খাল কেটে কুমির আনার অধিকার সরকারকে কেউ দেয়নি: জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় নিয়ে মামুনুল হক
Published: 11th, July 2025 GMT
ঢাকায় তিন বছরের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের একটি মিশন স্থাপনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি মাওলানা মামুনুল হক বলেছেন, গত ১৬ বছরে ঘটে যাওয়া বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও খুনের বিচার নিশ্চিত না করে এখন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য দরজা খুলে দেওয়া মানে অপরাধীদের দায়মুক্তি ও জনগণের প্রতি অবিচার। খাল কেটে কুমির আনার অধিকার সরকারকে কেউ দেয়নি। এই মানবাধিকার কার্যালয় ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হতে দেবেন না তাঁরা।
আজ শুক্রবার জুমার নামাজের পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর ফটকে এক প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে মামুনুল হক এ কথাগুলো বলেন। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যদি জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে অবিলম্বে সরে না আসে, তাহলে হেফাজতে ইসলাম সারা দেশে তীব্র আন্দোলনের ডাক দিতে বাধ্য হবে।
সমাবেশে হেফাজত নেতা মামুনুল হক বলেন, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল, তা বাস্তবায়নের পরিবর্তে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যা জন–আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী ও স্বাধীনতার মৌলিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সরকারকে সতর্ক করে মামুনুল হক বলেন, ‘অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা স্পষ্ট করে বলি, শহীদের রক্তের বিনিময়ে গঠিত এই সরকারকে জনগণের মতামত উপেক্ষা করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো অধিকার দেওয়া হয়নি। জাতিসংঘের তথাকথিত মানবাধিকার বাস্তবে ইসলাম ও মানবতার পরিপন্থী পশ্চিমা আদর্শের হাতিয়ার। খাল কেটে কুমির আনার অধিকার সরকারকে কেউ দেয়নি। আমরা এই মানবাধিকার কার্যালয় ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হতে দেব না। আজ আমরা শুধু প্রাথমিক প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু সরকার যদি এই সিদ্ধান্ত থেকে অবিলম্বে সরে না আসে, তাহলে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ সারা দেশে তীব্র আন্দোলনের ডাক দিতে বাধ্য হবে।’
সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে হেফাজতের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী, নায়েবে আমির মাওলানা মুহিউদ্দীন রাব্বানী, মাওলানা আহমাদ আলী কাসেমী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরীর সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মাওলানা জালালুদ্দীন, মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, মুফতি মুনির হুসাইন কাসেমী, মাওলানা আজহারুল ইসলাম, মাওলানা রাশেদ বিন নূর, মাওলানা এনামুল হক মুসা, মুফতি শরীফুল্লাহ, মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান, মাওলানা এহসানুল হক, মাওলানা ইমরানুল বারী সিরাজী, মাওলানা জোবায়ের রশীদ, মাওলানা এহতেশামুল হক সাকী প্রমুখ বক্তব্য দেন।
তিন দাবি
হেফাজতের সমাবেশে বক্তারা ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান। বিষয়টিকে তাঁরা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ‘স্পষ্ট হুমকি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। হেফাজত নেতারা বলেন, জাতিসংঘ বা কোনো বিদেশি সংস্থার মাধ্যমে মানবাধিকার ইস্যুতে হস্তক্ষেপ দেশের সংবিধান ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী। এ ধরনের কার্যালয় স্থাপন সরকারের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতার প্রতিফলন। দেশীয় ইসলামি মূল্যবোধ, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এটি দীর্ঘ মেয়াদে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
