Samakal:
2025-05-01@04:35:40 GMT

বিশ্ব বইমেলার আসরে

Published: 6th, March 2025 GMT

বিশ্ব বইমেলার আসরে

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা পৃথিবীর প্রাচীনতম বইমেলার মর্যাদা লাভ করেছে। শুধু বইমেলা নয়, বইয়ের উৎপত্তির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে ফ্রাঙ্কফুর্টের নাম। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের অধিবাসী জোহানেস গুটেনবার্গ [১৪৪০-৫০] কালের মধ্যে ছাপাখানা উদ্ভাবন করেন। তখন থেকেই বইয়ের অস্তিত্বের সূচনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালে আধুনিক ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা শুরু হলেও এর গোড়াপত্তন হয়েছিল প্রায় ৫০০ বছর আগে ১৪৬২ সালে। তবে শুধু বইমেলা নয়, ব্যাংক ও বারবনিতার জন্যও ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর বিখ্যাত। মহাকবি গ্যোটের জন্ম এই শহরে, তেমনি ধনকুবের রথসচাইল্ড পরিবারের আদি নিবাস এখানে।
মেলার জার্মান প্রতিশব্দ হলো মেসে, সারা বছরই কোনো কোনো মেলা চলে, অক্টোবরের গোড়ায় বুক মেসে। এটাই এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ বইমেলা। পাঁচ দিনের এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে প্রায় তিন লাখ অতিরিক্ত লোকের সমাগম ঘটে।
বিশ্বনন্দিত এই বইমেলায় আমার অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে। সে বছর ছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার ৭৫তম আসর। এবারের অতিথি দেশ স্লোভেনিয়া। মেলায় ১০২টি দেশের ৭ হাজার ৩০০ প্রকাশনী সংস্থা অংশগ্রহণ করে। এবারের বইমেলা ছিল শারদোৎসবের কালে। শরতের সৌন্দর্যের কোল থেকে হঠাৎ যেন নিজেকে আবিষ্কার করলাম ইউরোপীয় শীতের ধূসর প্রাঙ্গণে। কনকনে শীতকে সঙ্গী করে ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি আমরা গেলাম নির্ধারিত বাসভবনে। আমরা মানে তিনজন। হাড়কাঁপানো শীত ও পাকস্থলী কাঁপানো ক্ষুধা দুয়েরই নিবৃত্তি ঘটল কিছুক্ষণের মধ্যে। 
পরদিন বিকেলে নির্ধারিত সময়ে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বইমেলা প্রাঙ্গণে উপস্থিত হলাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত সরকারপ্রধান, লেখক, প্রকাশক, পাঠক, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের কোলাহলে মুখর ছিল মেলা প্রাঙ্গণ। বিশাল মিলনায়তনে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধন অনুষ্ঠান শুরু হয়। বইমেলার আয়োজক কমিটির প্রেসিডেন্ট, জার্মানির সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী ও বিভিন্ন দেশের লেখক এ বইমেলার তাৎপর্য তুলে ধরে চমৎকার বক্তব্য দেন। জার্মানির একজন জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন। তাঁর অসাধারণ উপস্থাপনা অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। অতিথিদের উদ্দেশে তিনি একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, হোয়াট ইজ দ্য রোল অব বুক ইন দিস ডিফিকাল্ট টাইম? মাত্র কয়েকদিন আগে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে হামাসের রক্তাক্ত সংঘাত শুরু হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছিল বইমেলার উদ্বোধনী আসরেও। নজিরবিহীনভাবে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে জড়িয়ে পড়েন বক্তারা। এমনকি বক্তার বক্তব্যের মাঝখানে দর্শকসারি থেকে মঞ্চের দিকে এগিয়ে গিয়েও কেউ কেউ প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি। আয়োজক কমিটির প্রতিনিধি প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছেন, তারা বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। 
উদ্বোধন অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। অতিথি দেশ স্লোভেনিয়ার শিল্পীরা দৃষ্টিনন্দন নৈপুণ্যে তাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উপস্থাপন করেন। উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর ছিল আকর্ষণীয় পানাহার পর্ব। এরপর অতিথি দেশ স্লোভেনিয়ার জন্য নির্ধারিত হলরুমে দর্শনার্থীদের প্রবেশ। মঞ্চে বাজছে স্লোভেনিয়ার নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রে সুরের লহরি। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের আড্ডা চলছে। সেখানেই দেখা হয়ে গেল আয়োজক দেশ জার্মানির সম্প্রচার ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী এবং স্লোভেনিয়ার সংস্কৃতিমন্ত্রীর সঙ্গে। দু’জনই নারী এবং তাদের চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের ছাপ। স্লোভেনিয়ার সংস্কৃতিমন্ত্রী অপেক্ষাকৃত তরুণ ও প্রিয়দর্শিনী। তাদের দু’জনের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হলো। বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি শুনে তারা আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তারাসহ আরও কয়েকটি দেশের প্রতিনিধির সঙ্গে সময় কাটিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা উদ্বোধনের দিন পার হলো। পরের দিন বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে বসে সিংহভাগ সময় পার হলো। প্যাভিলিয়নে ঘুরতে আসা বিভিন্ন দেশের লেখক, পাঠক, সাংবাদিক বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বই সম্পর্কে কৌতূহল প্রকাশ করেন। তাদের সঙ্গে আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে অনেকটা সময় অতিবাহিত হলো।
