মিরসরাই উপজেলার সাহেরখালি ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রাম। গ্রামের বেড়িবাঁধের পাশে নারকেল গাছের নিচে ঘাসের ওপর বই নিয়ে পড়াশোনা করছে ৫০-৬০ জন শিশু। মাঝখানে দাঁড়িয়ে বই হাতে শিশুদের পড়াচ্ছিলেন ইকবাল হোসেন। শুক্র ও শনিবার–সপ্তাহে দুই দিন চলে পড়ালেখা। ‘সোনালি স্বপ্ন’ নামের এই শিক্ষালয় দুই দিনের বিদ্যালয় হিসেবেই বেশি পরিচিত। শিশুদের বর্ণপরিচয়ের সঙ্গে পড়তে ও লিখতে শিখিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি উপযোগী করাই এই বিদ্যালয়ের লক্ষ্য।
সাহেরখালী ইউনিয়নে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল শিশুরা। শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে একযুগ আগে এই বিদ্যালয় চালু করেন স্থানীয় শিক্ষিত তরুণ ইকবাল হোসেন। উপকূলীয় এলাকার শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে খোলা মাঠে ‘সোনালি স্বপ্ন’ নামে অস্থায়ী বিদ্যালয় স্থানীয় শিশুদের কাছে এখন দারুণ জনপ্রিয়।
জানা গেছে, ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে সন্দ্বীপ থেকে পানির স্রোতে মিরসরাই উপকূলে ভেসে আসে জীবিত-মৃত অসংখ্য মানুষ। বেঁচে যাওয়া মানুষেরা উপকূলীয় বেড়িবাঁধের দুই পাশে গড়ে তোলেন বসতি। তখন তাদের সঙ্গে স্থানীয় দরিদ্র লোকজনও সরকারি জায়গায় তৈরি করেন মাথা গোঁজার ঠাই। সমুদ্র উপকূলে মাছ ধরে আর বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে জীবন চলে তাদের। সন্তানরা ছিল শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। সেই বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে ইকবাল হোসেন গড়ে তুলেন দুই দিনের বিদ্যালয়।
জানা গেছে, ফেনী সরকারি কলেজ থেকে অনার্স শেষ করার পর চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ থেকে একই বিষয়ে মাস্টার্স করেন ইকবাল হোসেন। ছয় বছর ধরে স্থানীয় বদিউল আলম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামের একটি নন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বল্প বেতনে শিক্ষকতা করে আসছেন তিনি। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে একদিন সাহেরখালী বেড়িবাঁধ এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যান ইকবাল। সেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর উপকূলীয় এলাকার নানা দৃশ্য যেমন আনন্দিত করেছিল তাকে ঠিক তেমনই কিছু ছবি বিষাদে ভরে দেয় মন। দেখতে পান লাকড়ির বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরছে ছোট শিশুরা। সে বিকেলেই আশপাশে ঘুরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন শীর্ণকায় শরীর আর উসকোখুসকো চুলের এসব শিশু কেউই বিদ্যালয়ে যায় না। তাদের নিয়ে তিনি শুরু করেন ‘সোনালি স্বপ্ন’ নামেনএকটি বিদ্যালয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, গজারিয়া বেড়িবাঁধ, শাহেরখালী বেড়িবাঁধ, ডোমখালী বেড়িবাঁধ ও সন্দ্বীপপাড়ায় কয়েক হাজার দরিদ্র মানুষের বাস। এখান থেকে সবচেয়ে কাছে যে প্রাথমিক বিদ্যালয় সেটির দূরত্বও প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার। ফলে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল এখানকার শিশুরা। 
ইকবাল হোসেন বলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আঁধার নামলে সাহেরখালী থেকে বাড়ি ফিরে আসি। রাতে ঘুমাতে গেলে চোখে ভাসছিল শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের মুখগুলো। সে রাতেই সিদ্ধান্ত নিই এসব শিশুর জন্য কিছু করার। এরপর থেকে নিয়মিত বেড়িবাঁধ এলাকায় যাতায়াত শুরু করি আমি। কথা বলি শিশুগুলোর পরিবারের সঙ্গে। ধীরে ধীরে তাদের আগ্রহী করে তুলি পড়াশোনায়।’ 
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র ১৪ জন শিশু নিয়ে বেড়িবাঁধ এলাকায় অস্থায়ী একটি বিদ্যালয় শুরু করেন ইকবাল। অবকাঠামো না থাকায় গাছতলায় ঘাসের ওপর বসে পড়ে শিশুরা। শুক্র ও শনিবার সপ্তাহে দুই দিন ক্লাস নেওয়া বিদ্যালয়টির পঠন-পাঠন বেশ আলাদা। শিশুদের বর্ণপরিচয়ের সঙ্গে পড়তে ও লিখতে শিখিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি উপযোগী করাই এ বিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য। 
ইকবাল হোসেন বলেন, ‘বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে সরকারি বিদ্যালয় অনেক দূরে হওয়ায় শিশু শিক্ষার্থীরা সেখানে পড়তে পারে না। আবার এখানে স্থায়ী কোনো অবকাঠামো না থাকায় বর্ষাকালে প্রায় বন্ধ রাখতে হয় বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। সমুদ্রের একেবারে কাছে হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ের সময় বিপন্ন হয়ে ওঠে মানুষের জীবন। তাই এখানে একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হলে সেখানে বিদ্যালয়ের কার্যক্রমও চালানো যাবে।’
ইকবাল আরও বলেন, ‘আমার স্ত্রী তানজিনা আক্তার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষিকা। এ কাজে তাঁর উৎসাহ এখন আমাকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করে।’
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিন বলেন, ‘স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচালিত ইকবাল হোসেনের অস্থায়ী বিদ্যালয়টি সম্পর্কে জানি। শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করতে তাঁর এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের শীতবস্ত্র ও শিক্ষাসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। সেখানে স্থায়ীভাবে একটি বিদ্যালয় করতে কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করব।’
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইকব ল হ স ন ন ইকব ল ধ এল ক সরক র উপক ল

