প্রাক-বাজেট আলোচনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। চেয়ারম্যানকে দুর্নীতি বন্ধের উদ্যোগ নিতে বলেছেন।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনে এ আলোচনা হয়। সভায় বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা অভিজ্ঞতা ও বাজেট প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিলেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) সভাপতি শাহদাত হোসেন সোহেল বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। দুর্নীতি বন্ধ করুন, আপনারা যা চান ব্যবসায়ীরা তা দেবে। যাদের বন্ড নাই, তাদের রপ্তানির ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন জায়গায় অনেক কিছু ঘটে। এসব অনিয়মের অনেক প্রমাণ আছে। এনবিআর চেয়ারম্যানকে ভয়েস মেসেজ পাঠানো হয়েছে। এসব এখনও বন্ধ হয়নি।’
এনবিআরের চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আবারও অনুরোধ করব, রাজস্ব বোর্ডের এআরও (সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা) অনেক শক্তিশালী। কোনো কোনো সদস্য আপনার থেকেও শক্তিশালী। গত পরশু এক এআরও ফোন করে আমাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। এটাই হচ্ছে বর্তমান চিত্র।’ উৎসে কর, নগদ প্রণোদনার উৎসে কর এবং ১০ ও ২০ কাউন্ট সুতায় শুল্ক ও কর কমানোর প্রস্তাব দেন তিনি।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট কে এম ইকবাল বলেন, ‘কয়েক দিন আগে পানগাঁওয়ে আমান প্লাস্টিকের দুটি কনটেইনার আটকে রেখে ৭ কোটি টাকা শুল্ক দাবি করা হয়। এ কারণে আমান প্লাস্টিকের মালিক এক সময় আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। আমি তাঁকে ফিরিয়ে আনছি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই কনটেইনার কোটি টাকা দিয়ে ছাড়াতে হয়েছে।’
এসবের প্রতিক্রিয়ায় এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ‘আপনি সুবিধা না দিলে সে নেবে কোথা থেকে? আপনি দেন, পরে সেটা আবার বলেনও। প্রমাণ দেন। দুদক আছে, ধরতে পারে। এনবিআরও ধরতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এসব লেনদেন এখন ক্যামেরা দিয়ে রেকর্ড করে রাখা যায়। মোবাইলে কথোপকথন রেকর্ড করা যায়। এনবিআর শত শত কোটি টাকা খরচ করে অনলাইনে অভিযোগ জানানোর সিস্টেম চালু করেছে। এটা ব্যবসায়ীদের ব্যবহার করতে হবে।’
বিভিন্ন সংগঠনের প্রস্তাব
২০৩০ সাল পর্যন্ত করপোরেট কর হার কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএম)। এ নিয়ে বিটিএম নেতাদের সঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যানের বাহাস হয়।
সংগঠনটির পরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, ভারতীয় সুতা আমদানির কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ৮-১০ হাজার কোটি টাকার সুতা অবিক্রীত রয়েছে। তাই করহার কমিয়ে আনতে হবে।
এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, করপোরেট কর নেওয়া হয় আয়ের ওপর। গত ৫-৭ বছরে করপোরেট কর কমাতে কমাতে ২৫ শতাংশে আনা হয়েছে। ১০০ টাকা লাভ হলে ২৫ টাকা সরকারকে দেবেন। লাভ না হলে কর দেবেন না। এ ছাড়া ভারতীয় সুতা এত কম দামে আসে কীভাবে জানতে চান চেয়ারম্যান।
রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরকারের নীতি সহায়তা চায় বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএপিএমইএ)। পাশাপাশি আগামী ৫ বছরের জন্য উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ করা, ব্যক্তি পর্যায়ে করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৪ লাখ টাকা করা, কোম্পানির ক্ষেত্রে সঞ্চয়ী আমানত, স্থায়ী আমানতের মুনাফার ওপর উৎসে কর ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ চেয়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশন ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে।
বেসিস তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতি ২০৩১ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠার আগে ক্যাশলেস ট্রানজেকশনের শর্ত শিথিল করা, দেশি সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তির ভ্যাট প্রত্যাহার, সফটওয়্যার রপ্তানিতে প্রণোদনা ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে।
রপ্তানি বাড়াতে প্লাস্টিক খেলনা উৎপাদনে ২৪ ধরনের কাঁচামাল আমদানিতে করছাড় চেয়েছে বিপিজিএমইএ। একইভাবে আমদানি করা ১৪টি কাঁচামালের করছাড় চায় বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতি।