হেফাজতে ইসলামের নেতারা আরও বলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না। ইমানি দায়িত্ব ও জাতীয় কর্তব্য থেকে তাঁরা এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলবেন এবং প্রয়োজনে আরও বৃহত্তর কর্মসূচির ঘোষণা করবেন।
এই সমাবেশ থেকে তিনটি দাবি জানানো হয়। এগুলো হলো ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাতিল করা, দেশের অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে দেওয়া এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম-খুনের নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ত স ঘ র ম নব ধ ক র ম ম ন ল হক সরক র ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
রাজনীতির নীতিহীনতা
আমাদের দেশে পার্টির শেষ নেই। নানান পার্টি। একেকটির একেক চরিত্র—চান্দা পার্টি, মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, গ্যাঞ্জাম পার্টি, ফার্স্ট পার্টি, থার্ড পার্টি, ব্যান্ড পার্টি। আছে নানান নামের পলিটিক্যাল পার্টি। এদের মধ্যে আবার ওয়ানম্যান পার্টিও আছে। তবে যে হারে পার্টির সংখ্যা বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে নতুন পার্টির নাম খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।
এমনই এক পার্টির নেতার কল্পিত সাক্ষাৎকার, যেখানে সাংবাদিকের প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘এই যে আপনি পার্টি করেছেন, সারা দেশের মানুষ তো আপনাকে চিনবে না।’ নেতা সগর্বে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন—
: আপনি কোন যুগে বাস করেন, ভাই? আপনি খালি বলেন, আপনিও একটা পার্টির জন্ম দেবেন, দেখবেন কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েক শ ক্যামেরা হাজির হয়ে গেছে। ব্রেকিং নিউজ হবে, বিভিন্ন চ্যানেলের স্ক্রলে আপনার নাম যাবে, টক শোতে ঘন ঘন ডাক পড়বে। প্রচারের জন্য আপনাকে কিছুই করতে হবে না, তারাই নানা রং লাগিয়ে সুন্দর সুন্দর শিরোনামে নিউজের সঙ্গে সঙ্গে কনটেন্টও ছাড়বে। সারা দেশে পয়সা ছাড়া খবর পৌঁছে যাবে।
: কিন্তু রাজনীতিতে তো খরচাপাতি আছে?
: এইটাও কোনো সমস্যা নয়, মতলববাজ ব্যবসায়ীরা বসে আছে ইনভেস্ট করার জন্য। সুতরাং টাকার অভাব হবে না।
: তারা টাকা দেবে কেন, তাদের লাভ?
: তারা দান করবে, আপনি তাদের কুকীর্তির লাইসেন্স প্রদান করবেন।
: কিন্তু দল করে আপনার লাভ?
: আমি নেতা হলাম। কথা বললেই নানান রঙের কয়েক ডজন মাইক্রোফোন আমার সামনে সাজানো থাকবে। ম্যালা চ্যানেল তো, ওদেরও খবর দরকার। ভোট পাই না পাই, আজকাল কিন্তু ‘ওয়ানম্যান পার্টি’রও কদর আছে। একসময় এদের অনেকে মন্ত্রীও ছিলেন। ওনারা জোটে যান, তবে ভোটে হারেন।
গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। তাই ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে নীতিমান রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতে হবে কথা নয়, কাজ দিয়ে। যাতে সুসময়েই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে: কিন্তু রাজনীতি করতে গিয়ে যদি সমস্যায় পড়েন?
: সুর চেঞ্জ করে ফেলব। স্ট্রেট পল্টি।
: নির্বাচন এলে কী করবেন?
: এই চামড়ার মুখে যত প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব সব দেব।
: কিন্তু প্রতিশ্রুতি যদি রক্ষা না করেন?
: জনগণ জানে, নির্বাচনের আগে অনেকেই অনেক কথা বলে। ওই সব মনের কথা নয়, মুখের কথা। জনগণ এসব বিশ্বাস করে না।
: জনগণ কি আপনার সঙ্গে আছে?
: আছে কি না জানি না, তবে সবাই সবকিছুই জনগণের ওপর দিয়া চালিয়ে দেয়, আমিও দিলাম। রাজনীতির নীতি কজন মেনে চলে?
