যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স কত দূর যেতে পারেন
Published: 9th, March 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের আর দশজন ভাইস প্রেসিডেন্টের মতো নন জেডি ভ্যান্স। তিনি একজন ভিন্ন ধরনের মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট।
ওয়াশিংটনের ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা তেমন কোনো নেতা তিনি নন, যিনি অন্তরালে থেকে কাজ করেন। অন্তরালে থেকে কাজ করা মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের একজন ডিক চেনি।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভ্যান্স অনুকূল ব্যক্তি নন। তরুণ ভ্যান্স বরং তাঁর কর্তা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে চরম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টের মূর্ত প্রতীক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন বলে মনে হয়।
আরও পড়ুনজেলেনস্কির প্রতি কেন এত মারমুখী ছিলেন ভ্যান্স০২ মার্চ ২০২৫গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠক হয়। এই বৈঠকে ভ্যান্সও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে জেলেনস্কির ওপর আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভ্যান্স। তাঁর উসকানির কারণেই একটি কূটনৈতিক সংকটের সূত্রপাত হয়।
এর আগে গত মাসের মাঝামাঝি জার্মানিতে অনুষ্ঠিত মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ভ্যান্স। এই সম্মেলনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্রদের আক্রমণ করেছেন। সম্মেলনে তাঁর বক্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্রদের জন্য অপমানজনক।
ভ্যান্স তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্যের জন্য যুক্তরাজ্যের পত্রপত্রিকার প্রথম পাতায় স্থান করে নেন। তিনি বলেছিলেন, গত ৩০-৪০ বছরে যুদ্ধ করেনি—এমন দেশের প্রস্তাবিত নিরাপত্তার নিশ্চয়তার চেয়ে ইউক্রেনের আরও ভালো নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দরকার।
ভ্যান্স অবশ্য পরে বলেন, তিনি এই বক্তব্যের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, এমনটা বলা ঠিক নয়। তবে বাস্তবতা হলো, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সই প্রকাশ্যে ইউক্রেনে শান্তিবাহিনী মোতায়েনের কথা বলছে।
আরও পড়ুনভ্যান্সকে কেন রানিং মেট হিসেবে বেছে নিলেন ট্রাম্প২৪ জুলাই ২০২৪ভ্যান্স ভালো করেই জানেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে হাওয়া কোন দিকে বইছে। আর সে কারণেই তিনি ট্রাম্পের প্রতি তাঁর অবজ্ঞা ত্যাগ করেছেন। অথচ এই তিনিই আট বছর আগে ট্রাম্পকে একজন ‘হাঁদারাম’ বলে উপহাস করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ২০১৬ সালে তিনি হিটলারের সঙ্গে ট্রাম্পের তুলনা করেছিলেন।
রিপাবলিকান দল এখন সর্বতোভাবে ট্রাম্পকে ভক্তি করে। আর ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স হলেন প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে বিশিষ্ট প্রকাশ্য ভক্তদের একজন।
ভ্যান্স একজন আকর্ষণীয় চরিত্রের ব্যক্তি। তিনি আইভি লিগভুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমানও।
ভ্যান্স কিছুদিনের জন্য ওহাইওর সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথাগত মূলধারার গণমাধ্যম ও ওয়াশিংটনের অভিজাতদের ঘৃণা করেন। তাই ট্রাম্পের জনতুষ্টিবাদের সঙ্গে তিনি স্বাভাবিকভাবেই মানানসই।
ভ্যান্স একজন সাবেক মার্কিন মেরিন সেনাও। তাই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে মার্কিন মিত্রদের অবদান সম্পর্কে তাঁর আরও ভালোভাবে জানাশোনা থাকার কথা।
আরও পড়ুনইউরোপের গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে তুলাধোনা করলেন ভ্যান্স১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫সিলিকন ভ্যালিতে ধনী হয়ে ওঠেন ভ্যান্স। বড় বড় প্রযুক্তি অভিজাতদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক রয়েছে, যাঁরা তীব্রভাবে ডানপন্থী হয়ে উঠেছেন। আর ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে তাঁকে কাছে টেনে নিয়েছেন।
ওহাইও এবং কেন্টাকির সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলে নিজের শৈশব নিয়ে একটি স্মৃতিকথামূলক বই লিখেছেন ভ্যান্স। বইটির নাম ‘হিলবিলি এলিগি’। এই বইয়ের জন্য তিনি আলোচিত হন।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তাঁর সমর্থকদের বোঝার জন্য ২০১৬ সালের এই বইটি ‘সারগ্রন্থ’ হয়ে ওঠে। এই পটভূমি বিবেচনায় নিলে এটা অবাক করার মতো কিছু নয় যে ভ্যান্স ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ অর্থনৈতিক নীতির পক্ষে প্রচারে সবচেয়ে স্পষ্ট যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন।
ভ্যান্সের বয়স এখন ৪০ বছর। এই বয়সেই তাঁকে ট্রাম্পের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী মনে করা হচ্ছে। যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি ফক্স নিউজকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে মজার ছলে বিষয়টি নাকচ করেছেন। ট্রাম্পের বক্তব্যে মনে হয়, তিনি এত তাড়াতাড়ি তাঁর সিংহাসন ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে রাজি নন।
আরও পড়ুনজেডি ভ্যান্সের সমালোচনায় জার্মান রাজনীতিকেরা১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ইউরোপ সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন ভ্যান্স। তিনি একজন স্বাতন্ত্র্যবাদী, যিনি ইউক্রেনে কোনো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থ দেখতে পান না। এ কারণেই ২০২২ সালে ভ্যান্স এক পডকাস্টে বলেছিলেন, ইউক্রেনের সঙ্গে কী ঘটছে, তা নিয়ে তিনি সত্যিই চিন্তা করেন না।
ভ্যান্সের নানা ঠোঁটকাটা কথাবার্তা ও ইঙ্গিত অনেক বিদেশিকে বিরক্ত করেছে। এর মধ্যে ইউরোপের অতি-ডানপন্থীদের প্রতি তাঁর সমর্থনের বিষয়টি আছে।
ওভাল অফিসে জেলেনস্কির মুখোমুখি হওয়ার এক দিন আগেই ভ্যান্স যুক্তরাজ্যে বাক্স্বাধীনতার বিষয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকে তিরস্কার করেছিলেন।
ভ্যান্স তরুণ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, আদর্শিক। তিনি দ্রুত উঁচুতে উঠছেন। তবে তাঁর অহংকার তাঁকে সূর্যের খুব কাছে যেতে বাধ্য করে কি না, তা দেখার বিষয়।
আরও পড়ুনট্রাম্পকে ‘আমেরিকার হিটলার’ বলা জেডি ভ্যান্সই এখন তাঁর রানিং মেট১৬ জুলাই ২০২৪.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর ছ ল ন ইউক র ন র জন য কর ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