কক্সবাজার শহরের হিলটপ সার্কিট হাউস সড়কে মার্কিন নারীকে শ্লীলতাহানির ঘটনায় করা মামলার তদন্ত শেষ করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ। গতকাল বুধবার বিকেলে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন কক্সবাজার সদর মডেল থানার পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আজিজুর রহমান।

মামলার একমাত্র আসামি তারিকুল ইসলাম প্রকাশ ওরফে ছুইল্যা তারেককে (২২) ১০ মার্চ বিকেল পাঁচটার দিকে পুলিশ শহরের ঝাউতলা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে তিনি কক্সবাজার জেলা কারাগারে আছেন। তারিকুল ইসলাম শহরের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাজের পাড়ার বাসিন্দা।

পুলিশ জানায়, ১০ মার্চ সকাল সোয়া আটটার দিকে শহরের হিলটপ সার্কিট হাউস সড়কে হাঁটার সময় মার্কিন নারীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেন তারিকুল ইসলাম। এ সময় হইচই-চিৎকার শুরু হলে তারিকুল পালিয়ে যান। ওই দিন মার্কিন নারী বাদী হয়ে থানায় নারী ও শিশু নিযার্তনে আইনে মামলা করেন। মার্কিন নারীর স্বামী ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি থেকে জাতিসংঘের অধীনে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত। সেই সুবাদে শহরের একটি ভাড়াবাসায় স্বামীর সঙ্গে থাকেন ওই নারী।

মার্কিন নারীকে শ্লীলতাহানির ঘটনায় করা মামলার তদন্ত শেষে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়ে পুলিশ সুপার মো.

সাইফউদ্দিন শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ১০ মার্চ কক্সবাজারে যোগদান করেন এবং যোগদানের কয়েক ঘণ্টা আগে মার্কিন নারীর ওপর যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে। ছয় ঘণ্টার মাথায় পুলিশ বিশেষ অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত তারিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। মামলার আসামি একজন। সাক্ষ্যপ্রমাণ, আদালতে আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং পুলিশের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে তারিকুল ইসলাম এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। ভুক্তভোগী বিদেশি নাগরিক, তাঁরা দ্রুত বিচার দেখতে চান। তা ছাড়া দ্রুত সময়ে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার এখতিয়ার পুলিশের আছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ১০ মার্চ সকাল সোয়া আটটার দিকে মার্কিন ওই নারী আরেকজন ভ্রমণসঙ্গীকে নিয়ে হিলটপ সার্কিট হাউস থেকে নামছিলেন। তারিকুল ইসলাম তাঁদের পেছন থেকে অনুসরণ করতে থাকেন। তারিকুলের পরনে ছিল হলুদ টি-শার্ট। কিছুক্ষণ পর তারিকুল হ্যালো বলে হ্যান্ডশেক করার জন্য মার্কিন নারীর দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। মার্কিন নারী হ্যান্ডশেক না করে ‘থ্যাঙ্কইউ’ বলেন। পরে হঠাৎ তারিকুল পেছন থেকে ওই নারীকে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় সঙ্গে থাকা ভ্রমণসঙ্গী তারিকুলকে মারধর করতে উদ্যত হলে এবং হইচই শুরু করলে তারিকুল পাহাড়ি ঢালু রাস্তা দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যান। নারী কণ্ঠের চিৎকার–চেঁচামেচি শুনে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিদেশি নারীকে উদ্ধার করে বাসায় পৌঁছে দেন। এরপর পুলিশ সড়কে লাগানো সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে হলুদ টি-শার্ট পরা তারিকুলকে শনাক্ত করে। টানা ছয় ঘণ্টা অভিযান চালানোর পর ওই দিন বিকেল পাঁচটার দিকে শহরের ঝাউতলার রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড এলাকা থেকে তারিকুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইলিয়াস খান প্রথম আলোকে বলেন, তারিকুল ইসলাম অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য মার্কিন ওই নারীর শ্লীলতাহানি ঘটিয়েছেন। আদালতে জবানবন্দি দিয়ে দায় স্বীকার করেছেন তারিকুল। তা ছাড়া মামলার সার্বিক তদন্ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ, আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মার্কিন নারীকে যৌন হয়রানির ঘটনায় তারিকুলের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। যেহেতু ঘটনাটা গুরুত্বপূর্ণ, সে বিবেচনায় পুলিশ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করার রেকর্ড করেছে।

ওসি মো. ইলিয়াস খান বলেন, ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর শহরের পাঁচ বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ করেছিলেন তারিকুল ইসলাম। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়েছিল। টানা কয়েক মাস কারাগারে ছিলেন। এরপর জামিনে মুক্ত হয়ে আবার অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন।

রাজমিস্ত্রির সহকারী থেকে কারাগারে

১১ মার্চ কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তারিকুল ইসলাম। ছয় মাস ধরে তিনি রাজমিস্ত্রির সহকারী (হেলপার) হিসেবে কাজ করছিলেন। কাজ করে প্রতিদিন আয় করেন ৬০০ টাকা। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেজ। ঘটনার দিন সকাল সাতটার দিকে তিনি কাজের সন্ধানে বের হন। মোহাজের পাড়ার টমটম স্টেশনে কন্ট্রাক্টর রিফাতের সঙ্গে দেখা করতে যান। রিফাতকে না পেয়ে পূর্ব মোহাজের পাড়ার মিস্ত্রি ওসমানের বাসায় যান। ওসমান কাজের জন্য ঝাউতলার ফিশ ওয়ার্ল্ডে মিস্ত্রি ইলিয়াছের সঙ্গে যেতে বলেন। কাজের জন্য সকাল আটটার দিকে মোহাজের পাড়ার বাড়ি থেকে মসজিদের পাশের গলি দিয়ে হিলটপ সার্কিট হাউসে ওঠেন। তখন তিনি বিদেশি দুজন নারীকে জগিং করতে দেখেন। দুই নারী তাঁর সামনে ছিলেন। এ সময় দুই নারীকে অতিক্রম করে সামনে চলে যান। ‘হ্যালো’ বলে হ্যান্ডশেকের জন্য এক নারীর দিকে হাত বাড়িয়ে দেন তিনি। ‘হ্যান্ডশেক’ না করে ধন্যবাদ বলেন ওই নারী। এরপর হঠাৎ ওই মার্কিন নারীকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। তখন ওই নারী চিৎকার দিলে দ্রুত ওই এলাকা ছেড়ে কাজের স্থান ফিশ ওয়ার্ল্ড এলাকায় চলে যান। পরে বিকেলে সেখান থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।

আরও পড়ুনকক্সবাজারে মার্কিন নারীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে তরুণ গ্রেপ্তার১০ মার্চ ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত র ক ল ইসল ম গ র প ত র কর ন ওই ন র ১০ ম র চ ন র ঘটন র জন য শহর র ঘটন য়

এছাড়াও পড়ুন:

রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে

রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।

এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন। 

পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।

এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়। 

এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে। 

মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়। 

জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।

এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়। 

এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।

যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।

তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে। 

ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই। 

অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়। 

এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।

এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে। 

এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়। 

এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে। 

বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