বিশ্বব্যাপী গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা টাস্কফোর্স গঠন করা হয়, যা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশে সম্প্রতি গঠিত প্রাথমিক ও গণশিক্ষার টাস্কফোর্সে সেই অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এতে নেই শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, শিশু মনস্তত্ত্ববিদ, বিশেষ শিক্ষাবিদ, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ, শিক্ষা গবেষক, পরিবেশবিদ, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী কিংবা ধর্মীয় নৈতিকতা বিশেষজ্ঞের উপস্থিতি। এমন একটি সীমাবদ্ধ কাঠামোর মধ্যে থেকে কীভাবে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব?
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী শিক্ষা টাস্কফোর্সের কাজ হওয়া উচিত শিক্ষানীতির সঠিক বাস্তবায়ন, শিক্ষাক্রমের উন্নয়ন, মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার সংস্কার, গবেষণাভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করা এবং প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ জন্য প্রয়োজন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দক্ষ কমিটি, যেখানে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞ একত্র হবেন।
প্রজ্ঞাপনে যেসব কাজের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে এ কমিটিতে ওপরের সব বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। কারণ শুধু প্রশাসনিক কাঠামো দিয়ে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন সম্ভব নয়; বরং শিক্ষানীতি ও পরিকল্পনায় যদি গবেষণার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তবেই কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে। এ ছাড়াও কমিটির কাজের পরিধি বাড়ানো যেতে পারে, যাতে এটি শুধু মনিটরিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে শিক্ষানীতি সংস্কার, শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রসার এবং শিক্ষার নৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষাক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সমাধান বের করতে হলে বহুমাত্রিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করা জরুরি।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তি জরুরি। শিক্ষার মৌলিক কাঠামো গঠন এবং শিক্ষাক্রম যুগোপযোগী করতে এই বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান শিক্ষাক্রমে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা নেই বললেই চলে, যা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতাকে ব্যাহত করছে। শিক্ষার্থীদের বাস্তব জ্ঞান অর্জন এবং আধুনিক যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষতার বিকাশ নিশ্চিত করতে শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞরা একটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শিশু মনস্তত্ত্ববিদ ও বিশেষ শিক্ষাবিদদের অন্তর্ভুক্তি আবশ্যক। প্রত্যেক শিশুর শেখার ধরন ভিন্ন এবং অনেক শিক্ষার্থী বিশেষ যত্নের দাবি রাখে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে বিশেষ শিক্ষাবিদদের ভূমিকা অপরিহার্য। শিশু মনস্তত্ত্ববিদরা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য, শেখার আগ্রহ, আত্মবিশ্বাস এবং সামাজিক দক্ষতা উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও কৌশল প্রদান করবেন।
মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষা গবেষকদের সংযুক্ত করা হলে শিক্ষার মান পরিমাপ এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বর্তমান সময়ে শুধু পরীক্ষার ফলের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা যথেষ্ট নয়। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতিতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন, উপস্থাপনা, গবেষণাধর্মী প্রকল্প এবং সৃজনশীল মূল্যায়ন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। শিক্ষা গবেষকরা নীতিনির্ধারণের আগে বিভিন্ন গবেষণা পরিচালনা করবেন, যা ভবিষ্যৎ শিক্ষানীতি প্রণয়নে সহায়ক হবে।
পরিবেশবিদদের অন্তর্ভুক্তি একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব শিক্ষা, নিরাপদ পানীয় জল ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে পরিবেশবিদরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। পাশাপাশি জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও ধর্মীয় নৈতিকতা বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তি শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধ গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জেন্ডার বিশেষজ্ঞরা লিঙ্গ সমতা, নারীর প্রতি সম্মান এবং সব শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করবেন। ধর্মীয় নৈতিকতা বিশেষজ্ঞরা শিক্ষা ব্যবস্থায় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে সহায়তা করবেন, যা একটি ন্যায়নিষ্ঠ ও নৈতিকভাবে দৃঢ় সমাজ গঠনে সহায়ক হবে।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরও শিক্ষা টাস্কফোর্সে যুক্ত করা দরকার। কারণ শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের সরাসরি শেখানোর দায়িত্ব পালন করেন এবং শিক্ষার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের মতামত ও অভিজ্ঞতা জানা গেলে শিক্ষানীতির দুর্বলতা ও শক্তিশালী দিকগুলো চিহ্নিত করা সহজ হবে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে একটি কার্যকর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক টাস্কফোর্স গঠন করা হলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষার সার্বিক অবস্থার পর্যালোচনা, মনিটরিং টিম গঠন, উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন, নতুন ধারণা গ্রহণ ও প্রচারণা, স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন, ঝরে পড়া রোধ, বেসরকারি বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রেশন তদারকি এবং নিয়মিত সভার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ– এসব কাজ সুচারুভাবে পরিচালিত হতে পারে যদি টাস্কফোর্সে সঠিক বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সঠিক পরিকল্পনা ও উপযুক্ত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে একটি কার্যকর শিক্ষা টাস্কফোর্স গঠন করা গেলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনা সম্ভব।
মো.