আসলেই রাজনীতি করলে একটি নীতির প্রশ্ন আসে। সেই নীতির প্রতি কতজনের প্রীতি আছে, কতজনের ভীতি আছে, আর কজন সেই নীতিকে ইতি করে দিয়েছেন, সেই ইতিহাস অনেকেরই জানা।
যাঁরা এই রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেন, তাঁরা নেতা। তবে এই নেতা ও নীতিকে অনেকে সমার্থক করে ফেলেন। মনে রাখতে হবে, নেতার কথাই নীতি নয়, নীতির ধারক হচ্ছেন নেতা। তবে আমাদের এখানে অনেক নেতার প্রিয় নীতির নাম দুর্নীতি, যা মহামারির রূপ ধারণ করেছে।
নীতি শব্দের আগে ‘দু’ উপসর্গ যুক্ত হয়ে শব্দটি তৈরি হয়েছে। যা অন্যায়, অনিয়ম, নীতিবিরুদ্ধ, সেটাই দুর্নীতি। দুর্নীতির প্রধান কারণ হচ্ছে লোভ।
অক্সফোর্ড গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ফ্রাঙ্ক বুকম্যান এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘পৃথিবীতে প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে বটে; কিন্তু সবার লোভ মেটানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়।’ এই লোভের কারণে অনেকেই দুর্নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। দেখা দেয় আর্থিক বিশৃঙ্খলা। ফলে দুর্নীতির গতি আর নীতির দুর্গতি অতিশয় ক্ষতির প্রভাব ফেলে সর্বত্র। কারণ, মানুষ তাকেই ভালোবাসে, যার নীতি ও আদর্শ আছে। সে জন্য রাজনীতিতেও দেখা যায় কেউ গালি খায়, কেউ তালি পায়।
কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কথা চিন্তা করুন। ভদ্রলোক প্রায় ১০ বছর শাসনক্ষমতায় ছিলেন। তারপর পদত্যাগ করলেন, কিন্তু দেশত্যাগ নয়। বরং পদত্যাগের পর তিনি নির্ভয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাধারণ মানুষের মতো। বিভিন্ন শপে গিয়ে কেনাকাটা করছেন। সেই ছবিও ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। ট্রুডোর এই জীবনযাত্রা থেকে অনেক রাজনীতিবিদেরই অনেক কিছু শেখার আছে।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক ময়দানে খুব গুরুত্বপূর্ণ নেতা কিংবা ব্যক্তির ভাষণ দেওয়ার আগে নানান বিশেষণ দেওয়া হয়, যেমন এবারে ‘ঐতিহাসিক ভাষণ’ দেবেন ‘সংগ্রামী জননেতা’, ‘বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর’, ‘জ্বালাময়ী বক্তা’...ইত্যাদি। সব বিশেষণ লিখতে গেলে লেখা বড় হয়ে যাবে। এসব শব্দ এখন আর তেমন গুরুত্ব বহন করে না।
এখন যে কারও ভাষণকে ঐতিহাসিক ভাষণ, যত ফ্যাসফেসে কণ্ঠই হোক না কেন, বলা হয় বলিষ্ঠ কণ্ঠ। তবে জ্বালাময়ী শব্দটির সঙ্গে আমি একমত। কারণ, বেশির ভাগ রাজনৈতিক ভাষণই এখন জ্বালাময়ী, যা শুনলে আমাদের শরীরে জ্বালা ধরে যায়। যদিও রাজনৈতিক এসব জ্বালাযন্ত্রণার মধ্যেই আমাদের বসবাস।
রাজনীতিতে মনোনয়ন-বাণিজ্য ও ভোট বিক্রি অত্যন্ত গর্হিত একটি দুর্নীতি। নির্বাচনী প্রচারণা যেমন ব্যয়বহুল, নির্বাচনে মনোনয়নও একটি লেনদেনভিত্তিক প্রক্রিয়া, যা একধরনের রাজনীতির নীতিহীনতা। আসছে নির্বাচন—ভয়, না জানি কোন মাত্রায় এই লেনদেন হয়!