এলপিজি অটোগ্যাস সেক্টরে ট্যাক্স হলিডে সুবিধা চায় বাংলাদেশ এলপিজি অটোগ্যাস স্টেশন অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। এলপিজি কনভারশন কিট, সিলিন্ডার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়েছে। এ ছাড়া ভোক্তা পর্যায়ে অটোগ্যাসের বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে সংযোজিত মূসক প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছে তারা।
বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি নগদ সহায়তায় ১০ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ)।
কেক, বিস্কুট ও কনফেকশনারি পণ্যে শুল্ক অব্যাহতি চেয়েছে বাংলাদেশ বিস্কুট, ব্রেড ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতি।
হীরা আমদানির মূসকে ২০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া ও স্বর্ণের গহনার ক্ষেত্রে তিন বছরের জন্য মূসকে ৫০ শতাংশ ভর্তুকির প্রস্তাব বাংলাদেশ জুয়েলারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবস য় ব যবস য় আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
গংগাচড়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ, আতঙ্ক কাটেনি এখনও
রংপুরের গংগাচড়ায় ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ঘিরে সহিংসতার শিকার হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। তবে ঘটনার তিন দিন পরেও এলাকায় ফেরেনি অনেক পরিবার। আতঙ্কে এখনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে।
গত ২৭ জুলাই রাতে ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার আগে এলাকায় মাইকিং করে লোকজন জড়ো করা হয়।
পুলিশ, প্রশাসন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, যারা হামলা করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন ‘বহিরাগত’। পাশের নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা থেকে লোকজন এসে হামলা চালিয়ে চলে যায়। হামলার সময় ২২টি ঘরবাড়ি তছনছ ও লুটপাট করা হয়।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এলাকায় অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প বসানো হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে পুলিশ টহল। প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঢেউটিন, কাঠ, চাল-ডাল ও শুকনো খাবার বিতরণ করেছে এবং ঘরবাড়ি মেরামতের কাজও শুরু হয়েছে। তবু আতঙ্কিত পরিবারগুলো।
ক্ষতিগ্রস্তদের একজন অশ্বিনী চন্দ্র মোহান্ত বলেন, “সেদিনের ঘটনা ছিল এক ভয়াবহ। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে ধর্ম অবমাননাকারী কিশোরকে থানা হেফাজতে দিয়েছি। কিন্তু তারপরও ঘরবাড়ি রক্ষা হয়নি। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি এবং কিছু মুরুব্বি আমাদেরকে অভয় দিয়েছিলেন, কিন্তু রক্ষা হয়নি।”
তিনি আরো বলেন, “আমরা নিজেরাই অভিযুক্ত কিশোরকে থানায় সোপর্দ করেছি। তারপরও মিছিল নিয়ে এসে দুই দফায় আমাদের ২০ থেকে ২৫টি ঘরবাড়ি তছনছ করে দিয়ে লুটপাট করেছে তারা। এদের মধ্যে অধিকাংশ লোকেই অপরিচিত।”
আরেক ভুক্তভোগী দেবেন্দ্র চন্দ্র বর্মন জানান, “প্রথমে অল্পসংখ্যক কম বয়সী কিছু ছেলে আসে। পরে হাজারো লোকজন এসে আমাদের বাড়িঘরে তাণ্ডব চালায়। অনেকেই এখনো আত্মীয়দের বাড়িতে। আমরা চরম আতঙ্কে আছি।”
রবীন্দ্র চন্দ্রের স্ত্রী রুহিলা রানী বলেন, “ছোট ছেলেটা যদি ভুল করে থাকে, আমরা তাকে থানায় দিয়েছি। কিন্তু তারপরও এমন ধ্বংসযজ্ঞ কেন? আমাদের গরু, সোনা-টাকা সব লুটে নিয়েছে। শুধু চাল-ডাল আর টিনে কি জীবন চলে?”
গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রংপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম ও সদস্য সচিব আনিসুর রহমান লাকুসহ একটি প্রতিনিধি দল। তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরণ করেন এবং পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
গংগাচড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আল এমরান বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে কিশোরটিকে গ্রেপ্তার করে থানায় আনা হয় এবং পরে আদালতের মাধ্যমে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এখন পর্যন্ত কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তারপরও পুলিশ প্রশাসন সর্বাত্মক নিরাপত্তায় নিয়োজিত।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহামুদ হাসান মৃধা বলেন, “অপরাধীদের ধরতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হচ্ছে সহায়তা। পুলিশ ও সেনাবাহিনী পুরো এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে।”
উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্যমতে, হামলায় ১৫টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাতে ২২টি পরিবার বসবাস করতেন। ঘর মেরামতের পর কিছু পরিবার ফিরলেও অভিযুক্ত কিশোর ও তার চাচার পরিবারের কেউ এখনো ফিরে আসেনি।
ঢাকা/আমিরুল/ইভা