sabbir.ict@bou.ac.bd
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন শ চ ত করত ন শ চ ত কর ক র যকর ব যবস থ ন ত কত ক ত কর করব ন ন নয়ন গ রহণ
এছাড়াও পড়ুন:
নড়াইলে সরকারি গাছ বিক্রির অভিযোগে চেয়ারম্যানসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা
নড়াইল সদর উপজেলার শাহাবাদ ইউনিয়নে সড়কের পাশে সরকারি গাছ চুরি করে বিক্রির অভিযোগে মামলা হয়েছে। গতকাল বুধবার রাতে শাহবাদ ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মশিউর রহমান বাদী হয়ে সদর থানায় মামলাটি করেন।
মামলায় ওই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমানসহ ১৩ জন আসামি করা হয়েছে। অন্য আসামিরা হলেন প্রশিকা নড়াইল উন্নয়ন এলাকা ব্যবস্থাপক শাহাব উদ্দিন ও প্রশিকার গঠিত সংগঠন প্রভাতী যুব সংঘের সভাপতি নড়াইল সদর উপজেলার তুজরডাঙ্গা এলাকার মুজিবুর রহমান, সদস্য একই এলাকার জরিনা বেগম, রজব আলী, মো. আজিবর, মো. ইলিয়াছ, ইমান আলী, মো. ওমর, মো. হায়দার, আবু সাঈদ, মো. এনামুল ও মো. শরিফুল।
এ বিষয়ে আজ বৃহস্পতিবার সকালে নড়াইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি গাছ চুরি করে বিক্রির অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মামলার এজহারে বাদী অভিযোগ করেছেন, গত ২৯ এপ্রিল নড়াইল সদর উপজেলার শাহাবাদ বাজার থেকে হাজির বটতলা পর্যন্ত সরকারি রাস্তার জায়গা থেকে গাছ কাটা ও চুরি করে বিক্রির সংবাদ পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে যান। উপস্থিত হয়ে দেখেন, কাটা গাছবোঝাই একটি ট্রাক এবং নছিমন জব্দ করেছেন নড়াইল সদর উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার দেবাশীষ অধিকারী। তখন ঘটনাস্থলে শ্রমিকদের জিজ্ঞাসাবাদ ও খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, মামলার আসামিরা কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই খাসজমি থেকে গাছ কেটে বিক্রি করেছেন। এর আগেও একবার তাঁরা ওই জমি থেকে গাছ বিক্রি করেছিলেন। জব্দ করা গাছের লগ, ডালপালা এবং আগে কাটা গাছের অবশিষ্ট ভূমিসংলগ্ন গুঁড়ি পর্যবেক্ষণ করে বোঝা গেছে, ওই স্থান থেকে আনুমানিক পাঁচ লাখ টাকার অধিক গাছ চুরি করে কাটা ও বিক্রি হয়েছে।
প্রশিকা নড়াইল উন্নয়ন এলাকার ব্যবস্থাপক শাহাব উদ্দিন বলেন, ২০০৯ সালে প্রশিকা, ইউনিয়ন পরিষদ ও প্রভাতী যুব সংঘের যৌথ উদ্যোগে একটি চুক্তির মাধ্যমে সড়কের পাশে গাছগুলো রোপণ করেছিল। সে সময় সড়কটি খাস খতিয়ানভুক্ত ছিল না। বর্তমানে তা সরকারের আওতায় পড়ায় গাছ কাটার অনুমতি চেয়ে ইউএনওর কাছে আবেদন করা হয়েছিল, তবে প্রশাসন কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। কিছুদিন আগে ইউপি সদস্য ইব্রাহিম তাঁকে ফোনে জানান, বিদ্যুৎ বিভাগের কাটা ডালপালা বিক্রি করতে চান চেয়ারম্যান। বিদ্যুৎ বিভাগের কাটা ডালপালাগুলো পড়ে থেকে নষ্ট হবে ভেবে তিনি বিক্রিতে সম্মতি দেন। পরে গাছ কীভাবে বা কারা কেটেছে, তা তিনি জানেন না।
মামলা করার আগে অবৈধভাবে গাছ কাটার অভিযোগের ব্যাপার জানতে চাইলে ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, প্রশিকার সঙ্গে চুক্তির একটি পক্ষ ছিল ইউনিয়ন পরিষদ। সেই হিসেবে গাছ কাটার অনুমতি নিতে ইউএনও বরাবর প্রশিকার আবেদন তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে সুপারিশ করেছিলেন। তবে গাছ কেটেছে প্রশিকা আর তাদের সংগঠন। এখানে চেয়ারম্যান-মেম্বরের কিছু নেই।
নড়াইল সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) দেবাশীষ অধিকারী বলেন, প্রশিকার চুক্তির সময় সড়কটি ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে ছিল, পরে ২০১৫ সালে এটি খাস খতিয়ানভুক্ত হয়। খাসজমি থেকে গাছ কাটা বেআইনি। এ কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।