দুর্নীতিপ্রেমিক রাজনীতিবিদেরা তাদের নানান কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায়, যা নিয়মনীতির চূড়ান্ত লঙ্ঘন। ফলে প্রতিবাদে জেগে ওঠে জনতা। আর জনতা জাগলে এই ধরাকে সরা জ্ঞান করা অরাজকদের পরাজিত হতে হয়। আর এই পরাজিত শক্তির কী পরিণতি হয়, তা তো আমরা স্বচক্ষে দেখেছিই। এসব কারণেই হলো অভ্যুত্থান, গঠিত হলো নতুন সরকার। একের পর এক চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয় সরকারের সামনে। দিন যতই যায়, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ছোট ছোট গোষ্ঠী নতুন নতুন দাবি নিয়ে হাজির হয়। এসব আন্দোলনকারীর কাছে যেন জিম্মি হয়ে পড়ে সরকার। জিম্মি হয় সাধারণ মানুষ।
ক্ষোভ, বিক্ষোভ, অনশন, অবস্থান, মানববন্ধন, কর্মবিরতিসহ নানান কর্মসূচিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দেশ, দেশের অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সবকিছুই। রাজনৈতিক অচলা অবস্থা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। পরিস্থিতি ঠেকাতে সিরিজ বৈঠক করেও সময়মতো সুরাহা হয় না। সাধারণ মানুষের ভোগান্তির দিকে যেন কারোরই নজর নেই। শাহবাগ থেকে যমুনা আন্দোলনের নতুন ঠিকানা।
একসময় পুলিশের গাড়ি দেখলেই আন্দোলন-মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত। আর এখন পুলিশ যেন দর্শক। হাতে লাঠি থাকলেও অন্যায়ের পিঠে ওঠে না। দেখে মনে হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের কোনো কাজ নেই। চারদিকে মবের ভয়, না জানি কখন কী হয়। এই মব কারও কাছে ভায়োলেন্স, কারও কাছে জাস্টিস। সুযোগসন্ধানীরা তৎপর। চান্দাই যেন এখন বড় ধান্দা। যে যেভাবে পারছে এই সুযোগে কার্য উদ্ধার করছে।
বৈশাখ গেল, দুটি ঈদ গেল। নানা রকম কর্মসূচি হলো। কেউ আনন্দ পেল, কেউ কষ্ট পেল, কেউ কেউ সুযোগের সদ্ব্যবহার করল। চরিত্র পাল্টানোর প্রতিযোগিতায় অনেকেই এগিয়ে গেল। দিন যতই যাচ্ছে, ‘দালাল’-জাতীয় ব্যক্তিদের জায়গা শক্ত হচ্ছে। মিশে যাচ্ছে পরিবর্তনের স্রোতে। মুখোশ পাল্টে সাজছে ভালো মানুষ। এই কাতারে শিল্পী, সাংবাদিক, আমলা, ব্যবসায়ীসহ অনেকেই আছেন। সাধারণ মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে এসব সার্কাস দেখছে।
এই করতে করতে শুরু হলো নির্বাচন-যুদ্ধ। ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে সরকারি অবস্থানের পক্ষ নিল কেউ কেউ। কেউ আবার চরম বিপক্ষে। গণতন্ত্রের জন্য সোচ্চার আওয়াজ। কিসের গণতন্ত্র? কেমন গণতন্ত্র? যারা গণতন্ত্রের জন্য মাঠ গরম করছে, তারা কি আচার-আচরণ কিংবা দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতান্ত্রিক?
কর্মীরা রাজপথে থাকে, নীতিনির্ধারণে তাদের ভূমিকা নেই। ফলে সংসদেও দেখা যায় তথাকথিত গণতন্ত্রের প্রতিফলন। রাজনৈতিক দলের কাজ কী? শাসন? দখল? দুর্নীতি? নাকি জনগণের সেবা? তারা কার কাছে জবাবদিহি করবে? জবাবদিহি শব্দটাই যেন উধাও। তাই সংসদে স্পিকারের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে, ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে কিংবা ‘না’ জয়যুক্ত হয়েছে, ‘না’ জয়যুক্ত হয়েছে। ‘হ্যাঁ’-কে ‘না’ বলার কিংবা ‘না’-কে ‘হ্যাঁ’ বলার সাহস কারও নেই। ফলে হাতের তালুতে আঘাত পেলেও সব শক্তি ঢেলে টেবিল চাপড়ে সম্মতি বা অসম্মতি জানায়।
