নারী সহিংসতা প্রতিরোধে আইএলও সনদ ১৯০ অনুস্বাক্ষর ও তার বাস্তবায়ন করতে হবে
Published: 8th, March 2025 GMT
বাংলাদেশে নারী শ্রমিকেরা যুগ যুগ ধরে শোষণ, বঞ্চনা, অবহেলা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন। নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে আইএলও (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা) সনদ ১৯০ অনুস্বাক্ষর ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে শনিবার সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর দোয়েল চত্বরে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশ বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। এ সমাবেশের আয়োজন করে জাতীয় নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র। সমাবেশ শেষে সেখান থেকে একট মিছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সমাবেশে যোগ দেয়।
নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আয়োজিত সমাবেশে বক্তারা বলেন, দেশের নারী শ্রমিকদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অবদান অপরিসীম। তবে দেশের নারীরা বিশেষ করে নারী শ্রমিকেরা যুগ যুগ ধরে নানা ধরনের শোষণ, বঞ্চনা, অবহেলা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন।
বাংলাদেশের শ্রম আইন ও আইএলও সনদে সমঅধিকারের কথা উল্লেখ থাকলেও নারী শ্রমিকেরা প্রায়ই মজুরিবৈষম্যের শিকার হন বলে অভিযোগ করেন বক্তারা। তাঁরা বলেন, পরিবার, কর্মক্ষেত্র কোনোটাই নারীর জন্য নিরাপদ নয়। বেশির ভাগ নারী শ্রমিক প্রসূতিকালীন সুবিধা ও সুরক্ষা পাচ্ছেন না। এ সময় অনেক নারী শ্রমিককে কর্মক্ষেত্র থেকে বিদায় নিতে হয়। পরে আর তাঁদের কাজে নেওয়া হয় না।
নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে আইএলও সনদ ১৯০ অনুস্বাক্ষর ও তার বাস্তবায়নের দাবি জানান বক্তারা। তাঁরা বলেন, সমান মজুরি, নারীদের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত, নারী শ্রমিকদের ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সুরক্ষা প্রদান এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
সমাবেশে জাতীয় নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক সাহিদা পারভীনের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন নারী শ্রমিক নেত্রী সায়েরা খাতুন, হুমায়রা বেগম, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের প্রচার সম্পাদক মোবারক হোসেন ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান।
সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের অর্থ সম্পাদক কাজী মো.
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বিশ্বে ১৩ কোটি ৮০ লাখ শিশু শ্রমে যুক্ত
চলতি শতকের শুরুর তুলনায় শিশুশ্রম প্রায় ৫০ শতাংশ কমলেও তা নির্মূলের লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে বিশ্ব। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক প্রচেষ্টার ফলে শিশুশ্রম উল্লেখযোগ্যভাবে কমলেও ২০২৪ সালে প্রায় ১৩ কোটি ৮০ লাখ শিশু শ্রমে যুক্ত ছিল। এর মধ্যে ৫ কোটি ৪০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত, যা তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
বৃহস্পতিবার ছিল বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। এ উপলক্ষে বুধবার ‘চাইল্ড লেবার: গ্লোবাল এস্টিমেটস ২০২৪, ট্রেন্ডস অ্যান্ড দ্য রোড ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। শিশুশ্রম নিরসনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জিত হলেও প্রতিবেদনে কঠিন বাস্তবতা উঠে এসেছে। এখনও লাখ লাখ শিশু শিক্ষা, খেলা এবং বেড়ে ওঠার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
প্রতিবেদনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শিশুশ্রম কমার চিত্র দেখা গেলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি সে রকম নয়। ২০১৩ সালে যেখানে দেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের হার ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৭ শতাংশে (প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু)। কিন্তু একই সময়ে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে শ্রমে যুক্ত থাকার সামগ্রিক হার ৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশে। ক্ষতিকর কাজে যুক্ত বৃহত্তর শিশুশ্রমের হার তুলনামূলক স্থিতিশীল। ২০১৩ সালে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে সামান্য বেড়ে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে ২০২২ সালে।
