কেনাকাটার বিল পরিশোধে ব্যাংকের কার্ড এখন বড় ভরসা। সময়ের চাহিদা বিবেচনায় ব্যাংকগুলোও এখন এদিকে মনোযোগী হয়েছে। কার্ড লেনদেনে আগ্রহী করতে তাদের প্রচেষ্টা অনেক বেড়েছে। সব মিলিয়ে কার্ড লেনদেন দ্রুত বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা প্রায় ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০২০ সালের পর লেনদেন বেড়েছে ১৬০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে দেশে ও দেশের বাইরে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার গত ডিসেম্বরে অনেক বেড়েছে। অবশ্য রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে চলতি মাসে যে সর্বোচ্চ লেনদেন হবে, তা বলাই যায়।

ব্যাংকাররা জানান, করোনা মহামারি নিঃসন্দেহে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে এনেছিল। করোনার নানামুখী ধাক্কা সারাবিশ্ব আজও বয়ে বেড়াচ্ছে। তবে ডিজিটাল লেনদেনের আগ্রহ  করোনার কারণে বেড়েছে । করোনার পর থেকে ডিজিটাল লেনদেন দ্রুত বেড়েছে। কেবল ক্রেডিট কার্ড নয়; ডেবিট, প্রিপেইড কার্ডের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। ২০২০ সালের শুরুতে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে করোনার আবির্ভাব ঘটে। বাংলাদেশে প্রথম করোনা ধরা পড়ে ওই বছরের মার্চে। এর পর লকডাউনসহ বিভিন্ন কারণে ব্যাংক শাখা বন্ধ ছিল। ওই সময় লেনদেন নিষ্পত্তির জন্য বড় ভরসা হয়ে ওঠে কার্ড, অ্যাপ, এমএফএসসহ বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। এর পরই মূলত দ্রুত সেবার প্রসার ঘটেছে। ব্যাংকগুলোও এ ধরনের নানা সেবা এনেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ইস্যু করা ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৬ লাখ ৭৬ হাজার। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে যা ছিল ১৫ লাখ ২৪ হাজার। ওই বছরের জানুয়ারিতে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে তা ৩ হাজার ৫৩২ কোটি টাকায় উঠেছে। কার্ড লেনদেনে আগ্রহী করতে ব্যাংকগুলো নানা প্রচার চালিয়ে আসছে। ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে বাড়তি আকর্ষণের জন্য কেনাকাটার বিল পরিশোধে দেওয়া হচ্ছে মূল্যছাড় বা ক্যাশব্যাক অফার। সবচেয়ে বেশি অফার পেয়ে থাকেন ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকরা।

ডেবিট বা প্রিপেইড কার্ড দিয়েও সব ধরনের লেনদেন করা যায়। এমনকি অনেক ব্যাংকের ডেবিট কার্ড থেকে বিদেশেও পরিশোধ করা যায়। ডেবিট বা প্রিপেইড কার্ডে বিল পরিশোধেও মিলছে নানা ছাড়। গত পাঁচ বছরে কার্ডের সংখ্যা ১৪২ শতাংশ বেড়ে গত ডিসেম্বর শেষে ৪ কোটি ৯৮ লাখে পৌঁছেছে। ২০২০ সালে যা ছিল মাত্র ২ কোটি ৬ লাখের কম। আর ২০২০ সালের তুলনায় কার্ড লেনদেন ১৬৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে কার্ডে মোট লেনদেন ছিল ১৬ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে তা বেড়ে ৪৪ হাজার ৬৯১ কোট টাকা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ লেনদেন কমাতে বিভিন্নভাবে ব্যাংকগুলোকে উৎসাহিত করছে। আগামী ২০২৭ সালের মধ্যে দেশের মোট লেনদেনের অন্তত ৭৫ শতাংশ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। অবশ্য বিনিময়সহ যেসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ানোর প্রচারণা চালানো হচ্ছিল, এরই মধ্যে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান সমকালকে বলেন, কয়েক বছর আগে প্রচলিত ধারার হাতে গোনা কয়েকটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ছিল। এখন অনেক ব্যাংক এই সেবা দিচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকগুলোও এখন ক্রেডিট কার্ড সেবায় যুক্ত হয়েছে। আবার মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে। সব মিলিয়ে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক ও লেনদেন বাড়ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ‘লেস ক্যাশ’ সোসাইটির কথা বলছে। নগদ লেনদেন কমানোর জন্য কার্ড, অ্যাপভিত্তিক লেনদেন বাড়ানোর বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন ক্রেডিট, ডেবিট কার্ডের পাশাপাশি অ্যাপভিত্তিক অনেক ধরনের লেনদেন হচ্ছে।

