জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক জট খুলেও যেন খুলছে না। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে পরিচালিত দুটো জরিপে জনগণ যেখানে দ্রুত একটা নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়েছেন, সেখানে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন ছাড়া আর কোনো অংশীজন, বিশেষত সরকারের বক্তব্যে ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে না।
গত বছর ১৫ থেকে ৩১ অক্টোবর পরিচালিত ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘পালস সার্ভে’র দ্বিতীয় ধাপের জরিপের ফলাফলে দেখা গিয়েছিল, ৭৯ শতাংশ উত্তরদাতা নির্বাচিত সরকার দেশ ভালো পরিচালনা করবে বলে মনে করেন। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ ইনোভেশন কনসালটিং বাংলাদেশ পরিচালিত জরিপের ফলও বলছে, ৫৮ দশমিক ১৭ শতাংশ ভোটার ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন চান।
সম্ভবত এ জনআকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনায় নিয়েই সোমবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, নির্বাচন কমিশন আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করার সময়সীমা অতিক্রম করতে চায় না। দায়িত্ব গ্রহণের পর এ পর্যন্ত সিইসি আরও একাধিকবার একই কথা বলেছেন।
অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.
গত বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা একই কথা বলেছিলেন। তবে মাঝখানে, গত ১০ ফেব্রুয়ারি বিএনপির প্রতিনিধি দলকে তিনি ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছিলেন। এর আগে ৬ জানুয়ারি জাপানের সংবাদমাধ্যম এনএইচকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি একই বক্তব্য দিয়েছিলেন। আবার গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের মার্চের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। (সমকাল)
সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে গিয়ে সরকার যে কৌশল বেছে নিয়েছে, তাতেও নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার শঙ্কা জেগেছে অনেকের মনে। এমনকি নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে গঠিত কমিশনের অন্যতম সদস্য ডা. জাহেদুর রহমান জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে ৭ মার্চ বলেছেন, ‘আমরা যদি কনটেক্সটটা দেখি তাহলে তা ঘোলাটে। প্রধান উপদেষ্টা এর আগে বলেছেন, যদি ১০টা বিষয়ে সংস্কারে ঐকমত্য হয়, তাহলে ১০টা করব। যদি একটার ব্যাপারেও ঐকমত্য না হয়, তাহলে কোনো সংস্কার ছাড়াই নির্বাচন দিয়ে দেব। কিন্তু এখন তাঁর ভাষার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। তিনি বলছেন, সংস্কার যত দ্রুত শেষ করা যায়, তার পর নির্বাচন করব। এখন সমাজে ও রাষ্ট্রে আবার এই ধরনের বয়ান তৈরি করা হচ্ছে।’
একই সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যে কমিশনের যে আলোচনা শুরুর কথা ছিল, সেটা না করে তারা এখন আমাদের প্রশ্নপত্র পাঠাচ্ছে। ফলে আমার মনে হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে সরকার কালক্ষেপণ করতে চায়।’
প্রসঙ্গত, সংস্কার বিষয়ে সরকার ইতোমধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছে। সেই কমিশনের সঙ্গে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ৩৪টি দলের বৈঠকও হয়েছে। কথা ছিল, আরেক দফা বৈঠক করে সংস্কার নিয়ে দলগুলোর মনোভাব জেনে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হবে। কিন্তু সরকার এখন এমসিকিউ পদ্ধতির একগুচ্ছ প্রশ্ন পাঠিয়ে দলগুলোকে বলছে টিক দিতে। উপরন্তু, ঐকমত্য কমিশনের উপপ্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ ১০ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘যখন যে দলের মতামত পাওয়া যাবে, সেই সময় থেকেই আলোচনার শুরু হবে’ (বাংলা ট্রিবিউন)। তিনি এও বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ব্যাপারে নাগরিকদের মতামত জানার জন্য শিগগিরই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ব্যবস্থা করা হবে। স্পষ্ট– ঐকমত্য তৈরি প্রক্রিয়াটা বেশ লম্বা ও সময়সাপেক্ষ।
গত বুধবার রয়টার্স প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার দেশের জনগণের নিরাপত্তা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত করতে পারেনি এবং এ বছর জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা কঠিন হতে পারে।’ তাঁর এ বক্তব্যের সঙ্গে সরকারের নির্বাচন ভাবনার যোগসূত্র আছে বলে অনেকেই মনে করেন। যেমন, জাহেদুর রহমান ডিডব্লিউর কাছে বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা এবং নতুন দল এনসিপির আহ্বায়কের কথার মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে।’