এছাড়াও পড়ুন:

শিশু শিক্ষার্থীকে উত্ত্যক্ত, থানায় অভিযোগ করায় নানাকে কুপিয়ে হত্যা

মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলায় তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার ঘটনায় কয়েক বখাটের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন তার স্বজন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই ছাত্রীর নানা আজগর আলীকে (৬০) কুপিয়ে হত্যা করেছে স্থানীয়ভাবে বখাটে হিসেবে পরিচিত আল-আমিন নামে এক যুবক ও তার সহযোগীরা। গত মঙ্গলবার রাতে উপজেলার জয়মন্টপ ইউনিয়নের রায়দক্ষিণ গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

নিহত আজগর আলী রায়দক্ষিণ গ্রামে একটি চায়ের দোকান চালাতেন। অভিযুক্ত আল-আমিন একই গ্রামের মৃত কালু প্রামাণিকের ছেলে।

পুলিশ, নিহতের পরিবার এবং স্থানীয় সূত্র জানায়, যে শিশুটিকে উত্ত্যক্ত করত বখাটেরা, তার মা পাঁচ বছর আগে মারা যান। মেয়েটি নানা আজগর আলীর বাড়িতে থেকে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে পড়ত। বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার পথে শিশুটিকে প্রায় উত্ত্যক্ত এবং অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করত আল-আমিন। এ নিয়ে আজগর আলীসহ মেয়েটির স্বজন বেশ কয়েকবার প্রতিবাদ করলেও কোনো কাজ হয়নি। গত সোমবার মেয়েটির নানা আজগর আলী সিংগাইর থানায় লিখিত অভিযোগ করেন। মঙ্গলবার অভিযোগটি তদন্ত করার পর তা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়।    

এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয় আল-আমিন। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আল-আমিন চার থেকে পাঁচটি মোটরসাইকেলে করে সহযোগীদের নিয়ে আজগর আলীর চায়ের দোকানে যায়। তারা বৃদ্ধ আজগর আলীকে দোকান থেকে বের করে নিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও লাটিসোঠা দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে। হামলাকারীরা চলে গেলে স্বজন ও প্রতিবেশীরা আজগর আলীকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখান থেকে রাতেই তাঁকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা আজগর আলীকে মৃত ঘোষণা করেন।

আজগর আলীর শ্যালক নজরুল ইসলাম জানান, মাদক সেবন, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িত বখাটে আল-আমিন। 

সিংগাইর থানার ওসি তৌফিক আজম বলেন, নিহতের বড় ছেলে আইয়ুব খান বুধবার আল-আমিনকে প্রধান আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। ঘটনার পর থেকে আল-আমিন ও তার সহযোগীরা পলাতক। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