আমাদের প্যাভিলিয়নের মুখোমুখি ছিল সিঙ্গাপুরের প্যাভিলিয়ন। কয়েকজন উজ্জ্বল তরুণ-তরুণী সেই প্যাভিলিয়নের দায়িত্বে ছিলেন। প্রায়ই তাদের সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় ও কথার আদান-প্রদান চলছিল। একই সারিতে ছিল ভারত, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানিসহ আরও কয়েকটি দেশের প্যাভিলিয়ন। বিশ্বসেরা বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা অসাধারণ বইয়ের সম্ভার নিয়ে নিজেদের গর্বিত উপস্থিতি তুলে ধরেছিল। আয়োজক দেশ জার্মানি, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের প্যাভিলিয়নে নানা বিষয়ে নিয়মিত সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন ভবনে, ভিন্ন ভিন্ন ফ্লোরে সুবিশাল পরিসরে স্থান পেয়েছিল বিশ্বের বৃহত্তম বইমেলা। প্রায় চার মিলিয়ন বর্গফুটের আবদ্ধ স্থানে এই আয়োজন। প্রতিটি দেশ ও প্রকাশনা সংস্থার প্যাভিলিয়নে গিয়েছি। সবখানে বসতে পারিনি, ভালোভাবে বই দেখতে পারিনি। যেখানে ভালো লেগেছে সেখানে বসেছি, কথা বলেছি। বলা বাহুল্য শুধু বইয়ের আকর্ষণে নয়, মানুষের আকর্ষণেও।
ফুটবল খেলায় বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের কোনো অবস্থান না থাকলেও ফুটবল উন্মাদনায় বাংলাদেশের নাম প্রথম সারিতে থাকবে। বিভিন্ন দেশের প্যাভিলিয়নে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল শতকোটি মানুষের আবেগের নাম আর্জেন্টিনায়। বাংলাদেশেও সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা এই দেশের ফুটবলারদের। ম্যারাডোনা থেকে মেসি– যার যার সময় সবচেয়ে বড় ফুটবলারের নাম। আর্জেন্টিনার প্যাভিলিয়নে ঢুকে তাদের প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীর সঙ্গে পরিচিত হলাম। আর্জেন্টিনার প্রতি আমার পরিবার ও দেশের গভীর অনুরাগের কথা জেনে তারা আনন্দিত হলেন। কয়েকটি বই হাতে নিয়ে ঘ্রাণ অনুভব করলাম। বাংলা সাহিত্যের মহত্তম প্রতিভা রবীন্দ্রনাথের নামও জড়িয়ে আছে আর্জেন্টিনার সঙ্গে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সুবাদে। কখনও আর্জেন্টিনা যেতে পারব কিনা জানি না, কিন্তু আর্জেন্টিনার নাগরিকদের সান্নিধ্য পেয়েছি, এটিই-বা কম কী! 
ব্রাজিল, মেক্সিকো, চিলিসহ আরও কয়েকটি দেশের প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীদের সঙ্গে আড্ডা হলো। ফুটবল খ্যাতিতে এই দেশগুলোও উজ্জ্বল। বিশ্বের বৃহত্তম এ বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে একটি আক্ষেপ খুব তীব্র হচ্ছিল। কত গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় বই নজর কেড়েছে। কিন্তু সেই বই কেনার উপায় নেই। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা মূলত প্রদর্শনী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রকাশক ও বিপণনকারীরা এখানে আসেন। অনুবাদ ও বইয়ের স্বত্বের জন্য তারা চুক্তিবদ্ধ হন।
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাকে এককথায় বলা যেতে পারে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন বুক’। মাত্র একটি ক্ষেত্রে এত বিচিত্র ধরনের শস্য এক অনন্য বিস্ময়। বিভিন্ন জাতির ও ভাষার লেখক, বুদ্ধিজীবী, প্রকাশক এবং বইপ্রেমী পাঠকের অন্তহীন মিলনমেলা। জ্ঞানের কোনো ভৌগোলিক সীমা নেই। মানবজ্ঞানের সমৃদ্ধ ভান্ডার যেন খণ্ড খণ্ড করে সমগ্র মানবজাতির জন্য সাজানো।  v

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আর জ ন ট ন র বইম ল র মন ত র র জন য উপস থ ফ টবল বইয় র

এছাড়াও পড়ুন:

রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে

রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।

এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন। 

পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।

এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়। 

এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে। 

মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়। 

জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।

এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়। 

এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।

যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।

তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে। 

ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই। 

অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়। 

এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।

এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে। 

এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়। 

এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে। 

বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