাইলে লিখিত উত্তরে দূতাবাস থেকে সমকালকে জানানো হয়, তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে কমপক্ষে দুই কোটি বাংলাদেশি উপকৃত হবে। বাংলাদেশের অনুরোধে চীন এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে এবং এর বিস্তারিত বাস্তবায়ন পরিকল্পনা তৈরি করেছে। তিস্তার যৌথ প্রকল্পে নদী ব্যবস্থাপনা ও এর প্রযুক্তি নিয়ে চীনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সঙ্গে বিনিময় করতে প্রস্তুত বেইজিং। এখন এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে কিনা– সে সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বাংলাদেশের। চীন বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে সম্মান করবে।

সফরের আগে গত ১৯ জানুয়ারি উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। বৈঠক শেষে তিব্বতে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে জানতে চাইলে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এ বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর ভাটির দেশগুলোর ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।’

দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও প্রকল্প অর্থায়নের গুরুত্ব দেওয়া হবে। সুদের হার ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসার পাশাপাশি ঋণের প্রতিশ্রুতি ফি দশমিক ৫ শতাংশ বাতিল চাইবে ঢাকা। এ ছাড়া আগের সমঝোতা অনুযায়ী চারটি জাহাজ সংগ্রহসহ বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে। বিশেষ করে যে প্রকল্পগুলোতে বর্তমানে অর্থায়ন বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের সহযোগিতা চাইবে ঢাকা। বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে রোহিঙ্গাদের পক্ষে থাকার আহ্বান জানানো হবে চীনকে। সেই সঙ্গে চীন থেকে আরও বিনিয়োগ প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর চীনই ২০ কোটি ডলারের ওপর বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার দেশটি। বিলম্বিত অর্থ দেওয়াসহ পণ্য ও এর কাঁচামালের অবাধ বাণিজ্যে সহযোগিতা চাইবে ঢাকা। সেই সঙ্গে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে উত্তরণের পর অতিরিক্ত আরও তিন বছর চীনের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা চাইবে।

আসন্ন বৈঠকে কোন কোন বিষয় গুরুত্ব পাবে– জানতে চাইলে দূতাবাস থেকে লিখিত উত্তরে সমকালকে জানানো হয়, এটি ২০২৫ সালে দুই দেশের প্রথম উচ্চ পর্যায়ের সফর এবং দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। সফরটি দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, রাজনৈতিক সহযোগিতা, সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তির যৌথ উদযাপন, দুই দেশের জনগণ পর্যায়ে বছরজুড়ে সফর এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়গুলোতে আলোচনা হবে।

এবারের বৈঠকে ব্রিকস ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থায় (এসসিও) বাংলাদেশের সদস্য পদ এবং সার্ককে সচল করতে চীনের সহযোগিতা চাইবে ঢাকা। বিশেষ করে সার্কে ২০০৫ সাল থেকে পর্যবেক্ষক সদস্য হিসেবে রয়েছে বেইজিং। সার্ককে সচল করতে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম জোরদার করতে পারে। সেই সঙ্গে কারিগরি সহযোগিতা ও অবকাঠামোগত বিনিয়োগের প্রস্তাব করবে বাংলাদেশ।

শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের উষ্ণতা কমে গেলেও সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার দরজা খোলা রেখেছে বেইজিং। গত ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বকে এগিয়ে নিতে একত্রে কাজ করার কথা ব্যক্ত করেছে। ফলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সফরটি আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে দুই দেশ। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির পাশাপাশি গুরুত্ব পাবে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক কৌশল। সফরে বাংলাদেশ নিজ স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি আঞ্চলিক স্বার্থগুলোও বিবেচনায় রাখবে। চীনের পক্ষ থেকে বৈঠকে বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) বাংলাদেশকে যুক্ত করার বিষয়টি জোর দেওয়া হবে।

পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া নিয়ে সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের জন্য তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। আমরা অবশ্যই একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখব। কাউকে অসন্তুষ্ট করতে চাই না। তবে অবশ্যই নিজ স্বার্থ রক্ষা করে তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখব।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ড ইউন স উপদ ষ ট র পরর ষ ট র ব যবস থ প রকল প সহয গ ত র সফর ব ষয়ট সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

শুধু ঘোষণা নয়, বাস্তবে প্রতিফলিত হোক

রাজধানী শহরসহ দেশের বড় শহরগুলোয় শব্দদূষণের অসহনীয় মাত্রার বিষয়টি কারও অজানা নয়। এটি এখন শুধু শব্দদূষণ নয়, শব্দসন্ত্রাস বলেও অভিহিত হচ্ছে। অতীতে ও বর্তমানে সরকারগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও কার্যকর হচ্ছে না। অতীতের ধারাবাহিকতায় রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা ও নিকেতনকে ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। এখন এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করাই হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ।

শহরের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে নীরব এলাকা ঘোষণা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি অবশ্যই সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ঘোষণা বাস্তবে কার্যকর হবে, নাকি এটিও অতীতের মতো কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে? এর আগে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং এর আশপাশের এলাকাকে নীরব এলাকা ঘোষণা করা হয়েছিল, কিন্তু তার ফল তেমন একটা ভালো পাওয়া
যায়নি। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঘোষণার পর কিছু এলাকায় শব্দ কিছুটা কমলেও সার্বিকভাবে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এই অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, শুধু ঘোষণা যথেষ্ট নয়, বরং এর কঠোর বাস্তবায়ন অপরিহার্য।

শব্দদূষণের ক্ষেত্রে আগের তুলনায় সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলতেই হয়। যার কারণে সাউন্ডবক্স বা মাইক বাজানোর বিষয়গুলো তুলনামূলকভাবে কমে এসেছে। তবে গাড়ির হর্ন এতটা বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করছে, যা অকল্পনীয়। এটিই এখন রাজধানীসহ বড় শহরগুলোর শব্দদূষণের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অতিরিক্ত শব্দ হৃদ্‌রোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। চিকিৎসকেরা বলছেন, এটিতে শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়, মেজাজ খিটখিটে হয়, মানুষ অনিদ্রায় ভোগে এবং শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটায়। তাই শুধু অভিজাত এলাকা নয়, পুরো শহরে ধাপে ধাপে কীভাবে নীরব এলাকা ঘোষণা করা যায়, সেই লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে এগোতে হবে।

তবে এ উদ্যোগ সফল করতে হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কঠোর হতে হবে। হর্ন বাজানোর বিরুদ্ধে আইন আছে। তা যদি আইনভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে প্রয়োগ না করা হয়, এ ঘোষণা কখনোই সফল হবে না। কেবল প্রশাসনের ওপর নির্ভর না করে নীরব এলাকা–ঘোষিত এলাকাগুলোর বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যেমন মসজিদ, মন্দির এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও এখানে গণসচেতনতার কাজে যুক্ত করতে হবে।

গাড়ির হর্ন বাজানো সীমিত করতে পরিবহনের বিভিন্ন ধরনের সমিতি–সংগঠনগুলোর যুক্ততাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। গাড়ির চালকদের অভ্যাসগত পরিবর্তনের জন্য শব্দদূষণের ক্ষতিকর দিকটি নিয়মিতভাবে তাঁদের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। হাইড্রোলিক হর্নসহ উচ্চমাত্রার যেকোনো হর্ন উৎপাদন, আমদানি ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। এ ব্যাপারে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।

সম্পর্কিত নিবন্ধ