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সও মনে করেন, ‘প্রফেসর ইউনূস যে ডিসেম্বরের নির্বাচন থেকে শিফট করার চেষ্টা করছেন, সেটা নতুন রাজনৈতিক দলের দিকে চেয়ে। ওই দলটির সঙ্গে তিনি সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। নতুন দলের প্রধানের সঙ্গে তাই তাঁর কথার মিল পাওয়া যায়।’
অন্যদিকে, বিএনপি এ মাসেই নির্বাচনী রোডম্যাপ চেয়েছে (ডিডব্লিউতে প্রকাশিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য)। প্রধান বাম দলগুলোর নিয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোটও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় দাবি করেছে। এ মুহূর্তে অন্যতম প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন পেছানোর পক্ষে কথা বললেও, বরারবই বিভিন্ন জাতীয় প্রশ্নে সুবিধাবাদী অবস্থান গ্রহণকারী দলটি ‘দ্রুত’ সংস্কার শেষে নির্বাচনের কথাও বলে।
সরকার যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মতভিন্নতার সুযোগ নিয়ে ডিসেম্বরের পরও ক্ষমতায় থাকতে চায়, তা দেশের জন্য শুভ হবে বলে মনে হয় না। দেশের অর্থনীতি নিয়ে সরকারের কেউ কেউ গত কিছুদিন যাবৎ একটা গোলাপি চিত্র আঁকতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবার দায়িত্ব গ্রহণের পরপর এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার অর্থনীতিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, আমাদের অর্থনীতির অবস্থা খুবই ভঙ্গুর; গাজার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে (সমকাল)।
আইনশৃঙ্খলার অবস্থাও তথৈবচ। ৫ আগস্টের পর থেকে যে মব সন্ত্রাস চলছে, তা প্রতি সপ্তাহেই নতুন মাত্রা ও রূপ নিচ্ছে। বিশেষত নারী এবং সমাজের ভিন্ন চিন্তা ও সংস্কৃতির মানুষ যেভাবে এর শিকার হয়ে চলেছেন, তা নজিরবিহীন।
বিলম্বিত নির্বাচন যে পরিস্থিতি আরও জটিল করতে পারে, তারও একটা ইঙ্গিত বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ দিয়েছেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রশ্নমালার ব্যাপারে তিনি বলেছেন, ‘ওই ধরনের টিক মার্কওয়ালা প্রশ্নের আমাদের দরকার নাই। আমাদের নিজস্ব সংস্কার পরিকল্পনা এবং প্রস্তাব আছে। এটা আমরা অনেক আগেই করেছি। সরকারকেও সেটা দিয়েছি।’ তিনি বলেছেন, ‘সময় নষ্ট না করে দ্রুত নির্বাচন দরকার। তা না হলে দেশে এখন যে পরিস্থিতি চলছে, তা আরও খারাপ হবে। তাই সরকার বা কোনো রাজনৈতিক দল যেন মোটিভেটেড হয়ে কোনো বক্তব্য না দেয়’ (ডিডব্লিউ)।
বাংলায় প্রবাদ আছে– যার কাজ তারে সাজে, অন্য লোকের লাঠি বাজে। এর মর্ম সরকারের কর্তাব্যক্তিদের না বোঝার কথা নয়।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ড স ম বর র সরক র র দলগ ল র ঐকমত য আম দ র পর চ ল বল ছ ন অবস থ ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
লন্ডন বৈঠকে বিচার ও সংস্কারের বিষয়টি নির্বাচনের মতো গুরুত্ব না পাওয়া অত্যন্ত হতাশাজনক: এনসিপি
লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি বলে মনে করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। বিষয়টিকে ‘অত্যন্ত হতাশাজনক’ বলেছে দলটি।
আজ শুক্রবার রাতে এনসিপির এক বিবৃতিতে এই প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহউদ্দিন সিফাত বিবৃতিটি পাঠিয়েছেন।
এনসিপির বিবৃতিতে বলা হয়, রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে এনসিপি। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে লন্ডনে অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকটি ‘সংসদ নির্বাচন’ বিষয়ে দলটিকে আস্থায় আনতে সফল হয়েছে সরকার। জাতীয় ঐক্য, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। কিন্তু বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নাগরিকদের প্রধান দাবি তথা বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি। এটা অত্যন্ত হতাশাজনক বলে মনে করে এনসিপি।
নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলে বারবার প্রতীয়মান হচ্ছে—এ কথা উল্লেখ করে এনসিপি আরও বলেছে, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, জুলাই সনদ কার্যকর করা এবং বিচারের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন গণ-অভ্যুত্থানকে স্রেফ একটি ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে পরিণত করবে এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন–আকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করবে।
জনগণের দাবি তথা জুলাই সনদ রচনা ও কার্যকর করার আগে নির্বাচনের কোনো তারিখ ঘোষিত হলে তা জনগণ মেনে নেবে না বলে উল্লেখ করেছে এনসিপি। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংস্কারের বিষয়গুলোর ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ও জুলাই সনদ রচনা এবং কার্যকর করেই আসন্ন জুলাইকে যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করার উদ্যোগ নিতে সরকারকে জোর দাবি জানাচ্ছে এনসিপি।’
জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে এনসিপি।