দেশের এসব কার্ডের বড় একটি অংশ রয়েছে কয়েকটি ব্যাংকে। ক্রেডিট কার্ডে এখন সবচেয়ে এগিয়ে আছে বেসরকারি খাতের দ্য সিটি ও ব্র্যাক ব্যাংক। পর্যায়ক্রমে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, ইউসিবিএল, ইস্টার্ন, ডাচ্‌-বাংলা, ন্যাশনাল, সাউথইস্ট ও ব্যাংক এশিয়া রয়েছে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের তালিকায়। ডেবিট কার্ডে এখন শীর্ষে রয়েছে ডাচ্‌-বাংলা ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। পর্যায়ক্রমে ব্যাংক এশিয়া, দ্য সিটি, সোনালী, ইউসিবিএল, ব্র্যাক, যমুনা, ট্রাস্ট ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক রয়েছে তালিকায়।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘ক্যাশলেস’ করার জন্য কার্ডভিত্তিক লেনদেন বাড়ানো খুব জরুরি। নগদ বহনের ঝামেলা না থাকায় এটি নিরাপদও। নিজের প্রয়োজনে কার্ডের প্রতি মানুষের ঝোঁক অনেক বেড়েছে। ব্যাংকগুলোও নানা অফার ও সুবিধার মাধ্যমে কার্ডের প্রতি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। এর পরও অনেকে এখনও কার্ড ব্যবহার করেন না। কার্ড ব্যবহারে সবাই উৎসাহ পায়, এমন আরও কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। তাতে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে লেনদেন বাড়বে। 

তিনি বলেন, যে কোনো অঙ্কের ক্রেডিট কার্ডে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কার্ড লেনদেন বাড়ানোর ক্ষেত্রে যা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি প্রত্যাহার করে বরং দুই লাখ বা পাঁচ লাখ টাকার একটি সীমা দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করলে বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। কর ছাড় বা অন্য কোনো সুবিধা দিলে মানুষের আগ্রহ বাড়বে। এখন ফেসবুকের মাধ্যমে অনেকে ছোট ছোট ব্যবসা করছে। 

বেশি ব্যবহার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ডের বেশির ভাগই তিনটি ব্র্যান্ডের– ভিসা, মাস্টারকার্ড এবং অ্যামেক্স ১০ শতাংশ। দেশে ও বিদেশে উভয় ক্ষেত্রেই ক্রেডিট কার্ডের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের বিল পরিশোধে। গত ডিসেম্বরে দেশের ভেতরে মোট ৩ হাজার ২১৫ কোটি টাকা লেনদেনের প্রায় ৪৯ শতাংশই হয়েছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। দেশের ভেতরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ গেছে খুচরা আউটলেট সেবার বিলে। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ ইউটিলিটি বিল পরিশোধ হয়েছে ৮ দশমিক ২৭ শতাংশ। এ ছাড়া ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ নগদ উত্তোলন, কাপড়ের দোকানের বিল পরিশোধে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ওষুধে ৫ দশমিক ৪০, ট্রান্সপোর্টেশনে ৩ দশমিক ৩৫ এবং সরকারি সেবায় ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। আর অর্থ স্থানান্তর হয়েছে ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ, ব্যবসায়িক
সেবায় ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং পেশাদারি সেবায় ব্যয় হয়েছে শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০২৪ সালের মার্চে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এর পর গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে তা কমে যায়। সরকার পরিবর্তনের পর গত সেপ্টেম্বর থেকে আবার বেড়েছে।

অন্যদিকে গত ডিসেম্বরে ক্রেডিট কার্ডে দেশের বাইরে ৪৯২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে ৩১ শতাংশ গেছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের বিল পরিশোধে। খুচরা আউটলেট সেবায় ব্যয় হয়েছে ১৭ শতাংশ। ওষুধে ১০ শতাংশ এবং ট্রান্সপোর্টেশনে ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। এ ছাড়া কাপড়, ব্যবসায়িক সেবা, পেশাদারি সেবা, নগদ উত্তোলন, সরকারি সেবা ও ইউটিলিটি বিল পরিশোধে গেছে বাকি অর্থ।

গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর বিদেশে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে বড় একটি পরিবর্তন এসেছে। গত জুলাই পর্যন্ত বিদেশে ক্রেডির্ট কার্ড লেনদেনের ৩০ শতাংশের বেশি হতো ভারতে। এখন তা কমে ৮ শতাংশে নেমেছে। গত কয়েক মাস ধরে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ড। গত ডিসেম্বরে বিদেশে ক্রেডিট কার্ডে মোট ৪৯২ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ ব্যয় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ১৮ শতাংশ খরচ হয়েছে থাইল্যান্ডে। এর পরের অবস্থানে থাকা সিঙ্গাপুরে হয়েছে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

গত ডিসেম্বরে চতুর্থ অবস্থানে নেমে আসা ভারতে খরচ হয়েছে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। পর্যায়ক্রমে যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আয়ারল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশ রয়েছে তালিকায়। ভারতের ভিসা পাওয়া কঠিন হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এখন ভ্রমণ, চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ অন্য দেশে যাচ্ছে। একইভাবে গত ডিসেম্বরে বিদেশি নাগরিকরা বাংলাদেশে এসে ২৪১ কোটি টাকা খরচ করেছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩২ শতাংশ খরচ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের খরচ ছিল ১০ দশমিক ২১ শতাংশ। আর ভারতের নাগরিকদের খরচ হয়েছে ৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। পর্যায়ক্রমে অস্ট্রেলিয়া, মোজাম্বিক, কানাডা, জাপান, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অন্যান্য দেশ রয়েছে তালিকায়।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র ব ল পর শ ধ ক র ড ল নদ ন ল নদ ন ব ড় ন ২০২০ স ল র ল নদ ন র র ল নদ ন ব যবহ র ন র পর র জন য পর য য় অন ক ব কর ন র ধরন র দশম ক সরক র ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

ভারতীয় উড়োজাহাজের ভয়াবহ ১০টি দুর্ঘটনা

কোঝিকোড় দুর্ঘটনা (২০২০)

২০২০ সালের ৭ আগস্ট এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের একটি ফ্লাইট কেরালার কোঝিকোড় বিমানবন্দরে অবতরণের সময় বৃষ্টিভেজা রানওয়েতে ছিটকে পড়ে এবং দুই ভাগ হয়ে যায়। এতে ২০জন নিহত হন, আহত হন বহু যাত্রী। খারাপ আবহাওয়া, কম দৃশ্যমানতা এবং টেবলটপ রানওয়ে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ছিল।

ম্যাঙ্গালুরু দুর্ঘটনা (২০১০)

২০১০ সালের ২২ মে দুবাই থেকে আসা এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের ফ্লাইট ৮১২ ম্যাঙ্গালুরুতে অবতরণের সময় রানওয়ে ছাড়িয়ে একটি খাদে পড়ে যায়। বিমানে থাকা ১৬৬ জনের মধ্যে ১৫৮ জন নিহত হন। রানওয়েটি ‘টেবলটপ’ হওয়ায় দুর্ঘটনার মাত্রা ভয়াবহ হয়। টেবলটপ রানওয়ে হলো এমন একটি বিমানবন্দর রানওয়ে, যা একটি পাহাড় বা উঁচু মালভূমির ওপর অবস্থিত এবং চারপাশে গভীর খাদ বা ঢাল থাকে।

পাটনা দুর্ঘটনা (২০০০)

২০০০ সালের ১৭ জুলাই কলকাতা থেকে দিল্লিগামী অ্যালায়েন্স এয়ারের একটি ফ্লাইট পাটনার একটি আবাসিক এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। এতে বিমানের ৫৫ যাত্রী ও ভূমিতে থাকা ৫ জনসহ মোট ৬০ জন নিহত হন। অবতরণের সময় পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটে।

উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত একজনকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ১২ জুন, ভারত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সরকারি হিসাবের চেয়ে করোনায় মৃত্যু ছিল বেশি
  • কুষ্টিয়ায় করোনা শনাক্তের পিসিআর ল্যাবে চুরি, খোয়া গেছে ৪০ লাখ টাকার যন্ত্রাংশ
  • কুষ্টিয়ার একমাত্র পিসিআর ল্যাবের সব যন্ত্রাংশ চুরি
  • ভারতীয় উড়োজাহাজের ভয়াবহ ১০টি দুর্ঘটনা