জানা যায়, গত দুই দশকে বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বাড়ায় কিছু উন্নতি হয়েছে। তবে শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্যে পৌঁছতে সঠিক গতিতে নেই বাংলাদেশ। শ্রমে যুক্ত অধিকাংশ শিশু কাজ করছে অনানুষ্ঠানিক খাতে। সেখানে তারা দীর্ঘ সময় ধরে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এ বাস্তবতা পরিবর্তনে বাংলাদেশে জরুরি প্রয়োজন স্থায়ী, দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই প্রচেষ্টা।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, এ বৈশ্বিক প্রতিবেদন এবং বাংলাদেশে পাওয়া তথ্য আমাদের উৎসাহ জোগায়। সংকটের সমাধান করতে উদ্বুদ্ধ করে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হ্রাসে অগ্রগতি আমরা স্বীকার করি। তবে সামগ্রিক শিশুশ্রমের হার একই রকম থাকায় এটি স্পষ্ট, আমাদের আরও অনেক কিছু করার রয়েছে। একটি শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এর মাধ্যমে পরিবারগুলোকে সহায়তা করতে হবে। সব শিশুর জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষার সর্বজনীন সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সমাজসেবা, বিশেষ করে শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমে আরও বিনিয়োগ করতে হবে। শিশুদের স্থান স্কুল ও খেলার মাঠে; কর্মক্ষেত্রে নয়। তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি জরুরি।
তিনি জানান, শিশুশ্রমের কারণ দারিদ্র্য এবং মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব। ফলে পরিবারগুলো সন্তানদের কাজে পাঠাতে বাধ্য হয়। সেই সঙ্গে বঞ্চনার চক্র বংশপরম্পরায় স্থায়ী হয়।
বিশ্বব্যাপী তথ্য অনুযায়ী, কৃষি খাত এখনও শিশুশ্রমের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। শিশুশ্রমের ৬১ শতাংশ ঘটে এই খাতে। এর পর রয়েছে সেবা খাত (২৭ শতাংশ), যেমন গৃহস্থালি কাজ বা বাজারে পণ্য বিক্রি। শিল্প খাতে রয়েছে (১৩ শতাংশ) শিশুশ্রম।
বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবসে আইএলও বাংলাদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গুঞ্জন ডালাকোটি জানান, আইএলও কনভেনশন নম্বর ১৩৮ ও ১৮২ বাস্তবায়ন করতে হবে। এর পাশাপাশি জাতীয় আইনগত কাঠামোর মাধ্যমে শিশুশ্রম নিরসন করতে হবে।
তিনি বলেন, অর্থপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করতে হলে কমিউনিটি, নিয়োগকর্তা, শ্রমিক সংগঠন, সুশীল সমাজ, এনজিও ও সংবাদমাধ্যমের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শিশুশ্রম থাকলে সেখানে যথাযথ শ্রমের পরিবেশ থাকে না। তিনি প্রতিটি শিশুর জন্য নিরাপদ, শিক্ষার সুযোগ-সংবলিত শৈশব নিশ্চিত করার সামগ্রিক উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।
ইউনিসেফ ও আইএলও অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে সরকার ও অংশীদারদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে। সুপারিশগুলো হলো– অসহায় পরিবারগুলোর জন্য জীবনচক্রভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করতে হবে। এর মধ্যে সর্বজনীন শিশু ভাতার মতো সামাজিক সুরক্ষা নেটওয়ার্ক অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের চিহ্নিত করে তাদের জন্য সর্বজনীন মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ ও সংকটাপন্ন এলাকায় প্রাপ্তবয়স্ক ও তরুণদের জন্য সম্মানজনক কাজ ও উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। শোষণ বন্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সরবরাহ শৃঙ্খলার সর্বত্র শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে আইন প্রয়োগ ও ব্যবসায়িক জবাবদিহি জোরদার করতে হবে।
শিশুশ্রম কমার বর্তমান গতি ধীর। ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম সম্পূর্ণভাবে নিরসনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বিশ্ব।