ডিসেম্বরে, নাকি ডিসেম্বরের পরে নির্বাচন, এ নিয়ে তর্কবিতর্ক, শোডাউন আর টক শোর দাপটে বাজার গরম হয়ে ওঠে। কেউ বলেন বিচার সময়সাপেক্ষ আর সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সুতরাং এর ওপর নির্ভর করে নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা যাবে না।
ঈদের সময় ঘোষিত হলো, এপ্রিলের শুরুতে হবে নির্বাচন। ব্যস, শুরু হয়ে গেল মিটিং-মিছিল, ‘মানি না মানি না’ স্লোগান। আর কেউবা ঘোষিত সময়ের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করলেন। কিন্তু ‘মানি না’ দলের শোডাউন বেশ জুতসই হওয়ায় জাতি চিন্তিত হয়ে পড়ল—আমাদের ভাগ্যে কি আদৌ নির্বাচন আছে? আবারও খই ফোটা শুরু হলো টক শোতে। শুধু টিভি চ্যানেলেই নয়, ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেলেও টক শো, দর্শক শো, নেতা শো, সাংবাদিক শো—শোয়ের শেষ নেই। একই ব্যক্তির নানান নামে নানান শো চলতে থাকে। মাঝেমধ্যে চিন্তা হয়, মানুষ এত কথা বলে কী করে? কারণ ব্যবসা। যত কথা তত ভিউ, যত ভিউ তত ব্যবসা। অর্থাৎ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা যত বাড়ে, অশান্তি যত বাড়ে, টক শোর টক এবং টকারও তত বাড়ে।
একই ব্যক্তি কত ধরনের সিদ্ধান্ত দিয়ে দিচ্ছেন, কী হলে কী হবে, কী না হলে কী ঘটবে। কী উচিত, কী অনুচিত। একজন অভিনয়শিল্পীর চেয়ে ‘টক’-শিল্পীদের পর্দায় উপস্থিতি বেশি, ফলে তারাও অভিনয় তারকার মতো ‘টক’ তারকা। সময়ের পরিবর্তনে টকারও বদলেছে। কিছু পুরোনো মুখের প্রস্থান, নতুন মুখের আগমন ঘটেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন চলন্ত গাড়িতে ব্রেকের মতো সবকিছুই থেমে গেল। কারণ লন্ডনের একটি বৈঠক, যেখানে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেল। এই ইঙ্গিতে রাজনৈতিক রণসংগীতের সমাপ্তি ঘটল।
রাজনৈতিক তর্জনগর্জনে কিছুটা বিরতি দেখা দিলে টকাররাও চিন্তিত হয়ে পড়লেন টক শো চলবে কী করে? সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে কী নিয়ে কথা বলবেন? ইস্যু কী? অনুসন্ধানে বেরিয়ে এল এক নতুন ইস্যু। নির্বাচনের তারিখের মধ্যে খোঁজ পাওয়া গেছে দুটি শব্দ ‘যদি’ এবং ‘কিন্তু’। ব্যস, আবার গরম হয়ে উঠল টক শোর আসর। এটা যদি সেটা হয়, সেটা কিন্তু ঠিক নয়। ‘যদি’, ‘কিন্তু’ থেকে এখন আবার তারিখ নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। শুরু হয়েছে কূটনৈতিক তৎপরতা। টক শোতে নতুন সুর।
কথায় আছে, ‘কথায় কথা বাড়ে’, কেউ আবার এই কথা ধরে ভিন্ন অর্থ করে। ‘যত মত তত পথ’—এটি একসময় ছিল সুবচন। সেই বচনে পচন ধরলে মূল অর্থের চেয়ে ভুল অর্থের আশঙ্কাই বেশি।
‘কথা কম কাজ বেশি’—বাক্যটি অনেকেই মনে রাখতে পারেন না। তাই তর্কে কেউ কারও কাছে হারেন না। অনেকে এটাও ভুলে যান যে শ্রোতাদের মধ্যেও তাঁদের চেয়ে জ্ঞানী বা গুণী মানুষ থাকতে পারে। এমন মানুষও থাকতে পারে, যাদের কাছে এসব কথার কোনো মূল্য নেই, প্রয়োজনও নেই। কারণ, তারা উদয়াস্ত জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত।
তবে ভবিষ্যতে একটি ভেজালবিহীন নির্বাচনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। তাই ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে নীতিমান রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতে হবে কথা নয়, কাজ দিয়ে, যাতে সুসময়েই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
হানিফ সংকেত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব